পুরোনো প্রক্রিয়ায় নতুন দুটি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স, কারা পেল
Published: 7th, October 2025 GMT
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার যে প্রক্রিয়ায় বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের (টিভি) লাইসেন্স দিত, সেই একই প্রক্রিয়ায় নতুন দুটি টিভির অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। চ্যানেল দুটির নাম ‘নেক্সট টিভি’ ও ‘লাইভ টিভি’।
নেক্সট টিভির লাইসেন্স পেয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক মো.
লাইভ টিভির লাইসেন্স পেয়েছেন আরিফুর রহমান নামের আরেকজন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বছর ছয়েক আগে পড়াশোনা শেষ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি একটি ইংরেজি দৈনিকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ছিলেন। তিনি জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য ছিলেন। তবে এনসিপিতে যোগ দেননি।
টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠা ও চালানোর মতো আর্থিক সক্ষমতা আরিফুর রহমান তুহিন ও আরিফুর রহমানের আছে কি না, সে প্রশ্ন রয়েছে। কী বিবেচনায় তাঁদের লাইসেন্স দেওয়া হলো, সে বিষয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে প্রশ্ন পাঠানো হয়েছিল। তবে উত্তর পাওয়া যায়নি।
নেক্সট টিভির লাইসেন্স পেয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক মো. আরিফুর রহমান তুহিন।অবশ্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নতুন টিভির অনুমোদন আগের প্রথা অনুযায়ী দেওয়া হয়েছে। আর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ২৮টি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদেরা এসব চ্যানেলের লাইসেন্স পেয়েছেন। এসব চ্যানেলের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল।
বর্তমানে দেশে অনুমোদিত বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ৫০। এর মধ্যে ৩৬টি পূর্ণ সম্প্রচারে আছে। ১৪টি সম্প্রচারের অপেক্ষায় আছে। অনুমোদিত আইপি টিভির (ইন্টারনেট প্রটোকল টেলিভিশন) সংখ্যা ১৫। টিভি চ্যানেল অনুমোদন পেতে আরও কিছু আবেদন জমা আছে।
লাইভ টিভির লাইসেন্স পেয়েছেন আরিফুর রহমান নামের আরেকজন।ছাত্রজীবনে তিনি একটি ইংরেজি দৈনিকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ছিলেন। তিনি জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য ছিলেন। তবে এনসিপিতে যোগ দেননি।অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বেসরকারি টেলিভিশন বিষয়ে বলা হয়েছে, বেসরকারি খাতে টেলিভিশন চ্যানেল চালুর অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে অর্থনীতি ও বাজারের চাহিদা ও সক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় লাইসেন্স দিয়ে একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে।
২০১৪ সালে করা জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় সম্প্রচার কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছিল। সম্প্রচারবিষয়ক লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে সুপারিশ করার কথা সম্প্রচার কমিশনের। আওয়ামী লীগ সরকার সম্প্রচার কমিশন গঠন করেনি। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন একটি গণমাধ্যম কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্সের বিষয়টিও এই কমিশনের আওতাধীন রাখার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকার এসব সুপারিশ এখনো বাস্তবায়ন করেনি। কিন্তু পুরোনো ধারায় দুটি টিভির লাইসেন্স দেওয়া হলো।
আবেদন করার পর তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যাচাই করা হয়। বেসরকারি টিভি লাইসেন্স পাওয়ার পর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছ থেকে ‘ফ্রিকোয়েন্সি ক্লিয়ারেন্স’ নিতে হয়। মূলত সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের ‘সবুজ সংকেত’ থাকলেই তরঙ্গ পাওয়া যায়।এখন যেভাবে অনুমোদনতথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, বেসরকারি টিভি চ্যানেল অনুমোদন দেওয়ার জন্য আলাদা আইন নেই। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা আছে; যেখানে বলা আছে সব সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানকে সরকার বা সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। যদিও টিভির লাইসেন্সের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য মন্ত্রণালয় বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভির অনুমোদন দেয়।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আবেদনের সঙ্গে বেশ কিছু কাগজপত্র জমা দিতে হয়। এগুলো হলো জাতীয় পরিচয়পত্র, আর্টিকেল অব মেমোরেন্ডাম (প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্র), সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন, ট্রেড লাইসেন্স, আয়কর সনদ, ব্যাংক সলভেন্সি সনদ, প্রকল্প প্রস্তাব এবং চ্যানেল চালানোর সামর্থ্য আছে মর্মে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা।
আবেদন করার পর তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যাচাই করা হয়। বেসরকারি টিভি লাইসেন্স পাওয়ার পর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছ থেকে ‘ফ্রিকোয়েন্সি ক্লিয়ারেন্স’ নিতে হয়। মূলত সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের ‘সবুজ সংকেত’ থাকলেই তরঙ্গ পাওয়া যায়।
এই সরকার আসার পর আমাদের আশা ছিল, প্রত্যাশা ছিল নিয়মনীতির মধ্যে সব সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু দেখছি একের পর এক সিদ্ধান্ত সেই আগের নিয়মেই হচ্ছে। টেলিভিশন অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাই। এ মুহূর্তে দুটি টিভির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, আরও হয়তো দেওয়া হবে, তা কোন নীতিতে?দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী পেছনে কারানেক্সট টিভির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে গত ২৪ জুন। এটি ‘৩৬ মিডিয়া লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে অনুমোদন পেয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনসিপি নেতা আরিফুর রহমান তুহিন। অফিসের ঠিকানা পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার করাতিটোলা লেন।
জানতে চাইলে আরিফুর রহমান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, এই টিভি চ্যানেলের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন বগুড়ার বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম হাফিজুর রহমানের ছেলে এ কে এম গোলাম হাসনাইন। তিনি সৌদি আরব প্রবাসী এবং সৌদি আরব (পূর্বাঞ্চল) বিএনপির সভাপতি।
গোলাম হাসনাইন গত রোববার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ৩৬ মিডিয়া লিমিটেডের অন্যতম পরিচালক। সেখানে তাঁর বিনিয়োগ রয়েছে।
সরকারি সূত্রমতে ‘লাইভ টিভি’ অনুমোদন পেয়েছে গত ১৪ জুলাই। এর মালিকানায় থাকা আরিফুর রহমানের প্রতিষ্ঠানের নাম ‘মিনার্ভা মিডিয়া লিমিটেড’। ঠিকানা ১৪৩ নম্বর সড়ক, গুলশান-১।
জানতে চাইলে আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কাগজপত্র-সংক্রান্ত আরও কিছু কাজ বাকি। আশা করেছেন, আগামী বছর সম্প্রচারে যেতে পারবেন। কীভাবে বিনিয়োগের অর্থের সংস্থান হচ্ছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর সঙ্গে বিনিয়োগকারী রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এই টিভির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকছেন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের শীর্ষ পর্যায়ের পদে দায়িত্ব পালন করা একজন সাংবাদিক। তিনিই মূলত নতুন টিভি গোছানোর কাজটি করছেন।
দুই টিভি চ্যানেলের বাইরে একটি ইন্টারনেট প্রটোকল টেলিভিশনের (আইপি টিভি) অনুমোদনও দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অনুমোদন পাওয়া আইপি টিভির নাম ‘চেঞ্জ টিভি প্রেস’। এর প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক আমিরুল মোমেনীন।
কোন আমলে কত টিভির অনুমোদনবেসরকারি খাতে টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ১৯৯৮ সালে। ওই বছর বেসরকারি মালিকানায় টেলিভিশন চ্যানেল স্থাপন ও পরিচালনবিষয়ক নীতি প্রকাশ করা হয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার তিনটি টিভির অনুমোদন দেয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদে ১০টি টিভি অনুমোদন পায়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ১০টি চ্যানেলকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে আরও দুটি লাইসেন্স পায়। ২০১১ সালের জুনে একটি ও অক্টোবরে আরেকটি এবং ওই বছরের ডিসেম্বরে আরও একটি টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে ১৫টি চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই সরকার আসার পর আমাদের আশা ছিল, প্রত্যাশা ছিল নিয়মনীতির মধ্যে সব সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু দেখছি একের পর এক সিদ্ধান্ত সেই আগের নিয়মেই হচ্ছে। টেলিভিশন অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাই। এ মুহূর্তে দুটি টিভির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, আরও হয়তো দেওয়া হবে, তা কোন নীতিতে? এখন তো নীতিই নেই, নীতি তো প্রণয়নই করা হয়নি। আমরা আশা করেছিলাম, অন্তর্বর্তী সরকার কোনো বিতর্ক হবে না এমন সিদ্ধান্তই নেবে।’
মতিউর রহমান চৌধুরী আরও বলেন, এ মুহূর্তে বিদ্যমান টিভিগুলোর অধিকাংশের অবস্থাই কাহিল। অনেক টিভিতে ঠিকমতো বেতন হচ্ছে না। কোনো কোনো টিভিতে কর্মী ছাঁটাইও হচ্ছে। বিজ্ঞাপনের বাজারও ছোট হয়ে আসছে। নতুন টিভি অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব চিন্তা করা হয়েছে কি না, তা অজানা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা এই সরকারের কাছ থেকে আশা করেছিলাম ভালো কিছু হবে। কিন্তু সেটা তো হলো না। সেই আগের নিয়মে মুখ দেখে বিবেচনা করা হচ্ছে, পরিবর্তনটা তাহলে কোথায়?’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আর ফ র রহম ন ত হ ন প রথম আল ক ল গ সরক র সরক র র স প রক র য় ব সরক র সদস য আওয় ম এনস প
এছাড়াও পড়ুন:
কাজগুলো হলে জেল রূপান্তরিত হবে সংশোধনকেন্দ্রে
ছবি: জাহিদুল করিম