জুলাই সনদ বাস্তবায়ন : বিএনপি-জামায়াতের বিপরীত মেরুতে অবস্থান
Published: 4th, October 2025 GMT
জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও জটিলতা তৈরি হয়েছে। প্রস্তাবিত ৮৪টি সংস্কার নিয়ে খসড়া চূড়ান্ত হলেও, বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতানৈক্য রয়ে গেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রবিবার (৫ অক্টোবর) ফের আলোচনায় বসছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। লক্ষ্য ১০ অক্টোবরের মধ্যে বাস্তবায়নের সুপারিশ চূড়ান্ত করে সরকারকে দেওয়া এবং ১৫ অক্টোবরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ সনদে দলগুলোর স্বাক্ষর নিশ্চিত করা। কিন্তু সংশয় থেকেই যাচ্ছে এই সময়সীমায় ঐকমত্য আদৌ সম্ভব কিনা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন থেকে জানা গেছে, আগামীকাল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তারা পুনরায় আলোচনায় বসতে যাচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে। কমিশনের পরিকল্পনা, ওই দিনই আলোচনা চূড়ান্ত করে ১০ অক্টোবরের মধ্যে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেওয়া। কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে ১৫ অক্টোবর, তার আগেই সব দলের স্বাক্ষরের মাধ্যমে সনদটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে তাদের।
৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গঠিত এই সনদের খসড়া চূড়ান্ত হলেও, মূল জটিলতা বাস্তবায়নের রূপরেখা ঘিরেই। গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনায় কোনো চূড়ান্ত ঐকমত্য না হওয়ায় আপাতত মুলতবি রাখা হয়। কারণ রাজনৈতিক মতপার্থক্য এখনো রয়েই গেছে।
রাজনৈতিক বিভাজন স্পষ্ট
দেশের প্রধান দুটি দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বিপরীতমুখি। বিএনপির মতে, সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার বাস্তবায়নের একমাত্র বৈধ পথ জাতীয় সংসদ। তারা আগামী সংসদের মাধ্যমে সংস্কার কার্যকর দেখতে চায়। এ ছাড়া তারা চায়, অন্তর্বর্তী সরকার এই সনদ বাস্তবায়ন করতে পারবে কি না, সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়া হোক।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দলের দাবি, জাতীয় নির্বাচন হওয়ার আগেই জুলাই সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সেই সনদের ভিত্তিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। দলগুলোর আশঙ্কা, সংসদের হাতে বাস্তবায়ন ছেড়ে দিলে বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চায়, একটি গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে এই সনদের বাস্তবায়ন হোক। তাদের মতে, নির্বাচনের পর গঠিত সংসদ একযোগে নিয়মিত সংসদ ও গণপরিষদ হিসেবে কাজ করতে পারে।
কমিশন সূত্র জানায়, দলগুলোর কাছ থেকে যেসব সুপারিশ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে রয়েছে: সনদের পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক বিষয় নিয়ে গণভোটের আয়োজন করা। বিশেষ করে সাংবিধানিক আদেশ, গণপরিষদ ত্রয়োদশ সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন, সংসদকে ‘সংবিধান সংস্কার সভা’ হিসেবে কাজ করার অনুমোদন, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়া।
বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, সংবিধান আদেশের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক কার্যকর করা সম্ভব। পরবর্তীতে গণভোটের মাধ্যমে জনসমর্থন নেওয়া যেতে পারে। তবে টেকসই বাস্তবায়নের জন্য গণপরিষদ বা গণভোট সেরা পথ হতে পারে বলে মত দিয়েছেন অনেকেই।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘‘বিশেষজ্ঞদের মতামত ও রাজনৈতিক প্রস্তাব সমন্বয় করে ১০ অক্টোবরের মধ্যেই বাস্তবায়ন পদ্ধতির সুপারিশ দিতে চাই। একাধিক বিকল্প থাকলেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকেই সমাধান আসা উচিত।’’
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এখনও কার্যকর রাজনৈতিক সমঝোতা হয়নি। কিছু দল নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেও বড় দলগুলোর মধ্যে আলোচনার অগ্রগতি নেই বললেই চলে। ফলে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে সনদ চূড়ান্ত করা যাবে কি না, তা নিয়ে বড় ধরনের সন্দেহ রয়েছে। বাস্তবায়ন পদ্ধতি মনপছন্দ না হলে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু দল সনদে স্বাক্ষর নাও করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘‘আমরা এটাকে শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নয়, বরং জাতির সঙ্গে করা প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেখি। বাস্তবায়নের দায়িত্ব ভবিষ্যতের সংসদের হাতে থাকবে। সেটি আমরা পরিষ্কার করেছি।’’ তবে, বিএনপি বারবার জানতে চাচ্ছে, এই সনদের আইনগত অবস্থান কী এবং এটি আদালতে প্রশ্নযোগ্য কি না। কারণ, এসব বিষয় স্পষ্ট না হলে ভবিষ্যতে এটি রাজনৈতিক ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি করবে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘‘সমঝোতার সুযোগ এখনও আছে। তবে দলীয় স্বার্থে বাধা দেওয়া হলে আর কমিশন শক্ত অবস্থান না নিলে কাজ হবে না। জনগণের প্রত্যাশা মাথায় রেখে সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আনোয়ার হোসেন নিরব এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘জুলাই সনদকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিভাজন সংকট তৈরি করেছে। কমিশনের সময় কমে আসছে, অথচ ঐকমত্যের পথ এখনও কুয়াশাচ্ছন্ন। এখন দেখার বিষয় ৫ অক্টোবরের বৈঠকে আলোচনার মোড় কোন দিকে ঘোরে।’’
তিনি বলেন, ‘‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে, অথচ সনদের ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত। রাজনৈতিক দলগুলোর বিভক্তি, বাস্তবায়ন নিয়ে মতানৈক্য এবং সময়সীমার চাপ সব মিলিয়ে কমিশনের সামনে একটি কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করছে। জুলাই সনদ কেবল কাগজে বন্দি থাকবে, নাকি এটি রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপ নেবে তা দেখা যাবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই।’’
ঢাকা/এএএম//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ল ই সনদ দলগ ল র স ই সনদ র অবস থ ন সরক র ব এনপ ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
কোনো দলের অভিসন্ধির কাছে মাথা নত করতে পারি না: সালাহউদ্দিন আহমদ
কোনো রাজনৈতিক দলের অভিসন্ধির কাছে বিএনপি কোনো দিন মাথা নত করতে পারে না, বলেছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘রাষ্ট্র কোনো ছেলেখেলা নয়। ১৮ কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে আমরা ছিনিমিনি খেলতে পারি না। এই রাষ্ট্রকে একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলতে দিতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের অভিসন্ধির কাছে আমরা কোনো দিন মাথা নত করতে পারি না। এই দেশের জনগণই হচ্ছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার মালিক।’
আজ শনিবার রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সংগঠন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন সালাহউদ্দিন আহমদ।
সংবিধান বদলের অধিকার কারও নেই
বিএনপির এই স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, ‘কোনো একটি আইনানুযায়ী বৈধ এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানকে পরিবর্তন করার কোনো অধিকার আমাদের কারও নেই।’ এমনটা হলে আগামী দুই বছর বা পাঁচ বছর পরে বারবার এই প্রক্রিয়ায় আবার সংবিধান বদলের দাবি উঠবে বলেন তিনি।
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের অভিপ্রায় প্রকাশ হয়েছে বলেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা যখনই একটা বৈধ প্রক্রিয়ার কথা বলি, তখন তারা বলে জনগণের অভিপ্রায় এখানে চূড়ান্ত। হ্যাঁ জনগণের অভিপ্রায় চূড়ান্ত। জনগণের অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়েছে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। সেই অভিপ্রায়ের মধ্য দিয়ে এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা সঠিক; কিন্তু এই অভিপ্রায়কে বাস্তবায়নের জন্য তো আমাদের সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে হয়েছে, আর্টিকেল ১০৬–এর দ্বারস্থ হতে হয়েছে। আমরা সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠন দেখেছি। উপদেষ্টাদের শপথ দেখেছি। আমরা সেটিকে বৈধ প্রক্রিয়া মনে করি।’
৫৬ শতাংশ মানুষ যে পিআর–পদ্ধতি বোঝেই না সেই পদ্ধতি চাইতে পারি?
সংখ্যানুপাতিক–পদ্ধতি (পিআর) নিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বাংলাদেশের ৫৬ শতাংশ মানুষ যে পিআরপদ্ধতি বোঝেই না সেই পদ্ধতি কি আমরা চাইতে পারি? সুতরাং এসব কথাবার্তা বলে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা না করাই উচিত।’
যারা হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে—দেশের স্বার্থ, জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছে, তাদের বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে সঠিক রাস্তায় ফেরত আসার আহ্বান জানান বিএনপির এই নেতা।
নির্বাচন বানচালে একটি রাজনৈতিক দল কাজ করছে
নির্বাচনে অস্থিরতা সৃষ্টি করা, বিলম্বিত এবং বানচাল করার জন্য যে শক্তি কাজ করছে, তার পক্ষে একটি রাজনৈতিক দল কাজ করছে বলে সন্দেহ সালাহউদ্দিন আহমদের। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যদি নির্বাচন বিলম্বিত হয়, তাহলে ফ্যাসিবাদের উৎপাত হবে আবার।’
বিএনপির শীর্ষ নীতিনির্ধারক ফোরামের এই নেতা বলেন, এখন কথা উঠছে যে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ভিত্তিতেই নাকি আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়িত হয়ে যাচ্ছে বলেন তিনি।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, শুধু সংবিধানের অংশটুকু বাস্তবায়নের জন্য পরবর্তী সংসদের প্রয়োজন এবং সংবিধান সংশোধনের নির্ধারিত প্রক্রিয়া প্রয়োজন। সেই অংশগুলোতে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য পরবর্তী জাতীয় সংসদকেই দায়িত্ব দিতে হবে।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ্ আল হারুন। এতে বক্তব্য দেন অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, গণদলের সভাপতি এ টি এম গোলাম মাওলা চৌধুরী, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমান, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নুরুল ইসলাম প্রমুখ।