আমাদের ধনখড়েরাও অপমানিত হয়ে অপসারিত হয়েছিলেন
Published: 4th, August 2025 GMT
প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় এক কলামে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় কী পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেছেন, তার বিস্তারিত লিখেছেন। সৌম্য লিখেছেন, এভাবে অসম্মানিত অপসারণ আরও ভয়ংকরভাবে এই বার্তা ছড়িয়ে দিল, ‘কর্তার’ রোষানলে পড়লে কারও রেহাই নেই।
এই বার্তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক আগেই প্রচারিত হয়েছিল। আমাদের দেশেও ধনখড় ছিল। অনেকে হয়তো জানেন না বা ভুলে গেছেন, আমাদের ধনখড়দেরও অনেক অসম্মান করে বিদায় দেওয়া হয়েছিল। তবে ‘কর্তার’ ইচ্ছায় নয়; বরং দুই ‘কর্ত্রীর’ ইচ্ছায়। সেসব ঘটনা ভারতের ধনখড়ের চেয়েও চমকপ্রদ এবং রাজনীতির নাটকে ভরপুর।
ধনখড় একসময় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন। সে সময়টায় রাজ্যের রাজনীতিতে তাঁর অতি সক্রিয়তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অতিষ্ঠ করে তোলে। নিয়তির কী উপহাস, মোদি তাঁকে উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণের একটা বড় কারণ ছিল ‘তাঁর অতি সক্রিয়তা’। অন্য বড় কারণটা ছিল ‘প্রটোকলের বিষয়ে স্পর্শকাতরতা’। আশ্চর্য এক মিল—বাংলাদেশের ধনখড়দের অপমান ও অপসারণের কারণও ছিল ঠিক এই দুটি।
বাংলাদেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ‘অতি সক্রিয়তা’ ও ‘প্রটোকলের বিষয়ে স্পর্শকাতরতা’ নিয়ে সুপ্রিম নেতাদের দেওয়া লাইনটা কিছুটা ‘অতিক্রম’ করেছিলেন। প্রতিক্রিয়া ছিল তৎক্ষণাৎ, তাঁদের অপমানিত হয়ে চাকরি হারিয়ে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। এই দুটি ঘটনা একসময় দেশের রাজনৈতিক আলোচনায় দারুণ ঝড় তুলেছিল।
২.ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাবা কফিল উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন তুখোড় রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের একজন বরেণ্য নেতা। ১৯৭২ সালে বাবার মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ চেয়েছিল বদরুদ্দোজা চৌধুরী বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করবেন। কিন্তু তিনি তা চাননি। তিনি একজন শীর্ষ স্থানীয় মেডিকেল শিক্ষাবিদ ও চিকিৎসক হিসেবে নিজে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর উপস্থাপনায় অনুষ্ঠান ‘আপনার ডাক্তার’ ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়।
১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেওয়ার পর তিনি জিয়ার উপদেষ্টা হন। পরে রাষ্ট্রপতি জিয়া যখন নিজের রাজনৈতিক দল গঠন করেন ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী হলেন দলের মহাসচিব। সবাই আশ্চর্য হয়ে গেলেন। যে মানুষটা রাজনীতিকে এত কাছ থেকে দেখার পরও রাজনীতি থেকে এতটা বছর দূরে ছিলেন, হঠাৎ কেন রাজনীতিতে যোগ দিলেন?
খালেদা জিয়া হয়তো মনে করতেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বি চৌধুরী তাঁকে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করতেন না। রাষ্ট্রপতির প্রটোকলের প্রতি অবিচল থাকায় চরম শাস্তি পেতে হলো বি চৌধুরীকে। তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দেওয়া হয়নি, প্রধানমন্ত্রী একটিবার তাঁর সঙ্গে কথা বললেন না। এই অপমান ধনখড়ের অপমানের চেয়ে কম নয়।রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে বি চৌধুরীর খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জিয়া খুব বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা করতেন বি চৌধুরীকে। জিয়ার মৃত্যুর পর একসময় খালেদা জিয়া বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। দলে ও খালেদা জিয়ার সরকারে বদরুদোজ্জা চৌধুরী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি তাঁকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর আইন অনুযায়ী তিনি মন্ত্রিত্ব ও বিএনপির সব দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি নেন।
বঙ্গভবনে যাওয়ার পর বি চৌধুরী সরকার ও দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তিনি রাষ্ট্র ও প্রেসিডেন্সিকে দলের ওপরে স্থান দিতেন এবং প্রেসিডেন্সির স্বাধীন সত্তা ও প্রটোকল বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। দলের ভেতরে এর মধ্যে বিএনপি নেতা সাইফুর রহমান, অলি আহমদ, মতিন চৌধুরী হয়ে ওঠেন খালেদা জিয়ার পরামর্শদাতা। তাঁরা দলের বাইরে বি চৌধুরীর স্বাধীন সত্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কান ভারী করতে থাকেন বলে আলোচনা আছে এবং দলের সংসদ সদস্যদেরও তাঁরা খেপিয়ে তোলেন। নিজের জন্য আলাদা ইমেজ গড়ে তোলার চেষ্টাই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ষ ট রপত বদর দ দ জ র র জন ত হয় ছ ল য় র পর অপস র করত ন ব এনপ অপম ন
এছাড়াও পড়ুন:
ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন
কমলাপুর রেলস্টেশনের ভাঙাচোরা প্ল্যাটফর্মে বোতল কুড়িয়ে কিংবা হাত পেতে খাবার জুটত হাসান আলী মুসাফিরের। বয়স তখন পাঁচ কিংবা ছয়। রাতে স্টেশনের পাশে ঘুমিয়ে থাকলে মাঝে মাঝেই তাড়িয়ে দিত পুলিশ।
এক রাতে স্টেশনের ইঞ্জিনের ছাদে উঠে পড়ে সে-তার ছোট্ট বন্ধুও সঙ্গে ছিল। বন্ধুকে টানতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় সে। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসার সময় খোঁজ নেওয়া হয় তার পরিবারের, কিন্তু কোনো সন্ধান মেলে না।
একপর্যায়ে দায়িত্ব নেয় অলাভজনক সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এলইইডিও)। তখন থেকেই তাদের আশ্রয়ে বড় হয় হাসান। এখন নবম শ্রেণির ছাত্র সে। শিখেছে গ্রাফিক ডিজাইনসহ নানা হাতের কাজ। স্বপ্ন-একদিন পুলিশ হয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে।
দুই দশকে ৩০-৩৫ হাজার শিশুর পুনর্বাসন
হাসানের মতো হাজারো শিশুর জীবনের বাঁক ঘুরেছে এলইইডিও-র হাত ধরে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় আড়াই দশকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার সুবিধাবঞ্চিত ও পরিবারহারা শিশুকে উদ্ধার করে পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছে তারা। কেউ কেউ ফিরে গেছে পরিবারের কাছে, আবার কেউ থেকে গেছে সংগঠনের আশ্রয়ে-গড়ে তুলেছে নিজের ভবিষ্যৎ।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) এমন ৩০০ শিশু-কিশোরকে নিয়ে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী আনন্দভ্রমণের। স্থান ছিল ঢাকার ধামরাইয়ের মোহাম্মদী গার্ডেন। সকাল থেকে চলেছে চকলেট দৌড়, পিলো পাসিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সব মিলিয়ে উৎসবমুখর এক দিন।
পথ থেকে আশ্রয়ে
এলইইডিওর সংগঠকরা জানান, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল পাচার, নিখোঁজ ও ভাসমান শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন। কর্মীরা প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। যেসব শিশুর পরিবারের সন্ধান মেলে না, তাদের উদ্ধার করে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যদি পরিবারের হদিস না মেলে, প্রথমে নেওয়া হয় ‘শেল্টার হোমে’, পরে ‘পিস হোমে’।
ঢাকার কমলাপুর ও কদমতলীতে রয়েছে দুটি শেল্টার হোম, আর ওয়াশপুরে একটি পিস হোম। শেল্টার হোমে প্রায় ২৫ জন ও পিস হোমে প্রায় শতাধিক শিশুর থাকার ব্যবস্থা রযেছে। শেল্টার হোমে থাকা শিশুদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলতে থাকে, ব্যর্থ হলে পাঠানো হয় সরকারি ছোট মনি নিবাসেও। পিস হোমে থাকা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়, শেখানো হয় বিভিন্ন কারিগরি কাজ।
এছাড়া ঢাকার কদমতলী, সদরঘাট, এয়ারপোর্ট, মিরপুর, কমলাপুর ও তেজগাঁওয়ে ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’ নামে ছয়টি মুক্ত বিদ্যালয় পরিচালনা করছে সংগঠনটি। খোলা আকাশের নিচে বসে পথশিশুরা সেখানে শেখে অক্ষর আর জীবনের নতুন দিশা।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পথশিশুরা
‘এলইইডিও’র উদ্যোগে এই শিশুরাই অংশ নিয়েছে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও। ২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপে, আর ২০২৩ সালে ভারতে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলার গৌরবও অর্জন করেছে তারা।
বিশেষ শিশুর গল্প: মালেকা আক্তার
কুড়িগ্রামের রাজারহাট থেকে ট্রেনে উঠে ঢাকায় চলে এসেছিল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু মালেকা আক্তার। স্মৃতিশক্তি দুর্বল, জন্মগতভাবে এপিলেপসিতে আক্রান্ত। তাকে উদ্ধার করে ‘এলইইডিও’।
এখন সে সংগঠনের পিস হোমে থাকে, স্কুলে যায়। শেখানো হয়েছে সেলাই ও ক্রাফটের কাজ। একসময় হাঁটতেও কষ্ট হতো তার, এখন নিয়মিত চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ। হাসতে হাসতে বলল, “এখানে আমি নিরাপদ, নিজের মতো করে বাঁচতে পারি।”
যে স্কুলে পড়েছেন, এখন সেই স্কুলেই শিক্ষক
মো. নিজাম হোসেনের গল্প যেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। রায়েরবাজারের ছেলেটি বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর ঘরহারা হয়। একসময় ভাসমান জীবনে জড়িয়ে পড়ে। ‘এলইইডিও’র কর্মীরা খুঁজে পেয়ে তাকে ভর্তি করান স্কুলে। এরপর পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়।
বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগে পড়ছেন নিজাম। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের লর্ডস স্টেডিয়ামে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলেছেন। এখন ‘এলইইডিও’র স্ট্রিট স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।
নিজামের ভাষায়, “আমি যে স্কুলে পড়েছি, আজ সেই স্কুলেরই শিক্ষক। এখানে ভাসমান শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি করাই।”
তার আঁকা ছবি সংগ্রহ করেছেন ফুটবলার হামজা চৌধুরী, ছাপা হয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্যালেন্ডারেও। ভবিষ্যতে জাতিসংঘে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
দিনভর হাসি, আনন্দ
বিকেলের দিকে মঞ্চে পুরস্কার বিতরণ। মাইকে নাম ঘোষণা হতেই শিশুদের উল্লাস-পিলো পাসিংয়ে কমলাপুরের বিজয়, চকলেট দৌড়ে হাবিবা, পিস হোম থেকে শামীম। মাঠ জুড়ে হাততালি আর হাসি।
প্রতি বছরই এমন আয়োজন করে ‘এলইইডিও’। অংশ নেয় ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’-এর শিক্ষার্থী, শেল্টার ও পিস হোমের শিশুরা।
এদিন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন, বোর্ড সদস্য তুষার আহমেদ ইমরান, এবং ফ্রেন্ডস অব স্ট্রিট চিলড্রেনের চেয়ারম্যান মাইক শেরিফ।
ফরহাদ হোসেন বলেন, “আড়াই দশক ধরে আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে আছি। এবার ৩০০ শিশুকে নিয়ে এসেছি। রাষ্ট্র যদি আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসে, এই শিশুরাই ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে উঠবে।”
শেষে সাংস্কৃতিক পর্বে শিশুরা গেয়েছে দেশাত্মবোধক ও জনপ্রিয় গান। অতিথি মাইক শেরিফ গাইলেন ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’ শিশুদের করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো মাঠ। বিকেলের রোদে সবার যৌথ ছবি তোলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসবের দিনটি- ভাসমান শিশুরা ফিরল মুখভরা হাসি নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে।
ঢাকা/এস