নামাজ যেভাবে শারীরিক–মানসিক সুস্থতা বাড়ায়
Published: 14th, August 2025 GMT
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে নামাজ একটি অপরিহার্য ইবাদত। এটি কেবল ধর্মীয় আচার নয়, বরং ভক্তি, শৃঙ্খলা ও আধ্যাত্মিক উত্তরণের প্রতীক। পবিত্র কোরআনে নামাজের গুরুত্ব বারবার তুলে ধরা হয়েছে। সুরা বাকারায় আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও এবং যারা রুকু করে তাদের সঙ্গে রুকু করো’ (আয়াত: ৪৩)।
ধর্মীয় তাৎপর্য ছাড়াও স্বাস্থ্যের বিবেচনায় নামাজের বেশ কিছু শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা রয়েছে, যা আমরা সচরাচর উপেক্ষা করে থাকি। এই নিবন্ধে আমরা নামাজে শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উপকারিতা এবং ওজুর ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ইসলামে আধ্যাত্মিকতা ও স্বাস্থ্যের সম্পর্কইসলামে আধ্যাত্মিকতা এবং শারীরিক সুস্থতা গভীরভাবে সম্পৃক্ত। নামাজ এই দুটির মধ্যে একটি সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। আধ্যাত্মিকতা ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ শান্তি, জীবনের উদ্দেশ্য এবং আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। নামাজ এই আধ্যাত্মিকতার একটি বাহন, যা শুধু আধ্যাত্মিক সংযোগ নয়, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাও নিশ্চিত করে। আমেরিকান মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন আধ্যাত্মিকতাকে স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। (আনন্দরাজা অ্যান্ড হাইট, ২০০১, পৃ.
নামাজ শরীর, মন এবং আত্মার সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি সামগ্রিক সুস্থতার পথ প্রশস্ত করেও।
আরও পড়ুননামাজ আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির একটি ধাপ১৭ জুলাই ২০২৫ওজু: শুদ্ধির প্রথম ধাপনামাজের পূর্বশর্ত হিসেবে ওজু একটি অপরিহার্য আচার। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ইমানদারগণ, যখন তোমরা নামাজের জন্য দাঁড়াও, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করো, মাথায় মাসেহ করো এবং পায়ের টাখনু পর্যন্ত ধৌত করো।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৬)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে মুসলিম আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ওজু করে এবং নামাজ আদায় করে, তার নামাজ তার পাপের কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) হয়ে যায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪৪৪)
ওজু শুধু আধ্যাত্মিক শুদ্ধি নয়, শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে:
জীবাণু হ্রাস: নিয়মিত হাত, মুখ, নাক ও পা ধোয়া জীবাণুর পরিমাণ কমায়।
স্নায়ুতন্ত্রের শিথিলতা: ওজুমানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমায়।
মুখের স্বাস্থ্য: মিসওয়াক ব্যবহার দাঁতের ক্ষয় রোধ করে এবং মুখের দুর্গন্ধ কমায়।
নাকের পরিচ্ছন্নতা: নাক ধোয়া ধুলাবালু ও অ্যালার্জেন দূর করে।
ত্বকের উপকার: মুখ ধোয়া ব্রণ ও বলিরেখা কমাতে সহায়তা করে।
দিনে পাঁচবার ওজু করার ফলে মননশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং নামাজের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিশ্চিত হয়। এটি শরীর ও মনের শুদ্ধি ঘটিয়ে নামাজের সামগ্রিক উপকারিতা বাড়ায়।
নামাজের শারীরিক উপকারনামাজের বিভিন্ন ভঙ্গিমা—দাঁড়ানো, রুকু, সিজদা ও বসা—শরীরের বিভিন্ন পেশি ও জয়েন্টের ওপর কাজ করে। প্রতিটি ভঙ্গিমার নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে:
১. তাকবির ও কিয়াম (দাঁড়ানো)
মাংসপেশি সক্রিয়করণ: তাকবিরে হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে পেক্টোরালিস পেশি প্রসারিত হয় এবং কাঁধের শক্তি বৃদ্ধি পায়।
ভঙ্গিমা উন্নতি: মেরুদণ্ড ও কাঁধের সঠিক সারিবদ্ধতা ভঙ্গিমা উন্নত করে।
রক্ত সঞ্চালন: দুই পায়ে সমান ওজন বণ্টন রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে।
২. রুকু (নত হওয়া)
মেরুদণ্ডের স্বাস্থ্য: রুকুতে প্যারাস্পাইনাল পেশি, হ্যামস্ট্রিং ও বাছুরের পেশি প্রসারিত হয়, যা অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি কমায়।
পিঠের ব্যথা হ্রাস: এটি পিঠের নিম্নাংশের ব্যথা উপশম করে।
নমনীয়তা: নিতম্ব ও নিম্ন মেরুদণ্ডের নমনীয়তা বৃদ্ধি পায়।
৩. জলসা (বসা)
জয়েন্টের নমনীয়তা: পা ভাঁজ করে বসা হাঁটুর জয়েন্টের নমনীয়তা বাড়ায়।
পেশি প্রসারণ: গোড়ালি ও পায়ের পেশি প্রসারিত হয়।
কোর শক্তি: জলসা থেকে অন্য রাকাতে স্থানান্তর কোর পেশির স্থিতিশীলতা বাড়ায়।
৪. সিজদা
মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন: মাথা হৃৎপিণ্ডের চেয়ে নিচে থাকায় মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, যা স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ উন্নত করে।
মেরুদণ্ড ও ঘাড়: ঘাড় ও মেরুদণ্ডের পেশি সক্রিয় হয়, পিঠের ব্যথা কমায়।
জয়েন্ট স্বাস্থ্য: নিতম্বের জয়েন্টের নমনীয়তা ডিজেনারেটিভ ডিস্ক রোগের ঝুঁকি কমায়।
আরও পড়ুননামাজ: দাসের মহিমা০৪ মার্চ ২০২৫৫. সালাম (ঘাড় ঘোরানো)
ঘাড়ের গতিশীলতা: ডানে-বাঁয়ে ঘাড় ঘোরানো ট্র্যাপিজিয়াস পেশি প্রসারিত করে এবং ঘাড়ের গতিশীলতা বাড়ায়।
স্ট্রেস হ্রাস: এই মৃদু ঘূর্ণন ঘাড় ও ওপরের পিঠের টান কমায়।
নামাজ দিনে পাঁচবার ১০-২০ মিনিটের জন্য সম্পাদিত হয়, যা নিম্ন থেকে মাঝারি তীব্রতার ব্যায়ামের সমতুল্য। এটি হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং মাসকুলোস্কেলেটাল সমস্যার ঝুঁকি কমায়। মসজিদে হেঁটে যাওয়া দৈনিক শারীরিক ক্রিয়াকলাপ বাড়ায়।
নামাজের মানসিক উপকারিতানামাজ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি মননশীলতার একটি রূপ, যা জাগতিক বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। নামাজর সময় খুশু বা মনোযোগী মননশীলতা মানসিক শান্তি নিয়ে আসে।
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত নামাজ আদায়কারীদের জীবনের সন্তুষ্টি বেশি এবং উদ্বেগ ও বিষণ্নতা কম থাকে। কোরআন তিলাওয়াত হাসপাতালে রোগীদের থাকার সময় কমায়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে অনেক মুসলিম মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য নামাজের মতো আধ্যাত্মিক অনুশীলনের ওপর নির্ভর করে, যা মানসিক শান্তি দেয়।
নামাজ ও যোগাসন: একটি তুলনানামাজ ও যোগাসন উভয়ই শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য উপকারী। যোগাসন প্রাচীন ভারতীয় দর্শন থেকে উদ্ভূত, যা শরীর, মন ও আত্মার সমন্বয়ের ওপর জোর দেয়। অন্যদিকে নামাজ আধ্যাত্মিক ভক্তি ও আল্লাহর সঙ্গে সংযোগের মাধ্যম। তবে উভয়ের শারীরিক ভঙ্গিমা অনেকাংশে একই রকম স্বাস্থ্য উপকারিতা প্রদান করে।
যোগাসনের আসনগুলো নমনীয়তা ও শান্তি বাড়ায়, যেখানে নামাজের ভঙ্গিমাগুলো শারীরিক ক্রিয়াকলাপের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক উত্তরণ ঘটায়। জামাতে নামাজে সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো সামাজিক ঐক্য তৈরি করে, যা যোগাসনের ব্যক্তিগত প্রকৃতির থেকে ভিন্ন। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, নামাজের ছন্দময় প্রকৃতি উদ্বেগ কমায় এবং মানসিক স্থিরতা বাড়ায়।
সারকথানামাজ কেবল ধর্মীয় অনুশীলন নয়, এটি শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সুস্থতার একটি সামগ্রিক পন্থা। ওজু শারীরিক পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করে, নামাজের ভঙ্গিমাগুলো শরীরের সুস্থতা বাড়ায় এবং খুশু মানসিক শান্তি প্রদান করে। আধুনিক গবেষণা এই প্রাচীন অনুশীলনের স্বাস্থ্য উপকারিতাকে সমর্থন করে, যা হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও মানসিক চাপ কমায়।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নামাজের স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়িয়ে এটিকে দৈনন্দিন জীবনে আরও সচেতনভাবে প্রয়োগ করলে আমাদের জীবন আরও সুষম ও পরিপূর্ণ হবে।
সূত্র: দ্য মুসলিম ভাইব ডট কম
আরও পড়ুনজীবনকে ছন্দে ফেরাবে ‘ধীর নামাজ’২৪ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ব স থ য উপক র ত ক উপক র ত র নমন য ত প রস র ত র জন য আল ল হ র একট
এছাড়াও পড়ুন:
এন্নিও মোররিকোনে, শোনাতেন ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের সুর
বাংলা সিনেমার এক টিপিক্যাল দৃশ্য দিয়ে শুরু করা যাক। ধরলাম, সিনেমার নায়ক জসিম। পাহাড়ের পাদতলে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি ছুটে যাচ্ছেন ভিলেন জাম্বুকে পাকড়াও করতে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে। এক ভুতুড়ে-রহস্যময় সুর। ড্রামের মৃদু তালে তালে ঠোঁটের শিস। ট্রাম্পেটের ঢেউ। কখনো সেই সুর মিলিয়ে যাচ্ছে হ্রেষায়, কখনো খুরের টগবগে (সুরকে যদি ভাষায় প্রকাশ করা যেত!)। ক্ষণে ক্ষণে গা শিউরে উঠছে দৃশ্য ও সুরের পরম্পরায়, ঘটনার উত্তেজনায়। কিন্তু তখন কি জানতাম, বাংলা সিনেমায় এমন জাদুকরি সুর নেওয়া হয়েছে ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’ থেকে!
কিংবদন্তি ইতালিয়ান কম্পোজার প্রয়াত এন্নিও মোররিকোনের এই ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর বিশ্ব সিনেমার জগতে অনন্য হয়ে থাকবে সব সময়। তেমনি ‘স্পেগেত্তি ওয়েস্টার্নের’ স্রষ্টা সার্জিও লিওনের ‘ডলার্স ট্রিলজি’। ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’র শেষ দৃশ্যে কবরস্থানে যখন ত্রিমুখী হয়ে বন্দুক হাতে ‘ম্যান উইথ নো নেম’ (ক্লিন্ট ইস্টউড), ‘টুকো’ (এলি ওয়ালাচ) ও ‘অ্যাঞ্জেল আইস’ (লি ফন ক্লিফ) দাঁড়ায়, তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে সেই বিখ্যাত সাসপেন্স-থ্রিলারমাখা সুর। সেই সুরের কথাই বলেছি মূলত শুরুতে। মোররিকোনের মিউজিক কেবল ঢালিউডে নয়; বলিউডের বহু চলচ্চিত্রেও হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ডলার্স’ সিরিজসহ লিওনের আরও দুই মাস্টারপিস ছবি ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন ওয়েস্ট’ ও ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন আমেরিকা’র মিউজিকও কম্পোজ করেন মোররিকোনে।
চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার সময় কোনো সুর ছিল না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা এখন এত দূর বিস্তৃত, যা এক শতকের মধ্যেই শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তো এখন সিনেমার কথা চিন্তাই করা যায় না!চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার সময় কোনো সুর ছিল না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা এখন এত দূর বিস্তৃত, যা এক শতকের মধ্যেই শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তো এখন সিনেমার কথা চিন্তাই করা যায় না! এখন দর্শক কেবল পর্দার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে থাকেন না; কানকেও কাজে লাগান সিনেমাবোধের জন্য। কাহিনিকে যদি আমার শরীর ধরি, তবে অভিনয় হচ্ছে সিনেমার প্রাণ। আর সংগীত যেন এই দুইয়ের সংযোগস্থল। কাহিনি ও অভিনয়কে আরও বেগবান করে তোলে সংগীত।
এন্নিও মোররিকোনে (১০ নভেম্বর ১৯২৮—৬ জুলাই ২০২০)