ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সীমান্ত এলাকা হরিণমারী। পিচঢালা পথের দুই পাশে সারি সারি গাছ। ডানে-বাঁয়ে ফসলি জমি, ঝোপঝাড় এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে দিগন্তে। দূরে সবুজ টিলার ওপর দাঁড়িয়ে সুবিশাল বট কিংবা অশ্বত্থের মতো গাছ। কাছে যেতেই চোখ ছানাবড়া। আসলে সেটি একটি আমগাছ। এটি সূর্যপুরী জাতের আম। গাছে তখন ভরা আম।

আমগাছটি ঠাকুরগাঁওকে দেশ-বিদেশে পরিচিত করে তুলেছে। ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের কারণে পর্যটকদের অনেকে আসেন গাছটি দেখতে। আমগাছ দেখতে দর্শনার্থীদের দিতে হয় ২০ টাকা।

গাছটির পাশে সাঁটানো উপজেলা প্রশাসনের তথ্যবোর্ড থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৩০০ বছর আগে তৎকালীন ভারতবর্ষের উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুরের সূর্যপুর এলাকায় এ আমের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। ধারণা করা হয়, সেখান থেকে এসেছে আমের জাতটি। তৎকালীন জমিদার সত্যেন্দ্র নাথ ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বৈরী ধনী এখানে আমগাছটি লাগিয়েছিলেন।

সূর্যপুরী একটি জনপ্রিয় আমের জাত। আমটি কেবল ঠাকুরগাঁওয়েই ভালো হয়। এ কারণে জেলার পরিচিতি তুলে ধরতে সূর্যপুরী আমকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সূর্যপুরী আম জিআই পণ্য হিসেবে (ভৌগোলিক নির্দেশক) নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা

সূর্যপুরী আমগাছটি দাঁড়িয়ে আছে দুই বিঘার বেশি জায়গাজুড়ে। উচ্চতা ৮০ থেকে ৯০ ফুট। মূল গাছের ঘের অন্তত ৩৫ ফুট। সবচেয়ে অদ্ভুত হলো গাছের ১৯টি মোটা ডাল। এগুলো তিন দিক থেকে গাছের মূল কাণ্ড থেকে বেরিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরেছে। দেখে মনে হয় যেন একটি বড় অক্টোপাস। চাইলে ডালের ওপর অনায়াসে হাঁটাচলা ও বসা যাবে। যদিও গাছে টাঙানো সাইনবোর্ডে লেখা, ‘গাছে ওঠা বা পাতা ছেঁড়া নিষেধ। নির্দেশ অমান্য করলে ৫০০ টাকা জরিমানা।’ মূল গাছের কাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা একটি ডালও চোখে পড়ল। ডালটি মৃত মনে হলেও শীর্ষভাগ এখনো সবুজ। থোকায় থোকায় ঝুলছে আম।

আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্রের চাঁপাইনবাবগঞ্জ কার্যালয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশীষ কুমার সাহা বলেন, আমগাছের ডাল মাটির সংস্পর্শে এলে শিকড় জন্মায়। শতবর্ষী ওই আমগাছের ডালটির ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে।

তিন দিক থেকে গাছের মূল কাণ্ড থেকে বেরিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরেছে। দেখে মনে হয় যেন একটি বড় অক্টোপাস। চাইলে ডালের ওপর অনায়াসে হাঁটাচলা ও বসা যাবে। যদিও গাছে টাঙানো সাইনবোর্ডে লেখা, ‘গাছে ওঠা বা পাতা ছেঁড়া নিষেধ। নির্দেশ অমান্য করলে ৫০০ টাকা জরিমানা।’কেমন আম সূর্যপুরী

সূর্যপুরী মাঝারি আকারের আম, দেখতে সরু। ওজন ১৫০ থেকে ১৭০ গ্রাম। আমটি কাঁচা অবস্থায় হালকা সবুজ, পাকলে হলুদ রং ধারণ করে। শাঁসের রং গাঢ় হলুদ, আঁটি ও খোসা পাতলা। এই আম সামান্য আঁশযুক্ত হলেও বেশ রসালো। খেতে সুস্বাদু ও ভিন্ন ধরনের সুগন্ধ আছে। জুন মাসের শেষে আমটি পরিপক্ব হয়। জুলাই মাসের শেষ পর্যন্ত বাজারে পাওয়া যায়।

উত্তরাধিকারসূত্রে বালিয়াডাঙ্গী সূর্যপূরী আমগাছটির মালিক দুই ভাই। তাঁদের একজন নূর ইসলাম বলেন, প্রতিবছর গাছটিতে প্রচুর আম হয়। প্রতি তিন বছরে গাছের আম একবারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। দুই বছর আগে দেড় লাখ টাকায় সাদেকুল ইসলাম নামের একজনের কাছে আম বিক্রি করেছেন।

সাদেকুল ইসলাম জানান, ২০২৩ সালে তিনি প্রায় দুই লাখ টাকার আম বিক্রি করেছিলেন। গত বছর আমের ফলন কম হয়েছিল। লাখখানেক টাকার আম বিক্রি হয়। এবার প্রচুর আম ধরেছে, আশা করছেন আগের চেয়ে বেশি টাকার আম বিক্রি করতে পারবেন। এখনই সব আম পাড়বেন না। গাছপাকা আম বিক্রি করছেন। প্রতিদিন গড়ে ৩০ কেজির ওপর আম বিক্রি হচ্ছে।

খ্যাতির কারণে গাছের আমের কদর একটু বেশি। ব্যতিক্রমী গাছের সুস্বাদু আম পেতে আগ্রহী অনেকেই। অন্যান্য আম যেখানে বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকায়, এ গাছের আমের কেজি ১০০ টাকা। বেশি দাম হলেও আমের স্বাদ পেতে দর্শনার্থীদের আগ্রহে কোনো কমতি নেই।

আমগাছের ডাল মাটির সংস্পর্শে এলে শিকড় জন্মায়। শতবর্ষী ওই আমগাছের ডালটির ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে।চাঁপাইনবাবগঞ্জ কার্যালয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশীষ কুমার সাহাসূর্যপুরীর কাছে একদিন

আমগাছটি দূর থেকে দেখা গেলেও চারপাশ বেড়া দেওয়া। সেখানে প্রবেশের একটি ফটক আছে। এ জন্য দর্শনার্থীদের গাছের মালিককে ২০ টাকার প্রবেশ ফি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। এরপর দর্শনার্থীরা গাছের নিচে গিয়ে ভালোভাবে গাছটি দেখতে পারেন।

২১ জুন দেখা যায়, গাছে থোকায় থোকায় আম ঝুলছে। কোনো কোনোটায় পাক ধরেছে। সামান্য বাতাসে গাছের পাকা আম মাটিতে পড়ছে। মাটিতে পড়ে আম যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য নিচে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে জাল। আমগাছ দেখতে ভিড় জমিয়েছেন দর্শনার্থীরা। পাশে দুটি সিমেন্টের বেঞ্চ ও গাছের পাশে একটি টং বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। দর্শনার্থীদের কেউ কেউ বেঞ্চে বসে বিশ্রামও নিচ্ছেন। ছায়ায় বসে গাছ দেখছেন।

এই আম সামান্য আঁশযুক্ত হলেও বেশ রসালো। খেতে সুস্বাদু ও ভিন্ন ধরনের সুগন্ধ আছে। জুন মাসের শেষে আমটি পরিপক্ব হয়। জুলাই মাসের শেষ পর্যন্ত বাজারে পাওয়া যায়।

গাজীপুর থেকে বেড়াতে আসা শিক্ষক সামছুল ইসলাম বলেন, ‘বিচিত্র এই গাছ সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি। তখন গাছের বর্ণনা শুনে অবাক হয়েছিলাম। এখানে এসে গল্পের সত্যতা পেয়ে বেশ ভালো লাগছে। এখানে এসে শতবর্ষী এই গাছের আমও খেলাম। আমটি বেশ সুস্বাদু। সাক্ষী হিসেবে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি।’ প্রবেশ ফি ২০ টাকা নিলেও কোনো আফসোস নেই তাঁর।

ঠাকুরগাঁও শহরে শিল্প ও বাণিজ্য মেলা চলছে। মেলার দোকানি মো.

ইসলাম আমগাছটি পরিদর্শনে এসে বলেন, ‘এখন আমের সময়। নানা জাতের আম খাওয়া হয়। ব্যতিক্রমী এই আমগাছের কথা শুনে এখানে চলে এলাম। প্রকৃতির আপন খেয়ালে বেড়ে ওঠা আমগাছটি দেখে আমি অভিভূত।’

গাছটির আরেক মালিক সাইদুর ইসলাম মোল্লা সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। দিনকয়েক হলো ছুটিতে এসেছেন। তিনি বলেন, এই আমগাছের চারা থেকে ৫০ বছর আগে একটি গাছ লাগানো হয়েছিল। সেই গাছের ডালগুলোও একইভাবে মাটির দিকে নুয়ে পড়ছে।

বিচিত্র এই গাছ সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি। তখন গাছের বর্ণনা শুনে অবাক হয়েছিলাম। এখানে এসে গল্পের সত্যতা পেয়ে বেশ ভালো লাগছে। এখানে এসে শতবর্ষী এই গাছের আমও খেলাম। আমটি বেশ সুস্বাদু। সাক্ষী হিসেবে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি।শিক্ষক সামছুল ইসলাম

আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্রের চাঁপাইনবাবগঞ্জ কার্যালয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশীষ কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, নানা জনশ্রুতি থাকলেও বালিয়াডাঙ্গীর শতবর্ষী আমগাছটি সাধারণ সূর্যপুরী জাতেরই। বয়সের কারণে গাছের ডাল মাটিতে নুয়ে পড়েছে। সূর্যপুরী জাতের আমের কিপিং কোয়ালিটি (পাকার পরও বেশ কিছুদিন খাওয়ার উপযুক্ত থাকে) বেশ ভালো। দেশের যেসব জাতের আমের কিপিং কোয়ালিটি দুর্বল, সেগুলোর সঙ্গে সূর্যপুরীর ক্রস (মুকুলের পরাগায়ন) করে উন্নত জাত উদ্ভাবন করা যেতে পারে।

ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা বলেন, সূর্যপুরী একটি জনপ্রিয় আমের জাত। আমটি কেবল ঠাকুরগাঁওয়েই ভালো হয়। এ কারণে জেলার পরিচিতি তুলে ধরতে সূর্যপুরী আমকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সূর্যপুরী আম জিআই পণ্য হিসেবে (ভৌগোলিক নির্দেশক) নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আমগ ছ র ড ল র আম ব ক র ই আমগ ছ র গ ছ র আম র আম র ক জ ত র আম ল ইসল ম শতবর ষ এই গ ছ হয় ছ ল ঠ ক রগ র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

প্রশাসনের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা চাই

রাজশাহীর তানোরের গোকুল-মথুরা খেলার মাঠ সেখানকার শত বছরের ঐতিহ্যের অংশ। এই মাঠ কেবল একটি খেলার জায়গা নয়, এটি এলাকার সংস্কৃতি, সামাজিক মেলবন্ধন এবং বহু প্রজন্মের স্মৃতির ধারক। অথচ এই শতবর্ষী মাঠের প্রায় ৪০ শতাংশ জায়গা দখল করে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভবন নির্মাণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, সরকারের আরএস ও এসএ দুটি খতিয়ানেই এই মাঠ খেলার মাঠ হিসেবে উল্লেখ আছে। ২০০০ সালের খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী খেলার মাঠ হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এরপরও স্থানীয় একটি মাদ্রাসা  কর্তৃপক্ষ কীভাবে কৌশলে মাঠটি নিজেদের নামে খারিজ করে নিতে পারল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

মাঠসংলগ্ন গোকুল-মথুরা দাখিল মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ১৯৯৯ সালের ৪ আগস্ট একটি দান দলিলের মাধ্যমে ৬ শতাংশ ও ওই বছরের ৮ আগস্ট একইভাবে দান দলিলের মাধ্যমে ৩৪ শতাংশ জমির মালিক হয়েছে। এর আগেই ১৯৮৩ সালের ৫ জুন গোকুল-মথুরা প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একইভাবে একটি প্রতারণামূলক দান দলিলের মাধ্যমে ৬৬ শতাংশ জমির মালিক হয়েছে। এই তিনটি দলিলের মাধ্যমে অতি গোপনে মাঠের সব জমি গ্রাস করা হয়েছে। এখানে ভূমি অফিসের যোগসাজশ থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

মাঠে ভবন নির্মাণের প্রতিবাদে স্থানীয় লোকজন সরব হন। মানববন্ধন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান—সবকিছুই করা হয়েছে। আদালতে মামলাও করা হয়েছে এবং আদালত অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছেন। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে জেলা প্রশাসককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এরপরও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ভবন নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিয়ে যায়। যদিও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে, তারা ভবন নির্মাণ করলে ভবনের খানিকটা মাঠের ভেতরে পড়বে।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সোমবার সকালে মাদ্রাসা ভবনের নির্মাণের উদ্বোধন করতে যান। কিন্তু স্থানীয় লোকজনের বাধার মুখে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা যায়নি। ঠিকাদারের লোকজন মাটি খননের চেষ্টা করলে স্থানীয় খেলোয়াড়েরা খননযন্ত্রের সামনে শুয়ে পড়েন। একপর্যায়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ভবন নির্মাণের কাজ স্থগিত ঘোষণা করে। বিকেলের দিকে ঠিকাদার লোকজন ও যন্ত্রপাতি নিয়ে চলে যান।

আমরা আশা করব, শতবর্ষী মাঠটি রক্ষায় প্রশাসন আরও জোরালো ভূমিকা রাখবে। মাঠের জমি দখল নিয়ে আগে যেসব অনিয়ম হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হোক। মাঠটির সুরক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটিই কাম্য।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আড়াই শ বছরের পুরোনো যে মন্দিরে চালু হয়েছিল বিদ্যালয়
  • প্রশাসনের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা চাই
  • ইটভাটায় পুড়ছে ফসল ক্ষতিগ্রস্তদের বিক্ষোভ
  • তানোরের শতবর্ষী খেলার মাঠ রক্ষায় ভূমিসচিবসহ ১৩ জনকে আইনি নোটিশ