জুলাই সনদ বাস্তবায়ন: দু-এক দিনের মধ্যে সরকারকে সুপারিশ দেবে কমিশ
Published: 9th, October 2025 GMT
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দল এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতকে বিবেচনায় নিয়ে ঐকমত্য কমিশন যেন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সরকারকে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট পরামর্শ দেয়—এ বিষয়ে আলোচনায় রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো মত দিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞ মতামত এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পাঁচটি বৈঠকের আলোচনায় প্রাপ্ত মতামতকে সমন্বিত করে আগামী দু-এক দিনের মধ্যে সরকারকে পরামর্শ দেবে ঐকমত্য কমিশন এবং এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী সকলকে তা অবহিত করবে।
বুধবার রাতে ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে আলোচনা শেষে সমাপনী বক্তব্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজ এসব কথা বলেন। এ সময় কমিশনের সদস্যদের মধ্যে বিচারপতি মো.
আরো পড়ুন:
জুলাই সনদ: একমত গণভোটে, অনিশ্চয়তা বাস্তবায়নে
‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে আবার অভ্যুত্থান অনিবার্য’
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাথে একই দিনে পৃথক ব্যালটে গণভোট নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট করার পক্ষে মত দিয়েছে। কমিশন মনে করে, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নের জন্য ত্রয়োদশ সংসদকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত সংবিধানের মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তনের ক্ষমতা প্রদান করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যত ঐকমত্য রয়েছে।
এছাড়া সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত বৈঠকে বিশেষজ্ঞগণ সর্বসম্মতভাবে পাঁচটি মতামত দিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন কমিশনের সহ-সভাপতি। মতামতগুলো হলো-
* ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নে একটি আদেশ জারি করতে হবে।
* এই আদেশের মাধ্যমে গণভোট আয়োজন করতে হবে।
* যেসব বিষয়ে ঐকমত্য বা বৃহত্তর ঐক্য রয়েছে এবং যেসব বিষয়ে ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) রয়েছে, গণভোটে সেই দুটি বিষয়ে আলাদা প্রশ্ন থাকবে।
* নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ গঠিত হবে।
* পরিষদ আদেশে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গণভোটের অনুমোদন সাপেক্ষে, ‘জুলাই জাতীয় সনদ’-এ বর্ণিত সংবিধান সংশ্লিষ্ট সংস্কারসমূহ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষর ছাড়াও কমিশনের পক্ষ থেকে আগামী ১৮-১৯ অক্টোবরের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পরাজয়কে সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এই ঐক্য অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে এবং এর কোনো বিকল্প নেই।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে গতকালের আলোচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি-সহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেন।
ঢাকা/এএএম/ফিরোজ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ল ই গণঅভ য ত থ ন সনদ ২০২৫ মত মত গণভ ট
এছাড়াও পড়ুন:
দুর্বোধ্য প্রস্তাবে গণভোট জনগণের প্রতি অবিচার
ঐকমত্য একটি চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে দরকার। সাধারণ মানুষের চাহিদাটি হলো একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক উত্তরণ এবং অর্থনীতি ভালো থাকা। এই দুটি বৃহত্তর জাতীয় চাহিদা মাথায় রেখেই আমাদের সমাধান খোঁজা দরকার।
আমরা দেখছি, একটু ঐকমত্য হলো, আবার ঐকমত্যের ঘাটতি হলো—এখানে পরীক্ষা সবাই দিচ্ছে। কমিশন তার দক্ষতা ও নিয়তের পরীক্ষা দিচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো সদিচ্ছার পরীক্ষা দিচ্ছে। জনগণ এখানে অনুপস্থিত নয়। জনগণ যমুনায় আমন্ত্রিত হচ্ছে না, কিন্তু পুরো প্রক্রিয়ার ওপর নজর রাখছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রক্রিয়া তিনটি গন্তব্যের দিকে যেতে পারে। এর মধ্যে একটি কাঙ্ক্ষিত। সেটি হলো, সম্মানজনক ও কার্যকর সমাপ্তি। দুটি অনাকাঙ্ক্ষিত। একটি হলো, ব্যাপক আয়োজন সত্ত্বেও কোনো সুনির্দিষ্ট ফলাফল না আসা। অন্যটি হলো, হযবরল অবস্থা তৈরি হওয়া। এটির মানে হলো, এগোনোর পথ অপরিষ্কার।
আরও পড়ুনসংসদকে দ্বৈত ভূমিকা দেওয়ার সুপারিশ করতে পারে কমিশন ৫৭ মিনিট আগেএকটা বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। যাঁরা ঐকমত্যের প্রক্রিয়ায় আছেন, ঐকমত্যের কথা বলছেন, কখনো কখনো তাঁরা একে অপরকে অবিশ্বাস করছেন। অবিশ্বাসের মধ্যে আমরা ঐকমত্য তৈরি করতে চাইছি, এটা তো স্ববিরোধী ব্যাপার।
আমরা দেখছি, যেখানে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রয়োজন ছিল, সেটার বদলে গণভোটের দিকে যাত্রা করা হচ্ছে। কারণ, নিজেরা সমঝোতায় আসতে পারছে না। গণভোট কখন হবে, সেটা নিয়েও একেক পক্ষের মতামত একেক রকম। এ ক্ষেত্রে অনুপস্থিত মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী জনগণ চরম বিরক্ত ও হতাশ হবে। কারণ, জনগণ চায় সম্মানজনক ও কার্যকর সমাপ্তি। অন্য কোনো গন্তব্য যেন তৈরি না হয়।
হযবরল অবস্থা তৈরি হলে দেশের সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক উত্তরণ হবে না। কোনোরকম উত্তরণ হলেও সমস্যার সমাধান ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হবে না। সে জন্য আশা করব, সদিচ্ছার পরীক্ষায় রাজনৈতিক পক্ষগুলো যেন উত্তীর্ণ হয়। হযবরল অবস্থা তৈরির আশঙ্কা যেন তারা বুঝতে পারে।
এখন সামনে এসেছে গণভোটের প্রসঙ্গ। এটা একধরনের মতামত জরিপ। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারে (পিপিআরসি) আমাদের মতামত জরিপ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে। এটাকে পন্থা হিসেবে গ্রহণ করতে হলে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন।
আরও পড়ুনগণভোটে ঐকমত্য, তবে সেটা কখন তা নিয়ে বিএনপি–জামায়াতের ভিন্ন মত০৫ অক্টোবর ২০২৫কোনো জটিল ও দুর্বোধ্য প্রস্তাবের ওপর গণভোট জনগণের প্রতি অবিচার করার শামিল। এতে হযবরল অবস্থা তৈরির আশঙ্কাই বেশি। গণভোটের মাধ্যমে মানুষকে তাত্ত্বিক জ্ঞান দেওয়ার কোনো আকাঙ্ক্ষা যদি এলিটদের (অভিজাত শ্রেণি) থাকে, সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। গণভোটের ক্ষেত্রে জটিল প্রস্তাব পরিহার করা প্রয়োজন। কারণ আমরা দেখেছি, জটিল বিষয়ে মতামত জরিপে প্রকৃত ফলাফল আসে না।
গণভোটের ক্ষেত্রে প্রশ্নটি যদি প্রাক্-ধারণানির্ভর হয়, তাহলে কিন্তু সেটা সৎ গণভোট হবে না। গণভোট সৎ হওয়া দরকার। কী চাওয়া হচ্ছে, সেটা কি মানুষের কাছে পরিষ্কার? মানুষ কি জুলাই সনদ সম্পর্কে জানে? মানুষ কি আইনি ভিত্তি দিলে কী হবে, সে সম্পর্কে ধারণা রাখে? শহরের মানুষ কিছু কিছু জানতে পারে। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামের প্রান্তিক মানুষেরা সেটা সম্পর্কে কি ধারণা রাখে?
মতামত জরিপের একটি সাধারণ সমস্যা হলো ‘লিডিং কোশ্চেন’ সমস্যা। আমি যেভাবে উত্তর চাই, সেভাবেই প্রশ্নটি সাজালাম। কিন্তু সেটা হওয়া উচিত নয়।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে একমত০৫ অক্টোবর ২০২৫জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রমের কার্যকর ও সম্মানজনক পরিসমাপ্তি যদি ১৫ অক্টোবরের মধ্যে হয়ে যায়, তারপর আরেকটি ঐকমত্য দরকার হবে। সেটিকে আমি বলছি ‘অন্য ঐকমত্য’। এর জন্য গণভোটের দরকার নেই। অন্য ঐকমত্য হলো, রাজনৈতিক দলগুলোকে গণ ঘোষণার মাধ্যমে বলতে হবে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলো কী কী করবে। এ বিষয়ে তাদের সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার থাকা দরকার। নির্বাচনী ইশতেহারে সেটা থাকতে পারে। তাহলে আমরা বলতে পারব, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে ঐকমত্য যেমন হয়েছে, তেমনটি ‘অন্য ঐকমত্যও’ হয়েছে।
মানুষ যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান করেছে, সেটার আকাঙ্ক্ষাকে কোনোভাবেই বিসর্জন দেওয়া যাবে না। এটা আমাদের অন্যতম একটি জাতীয় অর্জন। কাগজে-কলমে যা-ই হোক, আইন হোক, ধারা যুক্ত হোক, সেটা ছুড়ে ফেলে দেওয়া যায়। এর অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। কিন্তু যেটা ছুড়ে ফেলা যায় না, সেটা হলো মানুষের আকাঙ্ক্ষা, পরিবর্তনের প্রত্যাশা। জনপরিসরে সুস্পষ্ট অঙ্গীকারে শামিল হলে সেখান থেকে ফিরে যাওয়াটা কঠিন।
হোসেন জিল্লুর রহমান: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান
[মতামত লেখকের নিজস্ব]