ঠাকুরগাঁওয়ে সূর্যপুরী আমগাছ, টিকিট কেটে দেখতে হয়
Published: 27th, June 2025 GMT
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সীমান্ত এলাকা হরিণমারী। পিচঢালা পথের দুই পাশে সারি সারি গাছ। ডানে-বাঁয়ে ফসলি জমি, ঝোপঝাড় এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে দিগন্তে। দূরে সবুজ টিলার ওপর দাঁড়িয়ে সুবিশাল বট কিংবা অশ্বত্থের মতো গাছ। কাছে যেতেই চোখ ছানাবড়া। আসলে সেটি একটি আমগাছ। এটি সূর্যপুরী জাতের আম। গাছে তখন ভরা আম।
আমগাছটি ঠাকুরগাঁওকে দেশ-বিদেশে পরিচিত করে তুলেছে। ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের কারণে পর্যটকদের অনেকে আসেন গাছটি দেখতে। আমগাছ দেখতে দর্শনার্থীদের দিতে হয় ২০ টাকা।
গাছটির পাশে সাঁটানো উপজেলা প্রশাসনের তথ্যবোর্ড থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৩০০ বছর আগে তৎকালীন ভারতবর্ষের উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুরের সূর্যপুর এলাকায় এ আমের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। ধারণা করা হয়, সেখান থেকে এসেছে আমের জাতটি। তৎকালীন জমিদার সত্যেন্দ্র নাথ ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বৈরী ধনী এখানে আমগাছটি লাগিয়েছিলেন।
সূর্যপুরী একটি জনপ্রিয় আমের জাত। আমটি কেবল ঠাকুরগাঁওয়েই ভালো হয়। এ কারণে জেলার পরিচিতি তুলে ধরতে সূর্যপুরী আমকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সূর্যপুরী আম জিআই পণ্য হিসেবে (ভৌগোলিক নির্দেশক) নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানাসূর্যপুরী আমগাছটি দাঁড়িয়ে আছে দুই বিঘার বেশি জায়গাজুড়ে। উচ্চতা ৮০ থেকে ৯০ ফুট। মূল গাছের ঘের অন্তত ৩৫ ফুট। সবচেয়ে অদ্ভুত হলো গাছের ১৯টি মোটা ডাল। এগুলো তিন দিক থেকে গাছের মূল কাণ্ড থেকে বেরিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরেছে। দেখে মনে হয় যেন একটি বড় অক্টোপাস। চাইলে ডালের ওপর অনায়াসে হাঁটাচলা ও বসা যাবে। যদিও গাছে টাঙানো সাইনবোর্ডে লেখা, ‘গাছে ওঠা বা পাতা ছেঁড়া নিষেধ। নির্দেশ অমান্য করলে ৫০০ টাকা জরিমানা।’ মূল গাছের কাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা একটি ডালও চোখে পড়ল। ডালটি মৃত মনে হলেও শীর্ষভাগ এখনো সবুজ। থোকায় থোকায় ঝুলছে আম।
আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্রের চাঁপাইনবাবগঞ্জ কার্যালয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশীষ কুমার সাহা বলেন, আমগাছের ডাল মাটির সংস্পর্শে এলে শিকড় জন্মায়। শতবর্ষী ওই আমগাছের ডালটির ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে।
তিন দিক থেকে গাছের মূল কাণ্ড থেকে বেরিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরেছে। দেখে মনে হয় যেন একটি বড় অক্টোপাস। চাইলে ডালের ওপর অনায়াসে হাঁটাচলা ও বসা যাবে। যদিও গাছে টাঙানো সাইনবোর্ডে লেখা, ‘গাছে ওঠা বা পাতা ছেঁড়া নিষেধ। নির্দেশ অমান্য করলে ৫০০ টাকা জরিমানা।’কেমন আম সূর্যপুরীসূর্যপুরী মাঝারি আকারের আম, দেখতে সরু। ওজন ১৫০ থেকে ১৭০ গ্রাম। আমটি কাঁচা অবস্থায় হালকা সবুজ, পাকলে হলুদ রং ধারণ করে। শাঁসের রং গাঢ় হলুদ, আঁটি ও খোসা পাতলা। এই আম সামান্য আঁশযুক্ত হলেও বেশ রসালো। খেতে সুস্বাদু ও ভিন্ন ধরনের সুগন্ধ আছে। জুন মাসের শেষে আমটি পরিপক্ব হয়। জুলাই মাসের শেষ পর্যন্ত বাজারে পাওয়া যায়।
উত্তরাধিকারসূত্রে বালিয়াডাঙ্গী সূর্যপূরী আমগাছটির মালিক দুই ভাই। তাঁদের একজন নূর ইসলাম বলেন, প্রতিবছর গাছটিতে প্রচুর আম হয়। প্রতি তিন বছরে গাছের আম একবারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। দুই বছর আগে দেড় লাখ টাকায় সাদেকুল ইসলাম নামের একজনের কাছে আম বিক্রি করেছেন।
সাদেকুল ইসলাম জানান, ২০২৩ সালে তিনি প্রায় দুই লাখ টাকার আম বিক্রি করেছিলেন। গত বছর আমের ফলন কম হয়েছিল। লাখখানেক টাকার আম বিক্রি হয়। এবার প্রচুর আম ধরেছে, আশা করছেন আগের চেয়ে বেশি টাকার আম বিক্রি করতে পারবেন। এখনই সব আম পাড়বেন না। গাছপাকা আম বিক্রি করছেন। প্রতিদিন গড়ে ৩০ কেজির ওপর আম বিক্রি হচ্ছে।
খ্যাতির কারণে গাছের আমের কদর একটু বেশি। ব্যতিক্রমী গাছের সুস্বাদু আম পেতে আগ্রহী অনেকেই। অন্যান্য আম যেখানে বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকায়, এ গাছের আমের কেজি ১০০ টাকা। বেশি দাম হলেও আমের স্বাদ পেতে দর্শনার্থীদের আগ্রহে কোনো কমতি নেই।
আমগাছের ডাল মাটির সংস্পর্শে এলে শিকড় জন্মায়। শতবর্ষী ওই আমগাছের ডালটির ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে।চাঁপাইনবাবগঞ্জ কার্যালয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশীষ কুমার সাহাসূর্যপুরীর কাছে একদিনআমগাছটি দূর থেকে দেখা গেলেও চারপাশ বেড়া দেওয়া। সেখানে প্রবেশের একটি ফটক আছে। এ জন্য দর্শনার্থীদের গাছের মালিককে ২০ টাকার প্রবেশ ফি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। এরপর দর্শনার্থীরা গাছের নিচে গিয়ে ভালোভাবে গাছটি দেখতে পারেন।
২১ জুন দেখা যায়, গাছে থোকায় থোকায় আম ঝুলছে। কোনো কোনোটায় পাক ধরেছে। সামান্য বাতাসে গাছের পাকা আম মাটিতে পড়ছে। মাটিতে পড়ে আম যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য নিচে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে জাল। আমগাছ দেখতে ভিড় জমিয়েছেন দর্শনার্থীরা। পাশে দুটি সিমেন্টের বেঞ্চ ও গাছের পাশে একটি টং বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। দর্শনার্থীদের কেউ কেউ বেঞ্চে বসে বিশ্রামও নিচ্ছেন। ছায়ায় বসে গাছ দেখছেন।
এই আম সামান্য আঁশযুক্ত হলেও বেশ রসালো। খেতে সুস্বাদু ও ভিন্ন ধরনের সুগন্ধ আছে। জুন মাসের শেষে আমটি পরিপক্ব হয়। জুলাই মাসের শেষ পর্যন্ত বাজারে পাওয়া যায়।গাজীপুর থেকে বেড়াতে আসা শিক্ষক সামছুল ইসলাম বলেন, ‘বিচিত্র এই গাছ সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি। তখন গাছের বর্ণনা শুনে অবাক হয়েছিলাম। এখানে এসে গল্পের সত্যতা পেয়ে বেশ ভালো লাগছে। এখানে এসে শতবর্ষী এই গাছের আমও খেলাম। আমটি বেশ সুস্বাদু। সাক্ষী হিসেবে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি।’ প্রবেশ ফি ২০ টাকা নিলেও কোনো আফসোস নেই তাঁর।
ঠাকুরগাঁও শহরে শিল্প ও বাণিজ্য মেলা চলছে। মেলার দোকানি মো.
গাছটির আরেক মালিক সাইদুর ইসলাম মোল্লা সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। দিনকয়েক হলো ছুটিতে এসেছেন। তিনি বলেন, এই আমগাছের চারা থেকে ৫০ বছর আগে একটি গাছ লাগানো হয়েছিল। সেই গাছের ডালগুলোও একইভাবে মাটির দিকে নুয়ে পড়ছে।
বিচিত্র এই গাছ সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি। তখন গাছের বর্ণনা শুনে অবাক হয়েছিলাম। এখানে এসে গল্পের সত্যতা পেয়ে বেশ ভালো লাগছে। এখানে এসে শতবর্ষী এই গাছের আমও খেলাম। আমটি বেশ সুস্বাদু। সাক্ষী হিসেবে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি।শিক্ষক সামছুল ইসলামআঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্রের চাঁপাইনবাবগঞ্জ কার্যালয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশীষ কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, নানা জনশ্রুতি থাকলেও বালিয়াডাঙ্গীর শতবর্ষী আমগাছটি সাধারণ সূর্যপুরী জাতেরই। বয়সের কারণে গাছের ডাল মাটিতে নুয়ে পড়েছে। সূর্যপুরী জাতের আমের কিপিং কোয়ালিটি (পাকার পরও বেশ কিছুদিন খাওয়ার উপযুক্ত থাকে) বেশ ভালো। দেশের যেসব জাতের আমের কিপিং কোয়ালিটি দুর্বল, সেগুলোর সঙ্গে সূর্যপুরীর ক্রস (মুকুলের পরাগায়ন) করে উন্নত জাত উদ্ভাবন করা যেতে পারে।
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা বলেন, সূর্যপুরী একটি জনপ্রিয় আমের জাত। আমটি কেবল ঠাকুরগাঁওয়েই ভালো হয়। এ কারণে জেলার পরিচিতি তুলে ধরতে সূর্যপুরী আমকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সূর্যপুরী আম জিআই পণ্য হিসেবে (ভৌগোলিক নির্দেশক) নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আমগ ছ র ড ল র আম ব ক র ই আমগ ছ র গ ছ র আম র আম র ক জ ত র আম ল ইসল ম শতবর ষ এই গ ছ হয় ছ ল ঠ ক রগ র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
শতবর্ষী প্যাডেল স্টিমার ‘পিএস মাহসুদ’ চালু
প্রমোদতরী হিসেবে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে শনিবার (১৫ নভেম্বর) চালু হয়েছে শতবর্ষী প্যাডেল স্টিমার ‘পিএস মাহসুদ’।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে রাজধানীর সদরঘাটে শতবর্ষী এ প্যাডেল স্টিমার যাত্রার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
আরো পড়ুন:
‘নৌপথ ও মৎস্য সম্পদ রক্ষায় যৌথ উদ্যোগে কাজ করবে নৌপরিবহন ও মৎস্য মন্ত্রণালয়’
শ্রম উপদেষ্টার সঙ্গে জার্মান সংসদ সদস্যের সাক্ষাৎ
আগামী প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের নদীমাতৃক ঐতিহ্য তুলে ধরাই এর মূল লক্ষ্য।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুতফে সিদ্দিকীসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “পিএস মাহসুদ বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও নৌ-পর্যটনের মধ্যে এক অনন্য সেতুবন্ধন তৈরি করবে।”
তিনি আরো বলেন, “আগামী ২১ নভেম্বর থেকে ঢাকা-বরিশাল রুটে নিয়মিত পর্যটন সেবা শুরু করবে জাহাজটি।”
তিনি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিআইডব্লিউটিসির শতবর্ষী প্যাডেল স্টিমার ‘পিএস মাহসুদ’কে সংস্কার ও পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্তে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।”
সাখাওয়াত বলেন, “পিএস মাহসুদ শুধু একটি জাহাজ নয়, এটি বাংলাদেশের নদীমাতৃক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতীক। আমরা চাই নতুন প্রজন্ম দেখুক, একসময় নদীই ছিল যোগাযোগ ও সংস্কৃতির প্রাণ।”
তিনি জানান, নদী ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং নৌ-পর্যটনের সম্ভাবনা বাড়াতে পিএস অস্ট্রিচ, পিএস লেপচা ও পিএস টার্নসহ আরও কয়েকটি পুরনো স্টিমার মেরামতের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) কর্মকর্তারা জানান, স্টিমারটির সংস্কার ও আধুনিকীকরণে মূল কাঠামো ও ঐতিহাসিক নকশা অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। তবে, ইঞ্জিন, নিরাপত্তা ও অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ আধুনিক করা হয়েছে।
এতে রয়েছে আধুনিক কেবিন, পর্যটকবান্ধব ডেক ও ডিজিটাল নেভিগেশন ব্যবস্থা।
স্টিমারটি প্রতি শুক্রবার ঢাকা থেকে বরিশাল এবং প্রতি শনিবার বরিশাল থেকে ঢাকা যাবে। সকাল ৮টায় রাজধানীর সদরঘাট থেকে ছেড়ে রাতে বরিশালে পৌঁছাবে।
আগে স্টিমারটি শুধু রাতেই চলত। এবার দিনের ভ্রমণ চালু হওয়ায় পর্যটকরা নদী ও নদীর তীরের সৌন্দর্য আরও বেশি উপভোগ করতে পারবেন বলে আশা করছেন বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা। খবর বাসসের।
ঢাকা/এসবি