সাহাবিদের যুগে ইসলামি ফিকহের বিকাশ
Published: 8th, October 2025 GMT
ইসলামি ফিকহের ইতিহাসে সাহাবিদের যুগকে দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবে গণ্য করা হয়, যা রাসুল (সা.)–এর যুগের পর শুরু হয়। এই যুগকে ‘ভিত্তি ও বিকাশের পর্যায়’ বলা হয়। রাসুলের যুগের ফিকহ মূলত তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং ওহির অবতারণার সাথে যুক্ত ছিল, কিন্তু সাহাবিদের যুগে ফিকহের বিকাশ ঘটে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে, যা ইসলামি আইনশাস্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করে।
অনেকে মনে করেন যে সকল সাহাবিই ছিলেন ফকিহ এবং ইজতিহাদকারী। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। প্রথম মুসলিম সমাজে সাহাবিদের সবাই উলামা বা ফকিহ ছিলেন না।
রাসুলের যুগে বা খোলাফায়ে রাশেদিনের সময়ে তারা বেশিরভাগই দৈনন্দিন জীবনযাপন, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ইসলাম প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন। তারা ছিলেন ধার্মিক এবং সৎ, যারা ইসলামকে জীবনে প্রয়োগ করতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু গভীর জ্ঞানার্জন তাদের সকলের জন্য প্রধান লক্ষ্য ছিল না।
তারা ধর্মের প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করতেন এবং তা প্রয়োগ করতেন। এই পদ্ধতি কোরআন থেকে অনুপ্রাণিত, যা সকলকে জ্ঞানার্জনে ত্যাগী হতে বলেনি, বরং একটি দলকে ফিকহ অর্জনের জন্য নির্দেশ দিয়েছে যাতে তারা অন্যদের সতর্ক করতে পারে। (সুরা তাওবা, আয়াত: ১২২)
আমরা রাসুলের কাছ থেকে দশটি আয়াত শিখলে তা না বুঝে এবং প্রয়োগ না করে পরেরগুলোতে যেতাম না।সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)
সাহাবিদের মধ্যে উলামা সংখ্যা ছিল সীমিত। হাফেজ ইবনে কাইয়্যিম (রহ.) উল্লেখ করেছেন যে রাসুলের সাহাবিদের মধ্যে ফতোয়া দেওয়ার জন্য স্মরণীয় ছিলেন প্রায় ১৩০ জন, যাদের মধ্যে সাতজন ছিলেন সবচেয়ে বেশি ফতোয়া প্রদানকারী: ওমর ইবনে খাত্তাব, আলি ইবনে আবু তালিব, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, উম্মুল মুমিনিন আয়েশা, যায়দ ইবনে সাবিত, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও আব্দুল্লাহ ইবনো ওমর (রা.)। (ই‘লাম আল-মুওয়াক্কিঈন, ১/১০, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৯১)
বাকিরা ছিলেন মধ্যম পর্যায়ের বা কম ফতোয়া প্রদানকারী।
সাহাবিগণ কোরআনের প্রতি গভীর ভালোবাসা রাখতেন, কিন্তু তারা অল্প কয়েকটি আয়াত শিখলেও তা প্রয়োগ না করে পরের আয়াতে যেতেন না। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, “আমরা রাসুলের কাছ থেকে দশটি আয়াত শিখলে তা না বুঝে এবং প্রয়োগ না করে পরেরগুলোতে যেতাম না।” (ইবনে হাজার আল-আসকালানি, ইতহাফ আল-মাহরাহ বিল ফাওয়াইদ আল-মুবতাকারাহ, ১০/২৮০, মারকায খিদমাতিস সুন্নাহ ওয়াস সিরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, রিয়াদ, ১৯৯৫)
আরও পড়ুনহালাল খাদ্যাভ্যাস কেন গুরুত্বপূর্ণ৩১ আগস্ট ২০২৫রাসুলের যুগে সাহাবিদের ‘ইজতিহাদ’ইজতিহাদ হলো, শরিয়তের বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছার যোগ্যতা। তারা কোনো নতুন ঘটনার সমাধানে কোরআন ও হাদিসের আলোকে যুক্তি-প্রমাণ ব্যবহার করে আপ্রাণ চেষ্টা ও গবেষণা করেন। যে ব্যক্তি এই গবেষণা ও প্রচেষ্টায় সক্ষম হন, তাকে ‘মুজতাহিদ’ বলা হয়।
ফিকহ ও ইজতিহাদের প্রতি সাহাবিদের আগ্রহ রাসুলের যুগেই প্রকাশ পায়। রাসুল (সা.) কয়েকজন সাহাবিকে ইজতিহাদের প্রশিক্ষণ দিতেন, যেমন আবু বকর, ওমর, আলি এবং আমর ইবনুল আস (রা.)। তারা রাসুলের নির্দেশের ব্যাখ্যায় ইজতিহাদ করতেন।
উদাহরণস্বরূপ, বনু কুরাইজা অভিযানের সময় রাসুল বলেন, “আসরের নামাজ বনু কুরাইজায় পড়বে।” কেউ কেউ এটাকে আক্ষরিক অর্থে নিয়ে সময় পার হয়ে গেলেও সেখানে গিয়ে পড়েন, অন্যরা মনে করেন এটি দ্রুত করার জন্য বলা হয়েছে এবং যথাসময়ে নামাজ পড়েন। রাসুল উভয় দলকেই সঠিক বলেন, কারণ এটি ছিল তাদের ইজতিহাদ। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪০২৪)
তারা কোনো নতুন ঘটনার সমাধানে কোরআন ও হাদিসের আলোকে যুক্তি-প্রমাণ ব্যবহার করে আপ্রাণ চেষ্টা ও গবেষণা করেন। যে ব্যক্তি এই গবেষণা ও প্রচেষ্টায় সক্ষম হন, তাকে ‘মুজতাহিদ’ বলা হয়।রাসুলের পর সাহাবিদের ‘ইজতিহাদ’রাসুল (সা.) সাহাবিদেরকে তাঁর পরবর্তী যুগে ইজতিহাদের নির্দেশ দেন। আলি ইবনে আবু তালিব (রা.) বলেন, “আল্লাহর রাসুল, আপনার পর যদি এমন কোনো ঘটনা ঘটে যে–সম্পর্কে কোরআন বা আপনার কথায় স্পষ্ট নির্দেশ না থাকে?”
রাসুল বলেন, “আমার উম্মতের ধার্মিকদের একত্র করো এবং পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নাও, একজনের মতামতের ওপর নির্ভর করো না।” (খতিব আল-বাগদাদি, আল-ফাকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ, ১/৪৬৭, দারু ইবনিল জাওযি, রিয়াদ, ১৪১৭ হি.)
এতে ‘কিয়াস’ (সুন্নাহর তুলনামূলক মত) ও ‘ইজমা’র (ফকিহদের ঐকমত্য) ইঙ্গিত রয়েছে। ইজমা সাহাবাদের যুগে উদ্ভূত হয়, যা শুরু হয় পরামর্শ থেকে এবং চূড়ান্ত হয় ঐকমত্যে।
রাসুলের ইন্তেকালের পর সাহাবিগণ তাৎক্ষণিক ইজতিহাদ করেন, যেমন খলিফা নির্বাচন এবং কোরআন সংকলন ইত্যাদি।
আরও পড়ুনফরজে কিফায়া: একের পালন, সবার মুক্তি১০ জুলাই ২০২৫সাহাবিদের যুগে ফিকহের উৎসসমূহকোরআন ও সুন্নাহ ছাড়াও সাহাবাদের যুগে নতুন একাধিক উৎস উদ্ভূত হয়:
ইজমা: সাহাবিদের ইজমা বা ঐকমত্য সকলের কাছে প্রমাণস্বরূপ। কারণ তারা ওহীর সাক্ষী ছিলেন। (ইবনে আব্দুল্লাহ জারাকাশি, আল-বাহরুল মুহিত, ৬/৪৩৮, দারুল কুতুবি, কায়রো, ১৯৯৪)
যেমন, দাদীর উত্তরাধিকার, খলিফা নির্বাচনের অপরিহার্যতা, জাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, মৃতের ঋণ পরিশোধের অগ্রাধিকার, শূকরের চর্বির নিষিদ্ধতা প্রভৃতি। ইবনে হাজমের মারাতিবুল ইজমা এবং ইবনে মুনজিরের আল-ইজমা এ–বিষয়ক দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলন।
কিয়াস: সাহাবিগণ তাদের সময়কার বিভিন্ন ঘটনাকে পূর্বের অনুরূপ ঘটনার সঙ্গে তুলনা করতেন। আবু মুসাকে হজরত ওমর (রা.) লেখেন, “অনুরূপ ও সাদৃশ্যগুলো চিহ্নিত করো এবং বিষয়গুলো কিয়াস করো।” (ইবনে কাইয়্যিম জাওযি, ই‘লাম আল-মুওয়াক্কিঈন, ১/১৬৬, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৯১)
হজরত আবু বকর (রা.)–এর খেলাফতকে নামাজের ইমাম হওয়ার সঙ্গে কিয়াস করা সে–সময়কার কিয়াসের একটি ভালো উদাহরণ।
দুঃখের বিষয়, সাহাবাদের সকল ফিকহি মতামত বিস্তৃত পরিসরে সংকলন করা যায় নি, সামান্য কিছু গবেষণা করা হয়েছে মাত্র।সাহাবিদের ফতোয়া: সাহাবিদের প্রদত্ত ফতোয়া ফিকহের সমৃদ্ধির উৎস, যা কোরআন ও হাদিসের মূলপাঠের (নস) ভিত্তিতে তারা প্রদান করতেন, অন্যের অনুসরণ (তাকলিদ) করার মাধ্যমে নয়। (ইবনে কাইয়্যিম জাওযি, ই‘লাম আল-মুওয়াক্কিঈন, ২/১৭৮, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৯১)
কোরআনের ব্যাখ্যায় সাহাবিদের মন্তব্য: তারা ছিলেন কোরআনের সর্বোত্তম ব্যাখ্যাকারী। ইমাম শাতিবি বলেন, কোরআনকে অবতারণাকালের আরবি ভাষায় বুঝতে হবে। ওমর (রা.) বলেছেন, “জাহিলি যুগের কবিতা ধরে রাখো, কারণ তাতে তোমাদের কোরআনের ব্যাখ্যা আছে।” (ইবনে মুসা শাতিবি, আল-মুয়াফাকাত, ১/৫৮, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ২০০৩)
যেমন, সুরা নিসার শেষ দিকে ‘কালালাহ’ শব্দের ব্যাখ্যা, যাতে ওমর ও আবু বকরের (রা.) মতভেদ রয়েছে এবং সুরা তালাকে (আয়াত: ৬) বর্ণিত তালাকপ্রাপ্ত নারীর বাসস্থান ইত্যাদি।
‘মাসালিহ মুরসালাহ’: কোরআন ও হাদিসের মূলপাঠের (নস) যা নেই এমন কল্যাণকর কাজ, যা শরিয়তের উদ্দেশ্য সুরক্ষিত রাখে। (ইবনে আব্দুর রাহমান আল-ইসফাহানি, বায়ান আল-মুখতাসার শারহ মুখতাসার ইবনিল হাজিব, ৩/২৮৬, দারুল মাদানি, জেদ্দাহ, ১৯৮৬)
যেমন, কোরআন সংকলন করা, মদ্যপায়ীর দণ্ড, জরিমানা আদায় করা, অভিযুক্তকে প্রহার করা ইত্যাদি।
সাহাবিদের যুগের ফিকহের সুবিধাসমূহএই যুগের ফিকহের কয়েকটি বিশেষত্ব রয়েছে:
নসভিত্তিক: কোরআন ও সুন্নাহের ওপর নির্ভরশীল।
শুরা-ভিত্তিক: আবু বকর ও ওমর (রা.) ফকিহদের একত্র করে নতুন ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতেন; এমনকি ওমর (রা.) সাহাবিদের মদিনা ছাড়তে নিষেধ করেন।
কল্যাণ-ভিত্তিক: ‘ইজতিহাদ’ করতে হবে এমন বিষয়ে শরিয়তের উদ্দেশ্য রক্ষা।
বাস্তবমুখী: কোনো কাল্পনিক নয়, সমাজের চাহিদা পূরণকারী।
একক মত নয়, মতভেদ থেকে সমৃদ্ধি, যা ফিকহকে চিরায়ত করবে।
রাসুলের সুন্নাহ সংরক্ষণ।
দুঃখের বিষয়, সাহাবাদের সকল ফিকহি মতামত বিস্তৃত পরিসরে সংকলন করা যায় নি, সামান্য কিছু গবেষণা করা হয়েছে মাত্র।
আরও পড়ুনফকিহদের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের মধ্যকার প্রেম–ভালোবাসা২৬ জুলাই ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক রআন ও হ দ স র ইজত হ দ র স কলন ক ক রআন র র জন য ইসল ম করত ন ন ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
কুড়িগ্রামে ভেসে এল মৃত গন্ডার, হাড়গোড় যাবে জাদুঘরে
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দুধকুমার নদে একটি মৃত গন্ডার ভেসে এসেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা, কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে ভারতের কোনো বন্য প্রাণী সংরক্ষণ এলাকা থেকে ভেসে এসেছে এটি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কয়েক দিনে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় প্রবল বন্যা দেখা দিয়েছে। পাহাড়ধস ও বনাঞ্চল প্লাবিত হয়ে দুধকুমার নদ দিয়ে কাঠের গুঁড়ি, মৃত গরু, সাপ, মাছসহ নানা প্রাণী ভেসে আসছে। গত সোমবার (৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় দুধকুমার নদের স্রোতে গন্ডারটিকে মৃত অবস্থায় প্রথমবার ভাসতে দেখা যায়। পরে ভূরুঙ্গামারী উপজেলার তিলাই ইউনিয়নের দক্ষিণছাট গোপালপুর গ্রামের চরে আটকে পড়ে প্রাণীটির দেহ।
আরও পড়ুন‘পুষ্পা’ সিনেমার মতো কুড়িগ্রামে ভেসে এল কাঠ, ‘লাল চন্দন’ ভেবে কাড়াকাড়ি৬ ঘণ্টা আগেমঞ্জুরুল ইসলাম নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, উজানের ঢলে কালজানি ও দুধকুমার নদে শত শত গাছের গুঁড়ি ও কাঠ ভেসে এসেছে। এর সঙ্গে ওই মৃত গন্ডার ভেসে আসে।
খবর পেয়ে আজ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান তিলাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান, কুড়িগ্রাম রেঞ্জ কর্মকর্তা (সামাজিক বনায়ন) সাদিকুর রহমান, উপজেলা বন কর্মকর্তা সেকেন্দার আলী ও যমুনা সেতু আঞ্চলিক জাদুঘরের কিউরেটর জুয়েল রানা।
আরও পড়ুনকুড়িগ্রামের কালজানি নদীতে ভেসে আসছে হাজারো গাছের গুঁড়ি০৫ অক্টোবর ২০২৫ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘গতকাল এলাকাবাসী মৃত দেহটি দেখতে পেয়ে আমাকে খবর দিলে আমি বন বিভাগকে জানাই। আজ বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তাসহ যমুনা সেতু আঞ্চলিক জাদুঘরের কিউরেটর সরেজমিনে পরিদর্শন করেন।’
কুড়িগ্রাম বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা সাদিকুর রহমান বলেন, গন্ডারটি খুব বড় ও ভারী হওয়ায় সরানো সম্ভব হয়নি। তাই মাটিতে গর্ত করে সেখানেই পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জাদুঘরের লোকজন এর হাড়গোড় সংগ্রহ করবেন।
যমুনা সেতু আঞ্চলিক জাদুঘরের কিউরেটর জুয়েল রানা বলেন, গন্ডারটির দেহ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। দুই মাস পর পচনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে হাড়গোড় সংগ্রহ করে জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে। এগুলো শিক্ষা ও গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হবে।
আরও পড়ুনতিস্তার পানি কুড়িগ্রামে বিপৎসীমার ওপরে, লালমনিরহাটে নিচে০৬ অক্টোবর ২০২৫