মোহ কেটে গেলে এক ধরনের বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়, যেখানে মানুষ বা পরিস্থিতি যেমন ছিল, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সময়ে আগের সেই মোহ বা মুগ্ধতা আর থাকে না এবং প্রায়শই সম্পর্ক বা ব্যক্তি সম্পর্কে নতুন এবং ভিন্ন ধারণা জন্মায়।
গামিনি ডি সিলভা, যিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রধান কিউরেটর হিসেবে ১৫ বছর ধরে কাজ করে আসছিলেন, তাকে নিয়ে শনিবার সঠিক মূল্যায়নটাই দিলেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম, ‘‘উইকেট নিয়ে আমাদের অসন্তুষ্টি সবার মধ্যেই ছিল। তার সীমাবদ্ধতা ছিল। এজন্য সে ওভারকাম করতে পারেনি। আমরা যা চেয়েছি তা দিতে পারিনি। সময় এসেছে এখান থেকে বেরিয়ে আসার। ভালো কোচ ও ট্রেনারের চাইতেও উইকেট বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভালো উইকেট থাকলে অনেক কিছু ভালো হয়ে যেতে পারত। আমরা সেটা করতে পারিনি। এখন হয়তো সেটা হবে।’’
পাশে বসা আরেক পরিচালক ইফতেখার আহমেদ মিঠু যেন বিরক্তই গামিনির ওপর, ‘‘এতো গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই (গামিনিকে)। আমাদের রিয়ালেইজেশন বলতে পারেন (গামিনিকে নিয়ে)। আমরা চাচ্ছিলাম একজন পারেফক্ট লোক….
সাবেক শ্রীলঙ্কান ঘরোয়া ক্রিকেটার গামিনি খেলা শেষে আম্পায়ার হিসেবে কাজ করার পর স্রেফ কিউরেটর কোর্স করে বিসিবির চাকরি বাগিয়ে নিয়েছিলেন। এখন মাসে বেতন পাচ্ছেন সাড়ে চার হাজার ডলার। তাকে দিয়ে ‘আর চলবে না’ এই উপলব্ধি বিসিবি পেয়েছে সবশেষ পাকিস্তান সিরিজে।
তিন টি-টোয়েন্টির উইকেট নিয়ে প্রচন্ড হতাশ বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। তাকে ছাঁটাই কিংবা এক্সটেনশন পিরিয়ড শেষেই বিদায় করে দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা আজকের বোর্ড সভায় অনুমোদন পেয়েছে। ফলে এক বছর তিনি থাকবেন স্রেফ পদ আঁকড়ে। তার জায়গায় বিসিবি উড়িয়ে এনেছে ক্রিকেট মাঠ ও মাটির বিশেষজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ কিউরেটর টনি হেমিংকে।
খবরটা গামিনি ডি সিলভা আগেই পেয়েছিলেন। তাকে ছাড়তে হবে বাংলাদেশ হেড কিউটরের পদ। আজ সকালেই পাকিস্তান থেকে হেমিং বাংলাদেশে ফিরেছেন। আপাতত বিসিবি হেমিংয়ে আশার বীজ বপন করছেন। হেমিংয়ে বুঁদ হয়েই আছেন নাজমুল আবেদীন, ‘‘টনি হেমিং সম্পর্কে আমি অস্ট্রেলিয়ার এক নম্বর কিউরেটর অ্যাডাম লুইসের থেকে শুনেছি। পাকিস্তানে আমরা যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ওখানে যেই উইকেট হেমিং বানিয়েছিলেন..ওখানে ঘরোয়া টুর্নামেন্ট হয়েছে। পিএসএল হয়েছে। আরো খেলা হয়েছে, তারপরও শেষ দিকে উইকেটের যেই কন্ডিশন দেখেছি, আমি অবাক হয়ে গিয়েছি। আমরা তো অজুহাত দেই আমাদের এখানে এতো খেলা হয়। অথচ পাকিস্তানের উইকেট এতো পেস, সুন্দর বাউন্স, পরিচ্ছন্ন। এগুলো দেখে প্র্যাকটিক্যালি ইমপ্রেস হওয়ার সুযোগ ছিল। এছাড়া ঢাকাতেও আমি তার কাজ দেখেছি। দারুণ কাজ করে।’’
হেমিং ২০২৩ সালে বিসিবির চাকরিতে যোগ দেন দুই বছরের চুক্তিতে। এক বছর যেতে না যেতে গামিনির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বিসিবির চাকরি ছাড়েন। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডে (পিসিবি) দুই বছরের জন্য চাকরি নেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতে পিসিবির চাকরি ছেড়ে বিসিবিতে যোগ দিচ্ছেন এই অস্ট্রেলিয়ান।
এবারও দুই বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তাকে। আজ তার চুক্তি অনুমোদনও করা হয়েছে। কাল থেকেই কাজ শুরু করবেন। তাকে নিয়ে বিসিবির উচ্ছ্বাসটা টের পাওয়া গেল পরিচালক ইফতেখার আহমেদ মিঠুর কণ্ঠে, ‘‘হি ইজ দ্য বেস্ট, ওয়ার্ল্ডের দুই-তিনজন কিউরেটরের মধ্যে একজন। হয়তো তার বিসিবির অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগতভাবে ভালো ছিল। এজন্য ফিরেছেন।’’
‘‘আমরা তাকে প্রধান করে নিয়ে আসছি। সময় বলবে গামিনি থাকছে কী থাকছে না। টমি হেমিং যেভাবে চাবে সেভাবে তার বিভাগ সাজিয়ে নেবে। সে তো টার্ফ ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনের প্রধান। গ্রাউন্ডস কমিটি বসবে। প্লাস-মাইনাস সবারই তো আছে। টনি হেমিং জানেন সব। তার ওয়ার্ক ফ্লো নিজে ঠিক করবে। তাকে সপ্তাহ দশ দিন সময় দেই।’’
শুধু মাঠের উইকেটের দায়িত্বই নয়, হেমিং কাজ করবেন স্থানীয় কিউরেটর নিয়েও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল সায়েন্স থেকে নিয়োগ পাওয়া চার ট্রেইনি কিউরেটরকে প্রশিক্ষণ দেবেন।
‘‘আমাদের যেই গ্রাউন্ডসম্যান আছে। আমরা চাই তাদের ওপর বিনিয়োগ করতে। একটু অপেক্ষা করি। দেখি সামনে কী হয়। এখন আমরা অনেক স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করছি। অনেক ধরনের বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে আমরা চেষ্টা করছি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে। সেই অনুযায়ী আমরা এগিয়েছি। আমরা তাকে পেয়ে খুশি। আমরা এখন উন্নতির প্ক্রিয়াতে আছি।’’ - বলেছেন ইফতেখার আহমেদ।
১৭ দিনের ছুটি অনুমোন করা গামিনি ১০ আগস্ট শ্রীলঙ্কা যাচ্ছেন। হতে পারে বিসিবির চাকরিতে এটিই তার শেষ ছুটি।
ঢাকা/ইয়াসিন
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব স ব র চ কর র উইক ট আম দ র ক জ কর
এছাড়াও পড়ুন:
পৃথিবীকে নীল বিন্দু খেতাব দিয়েছিলেন যে বিজ্ঞানী
জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল স্যাগান মহাবিশ্বের সৌন্দর্যকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার জন্য আলোচিত। তিনি ১৯৩৪ সালের ৯ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। কিংবদন্তি জ্যোতির্বিজ্ঞানী, লেখক ও বিজ্ঞান প্রচারক হিসেবে কার্ল স্যাগান আলোচিত। বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলোকে সহজ ও কাব্যিক ভাষায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে তিনি বিশ্বকে মহাবিশ্বের বিস্ময়কর সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে শিখিয়েছেন। তাঁর কাজ কেবল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
কার্ল স্যাগানের সবচেয়ে বড় অবদান বলা যায় বিজ্ঞানবিষয়ক নানা বিষয়কে লেখালেখি ও টেলিভিশনের মাধ্যমে সবার সামনে ছড়িয়ে দেওয়া। ১৯৮০ সালে প্রচারিত তাঁর যুগান্তকারী টেলিভিশন সিরিজ ‘কসমস: এ পার্সোনাল ভয়েজ’ বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ দর্শককে মহাবিশ্বের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট করে। এই সিরিজ বৈজ্ঞানিক ধারণাকে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যা গভীর অথচ সহজে বোধগম্য। স্যাগানের বিখ্যাত উক্তি, ‘আমরা সবাই স্টারডাস্ট বা তারাধূলি দিয়ে তৈরি।
একজন পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে স্যাগানের গবেষণা মূলত ছিল গ্রহবিজ্ঞান নিয়ে। তিনি শুক্র, বৃহস্পতি গ্রহসহ অন্যান্য গ্রহের বায়ুমণ্ডলের ওপর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে ছিল শুক্র গ্রহের তীব্র তাপমাত্রা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা, যা পরে প্রমাণিত হয়। স্যাগান মঙ্গল গ্রহে প্রাণের অনুসন্ধান এবং এর পরিবেশ নিয়ে ব্যাপক কাজ করেন। তিনি নাসার মেরিনার, ভয়েজারসহ বিভিন্ন গ্রহ অনুসন্ধানকারী মিশনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। মঙ্গলের পৃষ্ঠে থাকা রহস্যময় ক্যানালি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক ছিল। স্যাগান বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করেন, এসব এলিয়েনদের তৈরি খাল নয়, বরং প্রাকৃতিক ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য।
দূরবর্তী মহাজাগতিক প্রাণীর কাছে পৃথিবীর অস্তিত্ব জানান দিতে স্যাগান দুটি ঐতিহাসিক প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭২ সালে উৎক্ষেপিত পাইওনিয়ার ১০ মহাকাশযানে একটি বিশেষ ফলক সংযুক্ত করার ধারণা দেন স্যাগান।
এই প্লেটে মানব জাতির চিত্র, আমাদের সৌরজগতের অবস্থান এবং মহাকাশযানের উৎক্ষেপণের সময়কাল চিহ্নিত করা হয়। এ ছাড়া ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড পাঠানোর সময় তাঁর ভূমিকা ছিল। এটি ছিল স্যাগানের নেতৃত্বাধীন সবচেয়ে বিখ্যাত প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি। ১৯৭৭ সালে উৎক্ষেপিত ভয়েজার ১ এবং ভয়েজার ২ মহাকাশযানে পৃথিবীর ছবি, শব্দ, সংগীত এবং বিভিন্ন ভাষার শুভেচ্ছাবার্তা নিয়ে তৈরি এই সোনালি রেকর্ড পাঠানো হয়। কার্ল স্যাগান ১৯৯৬ সালে আমাদের ছেড়ে চলে যান।
ভয়েজার ১ মহাকাশযান থেকে তোলা একটি ছবিকে জনপ্রিয় করেন তিনি। সেই ছবিতে পৃথিবীকে একটি ফ্যাকাশে নীল বিন্দুর মতো দেখায়। ৬০০ কোটি কিলোমিটার দূর থেকে ধারণ করা ছবিটি বিশ্বকে চমকে দেয়। ছবিটি তুলতে স্যাগান নাসাকে উৎসাহিত করেছিলেন। কার্ল স্যাগানের চিন্তায় প্রথমবারের মতো মানব জাতি বুঝতে পারে, মহাবিশ্বের বিশালতার পরিপ্রেক্ষিতে মানবজাতির গুরুত্ব ও ক্ষুদ্রতা কত নগণ্য।
ভয়েজার ১ মহাকাশযান থেকে পৃথিবীকে আলোর রশ্মিতে ঝুলে থাকা এক ফোঁটা নীল ধূলিকণার মতো মনে হয়। স্যাগান সেই ছবির বর্ণনায় বলেন, এই ক্ষুদ্র বিন্দুর ওপরই বাস করছে আপনার পরিচিত প্রতিটি ব্যক্তি। আমাদের সব হাসি-কান্না, আমাদের হাজারো ধর্ম, মতাদর্শ, অর্থনৈতিক বিশ্বাস, সভ্যতার উত্থান-পতন, রাজা-প্রজা, প্রেমিক-প্রেমিকা, উদ্ভাবক আর আমাদের প্রজাতির ইতিহাসে যত পাপি ও সাধু এসেছে সবাই। তারা সবাই ছিল সূর্যের আলোয় ভেসে থাকা ধূলিকণার এক কণামাত্র।
তথ্যসূত্র: আমেরিকান সায়েন্টিস্ট