একজন মানুষ অক্সিজেন না পেলে যেখানে তিন মিনিটের বেশি বেঁচে থাকতে পারে না, সেখানে প্রয়োজনের সময় ৭০ শতাংশ মানুষের অক্সিজেন না পাওয়ার তথ্য গভীরভাবে উদ্বেগজনক। অবশ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাধারণ চিত্র এটা। কিন্তু তাই বলে আমাদের নীতিনির্ধারকদের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি না। কেননা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অক্সিজেনকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আর কোভিড মহামারির দুঃসহ অভিজ্ঞতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে অক্সিজেন কতটা মহামূল্যবান সম্পদ হতে পারে।

রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে মঙ্গলবার ‘বাংলাদেশ অক্সিজেন সামিট–২০২৫ ’–এ উঠে এসেছে প্রয়োজনের সময় অক্সিজেন না পাওয়ার পেছনে চারটি কারণ রয়েছে। চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছাতে না পারা, চিকিৎসাকেন্দ্র প্রস্তুত না থাকা, অক্সিজেন সরবরাহ করতে না পারা ও নিম্নমানের অক্সিজেনের কারণে সংকট ও ভোগান্তিতে পড়েন রোগী ও তাঁর স্বজনেরা। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ ২০২২ সালে অক্সিজেনের নিরাপত্তা নিয়ে যে কমিশন গঠন করেছিল, এ বছর মার্চে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অক্সিজেনের চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি। জরুরি চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার, সিওপিডিসহ দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভোগা মানুষের জন্য অক্সিজেন অত্যাবশ্যকীয়। বাংলাদেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ৭৪ লাখ মানুষের মেডিকেল অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। আর এই প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে।

ল্যানসেট–এর প্রতিবেদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটা হলো, প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনের সময় হাসপাতালে বা ক্লিনিকে পৌঁছাতে পারেন না বা সেগুলো অসুস্থ ব্যক্তির বাড়ি থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। এটা নিশ্চিতভাবে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার, বিশেষ করে তৃণমূলের ভঙ্গুরতার চিত্রেরই প্রতিফলন। বছরের পর বছর ধরে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ৫ শতাংশে আটকে আছে। অথচ মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে বাজেটের অন্তত ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।

ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল হওয়ায় বেশির ভাগ রোগীকে ঢাকামুখী হতে হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন ঢাকার ওপর চাপ বাড়ছে, অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে চিকিৎসার পেছনে ব্যক্তিগত ব্যয় সর্বোচ্চ। কাজেই বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবার যে ভঙ্গুর ও বৈষম্যবাদী চিত্র, তার থেকে আলাদা করে দেখা যাবে না অক্সিজেন না পাওয়ার চিত্রটিকে।

সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো.

সায়েদুর রহমান অক্সিজেনকে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় বলে স্বীকৃতি দিয়ে এটিকে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার যে সিদ্ধান্তের কথা বলেছেন, সেটা ইতিবাচক বলেই মনে করি। সমস্যার স্বীকৃতিই সমাধানের মূল ধাপ। কোভিড মহামারির সময় মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যবস্থা বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তাতে করে অক্সিজেনের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু ঘাটতি ও সহজলভ্যতার বিচারে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর জন্য পথ যে অনেকখানি বাকি রয়ে গেছে, ল্যানসেট–এর প্রতিবেদন থেকেই সেটা স্পষ্ট।

জীবন রক্ষাকারী মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন ও তার সরবরাহ তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে এ খাতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য অক্সিজেনকে নাগরিকের অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র সময়

এছাড়াও পড়ুন:

শরীয়তপুরে চাহিদার ৭৫ শতাংশের কম সার সরবরাহ, দুশ্চিন্তায় চাষিরা

এখন চলছে ফসল আবাদের ভরা মৌসুম। এ মৌসুমে শরীয়তপুরে সারের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। কৃষকদের চাহিদার বিপরীতে ৪৪ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কম সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অনেক স্থানে নিকটবর্তী বাজারে সার না পেয়ে দূরবর্তী বাজার থেকে কৃষকদের অতিরিক্ত দাম দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় উৎপাদিত ফসলের খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।

শরীয়তপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, শরীয়তপুরের ৬টি উপজেলায় ৮২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ করেন কৃষকেরা। সেপ্টেম্বর মাস থেকে শরীয়তপুরের কৃষকেরা বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন শাকসবজি, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, রবিশস্য, তেলজাতীয় ফসল, ডালজাতীয় ফসল, মসলাজাতীয় ফসল, ধানের বীজতলা ও বিভিন্ন ধরনের ধানের আবাদ শুরু করেন। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত কৃষকেরা ওই সব ফসল আবাদ নিয়ে মাঠে ব্যস্ত থাকেন। এই চার মাস শরীয়তপুরে ফসল আবাদের ভরা মৌসুম। এ মৌসুমেই জেলায় সারের বরাদ্দ কম পাওয়া গেছে।

ফসলের এ মৌসুমে (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) শরীয়তপুরের ৮২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ফসল আবাদের জন্য জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে সারের চাহিদা পাঠায়। যার মধ্যে ইউরিয়া ১৮ হাজার ৫৯৫ মেট্রিক টন, টিএসপি ৪ হাজার ৮১০ মেট্রিক টন, ডিএপি ১২ হাজার ৭৭৫ মেট্রিক টন, এমওপি ৮ হাজার ৯৯২ মেট্রিক টন। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় সারের বরাদ্দ দিয়েছে কম। শরীয়তপুরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ইউরিয়া ৭ হাজার ৯৪৬ মেট্রিক টন, টিএসপি ১ হাজার ৭২৭ মেট্রিক টন, ডিএপি ৭ হাজার ৭৫ মেট্রিক টন, এমওপি ২ হাজার ২১৯ মেট্রিক টন। এ মৌসুমে চাহিদার চেয়ে কম পাওয়া গেছে ইউরিয়া ৫৭ শতাংশ, টিএসপি ৬৪, শতাংশ, ডিএপি ৪৪ শতাংশ এবং এমওপি ৭৫ শতাংশ।

শরীয়তপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের কাছে সার সরবরাহ করার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে মোট ৭১ জন ডিলার নিয়োগ দিয়েছে। সরকার–নির্ধারিত প্রতি কেজি ইউরিয়া ২৭ টাকা, টিএসপি ২৭ টাকা, ডিএপি ২১ টাকা ও এমওপি সার ২০ টাকা দামে বিক্রি করতে হবে। ওই দামে কৃষক তাঁর প্রয়োজনীয় সার ডিলার পয়েন্ট থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন।

চাহিদার চেয়ে কম সরবরাহ থাকায় ডিলার ও ডিলারদের নিয়ন্ত্রিত খুচরা ব্যবসায়ীরা বর্তমানে প্রতি কেজি সার ১০ থেকে ১২ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছেন।

কৃষি কর্মকর্তারা জানান, স্থানীয় কৃষি বিভাগ থেকে মন্ত্রণালয় সারা বছরের চাহিদা নেওয়ার পর তার বিপরীতে বরাদ্দের তালিকা পাঠায়। ওই তালিকা জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা মাস অনুযায়ী বণ্টন করেন। তারপর ইউনিয়নভিত্তিক সারের ডিলারদের মধ্যে ওই ইউনিয়নের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই বরাদ্দ অনুযায়ী বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), বিসিআইসি ও যশোরের নওয়াপাড়ায় থাকা বেসরকারি আমদানিকারকেরা ডিলারদের অনুকূলে সার সরবরাহ করেন।

কয়েকজন কৃষক জানান, শরীয়তপুরের কৃষকেরা ইউরিয়া, টিএসটি, ডিএপি ও এমওপি সার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন। প্রতি শতাংশ জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসলের জন্য তিন কেজি সার ব্যবহার করা হয়। যার সরকার–নির্ধারিত দাম ৮০ থেকে ৮২ টাকা। বাজারে সরবরাহ কম থাকায় বর্তমানে ওই সার কৃষককে ১১০ থেকে ১২০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। প্রতি শতাংশ জমিতে কৃষককে ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদিত ফসলের খরচ বাড়বে।

নড়িয়ার নশাসন এলাকার কৃষক মোকলেছ খন্দকার ১৬৫ শতাংশ জমিতে শীতকালীন শাকসবজি, পেঁয়াজ ও রসুন আবাদ করেছেন। ওই ফসলগুলোর জন্য তাঁর ২০ হাজার টাকার সার ক্রয় করতে হয়েছে। বাজারে সরবরাহ কম থাকায় তাঁকে সার সংগ্রহ করতে সাড়ে ছয় হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে।

মোকলেছ খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে ডিলারের কাছে গেলে বলেন সার পাই না, কোথা থেকে দেব? যা চাই, তার কম পাই। ফসল আবাদ করেছি, ফলন ভালো পেতে হলে সার তো দিতেই হবে। তাই বেশি দাম দিয়ে খুচরা দোকান থেকে কিনতে হয়েছে।’

জাজিরার ডুবলদিয়া এলাকার কৃষক হারুন মাদবর প্রথম আলোকে বলেন, ‘শর্ষে, ধনিয়া, কালিজিরা, পেঁয়াজ ও রসুনের আবাদ করেছি। বাজারে সারের দাম বেশি। প্রতিটি সার বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। আমরা কৃষক, আমাদের কথা কে ভাবে? সার ও শ্রমিকের দাম বেশি। ফসলের উৎপাদন খরচ বাড়ছে, কিন্তু বিক্রি করতে গেলে দাম পাই না।’

জানতে চাইলে বিএডিসির ফরিদপুর অঞ্চলের যুগ্ম পরিচালক এস এম ইকরামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সার দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা হয়। বিএডিসি ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমদানি করে। আর ইউরিয়া বিসিআইসি সরবরাহ করে। মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিভাগের বরাদ্দের তালিকা অনুযায়ী আমরা সেই সার ডিলারদের কাছে সরবরাহ করি। কোনো জেলায় চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দের ঘাটতি থাকলে তারা মন্ত্রণালয়ে উপবরাদ্দ চাইতে পারে। মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দিলে আমরা সরবরাহ দিতে পারব।’

শরীয়তপুর সার বিক্রেতা সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রব হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারের যা বরাদ্দ পাই, তা নির্ধারিত দামে বিক্রি করছি। অনেক সময় কিছু সার সরবরাহের ঘাটতি থাকে। তখন খুচরা বিক্রেতারা একটু বেশি দামে বিক্রির চেষ্টা করেন।’

শরীয়তপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোস্তফা কামাল হোসেন বলেন, চাহিদা অনুযায়ী সারের বরাদ্দ কম আছে। কৃষক বিভিন্নভাবে ঘাটতি মোকাবিলা করছেন। বেশি দামে সার বিক্রি রোধে মনিটরিং কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। প্রশাসনের সহায়তায় ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছেন। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৃষকদের অতিমাত্রায় সার ব্যবহার না করে সুষম মাত্রায় ব্যবহার করা উচিত।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সারে গ‍্যাসের দাম ১৬ থেকে বেড়ে ২৯ টাকা ২৫ পয়সা
  • উড়ালসড়কের পাইলিংয়ের সময় তিতাসের পাইপলাইনে ফাটল, গ্যাস সরবরাহ বন্ধ
  • খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে দ্রুত পদক্ষেপ নিন
  • রেহমান সোবহান এলডিসির খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানালেন
  • শরীয়তপুরে চাহিদার ৭৫ শতাংশের কম সার সরবরাহ, দুশ্চিন্তায় চাষিরা
  • ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের
  • গ্রী গ্লোবাল বাংলাদেশের পার্টনারস মিট: কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে দিকনির্দেশনা