গ্রাম ও শহর: বৈষম্য বৃদ্ধির প্রক্রিয়া যেখানে চলমান
Published: 8th, November 2025 GMT
তথ্যে-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, আর্থসামাজিক সূচকে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য কমছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) ‘স্টেট অব দ্য রিয়েল ইকোনমি’ শীর্ষক জাতীয় সমীক্ষায় দেখা যায়, গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ভালো অগ্রগতি অর্জন করেছে। সম্ভবত এ অগ্রগতির মূল উপাদান পাকা সড়ক নেটওয়ার্ক এবং দেশব্যাপী বিদ্যুৎ-সংযোগ। সেই সঙ্গে মানুষের মনে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা।
পিপিআরসির ওই সমীক্ষায় উল্লেখিত অগ্রগতি মানুষের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ও উদ্যোগ প্রমাণ করেছে। এই অর্জিত অগ্রগতি ধরে রাখতে হবে। জুলাই-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে রাজনৈতিক সংস্কার যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, অর্থনৈতিক সংস্কার ততটা পায়নি। জুলাই আন্দোলন কেবল রাজনৈতিক ছিল না, এর গভীরে ছিল অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
ব্যবসায় ভীতিকর অবস্থাদেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, চাঁদাবাজি, লুটপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল বা মালিকানার হাতবদল বৃহৎ, মাঝারি ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের ভীতিকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নিয়েছেন বা সংকুচিত করেছেন। এ কারণে স্থানীয় পর্যায়ে টাকার প্রবাহ কমেছে। দ্বিতীয়ত, কিছুসংখ্যক ব্যাংকের নাজুক অবস্থার কারণে প্রান্তিক বিনিয়োগকারীরা বেশ বিপাকে পড়েছেন। তৃতীয়, সরকারি অনেক প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে, নতুন প্রকল্পের সংখ্যা কমে এসেছে। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে শ্রমজীবী মানুষের কাজের সুযোগ কমেছে।
পিপিআরসির সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পর মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে অর্থাৎ টাকার দাম কমেছে। সার্বিক অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাপে পড়েছে, গ্রামের মানুষ কাজের সন্ধানে শহরে এসে অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত হচ্ছেন। গ্রাম-শহরের মধ্যে নানা সূচকের বৈষম্য কমলেও গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের অভাবে সেই অগ্রগতি পেছনের দিকে ফিরতে শুরু করেছে। যেমন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এ দেখা গেছে, দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭। আর পিপিআরসির ২০২৫-এর সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সে হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশে।
পিপিআরসির সমীক্ষায় পরিলক্ষিত গ্রাম-শহর বৈষম্যের বিশেষ কয়েকটির দিকে নজর দেওয়া যাক। গৃহ ক্যাটাগরিতে দেখা যাচ্ছে, গ্রামের ১৬ দশমিক ৬ এবং শহরের ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ উত্তরদাতা পাকা বাড়িতে বাস করেন। গ্রামের ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ ও শহরের ২৯ দশমিক ২ শতাংশ উত্তরদাতা টিনশেড বাড়িতে বাস করেন। গ্রাম এলাকার ৯১ দশমিক ৫ ভাগ উত্তরদাতা ও শহরের ৫৯ দশমিক ৮ ভাগ উত্তরদাতা নিজগৃহে বাস করেন। এসব তথ্য থেকে সম্পদের মালিকানা বৃদ্ধির একটি বিশেষ দিক উঠে এসেছে।
সুপেয় পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে শহরের তুলনায় গ্রাম সামান্য এগিয়ে আছে। গ্রামের উত্তরদাতাদের মধ্যে ৯৮ দশমিক ৬ শতাংশ সুপেয় পানি পান, অন্যদিকে শহরে এই হার ৯৭ দশমিক ৪ শতাংশ। বিদ্যুৎ–সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। গ্রামে বিদ্যুৎ-সংযোগের হার ৯৮ দশমিক ৩, শহরের ৯৮ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু বিদ্যুৎ-সংযোগ শেষ কথা নয়। বিদ্যুৎ থাকা ও না-থাকার (লোডশেডিং) ক্ষেত্র গ্রাম ও শহরের চিত্র এক নয়।
শহর ও গ্রামে চিকিৎসা ব্যয় বেশিমাসিক আয়ের ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের উত্তরদাতাদের মধ্যে পার্থক্য হলো যথাক্রমে ২৯,২০৫: ৪০,৫৭৮ টাকা। শহরের উত্তরদাতাদের মধ্যে আয়ের চেয়ে ব্যয় করার প্রবণতা বেশি; গ্রামের উত্তরদাতারা সঞ্চয়প্রবণ। উত্তরদাতাদের আয়ের বেশির ভাগ ব্যয় হয় খাবারের পেছনে। শহরবাসী ও গ্রামবাসী উভয় শ্রেণির উত্তরদাতাদের চিকিৎসার ব্যয় বেড়েছে। জীবনযাপনের ধরনের সঙ্গে সম্পর্কিত রোগ বেড়েছে উভয় শ্রেণিতেই—ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিস, ক্যানসার ও হৃদ্রোগের বৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। শিক্ষার ব্যয় শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি।
পিপিআরসির ওই সমীক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, স্মার্টফোন ব্যবহারের হার গ্রামে ৭১ শতাংশ, আর শহরে ৭৯ দশমিক ৬ শতাংশ। কম্পিউটার/ল্যাপটপ রয়েছে গ্রামের ২ দশমিক ৪ শতাংশ উত্তরদাতার। শহুরে উত্তরদাতাদের মধ্যে এর হার ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। গ্রামের ৭৬ দশমিক ৮ এবং শহরের ৭৯ দশমিক ৮ শতাংশ খানার যুবকদের স্মার্টফোন রয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহার করেন গ্রামের ৬৫ দশমিক ৪১ শতাংশ উত্তরদাতা; শহরে এই হার ৭৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এসব তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির এক নতুন দিকের সন্ধান দিচ্ছে। ব্যয় ও ভোগের ধরনের ক্ষেত্রে বৈষম্য গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি।
বাংলাদেশে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত সম্পদের মালিকানা বাড়ছে। সিংহভাগ অর্থ পুঞ্জীভূত হচ্ছে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হাতে। বৈষম্য বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলমান। বিদ্যমান আইন, নীতি-পরিকল্পনা জনগণের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় অধিকতর কার্যকর। এ জটিল অর্থনৈতিক সমীকরণের মধ্যে গ্রাম-শহর সমতা বা অসমতার চিত্র কীভাবে দেখা হবে, তা এক কঠিন প্রশ্ন।
কৃষি অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হলেও প্রান্তিক কৃষক বৈষম্যের শিকার.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র ম ও শহর র প প আরস র দশম ক ৮ ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
নতুন সংঘাতের পর পাকিস্তান–আফগানিস্তানের মধ্যে আলোচনায় আবারও অচলাবস্থা
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে চলমান আলোচনায় অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। যুদ্ধবিরতির মধ্যেই সীমান্ত এলাকায় সংঘাতের ঘটনায় দুই পক্ষ একে অপরকে দায়ী করার এক দিন পরই পাকিস্তান এ কথা বলল।
গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার দুই দেশের মধ্যকার আলোচনার সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে এমন তথ্য দিয়েছেন। পাকিস্তানের দাবির বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কাবুলের বক্তব্য জানা যায়নি। তবে এর আগে এক আফগান কর্মকর্তা বলেন, যৌথ আলোচনা চলার মধ্যেও সীমান্তে পাকিস্তানি ও আফগান বাহিনীর সংঘর্ষে চার আফগান নাগরিক নিহত এবং পাঁচজন আহত হয়েছেন।
আলোচনায় মধ্যস্থতা করায় তুরস্ক ও কাতারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন আতাউল্লাহ তারার। তিনি উল্লেখ করেন, আফগান তালেবান ২০২১ সালের দোহা শান্তিচুক্তি অনুযায়ী ‘সন্ত্রাসবাদ’ রোধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তারার বলেছেন, পাকিস্তান আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের এমন কোনো পদক্ষেপকে সমর্থন করবে না, যা আফগান জনগণ বা প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তাহির আন্দরাবি বলেন, আফগানিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আসিম মালিক। আর আফগান সরকারের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, আফগানিস্তানের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক আবদুল হক ওয়াসিক দেশটির প্রতিনিধিদলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ইসলামাবাদ আফগান নাগরিকদের শান্তি ও মঙ্গল কামনা করে যাবে। তবে একই সঙ্গে নিজস্ব নাগরিক ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষায় সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
কান্দাহার প্রদেশের স্পিন বোল্ডাক শহরের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান আলি মোহাম্মদ হাকমালের অভিযোগ, পাকিস্তানই আগে গুলি চালিয়েছে। তাঁর দাবি, ইস্তাম্বুলে দুপক্ষের মধ্যে শান্তি আলোচনা চলার কারণে আফগান বাহিনী এর জবাব দেয়নি।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তাহির আন্দরাবি দাবি করেছেন, আফগানিস্তানই গুলি চালানো শুরু করেছে।
পাকিস্তানের তথ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, দেশটি চলমান সংলাপের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তারা আফগান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একইরকম আচরণ আশা করছে।
মন্ত্রণালয়টির কর্তৃপক্ষের দাবি, দুপক্ষের যুদ্ধবিরতি এখনো কার্যকর আছে।
ইসলামাবাদের অভিযোগ, পাকিস্তান তালেবান (টিটিপি)-এর মতো গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে আফগানিস্তান। টিটিপির বিরুদ্ধে পাকিস্তানে বিভিন্ন হামলা চালানোর অভিযোগ আছে। আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালেবান সরকার অবশ্য ওইসব গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তাহির আন্দরাবি বলেন, আফগানিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আসিম মালিক।
আর আফগান সরকারের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, আফগানিস্তানের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক আবদুল হক ওয়াসিক দেশটির প্রতিনিধিদলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
মুজাহিদ আরও বলেন, সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদ থামানোর লক্ষ্যে পাকিস্তান তাদের দাবিগুলো মধ্যস্থতাকারীদের কাছে জমা দিয়েছে। মধ্যস্থতাকারীরা দাবিগুলোর বিষয়ে আফগান তালেবান প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এক এক করে আলোচনা করছেন।
আরও পড়ুননতুন করে যুদ্ধবিরতি আলোচনার মধ্যেই পাকিস্তান–আফগানিস্তান পাল্টাপাল্টি গোলাগুলি২১ ঘণ্টা আগেইসলামাবাদের অভিযোগ, পাকিস্তান তালেবানের (টিটিপি) মতো গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে আফগানিস্তান। টিটিপির বিরুদ্ধে পাকিস্তানে বিভিন্ন সময় হামলা চালানোর অভিযোগ আছে। আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালেবান সরকার অবশ্য ওইসব গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
২০২১ সালে আফগান তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে পাকিস্তান তালেবানের অনেক নেতা ও যোদ্ধা আফগানিস্তানে আশ্রয় নিয়েছেন, যা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও টানাপোড়েনের মধ্যে ফেলেছে।
গত সপ্তাহের আলোচনা শেষে তুরস্ক কর্তৃপক্ষ বলেছিল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান উভয় পক্ষ শান্তি বজায় রাখতে এবং যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনকারীদের শাস্তি দিতে একটি পর্যবেক্ষণ ও যাচাই–বাছাই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হয়েছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ অক্টোবর শুরু হওয়া সংঘর্ষে আফগানিস্তান সীমান্তে এ পর্যন্ত ৫০ বেসামরিক নাগরিক নিহত ও ৪৪৭ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া কাবুলে বিস্ফোরণে কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হন। ওই বিস্ফোরণের জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে আফগানিস্তান।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বলেছে, সংঘর্ষে তাদের ২৩ সেনা নিহত ও ২৯ জন আহত হয়েছেন, তবে বেসামরিক লোকজনের হতাহত হওয়ার কোনো তথ্য তারা উল্লেখ করেনি।