ইসলামের ইতিহাসে নবীরা (আ.) কেবল আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়ার দূত ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন চরিত্রের উজ্জ্বল আদর্শ। তাঁদের জীবন ছিল সততা, ধৈর্য, ক্ষমা, করুণা এবং দুনিয়ার প্রতি বৈরাগ্যের প্রতিফলন।

কোরআনে কারিম তাঁদের এই গুণাবলিকে সাধারণভাবে এবং বিশদভাবে বর্ণনা করেছে, যাতে মানবজাতি তাঁদের অনুসরণ করে জীবনকে সুন্দর করে তুলতে পারে। আল্লাহ বলেছেন, ‘তাঁরাই যাদেরকে আল্লাহ পথ দেখিয়েছেন, তাই তাঁদের পথানির্দেশ অনুসরণ করো।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ৯০)

নবীরা ছিলেন আল্লাহর নির্বাচিত ব্যক্তিত্ব, যাঁদের জীবন ছিল সদাচারণতার আয়না।

নবীদের চরিত্র: কোরআনের সাধারণ ও বিশদ বর্ণনা

কোরআন নবীদের চরিত্রকে সাধারণভাবে বর্ণনা করে বলেছে যে তাঁরা সবাই উত্তম গুণাবলির অধিকারী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিল ধৈর্য, ক্ষমা, উদারতা, সততা, বিশ্বস্ততা, নম্রতা, করুণা, দয়া, দুনিয়ার প্রতি বৈরাগ্য এবং মানুষের অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা।

এই গুণগুলো তাঁদের সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা করে তুলেছে এবং তাঁদের দাওয়াতকে সফল করেছে। কোরআনের এই বর্ণনা আমাদের শেখায়, নবীদের জীবন ছিল আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং মানুষের প্রতি সদয়তার সমন্বয়।

সাধারণভাবে কোরআন বলেছে, ‘তাঁরাই যাদেরকে আল্লাহ পথ দেখিয়েছেন, তাই তাঁদের পথানির্দেশ অনুকরণ করো।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ৯০)

এখানে ‘হুদাহুম’ শব্দটি নবীদের চরিত্র ও আচরণকে অনুসরণের নির্দেশ দেয়। নবীদের জীবন কেবল অলৌকিক ঘটনার গল্প নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগযোগ্য শিক্ষা। তাঁদের ধৈর্য দেখে আমরা কষ্ট সহ্য করতে শিখি, তাঁদের ক্ষমা দেখে আমরা অপরাধীদের ক্ষমা করতে উৎসাহিত হয়ে উঠি।

এই অনুকরণের মাধ্যমে আমরা নিজেদের আল্লাহর নিকটবর্তী করে তুলতে পারি।নবি

আরও পড়ুনউত্তম চরিত্র নিয়ে রাসুল (সা.

) যা বলেছেন১৬ নভেম্বর ২০২৩নবী ইবরাহিমের সহনশীল হৃদয়

কোরআনের বিশদ বর্ণনায় নবীদের চরিত্রের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর চরিত্র সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয় ইবরাহিম ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল, দুঃখিত, প্রায়ই তওবা করা ব্যক্তি।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ১১৪)

মুফাসসির মুহাম্মাদ রশিদ রিদা বলেছেন, কোরআনে এখানে একটি শব্দ এনেছে ‘আওয়াহ’; যার মানে দুঃখিত হওয়া, কিন্তু এটি থেকে এসেছে আল্লাহর ভয় এবং কাফিরদের জন্য দুঃখ থেকে। এটা তাদের খোদাভীতির লক্ষণ এবং দোয়া ও তওবার প্রবণতা স্পষ্ট করে। (তাফসিরুল মানার, ১০/২৩৪, দারুল মানার, কায়রো, ১৯৩৩ খ্রি.)

ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেছেন, ধৈর্যশীল বোঝাতে এখানে ‘হালিম’ শব্দ এসেছে; যার মানে যিনি অন্যায় ক্ষমা করেন এবং অত্যাচার সহ্য করেন। (আল-জামি’ লি আহকামিল কুরআন, ৮/২৫৮, দারুল কুতুবিল মিসরিয়া, কায়রো, ১৯৬৪ খ্রি.)

সুরা হুদে আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয় ইবরাহিম অত্যন্ত সহনশীল, অধিক অনুনয় বিনয়কারী, আল্লাহমুখী।’ (সুরা হুদ, আয়াত: ৭৫)

এখানে আল্লাহমুখী বোঝাতে ‘মুনিব’ শব্দটি যোগ হয়েছে, যা তওবা ও আল্লাহর প্রতি ফিরে আসার অর্থ বহন করে। ইবনে আশুর বলেছেন, এটা হলো অপরাধের পর ফিরে আসা, যা মহানবীর জন্য আত্মপরীক্ষার লক্ষণ (আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, ১২/১৪৫, আদ-দারুত তিউনিসিয়া, তিউনিস, ১৯৮৪ হি.)

ইবরাহিম (আ.)-এর এই চরিত্র আমাদের শেখায় যে ধৈর্য ও তওবা জীবনকে সুন্দর করে। তাঁর মতো হয়ে আমরা কষ্টের মধ্যে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য করতে পারি।

নবী হুদের চরিত্র: নম্রতা ও সততার সমন্বয়

কোরআন হুদ (আ.)-এর চরিত্রের মাধ্যমে নবীদের নম্রতা ও সততা দেখিয়েছে। আদের লোকেরা তাঁকে বলেছিল, ‘নিশ্চয় আমরা তোমাকে বোকা মনে করি এবং তোমাকে মিথ্যাবাদী মনে করি।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৬৬)

এই অপমান সত্ত্বেও হুদ (আ.) বলেছেন, ‘হে আমার কওম, আমার মধ্যে বোকামি নেই, বরং আমি বিশ্বজগতের রবের পক্ষ থেকে রাসুল। আমি তোমাদের আমার রবের বাণী পৌঁছে দিচ্ছি এবং আমি তোমাদের জন্য সত্যিকারের সুহৃদ।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৬৭-৬৮)

এখানে তাঁর নম্রতা স্পষ্ট—তিনি অপমানের জবাব দেননি, বরং তাঁর দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

এই দৃশ্য নবীদের দাওয়াতের সৌন্দর্য দেখায়। তাঁরা মানুষের সঙ্গে কঠোরতা করেননি, বরং নরমতা ও সততা দেখিয়েছেন। তাঁরা ছিলেন সর্বোচ্চ বুদ্ধিমান, হৃদয়বান এবং নম্র। ইবনে কাইয়িম বলেছেন, নবীদের সদাচারণতার মূল হলো সত্যের প্রতি অবিচলতা এবং মানুষের প্রতি নম্রতা। (মাদারিজুস সালিকিন, ২/৩২৬ দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৯ খ্রি.)

নুহ, সালেহ, শুয়াইব (আ.)-এর জীবনেও এই নম্রতা দেখা যায়।নব

আরও পড়ুননবী ইবরাহিম (আ.) ও চারটি পাখি১৭ জুন ২০২৫নবী ইউসুফের চরিত্র: ক্ষমা ও দয়ার চূড়ান্ত উদাহরণ

কোরআন ইউসুফ (আ.)-এর চরিত্রে ক্ষমা ও দয়ার চূড়ান্ত রূপ দেখিয়েছে। ভাইয়েরা তাঁকে কূপে ফেলে দিয়েছিল, কিন্তু রাজার মন্ত্রী হয়ে তাঁদের দেখে বললেন, ‘আজ তোমাদের ওপর কোনো তিরস্কার বা অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন, আর তিনি সবচেয়ে দয়ালু।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৯২)

এখানে তাঁর ক্ষমা সম্পূর্ণ—কোনো তিরস্কার বা অভিযোগ নেই, বরং তাঁরা ক্ষমা চাননি, তবু তিনি তাঁদের জন্য দোয়া করেছেন।

ইবনে কাইয়িম (রহ.) বলেছেন, সদাচারণতার মূল হলো সত্যের প্রতি অটলতা এবং নিজের স্বার্থহীনতা। নবীরা মানুষের সঙ্গে নিজের স্বার্থ ছাড়াই মিশতেন। (মাদারিজুস সালিকিন, ২/৩২৬ দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৯ খ্রি.)

ইবনে জাজি বলেছেন, ইউসুফ (আ.) নিজের অধিকার ত্যাগ করে তাদের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। (তাসহিলুল নুযুল, ১/৭৪৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৯ খ্রি.)

ইমাম কুরতুবি বলেছেন, ইউসুফ (আ.)-এর মতো ক্ষমা করা যুবকের কাছে সহজ, কিন্তু বৃদ্ধের কাছে কঠিন। ইয়াকুব (আ.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য আমার প্রতিপালকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করব।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৯৮) (আল-জামি’ লি আহকামিল কুরআন, ৯/২৫৮, দারুল কুতুবিল মিসরিয়া, কায়রো, ১৯৬৪ খ্রি.)।

সা’দি বলেছেন, ইউসুফ (আ.)-এর ক্ষমা সম্পূর্ণ, কোনো অপরাধের স্মরণ করিয়ে দেওয়া ছাড়াই দয়া দেখিয়েছেন, যা বিশেষ মানুষের গুণ। (তাইসিরুল কারিমুর রাহমান, পৃষ্ঠা: ৪০৪, দারুত তাইবা, রিয়াদ, ১৯৯৭ খ্রি.)

মহানবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর চরিত্র

কোরআন মহানবী (সা.)-এর চরিত্রকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয় তুমি উত্তম চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা কলম, আয়াত: ৪)

তাঁর জীবন ছিল সততা, দয়া, ক্ষমা ও নম্রতার আদর্শ। মক্কায় কাফিররা তাঁকে নানা রকমের অপমান করত, কিন্তু তিনি ধৈর্য ধরতেন। মদিনায় হিজরতের পরও তিনি শত্রুদের ক্ষমা করেছেন। তাঁর চরিত্র ছিল নবীদের সব গুণের সমন্বয়।

তাঁর ওপর যে যত অত্যাচার হয়েছে কিন্তু তিনি কখনো প্রতিশোধ নেননি। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি বলেছেন, ‘আজ কোনো তিরস্কার নেই। তোমরা ক্ষমা চাও।’ এই ক্ষমা ইসলামকে ছড়িয়ে দেওয়ায় সহায়ক হয়েছে। তাঁর নম্রতা ছিল এমন যে দরিদ্ররা তাঁর সঙ্গে খেতেন। তাঁর দয়া ছিল এমন যে শত্রুর সন্তানকেও আশ্রয় দিতেন।

সদাচারণ দাওয়াতের চাবিকাঠি

কোরআন নবীদের চরিত্রকে আমাদের জন্য আদর্শ করে দিয়েছে। নবী ইবরাহিমের ধৈর্য, হুদের নম্রতা, ইউসুফের ক্ষমা এবং মুহাম্মাদ (সা.)-এর সদাচারণ আমাদের শেখায় যে চরিত্রের সৌন্দর্যই জীবনের সার্থকতা।

আজকের দুনিয়ায় যেখানে অহংকার, প্রতিহিংসা বাড়ছে, এই গুণগুলো আমাদের শান্তি এনে দিতে পারে। আল্লাহ আমাদের সেসব মহামানবের চরিত্র অনুসরণের তাওফিক দিন। আমিন।

আরও পড়ুননবী প্রেমের প্রতিদান কী২৭ এপ্রিল ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জ বন ছ ল চর ত র র দ র জন য দ র জ বন আম দ র শ ইবর হ ম স ন দর ইউস ফ ক রআন

এছাড়াও পড়ুন:

অবিশ্বাস্য নাটকীয়তার ফাইনালে সুপার ওভারে হারলো বাংলাদেশ ‘এ’, পাকিস্তান শাহীনস চ‌্যাম্পিয়ন

উত্তেজনা, নাটকীয়তা, রোমাঞ্চ, নখ কামড়ানো একেকটি মুহুর্ত, একেকটি বল। হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রম। পেণ্ডুলামের মতো ঝুলতে থাকা ফাইনাল ম‌্যাচে কখনো পাকিস্তান শাহীনসের মুখে হাসি। আবার কখনো হাসে বাংলাদেশ ‘এ’। সব সীমা অতিক্রম করে, চরম নাটকীয়তা শেষে ইতিহাসের পাতায় পাকিস্তান শাহীনস।

দোহায় এশিয়া কাপ রাইর্জিং স্টারসের ফাইনাল ম‌্যাচ। নির্ধারিত ২০ ওভারের ম‌্যাচে কেউ কাউকে হারাতে পারে না। ম‌্যাচ গড়ায় সুপার ওভারে। সেখানে পাকিস্তান শাহীনস কাছে ম‌্যাচ হেরে শিরোপা হারিয়েছে বাংলাদেশ ‘এ’ দল। 

মূল ম‌্যাচে পাকিস্তান শাহীনস আগে ব‌্যাটিং করতে নেমে ১২৫ রানে গুটিয়ে যায়। জবাব দিতে নেমে ৯৬ রানে ৯ উইকেট হারায় বাংলাদেশ ‘এ’ দল। ম‌্যাচ পাকিস্তান শাহীনসের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু দশম উইকেটে সাকলায়েন আহমেদ ও রিপন মণ্ডল সব এলোমেলো করে দেন। রুদ্ধশ্বাস ব‌্যাটিংয়ে ২৯ রানের জুটি গড়ে ম‌্যাচ নিয়ে যান সুপার ওভারে। 

কিন্তু সুপার ওভারে প্রথমে সাকলায়েন ও পরে জিসান আলম আউট হলে বাংলাদেশ ৩ বলেই গুটিয়ে যায়। স্কোরবোর্ডে রান মাত্র ৬। পাকিস্তান সাদ মাসুদের বাউন্ডারিতে ২ বল আগেই জিতে নেয় সুপার ওভার। তাতে তৃতীয়বারের মতো নিশ্চিত করে প্রতিযোগিতার শিরোপা। 

বিস্তারিত আসছে …

ঢাকা/ইয়াসিন

সম্পর্কিত নিবন্ধ