কোরআনে নবীদের উত্তম চরিত্রের বর্ণনা
Published: 7th, October 2025 GMT
ইসলামের ইতিহাসে নবীরা (আ.) কেবল আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়ার দূত ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন চরিত্রের উজ্জ্বল আদর্শ। তাঁদের জীবন ছিল সততা, ধৈর্য, ক্ষমা, করুণা এবং দুনিয়ার প্রতি বৈরাগ্যের প্রতিফলন।
কোরআনে কারিম তাঁদের এই গুণাবলিকে সাধারণভাবে এবং বিশদভাবে বর্ণনা করেছে, যাতে মানবজাতি তাঁদের অনুসরণ করে জীবনকে সুন্দর করে তুলতে পারে। আল্লাহ বলেছেন, ‘তাঁরাই যাদেরকে আল্লাহ পথ দেখিয়েছেন, তাই তাঁদের পথানির্দেশ অনুসরণ করো।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ৯০)
নবীরা ছিলেন আল্লাহর নির্বাচিত ব্যক্তিত্ব, যাঁদের জীবন ছিল সদাচারণতার আয়না।
নবীদের চরিত্র: কোরআনের সাধারণ ও বিশদ বর্ণনাকোরআন নবীদের চরিত্রকে সাধারণভাবে বর্ণনা করে বলেছে যে তাঁরা সবাই উত্তম গুণাবলির অধিকারী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিল ধৈর্য, ক্ষমা, উদারতা, সততা, বিশ্বস্ততা, নম্রতা, করুণা, দয়া, দুনিয়ার প্রতি বৈরাগ্য এবং মানুষের অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা।
এই গুণগুলো তাঁদের সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা করে তুলেছে এবং তাঁদের দাওয়াতকে সফল করেছে। কোরআনের এই বর্ণনা আমাদের শেখায়, নবীদের জীবন ছিল আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং মানুষের প্রতি সদয়তার সমন্বয়।
সাধারণভাবে কোরআন বলেছে, ‘তাঁরাই যাদেরকে আল্লাহ পথ দেখিয়েছেন, তাই তাঁদের পথানির্দেশ অনুকরণ করো।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ৯০)
এখানে ‘হুদাহুম’ শব্দটি নবীদের চরিত্র ও আচরণকে অনুসরণের নির্দেশ দেয়। নবীদের জীবন কেবল অলৌকিক ঘটনার গল্প নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগযোগ্য শিক্ষা। তাঁদের ধৈর্য দেখে আমরা কষ্ট সহ্য করতে শিখি, তাঁদের ক্ষমা দেখে আমরা অপরাধীদের ক্ষমা করতে উৎসাহিত হয়ে উঠি।
এই অনুকরণের মাধ্যমে আমরা নিজেদের আল্লাহর নিকটবর্তী করে তুলতে পারি।নবি
আরও পড়ুনউত্তম চরিত্র নিয়ে রাসুল (সা.) যা বলেছেন১৬ নভেম্বর ২০২৩নবী ইবরাহিমের সহনশীল হৃদয়
কোরআনের বিশদ বর্ণনায় নবীদের চরিত্রের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর চরিত্র সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয় ইবরাহিম ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল, দুঃখিত, প্রায়ই তওবা করা ব্যক্তি।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ১১৪)
মুফাসসির মুহাম্মাদ রশিদ রিদা বলেছেন, কোরআনে এখানে একটি শব্দ এনেছে ‘আওয়াহ’; যার মানে দুঃখিত হওয়া, কিন্তু এটি থেকে এসেছে আল্লাহর ভয় এবং কাফিরদের জন্য দুঃখ থেকে। এটা তাদের খোদাভীতির লক্ষণ এবং দোয়া ও তওবার প্রবণতা স্পষ্ট করে। (তাফসিরুল মানার, ১০/২৩৪, দারুল মানার, কায়রো, ১৯৩৩ খ্রি.)
ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেছেন, ধৈর্যশীল বোঝাতে এখানে ‘হালিম’ শব্দ এসেছে; যার মানে যিনি অন্যায় ক্ষমা করেন এবং অত্যাচার সহ্য করেন। (আল-জামি’ লি আহকামিল কুরআন, ৮/২৫৮, দারুল কুতুবিল মিসরিয়া, কায়রো, ১৯৬৪ খ্রি.)
সুরা হুদে আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয় ইবরাহিম অত্যন্ত সহনশীল, অধিক অনুনয় বিনয়কারী, আল্লাহমুখী।’ (সুরা হুদ, আয়াত: ৭৫)
এখানে আল্লাহমুখী বোঝাতে ‘মুনিব’ শব্দটি যোগ হয়েছে, যা তওবা ও আল্লাহর প্রতি ফিরে আসার অর্থ বহন করে। ইবনে আশুর বলেছেন, এটা হলো অপরাধের পর ফিরে আসা, যা মহানবীর জন্য আত্মপরীক্ষার লক্ষণ (আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, ১২/১৪৫, আদ-দারুত তিউনিসিয়া, তিউনিস, ১৯৮৪ হি.)
ইবরাহিম (আ.)-এর এই চরিত্র আমাদের শেখায় যে ধৈর্য ও তওবা জীবনকে সুন্দর করে। তাঁর মতো হয়ে আমরা কষ্টের মধ্যে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য করতে পারি।
নবী হুদের চরিত্র: নম্রতা ও সততার সমন্বয়কোরআন হুদ (আ.)-এর চরিত্রের মাধ্যমে নবীদের নম্রতা ও সততা দেখিয়েছে। আদের লোকেরা তাঁকে বলেছিল, ‘নিশ্চয় আমরা তোমাকে বোকা মনে করি এবং তোমাকে মিথ্যাবাদী মনে করি।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৬৬)
এই অপমান সত্ত্বেও হুদ (আ.) বলেছেন, ‘হে আমার কওম, আমার মধ্যে বোকামি নেই, বরং আমি বিশ্বজগতের রবের পক্ষ থেকে রাসুল। আমি তোমাদের আমার রবের বাণী পৌঁছে দিচ্ছি এবং আমি তোমাদের জন্য সত্যিকারের সুহৃদ।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৬৭-৬৮)
এখানে তাঁর নম্রতা স্পষ্ট—তিনি অপমানের জবাব দেননি, বরং তাঁর দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
এই দৃশ্য নবীদের দাওয়াতের সৌন্দর্য দেখায়। তাঁরা মানুষের সঙ্গে কঠোরতা করেননি, বরং নরমতা ও সততা দেখিয়েছেন। তাঁরা ছিলেন সর্বোচ্চ বুদ্ধিমান, হৃদয়বান এবং নম্র। ইবনে কাইয়িম বলেছেন, নবীদের সদাচারণতার মূল হলো সত্যের প্রতি অবিচলতা এবং মানুষের প্রতি নম্রতা। (মাদারিজুস সালিকিন, ২/৩২৬ দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৯ খ্রি.)
নুহ, সালেহ, শুয়াইব (আ.)-এর জীবনেও এই নম্রতা দেখা যায়।নব
আরও পড়ুননবী ইবরাহিম (আ.) ও চারটি পাখি১৭ জুন ২০২৫নবী ইউসুফের চরিত্র: ক্ষমা ও দয়ার চূড়ান্ত উদাহরণকোরআন ইউসুফ (আ.)-এর চরিত্রে ক্ষমা ও দয়ার চূড়ান্ত রূপ দেখিয়েছে। ভাইয়েরা তাঁকে কূপে ফেলে দিয়েছিল, কিন্তু রাজার মন্ত্রী হয়ে তাঁদের দেখে বললেন, ‘আজ তোমাদের ওপর কোনো তিরস্কার বা অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন, আর তিনি সবচেয়ে দয়ালু।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৯২)
এখানে তাঁর ক্ষমা সম্পূর্ণ—কোনো তিরস্কার বা অভিযোগ নেই, বরং তাঁরা ক্ষমা চাননি, তবু তিনি তাঁদের জন্য দোয়া করেছেন।
ইবনে কাইয়িম (রহ.) বলেছেন, সদাচারণতার মূল হলো সত্যের প্রতি অটলতা এবং নিজের স্বার্থহীনতা। নবীরা মানুষের সঙ্গে নিজের স্বার্থ ছাড়াই মিশতেন। (মাদারিজুস সালিকিন, ২/৩২৬ দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৯ খ্রি.)
ইবনে জাজি বলেছেন, ইউসুফ (আ.) নিজের অধিকার ত্যাগ করে তাদের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। (তাসহিলুল নুযুল, ১/৭৪৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৯ খ্রি.)
ইমাম কুরতুবি বলেছেন, ইউসুফ (আ.)-এর মতো ক্ষমা করা যুবকের কাছে সহজ, কিন্তু বৃদ্ধের কাছে কঠিন। ইয়াকুব (আ.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য আমার প্রতিপালকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করব।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৯৮) (আল-জামি’ লি আহকামিল কুরআন, ৯/২৫৮, দারুল কুতুবিল মিসরিয়া, কায়রো, ১৯৬৪ খ্রি.)।
সা’দি বলেছেন, ইউসুফ (আ.)-এর ক্ষমা সম্পূর্ণ, কোনো অপরাধের স্মরণ করিয়ে দেওয়া ছাড়াই দয়া দেখিয়েছেন, যা বিশেষ মানুষের গুণ। (তাইসিরুল কারিমুর রাহমান, পৃষ্ঠা: ৪০৪, দারুত তাইবা, রিয়াদ, ১৯৯৭ খ্রি.)
মহানবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর চরিত্রকোরআন মহানবী (সা.)-এর চরিত্রকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয় তুমি উত্তম চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা কলম, আয়াত: ৪)
তাঁর জীবন ছিল সততা, দয়া, ক্ষমা ও নম্রতার আদর্শ। মক্কায় কাফিররা তাঁকে নানা রকমের অপমান করত, কিন্তু তিনি ধৈর্য ধরতেন। মদিনায় হিজরতের পরও তিনি শত্রুদের ক্ষমা করেছেন। তাঁর চরিত্র ছিল নবীদের সব গুণের সমন্বয়।
তাঁর ওপর যে যত অত্যাচার হয়েছে কিন্তু তিনি কখনো প্রতিশোধ নেননি। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি বলেছেন, ‘আজ কোনো তিরস্কার নেই। তোমরা ক্ষমা চাও।’ এই ক্ষমা ইসলামকে ছড়িয়ে দেওয়ায় সহায়ক হয়েছে। তাঁর নম্রতা ছিল এমন যে দরিদ্ররা তাঁর সঙ্গে খেতেন। তাঁর দয়া ছিল এমন যে শত্রুর সন্তানকেও আশ্রয় দিতেন।
সদাচারণ দাওয়াতের চাবিকাঠিকোরআন নবীদের চরিত্রকে আমাদের জন্য আদর্শ করে দিয়েছে। নবী ইবরাহিমের ধৈর্য, হুদের নম্রতা, ইউসুফের ক্ষমা এবং মুহাম্মাদ (সা.)-এর সদাচারণ আমাদের শেখায় যে চরিত্রের সৌন্দর্যই জীবনের সার্থকতা।
আজকের দুনিয়ায় যেখানে অহংকার, প্রতিহিংসা বাড়ছে, এই গুণগুলো আমাদের শান্তি এনে দিতে পারে। আল্লাহ আমাদের সেসব মহামানবের চরিত্র অনুসরণের তাওফিক দিন। আমিন।
আরও পড়ুননবী প্রেমের প্রতিদান কী২৭ এপ্রিল ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জ বন ছ ল চর ত র র দ র জন য দ র জ বন আম দ র শ ইবর হ ম স ন দর ইউস ফ ক রআন
এছাড়াও পড়ুন:
ডাকসু নির্বাচনের পর যেসব প্রশ্ন তোলা জরুরি ছিল
ডাকসু নির্বাচনের পর এক মাস পার হলো। এখনো প্রশ্ন উঠছে, এই নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু হয়েছে কি না। প্রশ্ন উঠছে ব্যালট পেপার নিয়ে—কোথায় ছাপানো হয়েছে, কতগুলো ছাপানো হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট সুরক্ষা ছিল কি না।
এর আগে অভিযোগ উঠেছিল প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের। প্রার্থীদের পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল নির্বাচনী আচরণবিধি না মানার। সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছিল নির্বাচনের দিন—নির্দিষ্ট প্যানেলের পক্ষে ভোট দেওয়া ব্যালট পেপার সরবরাহের ও ভোট গণনার ত্রুটির।
এগুলো অবশ্যই প্রশ্ন তোলার মতো বিষয়। এগুলোর জবাব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারত, জাতীয় রাজনীতির এই সন্ধিক্ষণে তোড়জোড় করে ডাকসু নির্বাচনের প্রয়োজন কী ছিল।
বছরের পর বছর তো ছাত্র সংসদ নির্বাচন না করেই বিশ্ববিদ্যালয় চলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর রাজনীতিও চলছে। এই মুহূর্তে ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে কে বা কারা এত উৎসাহী হলো। দেখা গেছে, সেই উৎসাহে অধিকাংশ ছাত্রসংগঠনেরই সায় ছিল। এমনকি বেশির ভাগ সংগঠন দ্রুত নির্বাচনের জন্য এক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল।
আরও পড়ুনশিবিরের উত্থানের রাজনীতি, বাস্তবতা ও নানা সমীকরণ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫নির্বাচনের পর প্রশ্ন তোলা জরুরি ছিল, ডাকসুতে ছাত্রশিবিরের এই বিপুল জয়ের কারণ কী। দীর্ঘ সময় ধরে গোপনে রাজনীতি করে যাওয়া একটি সংগঠন কীভাবে এত শক্তি অর্জন করল। নির্বাচনের আগে তাদের প্রকাশ্যে আসার কারণ এবং কয়েক মাস ধরে ক্যাম্পাসে তাদের সেবামূলক কাজের উদ্দেশ্য এখন বোঝা যাচ্ছে।
ছাত্রশিবির কতটুকু জনপ্রিয় হয়ে উঠল এটি যেমন প্রশ্ন, তেমনি অন্য সংগঠনগুলোর প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা কমছে কি না, এটিও প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের জবাব থেকে ছাত্রসংগঠনগুলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে ছাত্ররাজনীতির প্রচলিত ধরনে তারা বদল আনবে কি না।
কথা বলা দরকার ছিল, আগামী ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে আরও গ্রহণযোগ্য করার জন্য কী করা যেতে পারে তা নিয়ে। এবার যেমন নির্বাচনের আগে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নতুন করে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসিয়ে সুরক্ষিত করা হয়েছিল। ভোটকেন্দ্রগুলোতেও বিপুলসংখ্যক ক্যামেরা ছিল। তা ছাড়া ভোট গণনার কক্ষেও ক্যামেরা বসিয়ে বাইরে থেকে সরাসরি দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। এরপরও ভোটার উপস্থিতি ও ভোট দেওয়ার হার নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিভিন্ন পক্ষ ও প্রার্থী উপস্থিতিপত্র ও সিসিটিভি ফুটেজ দাবি করেন।
ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট পেপার নিয়েও গণমাধ্যমে কয়েক দিন ধরে তোলপাড় হয়েছে। কোথায় ছাপানো হলো, কোন প্রতিষ্ঠান ছাপাল—এগুলো প্রশ্ন হতে পারে; কিন্তু এর চেয়ে গুরুতর প্রশ্ন, এসব ব্যালট তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা পক্ষের হাতে গেল কি না।নির্বাচনের দিন প্রার্থীদের এজেন্ট যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে এত দিন পর এসব প্রশ্ন উঠত না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা নির্বাচনের কাজে যুক্ত ব্যক্তিরা কোনো পক্ষকে জিতিয়ে বা হারিয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করেননি। যদি করতে চাইতেনও, সেটি সম্ভব ছিল না। নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট কাজের প্রতিটি ধাপে যেসব শিক্ষক ও কর্মকর্তা কাজ করেছেন, তাঁদের একটি বড় অংশ কোনো না কোনো পক্ষের রাজনীতি করেন। অতএব অনিয়ম করে সবার চোখ ফাঁকি দেওয়া সম্ভব ছিল না।
ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট পেপার নিয়েও গণমাধ্যমে কয়েক দিন ধরে তোলপাড় হয়েছে। কোথায় ছাপানো হলো, কোন প্রতিষ্ঠান ছাপাল—এগুলো প্রশ্ন হতে পারে; কিন্তু এর চেয়ে গুরুতর প্রশ্ন, এসব ব্যালট তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা পক্ষের হাতে গেল কি না।
আরও পড়ুনডাকসু নির্বাচন, ফলাফল ও তরুণ মনের চাওয়া১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫এবার কেবল ছাপানোর মধ্য দিয়েই ব্যালট পেপারের কাজ শেষ হয়ে যায়নি। ব্যালট ছাপানো ও কাটার পরে মেশিনে পাঠযোগ্য করার জন্য কোড বসানো হয়েছে। তারপর সেগুলো নির্বাচন কমিশন নির্দিষ্ট সংখ্যায় বুঝে নিয়েছে। প্রতিটি ব্যালটে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর বসিয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যায় প্যাকেট করা হয়েছে। নির্বাচনের দিন এসব প্যাকেট ডাকসুর ১০ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিজেদের হাতে নিজ নিজ কেন্দ্রে নিয়ে গেছেন।
অতীতের ডাকসু নির্বাচনগুলোর মতো এবারও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন তোলা উচিত, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের জন্য এত উদ্বেগ তৈরি হবে কেন।
যে নির্বাচনটি হওয়া দরকার ছিল উৎসবমুখর, সেটি আয়োজনের জন্য এত সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও মানুষকে উৎকণ্ঠিত সময় পার করতে হবে কেন। কিসের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এত প্রস্তুতি, সেনাবাহিনী ডাকা হবে কি না, এ রকম প্রশ্ন। প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ও সময়ের অপচয় কার জন্য, কিসের জন্য। প্রশ্ন তোলা যায়, ডাকসুর একেকজন ছাত্রনেতা কী ক্যারিশমায় জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন!
আরও পড়ুনডাকসু-জাকসুতে শিবির জিতেছে, বাকিরা কি জিততে চেয়েছে১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫প্রশ্ন উঠতে পারে, ডাকসু কোনো দলীয় নির্বাচন না হলেও ছাত্রসংগঠনগুলো কেন প্যানেল পরিচয়ে নির্বাচন করে, প্রচারণা চালায়। উত্তর খুঁজতে হবে, ছাত্রসংগঠন বা ছাত্রনেতাদের পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা কীভাবে বাড়ানো যায়। এই সহনশীলতা অবশ্যই দরকার। কারণ, তা না হলে বহুমত ও পথের জয়ী প্রার্থীদের নিয়ে ছাত্র সংসদ কার্যকর করা সম্ভব নয়। সবার এবং সব পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও শিক্ষাসহায়ক পরিবেশের উন্নতি হতে পারে।
ডাকসু নির্বাচনে কারা ভোটার হবেন এবং কারা প্রার্থী হতে পারবেন—এই প্রশ্নেরও মীমাংসা দরকার। এবার বয়সের সীমা তুলে দেওয়া হয়েছে; এতে কোনো ক্ষতি হয়নি। নিয়মিত ছাত্রদের নির্বাচনে ভোটার ও প্রার্থী হওয়ার নতুন বিধিতে কোনো সমস্যা নেই। তবে এমফিল বা পিএইচডি, এ ধরনের উচ্চতর ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য ভোটার বা প্রার্থী হওয়ার সুযোগ রাখা হবে কি না, সেটি নিয়ে ভাবা দরকার। এই সুযোগ থাকলে পাস করে যাওয়া শিক্ষার্থীও উচ্চতর ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে যেকোনো সময়ে নির্বাচন করতে চাইবেন।
সবশেষে আরেকটি প্রশ্ন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন আদৌ নিয়মিত হবে কি না। এটি করা গেলে নির্বাচনবিষয়ক বিদ্যমান উৎকণ্ঠা ও চাপ কমে যাওয়ার কথা। ডাকসুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডারে নিয়ে আসার ব্যাপারে সব ছাত্রসংগঠনই একমত হয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ব্যাপারে কী করে, সেটি দেখার বিষয়।
● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক