বাংলাদেশে শেখ হাসিনার রায় ও আসন্ন গণভোটে দক্ষিণ এশিয়ায় পালাবদলের ইঙ্গিত
Published: 20th, November 2025 GMT
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁকে এ দণ্ড দেওয়া হয়। আদালত এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের ওপর চালানো সহিংস দমন-পীড়নের জন্য দায়ী। জাতিসংঘের হিসাবে, ওই ঘটনায় ‘প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন’ নিহত হয়ে থাকতে পারেন। তবে শেখ হাসিনা তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ‘বর্ষা বিপ্লব’ নামে পরিচিত ওই জেন–জি বিক্ষোভে হাসিনা সরকারের পতন হয় এবং তাঁকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।
এ রায় কেবলই একটি রাজনৈতিক পরিবারের পতনকেই সামনে আনেনি; বরং বাংলাদেশের আসন্ন গণভোট ও নির্বাচন মিলে এটি দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির একটি ফাটলের ইঙ্গিত দেয় এবং একই সঙ্গে সম্ভাব্য আরও বহুকেন্দ্রিক আঞ্চলিক ব্যবস্থার দ্বার উন্মোচন করতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ ভারতের ওপর কম নির্ভরশীল থাকবে। পালাবদলের এ মুহূর্ত বাংলাদেশকে একটি প্রান্তিক শক্তি থেকে দ্বিধাবিভক্ত অঞ্চলটিতে স্থিতিশীল একটি শক্তি হিসেবে রূপান্তর করতে পারে।
নতুন কুশীলব, নতুন মেরুকরণ
‘বর্ষা বিপ্লব’ শুধু শেখ হাসিনার সরকারের পতনই ঘটায়নি; বরং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর দল আওয়ামী লীগ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) যে কয়েক দশকের পুরোনো দ্বিদলীয় আধিপত্য ছিল, সেটাও ভেঙে দিয়েছে। বিপ্লবের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের এই সময়ে এ সরকার নেতৃত্ব দিচ্ছে।
এ পরিবর্তন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে নতুন রাজনৈতিক কুশীলবদের জন্য জায়গা তৈরি করেছে। এদের মধ্যে রয়েছে ছাত্র-বিপ্লবীদের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং শেখ হাসিনার সরকার আমলে নিষিদ্ধ ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী। দলটি শিবির নামে পরিচিত নিজেদের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ পুনরুত্থান উপভোগ করছে।
নিজেদের একটি মধ্যপন্থী ও বহুত্ববাদী শক্তি হিসেবে বর্ণনা করা এনসিপি ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ও একটি নতুন সংবিধানের দাবি জানিয়েছে। সাংগঠনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও দলটির যে জনপ্রিয়তা, তা মূলত পরিবারন্ত্রিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির প্রতি গণ–অসন্তোষেরই বহিঃপ্রকাশ। জামায়াত নিজেদের একটি মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে নতুন করে পরিচয় করাচ্ছে। দলটি অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কার এজেন্ডাকে প্রভাবিত করতে এবং সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) জন্য চাপ তৈরিতে এনসিপির সঙ্গে অভিন্ন অবস্থান নেয়।
সন্ত্রাস দমন আইনে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছে না। শেখ হাসিনা ও তাঁর দল তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা প্রত্যাখ্যান করে আসছে। গত রোববার শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা বাংলাদেশে নির্বাচন রুখে দিতে চাইবে এবং নির্বাচনের আগে সহিংসতারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে দলের নেতাদের মধ্যে অনৈক্য এবং দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে, যদিও দলটি এ বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স (শূন্য সহিষ্ণুতা)’ নীতির কথা বলে আসছে। কিছু বিশ্লেষণে বিএনপিকে নির্বাচনের সম্ভাব্য বিজয়ী দল হিসেবে দেখানো হলেও এখনই নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করা বেশ কঠিন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের বিজয় জামায়াতের জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করে, যদিও এই সাফল্য জাতীয় পর্যায়ে না–ও দেখা যেতে পারে।
জুলাই সনদ গণভোট
ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে গণভোটটি বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদলের মুহূর্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। জুলাই জাতীয় সনদ হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব করা সংস্কারের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। গত অক্টোবরে বিএনপি, জামায়াতসহ ২৫টি রাজনৈতিক দল এতে স্বাক্ষর করে।
এটি বিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে অভূতপূর্ব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে একত্র করেছে। সনদে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রীর জন্য মেয়াদসীমা, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব–ব্যবস্থা এবং ২০২৪ সালের গণ–আন্দোলনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। এতে নির্বাহী ক্ষমতার ওপর আরও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও সংসদীয় প্রভাব বা একচ্ছত্র আধিপত্য ঠেকানোর সুরক্ষাব্যবস্থাও যুক্ত করা হয়েছে।
কোন দলের কারা কারা জুলাই সনদে সই করল, তা দেখাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গত ১৭ অক্টোবর ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র প র জন ত ক ব যবস থ র জন য আওয় ম ব এনপ গণভ ট র একট
এছাড়াও পড়ুন:
ইসলাম প্রতিষ্ঠায় নারীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে: গোলাম পরওয়ার
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, “ইসলাম প্রতিষ্ঠায় পুরুষের পাশাপাশি নারীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। হজরত সুমাইয়া (রা.) ছিলেন মহিলা সাহাবিদের মধ্যে প্রথম শহীদ। আম্মাজান আয়েশাও (রা.) যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তাই ন্যায়, ইনসাফ ও কল্যাণকর রাষ্ট্র বিনির্মাণে নারীদের এগিয়ে আসতে হবে।”
বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) বিকেলে খুলনা-৫ আসনের আটরা-গিলাতলা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত ভোটার সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
আরো পড়ুন:
বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে কাফনের কাপড় পরে মিছিল
নির্বাচন উৎসবমুখর করতে সেনাবাহিনীর সহায়তা দরকার: প্রধান উপদেষ্টা
দলের নারী কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেছেন, প্রতিদিন সকাল-বিকেল গ্রুপ করে করে নারী অঙ্গনে দাঁড়িপাল্লা মার্কার দাওয়াত পৌঁছাতে হবে। পুরুষরা পুরুষদের কাছে, নারীরা নারীদের কাছে ইসলামী রাষ্ট্র গড়তে দাঁড়িপাল্লা মার্কার দাওয়াত দেবেন। তাহলে, আমরা সবাই মিলে ইসলামী রাষ্ট্র গড়তে পারব, ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র ও জীবনকে শান্তিময় করতে ইসলামী অনুশাসন প্রয়োজন। রাষ্ট্রে ইসলামী আইন চালু হলে সকল ধর্মের, বর্ণের, গোত্রের মানুষ সুখে-শান্তিতে থাকবে। ন্যায় ও ইনসাফের সাথে দেশ পরিচালিত হবে। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, দখলদারিত্ব থাকবে না। একমাত্র ইসলামই সকল মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। তাই, আগামী নির্বাচনে সারা দেশে ইসলামপন্থী আলেম-ওলামা ও আল্লাহভীরু লোকদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে রাষ্ট্রে সকল মানুষের সুখ ও শান্তি নিশ্চিত করতে হবে।
আটরা-গিলাতলা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি মো. শফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে সমাবেশে বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মুন্সী মিজানুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি প্রিন্সিপাল গাওসুল আযম হাদী, জেলা কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবু ইউসুফ মোল্যা। সেক্রেটারি মো. কামরুল গাজীর সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন খানজাহান আলী থানার আমির ডা. সৈয়দ হাসান মাহমুদ টিটো, সেক্রেটারি গাজী মোর্শেদ মামুন, জামায়াত নেতা মো. সুলতান মাহমুদ, মো. মোশারফ হোসেন, নূর ইসলাম গাজী, মো. রানা আকুঞ্জী প্রমুখ।
জান্নাতের টিকিট বিক্রি করা নিয়ে বিরোধীদের অপপ্রচারের জবাবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, জামায়াত কখনো মানুষের কাছে জান্নাতের টিকিট বিক্রি করে না। তবে, মহান আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য গাইডলাইন পবিত্র কুরআনুল কারিম পাঠিয়েছেন। কুরআনে আল্লাহ আমাদের জানিয়েছেন, কোন কাজগুলো করা উচিত আর কোনগুলো বর্জন করতে হবে। আমরা মানুষের কাছে সেই কথাগুলো তুলে ধরি। বিরোধীরা কুরআন না বোঝার কারণে কুরআন না পড়ার কারণে তারা এই কথাগুলো বলে থাকে।
এ সময় তিনি বিরোধীদের এ ধরনের অপপ্রচার থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।
বিভিন্ন স্থানে তালিম প্রোগ্রামে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাধার কথা তুলে ধরে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের ভাষায় কথা বলছে। আওয়ামী লীগ ইসলামী গণজাগরণ ঠেকাতে যেমন বিভিন্ন সময় জামায়াত-শিবিরকে কখনো রাজাকার, কখনো জঙ্গি ট্যাগ দিত, ঠিক তেমনই বিএনপি এখন সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তারা বর্তমানে মাহফিলে বাধা দেয়, মা-বোনদের তালিম প্রোগ্রামে বাধা দেয়। এটি করে তারা জামায়াতকে নয়, মূলত ইসলামকে বাধাগ্রস্ত করছে। এগুলো করে মূলত তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
এর আগে সকালে সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পরওয়ার শিরোমণির ডাকাতিয়া গ্রামে গণসংযোগ করেন। এ সময় জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি অধ্যাপক মিয়া গোলাম কুদ্দুস, খানজাহান আলী থানার আমির ডা. সৈয়দ হাসান মাহমুদ টিটোসহ স্থানীয় জামায়াত নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। পরে রাতে সাজিয়াড়া শামসুল উলুম মাদ্রাসার ১০৫তম বার্ষিক মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন তিনি।
মিয়া গোলাম পরওয়ার আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “এবার সুযোগ এসেছে দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিন। যেখানে দাঁড়িপাল্লার প্রার্থী আছে, সেখানে দাঁড়িপাল্লার প্রার্থীকে; আর যেখানে ইসলামী জোটের প্রার্থী আছে, সেখানে জোটের প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে।”
একটি দলের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “ওই দলের মহাসচিব বলেছেন, ইসলামী শরিয়া আইন তারা কায়েম করবে না। তারা বলে, কুরআনে রাজনীতির কথা নেই। কিন্তু, কুরআনের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ছাড়া তা বোঝা সম্ভব নয়।”
তিনি আরো বলেন, “তারা বলে, মদিনার ইসলাম; কিন্তু মদিনার ইসলাম কি দাড়ি কেটে বা গান-বাজনার ইসলাম? যারা শরিয়া মানে না, তারা কীভাবে মদিনার ইসলামের অনুসারী দাবি করে?”
মিয়া গোলাম পরওয়ার জানান, ইসলামী জোটের লক্ষ্য হলো— কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠা করা। এর জন্য জনগণের সমর্থন প্রয়োজন।
ঢাকা/নূরুজ্জামান/রফিক