অন্তর্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ‘বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩’ হালনাগাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ‘ওয়ারপো’ বা পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ইতোমধ্যে একাধিক সভা ও কর্মশালা আয়োজন করেছে। উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, পানি আইন প্রণয়নের পর ইতোমধ্যে এক যুগ পার হয়ে গেছে এবং এই সময়ের মধ্যে দেশের পানিসম্পদ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুতর কিছু পরিবর্তন এসেছে। এখন যখন আইনটি হালনাগাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তখন আগার কিছু আলাপ ও গোড়ার কিছু গলদ মীমাংসা করা জরুরি।
বস্তুত, পানিসম্পদ-সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়ার কিছু বৈশ্বিক রেওয়াজ রয়েছে। সাধারণত, প্রথমে পানি আইন প্রণয়ন করা হয়, তারপর এর আওতায় জাতীয় পানিনীতি প্রণীত হয়। পানি আইন ও পানিনীতি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হয় পানি বিধিমালা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে সেভাবেই ১৯৭৪ সালে পানি আইন প্রণয়নের পর নীতিমালা ও বিধিমালা প্রণীত হয়েছিল। বাংলাদেশে এই ধারাবাহিকতা মানা হয়নি। অনেকটা প্রবাদের ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়া হয়েছে।
প্রথমেই, ১৯৯৯ সালে, প্রণীত হয়েছিল জাতীয় পানিনীতি। এর ১৪ বছর পর এসে প্রণীত হয়েছিল পানি আইন। পানি বিধিমালা তৈরি হয়েছিল ২০১৮ সালে এসে। মুশকিল হয়েছে, পানি আইনের ৮ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে জাতীয় পানিনীতি প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে, ততদিনে তার বয়স আইনের চেয়ে দেড় দশক বেশি হয়ে গেছে; অর্থাৎ বাঁশের চেয়ে কঞ্চি হয়ে গেছে দড়। আবার নতুন করে পানিনীতি প্রণয়ন করতে প্রয়োজনীয় বিধিমালাও এসেছে পাঁচ বছর পর। যে কারণে, বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় এই তিন আইনি দলিলের অবদান খুঁজে পাওয়া কঠিন।
অতীত ঘাঁটলে দেখা যাবে, ধারাবাহিকতার ঘাটতির কারণে বাস্তবায়নযোগ্যতায় ঘাটতি দেখা দেওয়ায় পানি বিধিমালা প্রণীত হওয়ার আগেই খোদ আইনটি সংশোধনের আলোচনা শুরু হয়েছিল। আবার, ২০১৮ সালে বিধিমালা প্রণীত হওয়ার পরও আইনটি কার্যকর হচ্ছিল না; কারণ পানি আইনের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে আইন লঙ্ঘনের কারণে যে দণ্ড, অর্থদণ্ড ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে, সেটি ২০০৯ সালের মোবাইল কোর্ট আইনের তপশিলভুক্ত নয়। এ জন্য ২০২০-২১ সালের দিকে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয়। সেই কমিটির সুপারিশ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পর কী ঘটেছে, জানা নেই।
এই দফায় অবশ্য জাতীয় পানিনীতি ১৯৯৯ এবং বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ একই সঙ্গে হালনাগাদের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আবারও যদি পানিনীতির আগে পানি আইন হালনাগাদ হয়, তাহলে আগের মতোই ধারাবাহিকতার সংকট দেখা দেবে। সে ক্ষেত্রে উচিত হবে প্রথমে পানি আইন হালনাগাদ চূড়ান্ত করে, তারপর তার আলোকে নীতিমালা হালনাগাদ করা। এরপর আসবে বিধিমালাটি হালনাগাদের প্রশ্ন। আর পানি আইনের বিভিন্ন ধারা অন্য যেসব আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত, যেমন মোবাইল কোর্ট আইন বা পরিবেশ আদালত, সেগুলোর সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব তপশিলভুক্ত করতে হবে। দেশের পানিসম্পদ পরিস্থিতির অবনতি যে তলানিতে গিয়ে ইতোমধ্যে পৌঁছেছে এবং যে হারে সেটি ঘটে চলছে, তাতে করে আগের মতো আরও দুই দশকের গদাইলস্করির বিলাসিতা মানায় না।
প্রশ্ন হচ্ছে, পানিসম্পদ সম্পর্কিত আইনি কাঠামোর ধারাবাহিকতা ও গতিশীলতাই কি শেষ কথা? সেটি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু এগুলো আগার আলাপ মাত্র। একই সঙ্গে গোড়ার কিছু গলদও দূর করতে হবে। যেমন, বাংলাদেশের পানিসম্পদের মূলসূত্র হচ্ছে নদনদী। বিস্ময়কর হলেও সত্য, বিদ্যমান পানি আইনে যে ৩৫টি বিষয়ে সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানে ‘নদী’ শব্দটিই নেই! বস্তুত, এটি আমাদের দেশের পানিসম্পদ সম্পর্কিত আইনি কাঠামোর বৃহত্তম ত্রুটি। রিভারাইন পিপল থেকে আমরা গবেষণা করে দেখেছি, ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ ভারতে প্রণীত ‘দ্য ক্যানেল অ্যাক্ট’ থেকে ২০১৩ সালের জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন আইন পর্যন্ত– বর্তমান বাংলাদেশে প্রচলিত পানিসম্পদ সম্পর্কিত ৩১টি আইনের কোথাও নদীর সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়নি!
ওয়ারপো ধন্যবাদ পেতে পারে যে, পানি আইন হালনাগাদের প্রস্তাবনায় ‘নদী’ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, নদীর সংজ্ঞা না থাকার বিষয়টি আমরা দীর্ঘদিন ধরে জনপরিসরে তুলে ধরার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের আগস্টে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন প্রকাশিত নদনদীর তালিকাতেও একটি সংজ্ঞা সংযোজিত হয়েছিল।
সংজ্ঞায়িত হলেই যেসব ঠিক থাকবে এমন নয়। যেমন, বিদ্যমান পানি আইনে ‘বাঁধ’ বলতে ‘মাটি বা অনুরূপ উপাদান দ্বারা নির্মিত কোনো ড্যাম, ওয়াল, ডাইক, বেড়িবাঁধ বা অনুরূপ কোনো বাঁধ’ বোঝানো হয়েছে। ওয়ারপোর প্রস্তাবনায় এটিকে দুই ভাগ করে নদীর সমান্তরালের স্থাপনাকে ‘বাঁধ’ এবং আড়াআড়ি স্থাপনাকে ‘ড্যাম’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে ড্যাম, ব্যারাজ, ডাইক সম্পূর্ণ আলাদা কারিগরি বিষয়। অথচ বাংলা ভাষায় রয়েছে এর দারুণ বিকল্প শব্দ; নদীর সমান্তরালে ‘বেড়িবাঁধ’ এবং আড়াআড়ি ‘আড়িবাঁধ’! এমন আরও কিছু জায়গা আছে, সেখানে প্রস্তাবনাগুলোই পর্যালোচনা দরকার।
বিদ্যমান পানি আইনের আরেকটি গোড়ার গলদ হচ্ছে, জাতীয় পানিসম্পদ পরিষদ এবং নির্বাহী কমিটি নামে দুটি ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন’ কর্মকাঠামো। এর মধ্যে ৪৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় পানিসম্পদ পরিষদের চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং; বাকি সদস্যরাও মন্ত্রী বা সচিব, নিদেনপক্ষে মহপরিচালক বা প্রধান প্রকৌশলী। তাদের মধ্যে ৪ জন বিশেষজ্ঞ বা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি রয়েছেন, তারাও প্রধানমন্ত্রী মনোনীত। পানিসম্পদ মন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন নির্বাহী কমিটির পরিস্থিতিও তথৈবচ। বলা বাহুল্য, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন কোনো পরিষদ বা কমিটির বৈঠক হওয়া আর আধা মণ ঘি জোগাড় করে রাধিকার নৃত্য দেখা সমান কথা।
ওয়ারপোর প্রস্তাবে অবশ্য জাতীয় পানিসম্পদ পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৪৩ থেকে কমিয়ে ২৫ জনে আনা হয়েছে এবং চেয়ারপারসন হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বদলে পরিকল্পনামন্ত্রীর কথা বলা হয়েছে। নির্বাহী কমিটির সদস্য সংখ্যাও ২৪ থেকে ২১ করা হয়েছে। কিন্তু এই দুই কর্মকাঠামোর কার্যকারিতা কেবল সংখ্যাগত নয়, বরং গুণগত সংস্কারের ওপর নির্ভর করে। যেমন, এসব কমিটিতে আমলাদের বদলে বরং একাডেমিক, গবেষক ও নাগরিক প্রতিনিধির সংখ্যা এমনভাবে বাড়ানো দরকার, যাতে তারা সংখ্যায় অর্ধেকের বেশি হন।
আর এসব কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সচিবদেরই প্রধান বা চেয়ারপারসন হতে হবে কেন? তারা তো এমনিতেই ক্ষমতাধর; মন্ত্রী বা সচিব হিসেবে অবারিত ক্ষমতা ধারণ ও প্রয়োগ করতে পারেন। কোন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর বা সংস্থার কোন কর্মকর্তার ঘাড়ে দুটি মাথা রয়েছে যে, তাদের নির্দেশনার ব্যত্যয় করবেন? বরং এই কমিটিগুলোর প্রধান হিসেবে একাডেমিক, গবেষক বা নাগরিক প্রতিনিধিদের আনা যায় না? একই কথা বলা চলে পানিসম্পদ-বিষয়ক বিধিবদ্ধ সংস্থা ও কমিশনগুলোর ব্যাপারে। তাহলেই আমরা সম্ভবত পানিসম্পদ বিষয়ে প্রকৃত সংস্কারের পথে যেতে পারব।
সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের মাঝামাঝি নতুন ও রাজনৈতিক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছে। সব পক্ষের সদিচ্ছা থাকলে তার আগেই পানিসম্পদ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি আইনি কাঠামো– পানি আইন, পানি নীতিমালা, পানি বিধিমালা হালনাগাদ, সংস্কার ও কার্যকর করা অবশ্যই সম্ভব।
শেখ রোকন: লেখক ও নদী গবেষক
skrokon@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ধ র ব হ কত প রস ত ব ত হয় ছ ল প রণয়ন কম ট র মন ত র নদ র স আইন প সদস য আইন র
এছাড়াও পড়ুন:
পানি আইন: আগার আলাপ ও গোড়ার গলদ
অন্তর্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ‘বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩’ হালনাগাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ‘ওয়ারপো’ বা পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ইতোমধ্যে একাধিক সভা ও কর্মশালা আয়োজন করেছে। উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, পানি আইন প্রণয়নের পর ইতোমধ্যে এক যুগ পার হয়ে গেছে এবং এই সময়ের মধ্যে দেশের পানিসম্পদ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুতর কিছু পরিবর্তন এসেছে। এখন যখন আইনটি হালনাগাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তখন আগার কিছু আলাপ ও গোড়ার কিছু গলদ মীমাংসা করা জরুরি।
বস্তুত, পানিসম্পদ-সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়ার কিছু বৈশ্বিক রেওয়াজ রয়েছে। সাধারণত, প্রথমে পানি আইন প্রণয়ন করা হয়, তারপর এর আওতায় জাতীয় পানিনীতি প্রণীত হয়। পানি আইন ও পানিনীতি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হয় পানি বিধিমালা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে সেভাবেই ১৯৭৪ সালে পানি আইন প্রণয়নের পর নীতিমালা ও বিধিমালা প্রণীত হয়েছিল। বাংলাদেশে এই ধারাবাহিকতা মানা হয়নি। অনেকটা প্রবাদের ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়া হয়েছে।
প্রথমেই, ১৯৯৯ সালে, প্রণীত হয়েছিল জাতীয় পানিনীতি। এর ১৪ বছর পর এসে প্রণীত হয়েছিল পানি আইন। পানি বিধিমালা তৈরি হয়েছিল ২০১৮ সালে এসে। মুশকিল হয়েছে, পানি আইনের ৮ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে জাতীয় পানিনীতি প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে, ততদিনে তার বয়স আইনের চেয়ে দেড় দশক বেশি হয়ে গেছে; অর্থাৎ বাঁশের চেয়ে কঞ্চি হয়ে গেছে দড়। আবার নতুন করে পানিনীতি প্রণয়ন করতে প্রয়োজনীয় বিধিমালাও এসেছে পাঁচ বছর পর। যে কারণে, বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় এই তিন আইনি দলিলের অবদান খুঁজে পাওয়া কঠিন।
অতীত ঘাঁটলে দেখা যাবে, ধারাবাহিকতার ঘাটতির কারণে বাস্তবায়নযোগ্যতায় ঘাটতি দেখা দেওয়ায় পানি বিধিমালা প্রণীত হওয়ার আগেই খোদ আইনটি সংশোধনের আলোচনা শুরু হয়েছিল। আবার, ২০১৮ সালে বিধিমালা প্রণীত হওয়ার পরও আইনটি কার্যকর হচ্ছিল না; কারণ পানি আইনের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে আইন লঙ্ঘনের কারণে যে দণ্ড, অর্থদণ্ড ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে, সেটি ২০০৯ সালের মোবাইল কোর্ট আইনের তপশিলভুক্ত নয়। এ জন্য ২০২০-২১ সালের দিকে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয়। সেই কমিটির সুপারিশ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পর কী ঘটেছে, জানা নেই।
এই দফায় অবশ্য জাতীয় পানিনীতি ১৯৯৯ এবং বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ একই সঙ্গে হালনাগাদের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আবারও যদি পানিনীতির আগে পানি আইন হালনাগাদ হয়, তাহলে আগের মতোই ধারাবাহিকতার সংকট দেখা দেবে। সে ক্ষেত্রে উচিত হবে প্রথমে পানি আইন হালনাগাদ চূড়ান্ত করে, তারপর তার আলোকে নীতিমালা হালনাগাদ করা। এরপর আসবে বিধিমালাটি হালনাগাদের প্রশ্ন। আর পানি আইনের বিভিন্ন ধারা অন্য যেসব আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত, যেমন মোবাইল কোর্ট আইন বা পরিবেশ আদালত, সেগুলোর সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব তপশিলভুক্ত করতে হবে। দেশের পানিসম্পদ পরিস্থিতির অবনতি যে তলানিতে গিয়ে ইতোমধ্যে পৌঁছেছে এবং যে হারে সেটি ঘটে চলছে, তাতে করে আগের মতো আরও দুই দশকের গদাইলস্করির বিলাসিতা মানায় না।
প্রশ্ন হচ্ছে, পানিসম্পদ সম্পর্কিত আইনি কাঠামোর ধারাবাহিকতা ও গতিশীলতাই কি শেষ কথা? সেটি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু এগুলো আগার আলাপ মাত্র। একই সঙ্গে গোড়ার কিছু গলদও দূর করতে হবে। যেমন, বাংলাদেশের পানিসম্পদের মূলসূত্র হচ্ছে নদনদী। বিস্ময়কর হলেও সত্য, বিদ্যমান পানি আইনে যে ৩৫টি বিষয়ে সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানে ‘নদী’ শব্দটিই নেই! বস্তুত, এটি আমাদের দেশের পানিসম্পদ সম্পর্কিত আইনি কাঠামোর বৃহত্তম ত্রুটি। রিভারাইন পিপল থেকে আমরা গবেষণা করে দেখেছি, ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ ভারতে প্রণীত ‘দ্য ক্যানেল অ্যাক্ট’ থেকে ২০১৩ সালের জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন আইন পর্যন্ত– বর্তমান বাংলাদেশে প্রচলিত পানিসম্পদ সম্পর্কিত ৩১টি আইনের কোথাও নদীর সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়নি!
ওয়ারপো ধন্যবাদ পেতে পারে যে, পানি আইন হালনাগাদের প্রস্তাবনায় ‘নদী’ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, নদীর সংজ্ঞা না থাকার বিষয়টি আমরা দীর্ঘদিন ধরে জনপরিসরে তুলে ধরার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের আগস্টে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন প্রকাশিত নদনদীর তালিকাতেও একটি সংজ্ঞা সংযোজিত হয়েছিল।
সংজ্ঞায়িত হলেই যেসব ঠিক থাকবে এমন নয়। যেমন, বিদ্যমান পানি আইনে ‘বাঁধ’ বলতে ‘মাটি বা অনুরূপ উপাদান দ্বারা নির্মিত কোনো ড্যাম, ওয়াল, ডাইক, বেড়িবাঁধ বা অনুরূপ কোনো বাঁধ’ বোঝানো হয়েছে। ওয়ারপোর প্রস্তাবনায় এটিকে দুই ভাগ করে নদীর সমান্তরালের স্থাপনাকে ‘বাঁধ’ এবং আড়াআড়ি স্থাপনাকে ‘ড্যাম’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে ড্যাম, ব্যারাজ, ডাইক সম্পূর্ণ আলাদা কারিগরি বিষয়। অথচ বাংলা ভাষায় রয়েছে এর দারুণ বিকল্প শব্দ; নদীর সমান্তরালে ‘বেড়িবাঁধ’ এবং আড়াআড়ি ‘আড়িবাঁধ’! এমন আরও কিছু জায়গা আছে, সেখানে প্রস্তাবনাগুলোই পর্যালোচনা দরকার।
বিদ্যমান পানি আইনের আরেকটি গোড়ার গলদ হচ্ছে, জাতীয় পানিসম্পদ পরিষদ এবং নির্বাহী কমিটি নামে দুটি ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন’ কর্মকাঠামো। এর মধ্যে ৪৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় পানিসম্পদ পরিষদের চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং; বাকি সদস্যরাও মন্ত্রী বা সচিব, নিদেনপক্ষে মহপরিচালক বা প্রধান প্রকৌশলী। তাদের মধ্যে ৪ জন বিশেষজ্ঞ বা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি রয়েছেন, তারাও প্রধানমন্ত্রী মনোনীত। পানিসম্পদ মন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন নির্বাহী কমিটির পরিস্থিতিও তথৈবচ। বলা বাহুল্য, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন কোনো পরিষদ বা কমিটির বৈঠক হওয়া আর আধা মণ ঘি জোগাড় করে রাধিকার নৃত্য দেখা সমান কথা।
ওয়ারপোর প্রস্তাবে অবশ্য জাতীয় পানিসম্পদ পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৪৩ থেকে কমিয়ে ২৫ জনে আনা হয়েছে এবং চেয়ারপারসন হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বদলে পরিকল্পনামন্ত্রীর কথা বলা হয়েছে। নির্বাহী কমিটির সদস্য সংখ্যাও ২৪ থেকে ২১ করা হয়েছে। কিন্তু এই দুই কর্মকাঠামোর কার্যকারিতা কেবল সংখ্যাগত নয়, বরং গুণগত সংস্কারের ওপর নির্ভর করে। যেমন, এসব কমিটিতে আমলাদের বদলে বরং একাডেমিক, গবেষক ও নাগরিক প্রতিনিধির সংখ্যা এমনভাবে বাড়ানো দরকার, যাতে তারা সংখ্যায় অর্ধেকের বেশি হন।
আর এসব কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সচিবদেরই প্রধান বা চেয়ারপারসন হতে হবে কেন? তারা তো এমনিতেই ক্ষমতাধর; মন্ত্রী বা সচিব হিসেবে অবারিত ক্ষমতা ধারণ ও প্রয়োগ করতে পারেন। কোন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর বা সংস্থার কোন কর্মকর্তার ঘাড়ে দুটি মাথা রয়েছে যে, তাদের নির্দেশনার ব্যত্যয় করবেন? বরং এই কমিটিগুলোর প্রধান হিসেবে একাডেমিক, গবেষক বা নাগরিক প্রতিনিধিদের আনা যায় না? একই কথা বলা চলে পানিসম্পদ-বিষয়ক বিধিবদ্ধ সংস্থা ও কমিশনগুলোর ব্যাপারে। তাহলেই আমরা সম্ভবত পানিসম্পদ বিষয়ে প্রকৃত সংস্কারের পথে যেতে পারব।
সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের মাঝামাঝি নতুন ও রাজনৈতিক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছে। সব পক্ষের সদিচ্ছা থাকলে তার আগেই পানিসম্পদ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি আইনি কাঠামো– পানি আইন, পানি নীতিমালা, পানি বিধিমালা হালনাগাদ, সংস্কার ও কার্যকর করা অবশ্যই সম্ভব।
শেখ রোকন: লেখক ও নদী গবেষক
skrokon@gmail.com