অনুষ্ঠান শুরুর সময় নির্ধারিত ছিল বিকেল সাড়ে চারটা। সোনারগাঁও হোটেলের ওয়েসিস ফাংশন হলে অতিথিরা আসতে শুরু করলেন ঘড়ির কাঁটা তিনটা পার হতেই। আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বলেই ‘অতিথি’ বলা। নইলে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সাবেক ও বর্তমানের ক্রীড়াবিদদের এই উৎসাহী ও সরব উপস্থিতি মূলত একে অপরের সঙ্গে দেখা–সাক্ষাতের, পুনর্মিলনীর আড্ডায় মেতে ওঠার।

সিটি গ্রুপ–প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার অনুষ্ঠানের সৌজন্যে প্রতিবছরই এভাবে এক ছাদের নিচে একত্রিত হন দেশের বিভিন্ন খেলার ক্রীড়াবিদেরা। আজ বিকেলে ক্রীড়াবিদদের এই মিলনমেলায় ২০২৪ সালের বর্ষসেরার স্বীকৃতি পেয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় ঋতুপর্ণা চাকমা। পাঠকের ভোটে বর্ষসেরাও ২১ বছর বয়সী এই উইঙ্গার। বর্ষসেরা রানারআপ হয়েছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় তাসকিন আহমেদ ও মেহেদী হাসান মিরাজ।

ঘোষণার আগপর্যন্ত কোনো মনোনয়ন নেই, অনুষ্ঠানে কারও জন্য কোনো আসন সংরক্ষিত নেই—এমন ব্যতিক্রমী ধারার সিটি গ্রুপ–প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার অনুষ্ঠানের এবার ছিল দুই দশক পূর্তি। ২০০৫ সাল থেকে আয়োজিত হয়ে আসা এই পুরস্কারে আগের বছরের সেরা ক্রীড়াবিদদের স্বীকৃতি জানানো হয়। সাবেক কোনো খেলোয়াড়–সংগঠককে আজীবন সম্মাননা জানানো হয় ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখার জন্য।

এবার ‘আজীবন সম্মাননা’ পেয়েছেন মোশাররফ হোসেন শামীম। আশির দশকে টানা সাতবার দেশের দ্রুততম মানব হওয়া এই কীর্তিমানকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, তাঁর হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (বিক্রয় ও বিপণন) জাফর উদ্দিন সিদ্দিকী।

আজীবন সম্মাননা পাওয়া মোশাররফ হোসেন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘জীবনসায়াহ্নে এসে এই পুরস্কার অর্জন করতে পেরেছি। তাঁরা যে আমাকে যোগ্য মনে করেছেন, সে জন্য প্রথম আলোকে ধন্যবাদ।’ এর আগে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘কাউকে আজীবন সম্মাননার পুরস্কার দেওয়ার চেয়ে বড় হচ্ছে এই সম্মাননা দিয়ে আমরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করি।’

অনুষ্ঠানে উপস্থিতির সংখ্যা অন্যবারের চেয়ে বেশি উল্লেখ করে প্রথম আলো সম্পাদক বলেন, ‘আপনারা জানেন, আমরা সত্য দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করি। মামলা–হামলা–ঝামেলায় আমাদের পড়তে হয়। কোনো সরকারই আমাদের বন্ধু নয়। আমরা সত্য বলার চেষ্টা করি। সেদিক থেকে আপনাদের সহযোগিতা, সমর্থন, সাহায্য আর আজকের এই উপস্থিতি আমাদের সাহস জোগায়, উৎসাহিত করে।’

সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক জাফর আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘সিটি গ্রুপ খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ফজলুর রহমানের হাত ধরে। তাঁর প্রয়াণের পর তাঁর ছেলে সিটি গ্রুপের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাসান সেই লিগ্যাসিটা ধরে রেখেছেন।’ জাফর আহমেদ নিজের শৈশব–কৈশোরের স্মৃতিচারণা করে সে সময়ের স্বপ্নের নায়ক রকিবুল হাসান, প্রতাপ শংকর হাজরাদের এই অনুষ্ঠানে চোখের সামনে দেখার অনুভূতি প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন স্বাধীনতার পর থেকে গত পাঁচ দশকে কত উজ্জ্বল সম্ভাবনা জাগিয়েছিল, সেই সম্ভাবনা কতবার হোঁচট খেয়ে বড় পরিসর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি—উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ তাঁর বিশেষ বক্তৃতায় বলেছেন সে কথাই। পরে বক্তব্যের মূল কথার সঙ্গে সংগতি রেখে তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গান ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’ পরিবেশন করেন। এই গানে তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মেলান সাবেক ফুটবলার শেখ মোহাম্মদ আসলাম ও সাবেক শুটার সাবরিনা সুলতানা এবং আসিফ হোসেন খান।

সমন্বয় ঘোষ ও শ্রাবণ্য তৌহিদার উপস্থাপনায় পুরস্কারের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় বর্ষসেরা উদীয়মান দিয়ে। এই পুরস্কারটি জেতেন দাবাড়ু মনন রেজা। তাঁর হাতে ক্রেস্ট ও চেক তুলে দেন ২০০৪ সালের বর্ষসেরা উদীয়মান হকি তারকা রাসেল মাহমুদ জিমি। সাবেক ভারোত্তোলক মোল্লা সাবিরা সুলতানা বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদের পুরস্কার তুলে দেন তহুরা খাতুনের হাতে। বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের এই স্ট্রাইকার ভুটানের নারী লিগে খেলার ফাঁকে ঢাকায় এসেছেন। ২০১৮ সালের পর আবারও বর্ষসেরা নারী হওয়া তহুরা বলেন, দেশের ক্লাবগুলো দল বানালে তাঁদের ভুটানে খেলতে যেতে হতো না। এ বিষয়ে দেশের বড় দলগুলোকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সিটি গ্রুপ–প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারে দুজনকে দেওয়া হয় রানারআপ পুরস্কার। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার একজন রানারআপ হিসেবে ওয়ানডে দলের অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজের নাম ঘোষণা করেন। মিরাজ পুরস্কার হাতে নিয়ে মুখবন্ধ খাম খুলে জানান, অপর রানারআপ অনুষ্ঠানস্থলে তাঁরই পাশে বসে থাকা জাতীয় দল সতীর্থ তাসকিন আহমেদ।

দুই ক্রিকেটার পুরস্কার নিয়ে নামার পর বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদের নাম ঘোষণা করতে মঞ্চে ওঠেন রানী হামিদ। দাবার রানী বর্ষসেরা হিসেবে ঘোষণা করেন ঋতুপর্ণার নাম। ২০২২ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর বর্ষসেরা হয়েছিলেন সাবিনা খাতুন, এবার ২০২৪ সালের সাফল্যের সূত্রে একই স্বীকৃতি উঠেছে ঋতুপর্ণার হাতে।

বর্ষসেরা, রানারআপ, বর্ষসেরা নারী আর উদীয়মান—সব কটি পুরস্কার বিজয়ী চূড়ান্ত করেছে ৫ সদস্যের জুরি বোর্ড। সাবেক ফুটবলার আশরাফউদ্দিন চুন্নুর নেতৃত্বে জুরি বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন সাবেক সাঁতারু ও কোচ মাহফুজা খাতুন শীলা, সাবেক ক্রিকেটার আতহার আলী খান, সাবেক শুটার শারমিন আক্তার ও ক্রীড়া সাংবাদিক দুলাল মাহমুদ।

পাঠকের ভোটেও বর্ষসেরা হয়েছেন ঋতুপর্ণা। প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকা ও অনলাইনে দুই ধাপের ভোটাভুটিতে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন তিনি। এই পর্বে তাঁর সঙ্গে পাঠক–ভোটের লড়াইয়ে ছিলেন তিন ক্রিকেটার তাসকিন, মিরাজ ও জাকের আলী এবং দুই ফুটবলার সাবিনা খাতুন ও শেখ মোরছালিন। পাঠকের ভোটে বর্ষসেরা নির্বাচনে যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁদের মধ্য থেকে লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত ৩২ জন পেয়েছেন সরাসরি অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ।

প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্রর বক্তব্য দিয়ে শুরু হওয়া অনুষ্ঠান সন্ধ্যা সাতটায় শেষ হয় ক্রীড়া সম্পাদক তারেক মাহমুদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। সে সমাপ্তিতে মিশে থাকল আরেকটি নতুন শুরুর রেশ। আগামী বছরও কারও না কারও হাতে উঠবে পুরস্কার, তবে তার চেয়েও বড় হয়ে উঠবে আরেকটি পুনর্মিলনীর আনন্দ।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ই প রস ক র প রথম আল অন ষ ঠ ন র ন রআপ উপস থ ফ টবল আহম দ

এছাড়াও পড়ুন:

পুরস্কার হাতে স্মৃতিকাতর তহুরা

২০১৮ সালটা তহুরার জন্য খুবই স্মরণীয়। সেবারই প্রথম জাতীয় নারী ফুটবল দলের জার্সি গায়ে জড়িয়েছিলেন এই ফরোয়ার্ড। ঠিক সেই বছর সিটি গ্রুপ–প্রথম আলো বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদও হয়েছিলেন তহুরা।

শনিবার আরও একবার একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিয়েছেন নিজের দ্বিতীয় বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদের পুরস্কার। গতকাল ২০২৪ সালের জন্যও দ্বিতীয়বারের মতো সেই পুরস্কার নিতে এসে খানিকটা স্মৃতিকাতরই হয়ে পড়লেন তিনি।

২০১৮ সালে যখন প্রথমবার বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদ হয়েছিলেন, তখন টুর্নামেন্টে থাকার কারণে নিজে পুরস্কার নিতে আসতে পারেননি তহুরা। তহুরার হয়ে পুরস্কার নিয়েছিলেন তাঁর বাবা। কাল পুরস্কার হাতে সে দিনের স্মৃতিতে ফিরে গেলেন, বললেন এবারের রোমাঞ্চের কথাও, ‘২০১৮ সালে যখন এই পুরস্কার পাই, তখন এত বেশি বুঝতাম না পুরস্কারটা কী! তখন টুর্নামেন্ট থাকায় আসতে পারিনি। আমার বাবা এসেছিলেন, নিজে না আসতে পারায় মন খারাপ হয়েছিল। এবার আবার পুরস্কার পেলাম। প্রথম আলোকে ধন্যবাদ। এই আয়োজনের সঙ্গে যাঁরা সম্পৃক্ত তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।’

বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদ হয়েছেন তহুরা খাতুনের হাতে পুরস্কার তুলে দেন মোল্লা সাবিরা

সম্পর্কিত নিবন্ধ