ডানাঅলা লেখা ও প্রথম আলোয় আস্থা
Published: 8th, November 2025 GMT
স্কুল–কলেজ নিয়ে লিখত। গান–নাটক আর সামাজিক প্রতিবাদের কথা লিখত। প্রথম আলোয় ছাপা হতো। যেদিন লেখা ছাপা হতো, সেদিন ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখত ছাপা হওয়া লেখার অক্ষর। এসব লেখার ডানা থাকত। যেদিন লেখা ছাপা হতো, সেদিন হাওয়া বইতো খুব। সেই হাওয়ায় উড়ে যেত পাতা। আর গ্রাম থেকে আসা আমি সাইকেল ফেলে এক ছুটে ধরে আনতাম বন্ধুর ডানাঅলা লেখা। সেই মফস্সলি কলেজের দিনে লেখার সুযোগ পেয়েছিল আমার বন্ধু। আর আমি তাঁর কাগজকুড়োনি বন্ধু। তাঁকে সাইকেলের পেছনে নেওয়ার আনন্দে হাওয়ায় খুলে রাখতাম নিজের বুকের বোতাম।
সাইকেল চালাতে চালাতে পেছনের বন্ধুকে প্রশ্ন ছুড়ে দিই—লিখতে পারব না আমি? কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব আসে—দুজন ঘুরে ঘুরেই তো লেখার তথ্য জোগার করি। তাই সব লেখাই তোমার আর আমার। আর একদম নিজের লেখা লিখতে হলে আরও কিছু শিখতে হবে; আরও পথ পেরিয়ে উঠতে হবে।
কিন্তু মানুষের মুখ ছাড়া তো আর কোনো পথ চিনি না আমি। মানুষের মুখের মধ্য দিয়েই আমার সমস্ত পথ নানা দিকে চলে গেছে। তাই পথফুলের হাসি ফুটে ওঠা বন্ধুর মুখের দিকে দেখি। এই মুখ বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, ভালোবাসতে ইচ্ছা হয়।
তারপর এই মুখ অন্তরে গচ্ছিত রেখে আমরা আলাদা হয়ে পড়েছিলাম। দুজন দেশের দুই দূর অচেনা জায়গায়। তবু প্রথম আলো আর ওই লেখার মায়া ফুরায়নি কোনো দিন।
আরও কিছু পথ পেরিয়ে পড়াশোনার প্রাতিষ্ঠানিক পাট চোকানো শেষে আবার সেই বন্ধুর কাছে ফিরি। বলেছি তাঁকে—পারো যদি, এবার এই একলা আমার, বন্ধু তুমি তুলে নাও ভার!
কিন্তু বন্ধুর শহরে আসার আগেই জেনে গেছি—এ শহর আসলে সন্দেহভূমি। যে শহরের বাসে উঠলেই ঘোষণা আসে—‘সহযাত্রীর দেওয়া কিছু খাবেন না, বিপজ্জনক হতে পারে।’ প্রতি মূহূর্তে এই শহরে এ রকম শত শত সহযাত্রীর মুখ কী করে বিশ্বাস করব? এই শহরে তো তাহলে কেউ কারও বন্ধু নয়! এ শহরে সবাই কান্নার মতো একা। কোথায় যাব আমি? আর তো ফেরাও নেই। ফিরব কোথায়? ঘর ছেড়ে আসা মানুষ কী আর ফিরতে পারে কোথাও!
অবশেষে সেই বন্ধুই হাত ধরে রাস্তা পার করে প্রথম আলোতে পৌঁছে দিয়ে বলেছিল—‘এবার নিজেই লিখে ফেলো তোমার ডানাঅলা লেখা। দোস্ত শোনো, এই শহরে মানুষের জীবন ভীষণ ক্রেজি ব্যাপার। এখানে নিজেকে নিত্য বিক্রি করে বেঁচে থাকতে হয়। সেটাই বরং শেখো।’
লিখছি টুকটাক। ছাপাও হচ্ছে প্রথম আলোয়। কিন্তু কোথাও কি থিতু হতে পারব না আমি। জীবনে! ‘নিজেকে নিত্য বিক্রি করে বেঁচে থাকতে হয়’—বন্ধুর এ কথায় আমার চক্ষু হাহাকার। এক আঁটি লালশাক কোনো দিন বেচতে পারিনি, নিজেকে বিক্রি করব কীভাবে?
বেশ আগের কথা। কাজ থেকে বাবার বাড়ি ফিরতে আরও কয়েক দিন দেরি হবে। এ কারণে বাড়ির বাজার খরচ আর স্কুলের খাতা–কলম কিনতে হঠাৎ টাকার দরকার পড়ল। খেত থেকে লালশাক তুলে হাটে বিক্রি করতে বলেছে মা। আমরা পিঠাপিঠি তিন ভাই শাক তুলে ধুয়ে আঁটি বেঁধেছি। এরপর হাফপ্যান্ট–হাফশার্ট, খালি পা আমি ভাইদের সঙ্গে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে শাক হাটে নিয়ে গেছি। পাশের দোকানের নেতিয়ে পড়া শাক কিনছে মানুষ। কিন্তু আরও কম দামে আমাদের সতেজ শাক কেউ কেনেনি। এই অপমানে সেদিন সন্ধ্যায় সব শাক পুকুরপাড়ে ফেলে আমরা থম মেরে বসে ছিলাম অন্ধকারে। এই অন্ধকারেও আমাদের চোখ বন্ধ ছিল। কারণ, আমরা জানতাম—চোখ খুলে গেলেই সামনের আর সব পথ শূন্য হয়ে যাবে। পরে ভাইয়েরা মুঠো করে জোনাকি ধরে দেশলাই বাক্সে ভরে দিয়েছিল। শুকনা মুখে রাতের অন্ধকারে দেশলাই বাক্স একটু একটু করে খুলে জোনাকির আলো দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরেছি সেদিন।
সেদিন–ই জেনেছি—আলোর কাজ হচ্ছে অন্ধকারকে রানীর মতো সাজানো, যেন কারও চোখ তা এড়িয়ে না যায়। তাহলে প্রথম আলো! সেটাও তো আলো। গ্রাম থেকে আসা সেই আমি প্রদায়ক হিসেবে ‘প্রথম আলো’য় লেখা শুরু করেছি কেবল। এই–ই শুধু পারি। কিন্তু এই ঢাকা শহরে কী নিজেকে বিক্রি করতে পারব? জানি না আমি। তাই নিজের কাছেও অনেক দিন গোপনে রেখেছি আসতে চাওয়া প্রেম।
এই শহরে ভয় ও বিপন্নতা নিয়ে পথ চলি। নানা রঙের ভয়। অপমানের ভয়, হিংস্রতার ভয়। যে আমি মানুষের মুখ ছাড়া পথ চিনি না। সেই আমি চিনতে না পেরে উঠে পড়ি যেকোনো বাসে। বাস নিয়ে যায় না–চেনা জায়গায়। অবশ্য ঘর ছাড়া চেনা জায়গা বলতে একটাই—প্রথম আলো, কারওয়ান বাজার। এই শহরে ঠিকানাও ওই একটাই, এখনো তা–ই। পকেটে বাড়তি ভাড়ার টাকা না থাকায় পায়ে হেঁটে হেঁটে সেখানেই ফিরি।
অর্থহীন মানুষের খিদে বেশি। জানেন, সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা ও রাতে খিদে পায়। ভরপেট খেতে না পারার কষ্টে মন খারাপ হয়। এমন সময় চোখ বন্ধ করে যাদের পাশে বন্ধু ভেবে বসে থাকা যায়, তাদের পাশে গিয়ে বসি। ঠিকানাহীন কোনো অলীক দোকানে নতুন বন্ধুসহ চায়ে চুবিয়ে চুবিয়ে পাউরুটি খাই আর রাস্তায় দেখা হওয়া মানুষেরা কেন আন্তরিকতাহীন ও কর্কশ স্বরে কথা বলে তার উত্তর খুঁজি।
রোদে–জলে মানুষের ছায়া পড়ে। কিন্তু কর্কশ স্বরের কোনো ছায়া পড়ে না। যেমন এত দিনেও আমার মাথার ওপর কোনো ছায়া পড়েনি। ওই চায়ে চুবিয়ে চুবিয়ে পাউরুটি খাওয়ার সময় অলীক বন্ধুরা বলেছে এ কথা। তারাই এখন সঙ্গ দেয় বেশি। তারাই বিড়বিড় করে বলে—এত দিনেও থিতু হতে পারলে না! তোমার ভবিষ্যৎ, মায়ের ওষুধ এসবের কী হবে। এসব কথায় কান্না পায় ভীষণ আমার। মনে হয়, লেখালিখি ছেড়ে দিই। অন্য কোথাও কাজের চেষ্টা করি। কিন্তু ওই অলীক বন্ধুরা বলেছে—শোনো, এভাবে কেঁদো না। আর কটা দিন টিকে থাকো। তারপর যেভাবে খুশি ঝরে পড়ো।
তাই থাকি। থাকতে থাকতে বুঝেছি—প্রথম আলোর মানুষগুলো ভিন্নতর। স্বর কর্কশ নয়। বরং কেউ কেউ আশ্চর্য দিঘির মতো। কাছে গেলেই শীতল হয়ে আসে মন। কারও কারও কথা ক্লান্তি, বিষাদ কাটিয়ে দিয়ে আবার জেগে ওঠার ওষুধ হয়ে যায়। চুপচাপ তাঁদের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ থাকি, কথা শুনি। এই শহরে টিকে থাকার চেষ্টায় বিষণ্ন হওয়া মন কিছুটা স্থির হয়। মনে হয়, আলো থেকে, রোদ থেকে তাঁদের ছায়া তুলে বুকপকেটে রাখি। তারপর হেঁটে হেঁটে শান্ত মন নিয়ে ঘরে ফিরে আসি। কিন্তু সেই ছায়া আমি আর ধরতে পারি না।
শেষমেশ একদিন সেই ছোটবেলায় সব শাক পুকুরপাড়ে ফেলে দেওয়ার মতো করে মনে মনে নিজেকে ওই সব ছায়ার ওপর ফেলে দিয়েছিলাম। তত দিনে নেশা হয়ে গেছে লেখা। ডানাও হয়েছে তার। আর ধীরে ধীরে বাড়ছে ডানার পালকবাহার। তত দিনে প্রথম আলো মানে শীতল ছায়া, কেউ একটু ভালোবাসলে তার কাছে বসে থাকার সময় যে হাওয়া বয়, সেই হাওয়া এসে বিলি কাটে চুলে। এই ছায়া ও হাওয়ার ওপর ভরসা রাখা যায়। আমার এই ভরসার ওপর আস্থা রেখেছিল প্রথম আলোও। তাই আমাকে সুযোগ দিয়েছিল, নিজের করে নিয়েছিল।
এরপর আরও কিছু বসন্ত ফিরিয়ে দিয়েছি। অন্যখানে ভালো বেতনের চাকরি, যার কাছাকাছি এখনো পৌঁছানো যায়নি। কিন্তু নেশা আর শীতল ছায়া ছেড়ে কী করে যাব আমি? তাই মা–বাবাকে ভুল বলে থেকে গেছি এইখানে। বুঝিয়েছি—তেমন আলাদা কিছু নয়। বর্ষাকালে বৃষ্টি হলে এখানেও থইথই ভাসে জল, ভাসে করঞ্জার ফুল; ওখানে যেমন।
সেই থেকে প্রথম আলোর জল–হাওয়ায় ভেসে ভেসে আছি। প্রথম আলোর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উৎসব চলছে। আর এ নিয়ে চাকরি না–হওয়ার সময় থেকে এ পর্যন্ত প্রথম আলোতে আমার বয়স ১৭ বছর। তরুণ হতে এখনো কিছুটা বাকি। এই দৃশ্য দেখে বুকের আড়াল থেকে মুচকি হাসছে হাফপ্যান্ট–হাফশার্ট আর খালি পা–এর সেই কিশোর শাকঅলা। সে আমার বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকে। জানিয়েছে—স্মৃতি রেখে মুছে গেছে তার গাল বেয়ে নেমে যাওয়া চোখের জলের দাগ। উড়িয়ে দিয়েছে দেশলাই বাক্সে ধরে রাখা সব জোনাকির আলো। এই আনন্দে সহপাঠী এক কিশোরী সাইকেলের পেছনে বসিয়ে তাকে আজ নিয়ে যাবে পুল পেরিয়ে মরমহাওয়ার দিকে…
সুজন সুপান্থ: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমন্বিত বার্তা বিভাগ, প্রথম আলো
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল এই শহর বন ধ র র ওপর আরও ক
এছাড়াও পড়ুন:
রাজধানীর কালশীতে সড়ক দুর্ঘটনায় এক ব্যক্তির মৃত্যু
রাজধানীর কালশীতে সড়ক দুর্ঘটনায় সৈয়দ হেলাল হোসেন (৫৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তিনি পেশায় ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি ছিলেন।
শনিবার (৮ নভেম্বর) সকাল ১১টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় স্বজনরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক দপুর ২টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহতের মেয়ের জামাই মোহাম্মদ রায়হান মিয়া জানান, নিহতের বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানায়। তিনি রাজধানীর কড়াইলে স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন।
তিনি আরও জানান, বাসা থেকে কাজের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় কালশীতে গাড়ির ধাক্কায় গুরুতর আহত হন তিনি। পরে পথচারীরা তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে গাড়িটি শনাক্ত করা যায়নি।
ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মোহাম্মদ ফারুক বলেন, ‘‘মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল মর্গে রাখা হয়েছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানাকে অবগত করা হয়েছে।’’
ঢাকা/তারা//