বছরে বিশ্বের এক–তৃতীয়াংশ নারী সঙ্গীর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন: ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদন
Published: 20th, November 2025 GMT
বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নারী জীবনে কোনো না কোনো সময়ে স্বামী বা ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর হাতে শারীরিক অথবা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন—সংখ্যার হিসাবে এর পরিমাণ প্রায় ৮৪ কোটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নতুন এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল বুধবার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সের প্রায় ৩১ কোটি ৬০ লাখ নারী ও মেয়েশিশু নিজের একজন ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর হাতে শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ১৬৮টি দেশের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে ডব্লিউএইচও এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে।এই সংখ্যা বিশ্বজুড়ে এই বয়সসীমার নারী ও মেয়েশিশুদের প্রায় ১১ শতাংশের সমান।
বুধবার প্রকাশিত এই প্রতিবেদনের সঙ্গে ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস একটি বিবৃতি দিয়েছেন।
বিবৃতিতে ডব্লিউএইচও মহাপরিচালক বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা মানবজাতির ওপর হওয়া প্রাচীনতম এবং সর্বব্যাপী অন্যায়। অথচ এখন পর্যন্ত এ নিয়ে সবচেয়ে কম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
গেব্রেয়াসুস আরও বলেন, ‘কোনো সমাজই নিজেকে ন্যায্য, নিরাপদ বা সুস্থ বলতে পারে না, যখন তার অর্ধেক জনসংখ্যা ভয়ের মধ্যে বাস করে। এই সহিংসতা শেষ করা কেবল নীতিগত বিষয় নয়; এটি মর্যাদা, সমতা এবং মানবাধিকার–সংক্রান্ত বিষয়। প্রতিটি পরিসংখ্যানের পেছনে এমন একজন নারী বা মেয়ে রয়েছেন, যাঁর জীবন চিরতরে বদলে গেছে।’
নারীর প্রতি সহিংসতা মানবজাতির ওপর হওয়া প্রাচীনতম এবং সর্বব্যাপী অন্যায়, অথচ এখন পর্যন্ত এ নিয়ে সবচেয়ে কম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস, ডব্লিউএইচও মহাপরিচালকআগামী ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিকভাবে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার অবসান দিবস পালিত হবে।
জাতিসংঘের ‘নারী ও মেয়েশিশুদের প্রতি সহিংসতা নির্মূলের আন্তর্জাতিক দিবস’–কে সামনে রেখে ডব্লিউএইচও এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।
২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ১৬৮টি দেশের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে ডব্লিউএইচও এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে।
ছবি: প্রথম আলো গ্রাফিকস.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কামাল সিদ্দিকী: আমলাতন্ত্রের ঘেরাটোপ ভাঙা একজন দেশপ্রেমী
নভেম্বর ৩, ২০২৫ হাসপাতালের কড়িকাঠ গুনছি আর প্রিয়জনদের মুখগুলো স্মরণ করার চেষ্টা করছি। মুঠোফোন নিদ্রায়। ফোন ধরা বারণ; তারপরও ফোনটা ধরলাম। পর্দায় নাম উঠেছে কাশেম কিশোর। কাশেম ছিলেন পথশিশু; বাড়ি থেকে অভিমান করে চলে এসে থাকতেন কমলাপুর রেলস্টেশনে। সেখান থেকে পুলিশ একদিন তাঁকে ধরে মানিকগঞ্জের এক ভবঘুরে কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়। একদিন রাতে সেখান থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়লে তাকে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারপর কোনো অজানা কারণে তাঁর ঠাঁই হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
কাশেম এখন একটি তৈরি পোশাক কারখানার সুপারভাইজার। আমি শুধু কাশেমের কান্না শুনি। কোনো কথা নেই, শুধুই কান্নার ধ্বনি। অনেক কষ্টে বুঝলাম, কামাল ভাই চলে গেছেন। এই বার্তাই কাশেম দিতে চাইছেন। কাশেমকে ধন্যবাদ। জানিনা সেদিন কাশেমের মতো কত মানুষ কেঁদেছেন। কামাল সিদ্দিকীর একক প্রচেষ্টায় দেশের সব কটি জেলখানা আর শিশুদের আটকে রাখা নানা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিশুর মুক্তি আর তাদের বাড়িতে স্বজনদের কাছে ফেরার ব্যবস্থা করেন ১৯৯২-৯৩ সালে। কাশেম ছিলেন তাঁদেরই একজন।
সত্তরের দশক থেকেই বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে অসংখ্য শিশুকে আটকে রাখা প্রায় রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। জেলে আটক দাগি আসামিদের (কখনো রাজবন্দীদের) ফুটফরমাশ আর শারীরিক আরাম দেওয়ার জন্য এসব শিশুকে ব্যবহার করা হতো। কারাগারের ভাষায় এদের ‘ফালতু’ বলে ডাকা হতো। এসবের বিরুদ্ধে দেশের শিশু অধিকার সংগঠনগুলো প্রকল্পভিত্তিক ‘মিনমিন’ আন্দোলন করছিল অনেক দিন থেকে; কিন্তু হালে পানি পাচ্ছিল না। একটা কাঁচা হাতে ডকুমেন্টারি বানিয়ে জনমত তৈরির কাজ চলছিল; সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের নাগাল পাওয়া যাচ্ছিল না।
অনেক আমলা আর রাজনীতিবিদ পথে আর জেলে থাকা শিশুদের ‘পাক্কা অপরাধী’ ভাবতেন। ফৌজদারি দায়বদ্ধতার (ক্রিমিনাল রেসপন্সিবিলিটি) বয়স ছিল মাত্র সাত বছর। মানে সাত বছরের একটি শিশুকেও খুনের মামলায় অভিযুক্ত করা যেত। শিশুদের পকেটে যেহেতু জন্মসনদ থাকে না, তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজনের চোখের হিসাবই ছিল শেষ কথা। কারাগার ছাড়াও রাস্তা থেকে ধরে শিশুদের বিভিন্ন ভবঘুরে কেন্দ্রে আটকে রাখা হতো হিসাব ছাড়া (দায়বদ্ধতা পড়ুন)। ভবঘুরে কেন্দ্রগুলো থেকে শিশুদের, বিশেষ করে মেয়েশিশুদের নিয়ে যেতে পারতেন সরকারি কর্মকর্তারা অভিভাবকত্বের বাহানায়। অভিভাকত্বের লেবাসে এসব শিশুদের স্রেফ গৃহকর্মী হিসেবে রাখা হতো। কেউ একাধিক শিশুকে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিলিবণ্টন করে খেদমত করতেন।
ঠিক হলো যেভাবেই হোক মুখ্য সচিব কামাল সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করে শেষ চেষ্টা করা হবে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তাঁর ১০ মিনিট সময় পাওয়া গেল। ২০০১ সালের কোনো এক সোমবার বিকেলে দেখা হলো। ১০ মিনিটের মিটিং চলল প্রায় ২ ঘণ্টা। অফিস ছুটির পরেও আমাদের কথা শেষ হয় না। আটক শিশুদের নিয়ে তৈরি সেই ১২ মিনিটের কাঁচা ডকুমেন্টারি দুবার দেখলেন। একপর্যায়ে তিনি কেঁদে ফেলে বললেন, ‘এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না।’ তখন মঙ্গলবার থাকত সরকারের ‘নো মিটিং ডে’। বললেন, ‘কাল সকালে আবার আসুন, আমি সচিবদের ডাকছি।’
বলাবাহুল্য মঙ্গলবারের সেই সভা সিনিয়র সচিবদের জন্য খুব সুখকর ছিল না। সেই সভায় ঠিক হয় আটক শিশুদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর শিশু অধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য একটি আন্তমন্ত্রণালয় স্থায়ী কমিটি গঠিত হবে। ২০০২ সালের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ সরকারের শিশু অধিকার–সংক্রান্ত আন্তমন্ত্রণালয় স্থায়ী কমিটি কাজ শুরু করে। এই কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনিই শিশুদের দায়িত্ব নেন। একে একে বিনা অপরাধে আটক শিশুরা মুক্তি পেতে থাকে। রাস্তা পাওয়া শিশুদের আটক করে ভবঘুরে কেন্দ্রে পাঠানো বন্ধ হয়। চালু হয় প্রতি মাসে আটক শিশুদের হালনাগাদ তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানোর রেওয়াজ।
সেই বছরের ১২ মার্চ কামাল সিদ্দিকী এশিয়ান কো-অপারেশন ডায়ালগের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় শিশুশ্রম–সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালার আয়োজন করেন। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি বাংলাদেশে শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ক্রমিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করতে জেনেভায় শিশু অধিকার–সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।
মার্চ ২০০৪ সাল থেকে কামাল সিদ্দিকী বাংলাদেশের জন্য স্বাধীন শিশু কমিশনারের অফিসের সাংগঠনিক সেট-আপের পরামর্শ দেওয়ার জন্য জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের লক্ষ্যে তিনি এই দেশগুলোর শিশু ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান অধ্যয়নের জন্য ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালে ফ্রান্স, নরওয়ে ও সুইডেনে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।
ফেব্রুয়ারি ২০০৫ সাল থেকে তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের শিশু অধিকারবিষয়ক কমিটির চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিন বছরের মধ্যে কারাগার থেকে বিপুলসংখ্যক শিশুর মুক্তি, মায়ের সঙ্গে থাকা শিশুদের জন্য কারাগারে নার্সারি স্থাপন এবং নিরাপদ আশ্রয়, অপরাধমূলক দায়বদ্ধতার বয়স বাড়ানো এবং শিশুদের জন্য সংশোধনকেন্দ্রকে উন্নয়নকেন্দ্রে রূপান্তর করা প্রভৃতি কাজ তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে প্রায় একক প্রচেষ্টায় সম্পন্ন করেন। তাঁর এসব উদ্যোগের কারণে ২০০৩ সালে একটি শিশু অধিকার মামলার যুগান্তকারী রায়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ তাঁকে শিশুদের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে উল্লেখ করে।
পাকিস্তান পার্লামেন্টে আলোচিত সেই তরুণকামাল সিদ্দিকীর নাম প্রথম শুনি ১৯৬৮ সালে। তখন পাকিস্তানের পার্লামেন্টে সারা দিনের আলোচনার একটি সারসংক্ষেপ রাতে রেডিওতে প্রচারিত হতো। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে পয়েন্ট অব অর্ডারে সীমান্ত গান্ধী আবদুল গাফফার খানের ছেলে ওয়ালি খান দাঁড়িয়ে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের এক তরুণকে লাহোরে চলমান নতুন সিএসপিদের প্রশিক্ষণে যোগদান করতে না দেওয়ার বিষয়টি স্পিকারের দৃষ্টিতে আনেন। সেদিন কোনো কারণে স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরী পার্লামেন্টে অনুপস্থিত থাকায় ডেপুটি স্পিকার আবদুল জব্বার খান (রাশেদ খান মেননের বাবা) পার্লামেন্ট পরিচালনা করছিলেন। ওয়ালি খানের পর একে একে দাঁড়িয়ে যান বালুচ নেতা মীর গাউস বকশ বিজেঞ্জো আর আবদুল সামাদ খান আচকাজি।
তখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত ব্যক্তিদের মধ্যে বিরোধী দলে ছিলেন ঢাকার আতাউর রহমান খান, ময়মনসিংহের আবুল মনসুর আহমদ (ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বাবা), আবদুল আউয়াল, রংপুরের মশিউর রহমান যাদু মিয়া; রাজশাহীর /মাজিবুর রাহমান চৌধুরী আর পাবনার আবদুল লতিফ বিশ্বাস।
সেদিন আইয়ুবপন্থী নুরুল আমিন, শাহ আজিজও পার্লামেন্টে উপস্থিত ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের এক তরুণের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা টেবিল চাপড়িয়ে পার্লামেন্ট গরম করছেন; কিন্তু বিষয়টি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মগজেই নেই! কাজটা আসলে মওলানা ভাসানী করেছিলেন। তিনি গাফফার খানকে তার (টেলিগ্রাফ) করেছিলেন তাঁর নিজের ভঙ্গিতে।
আকবর আলি খান লিখেছেন …‘কামাল সিদ্দিকী ভারতীয় বাহিনীর লুটতরাজের বর্ণনা দিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। এ সময় ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসারের কন্যা খুলনার মুক্তাঞ্চল দেখতে আসেন। কামাল সিদ্দিকী তাঁকে এই প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি দেন। এই প্রতিবেদন শেষ পর্যন্ত পি এন হাকসারের কাছে চলে যায়। এর ফলে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। …’কামাল সিদ্দিকী কেবল একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন তা নয়, তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন তিনি। ১৯৬২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যখন ভর্তি হন, তখন শিক্ষা আন্দোলনের ঢেউ দেশের আনাচকানাচে পৌঁছে গেছে। ছাত্র ইউনিয়ন তখন প্রধান নেতৃত্বে। তাঁর সহপাঠীরা বলেছেন ‘কামাল তখন আন্দোলন-সংগ্রামে থাকলেও পড়াশোনার বিষয়ে ছিল খুবই সিরিয়াস। ক্লাস ফাঁকি দিত না।’
১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়। ছাত্রদের সিদ্ধান্ত ছিল, সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে বর্জন করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদাধিকারবলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ছিলেন। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোনায়েম খানের আগমন উপলক্ষে ছাত্ররা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মোনায়েম খান অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হলে প্রতিরোধের মুখে পড়েন এবং এই নিয়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পুলিশের বাধা অতিক্রম করে সভামঞ্চের কাছাকাছি গিয়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। মোনায়েম খানকে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে বাধা প্রদানের ক্ষেত্রে কামাল সিদ্দিকীও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
ঘটনার পর কামাল সিদ্দিকীসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। দুজন ছাত্রের ডিগ্রি কেড়ে নেওয়া হয়। কামাল সিদ্দিকী হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। তরুণ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম তাঁর পক্ষে আদালতে দাঁড়ান। কোর্টের রায়ে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহৃত হলে কামাল সিদ্দিকী আবার ক্লাসরুমে ফিরে যান; কিন্তু ক্ষুব্ধ মোনায়েম খান মামলা ঝুলিয়ে রাখেন। এর মধ্যে ১৯৬৮ সালে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন; কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে প্রশাসন তাঁর নিয়োগ স্থগিত করে, অর্থাৎ তাঁকে আটকে রেখে যোগদান করতে দেওয়া হয়নি।
ওয়ালি খান বিষয়টি বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তান সরকারের অবিচারের একটা তাজা দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত করলেও তুখোড় বক্তা বালুচ নেতা বিজেঞ্জো ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে কেন বাঙালিরা এখন ছয় দফার চাইতে বাধ্য হচ্ছে সেই প্রসঙ্গ টেনে এনে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের বিখ্যাত উক্তি ‘এইস্য দিন নেহি রহেগা’ (এ রকম দিন বেশি দিন থাকবে না বা এই কঠিন দিনও একদিন শেষ হবে।) বলে তাঁর ভাষণ শেষ করেন। (অবশ্য তার অনেক আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিচিত্র’ নামক গানে ‘এমন দিন আর থাকবে না’ কথাটি বলে রেখেছিলেন। বিজেঞ্জোর শেষ কথা ছিল ‘এ রকম চলতে থাকলে বাঙালিরা তাদের নেতা ভাসানীর মতো আমাদের আসসালামু অলাইকুম জানাতে বাধ্য হবে। পাকিস্তান থাকবে না’।
স্পিকার অবশ্য শেষের কথাগুলো পার্লামেন্টের বিবরণ থেকে এক্সপাঞ্জ (বাদ) দেওয়ার রুল দেন; কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। পার্লামেন্টের বিরোধী আর স্বতন্ত্র বেঞ্চের সবাই উঠে দাঁড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণটির প্রতি ‘ইনসাফ’–এর দাবি জানাতে থাকেন।
স্পিকার পার্লামেন্ট এক ঘণ্টার জন্য মুলতবি করেন। মুলতবি সময়ে স্পিকার অচলাবস্থা কাটানোর সব পার্টির নেতাদের সঙ্গে বসেন। সিদ্ধান্ত হয় চলমান প্রশিক্ষণে যোগদানের জন্য স্পিকারের তখনই কর্তৃপক্ষকে টেলিফোনে অনুরোধ করবেন আর লিখিতভাবেও সে কথা জানিয়ে দেবেন। নচেৎ তাঁরা সদলবলে ওয়াকআউট করবেন। অধিবেশনে আর কখনই ফেরত যাবেন না।
তার পরের ঘটনা আমাদের সবার জানা—কামাল সিদ্দিকীকে বিশেষ ব্যবস্থায় তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি প্রশিক্ষণে যোগ দেন। পার্লামেন্টকে সেটি অবহিত করা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানে পোস্টিং দেওয়া হয়। একাত্তরে তিনি ছিলেন নড়াইলের এসডিও বা মহকুমা প্রশাসক। (নড়াইল তখন জেলা নয়, অধুনালুপ্ত মহকুমা)।
শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ’৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি নড়াইলে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। নড়াইলের মুষ্টিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পর ৬ এপ্রিল সকাল আটটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি জেট বিমান থেকে নড়াইল আদালত চত্বর, ডাকবাংলো এবং এসডিওর বাসার ওপর প্রায় ১৫-২০টি বোমা নিক্ষেপ করা হয়। ওই বোমাবর্ষণের ঘটনায় সদ্য নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য এবং নড়াইল মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট খন্দকার আবদুল হাফিজুর রহমান পিঠ, পা ও মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন।
এসডিওর বাসার পাশেই ছিল তার অফিস। ঘটনার সময় তিনি অফিস থেকে হেঁটে পাশের চিত্রা নদীর ঘাটের দিকে আসছিলেন। পাকিস্তানিদের বিমান হামলায় কয়েকজন আহত হন। বোমাবর্ষণে আদালত চত্বরের বড় বটগাছ, কাঞ্চিরাম ও ট্যাংরা কুণ্ডুর মিষ্টির দোকানসহ তিনটি দোকান আগুনে পুড়ে যায়। এ ছাড়া পাশের লঞ্চঘাটে মুক্তিযুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত একটি লঞ্চ, নড়াইল ফেরিঘাটের ফেরি ডুবে যায়।
এসডিওর বাসভবন কেন টার্গেট করা হয়েছিল?একাত্তরের ২৫ মার্চের পর মুক্ত অনেক জেলা মহকুমা শহরে দখলদার বাহিনীর বিমান থেকে গোলাগুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটলেও সরকারি বাসভবন বিশেষ করে জেলা ও মহকুমার প্রধান নির্বাহীর বাসভবনে বা দপ্তরে ইচ্ছাকৃত আক্রমণের ঘটনা ছিল বিরল।
কামাল সিদ্দিকীকে টার্গেট করার একটা প্রেক্ষাপট ছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যখন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম উত্তেজনাপূর্ণ ছিল, তখন ড. কামাল সিদ্দিকী প্রতিবাদ ও প্রতীকী অবস্থান হিসেবে তার সরকারি গাড়িতে কালো পতাকা লাগিয়ে যাতায়াত করতেন।
সেই সময় দেশের সংকটময় পরিস্থিতি নিয়ে আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকেরা ডিসি, এসডিও, এসপিদের নিয়ে আইনশৃঙ্খলা পর্যালোচনা সভার আয়োজন করে। যশোর সেনানিবাসে আয়োজিত এ রকম এক সভায় তিনি কালো পতাকা লাগানো গাড়ি নিয়েই যোগদান করতে যান। কালো পতাকা নামিয়ে সেনানিবাসে তাঁকে প্রবেশ করতে বলা হলে তিনি পতাকা না নামিয়ে কর্মস্থলে ফিরে যান। সামরিক জান্তারা এর প্রতিশোধ নিতেই তাঁর বাসভবন আক্রমণ করে।
যুদ্ধের ক্যাম্প থেকে ফিরিয়ে আনাএকাত্তরের ১২ এপ্রিল তিনি কলকাতায় পৌঁছান। কলকাতায় গিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল সেখানে বসে থাকলে যুদ্ধ হারিয়ে যাবে। তিনি চলে যান ঘোজাডাঙ্গা-সাতক্ষীরা সীমান্ত ক্যাম্পে। সেখান থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেই ক্যাম্পের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন।
জুন মাসে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী ঘোজাডাঙ্গা মুক্তিযুদ্ধ ঘাঁটি পরিদর্শনে এসে একরকম জোর করে তাঁকে আবার কলকাতা নিয়ে যান। জেনারেল ওসমানী তাঁকে বলেন কলকাতার যুদ্ধটা ছোট নয় ওখানে তোমাকে বেশি দরকার। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপসচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। ওসমানীর সেদিনের জবরদস্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।
পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে যাওয়ার ‘মোস্তাক ষড়যন্ত্র’ কামাল সিদ্দিকীই প্রথম ধরে ফেলেন এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে ব্যক্তিগতভাবে অবহিত করেন। কাজটা খুব সহজ ছিল না। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে এই লেখককে তিনি বলেছিলেন ‘মোশতাকের ষড়যন্ত্র টের পাওয়ার পর আমার ঘুম হারাম হয়ে যায়, একদিন আমার রুমমেট আকবর ভাই আমার অস্থিরতা টের পেয়ে মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে জানতে চান কী হয়েছে তোমার? বারবার পানি খাচ্ছ, টয়লেটে যাচ্ছ! কোনো খারাপ খবর?’
সব শুনে আকবর ভাই বললেন ‘আমলাতন্ত্রের চোখে বসের বিষয়ে ঊর্ধ্বতনের কাছে অভিযোগ সাব–অর্ডিনেশন।’ আমি (কামাল সিদ্দিকী) বললাম ‘কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আমাকে দায়িত্ব দেওয়ার সময় বলেছিলেন, দেশের স্বার্থে আমি যেন বিবেক অনুযায়ী দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি দায়বদ্ধ থাকি। এখন যে ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, এ যদি আমি প্রধানমন্ত্রীকে না জানাই, তাহলে দেশের চরম ক্ষতি হয়ে যাবে—ক্ষতি হবে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের।’
পরের দিন ভোরেই কামাল সিদ্দিকী ছুটে যান তাজউদ্দীনের কাছে। দেখেন, প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আলো জ্বলছে। তিনি খালি গায়ে তোয়ালে পরে বাথরুমে নিজ হাতে কাপড় পরিষ্কার করছেন। বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়েই কামাল সিদ্দিকী তাঁকে বিস্তারিত জানান, জাতিসংঘে গিয়ে খন্দকার মোশতাক কনফেডারেশনের ঘোষণা দেবেন এবং সে ঘোষণার খসড়ায় তৈরি হয়ে গেছে। কামাল সিদ্দিকী দেখলেন, তাঁর কথা শুনে প্রধানমন্ত্রীর মুখের কোনো পরিবর্তন হলো না। প্রধানমন্ত্রীকে সালাম দিয়ে কামাল সিদ্দিকী বের হয়ে আসেন। খন্দকার মোশতাকের জাতিসংঘে যাওয়া বন্ধ হয়। এরপর থেকে খন্দকার মোশতাককে একধরনের নজরদারিতে রাখা হয়। অনেক ঝুঁকি নিয়ে খোন্দকার মোশতাকের পাকিস্তানি ঘোড়ার লাগাম তিনি টেনে না ধরলে আমার মুক্তিযুদ্ধ অন্য এক খাদে পড়ে যেত।
নতুন যুদ্ধের ভূমিকায়দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর কামাল সিদ্দিকীকে খুলনার জেলা প্রশাসক করা হয়। এই প্রসঙ্গে আকবর আলি খান লিখেছেন ‘শত্রুমুক্ত দেশে সরকারের প্রথম দায়িত্ব ছিল প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসন গড়ে তোলা। প্রথম জেলা প্রশাসক মনোনীত হন ওয়ালিউল ইসলাম। যশোর সেনানিবাস পতনের পর ৯ ডিসেম্বর পূর্বাহ্ণে যশোর কালেক্টরেটে ওয়ালিউল ইসলামের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জেলা প্রশাসনের যাত্রা শুরু হয়। এরপর কয়েক দিনের মধ্যেই সরকার ১৭টি জেলায় জেলা প্রশাসক নিয়োগ করে। এ সময় আমার যেসব সহকর্মী ডেপুটি কমিশনার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই জেলা প্রশাসনে টিকতে পারেননি। তাঁরা সচিবালয়ে ফিরে আসেন।’
কামাল সিদ্দিকী দায়িত্বটাকে আরেকটা যুদ্ধ হিসেবে নেন। সেই যুদ্ধ নিঃসন্দেহে অনেক কঠিন ছিল। মব তৈরি করে একের পর এক কলকারখানা বাড়িঘর লুটপাট হচ্ছিল। সঙ্গে ছিল অবাঙালি নারী নির্যাতনের অভিযোগ। প্লাটিনাম জুটমিলের প্রধান নির্বাহীর স্ত্রী ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক, তিনি একদিন জেলা প্রশাসকের দপ্তরে এসে নালিশ দিলেন। কারখানার মালামালের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িটিও লুণ্ঠনকারীরা নিয়ে গেছে। সব চলছে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায়। সেই সাথে মিত্রবাহিনীর লুটতারাজ।
আকবর আলি খান লিখেছেন …‘কামাল সিদ্দিকী ভারতীয় বাহিনীর লুটতরাজের বর্ণনা দিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। এ সময় ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসারের কন্যা খুলনার মুক্তাঞ্চল দেখতে আসেন। কামাল সিদ্দিকী তাঁকে এই প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি দেন। এই প্রতিবেদন শেষ পর্যন্ত পি এন হাকসারের কাছে চলে যায়। এর ফলে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। …’
কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী আর আসবেন না; কিন্তু দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করা যায়—তার একটি উদাহরণ হয়ে থাকবেন তিনি। আমাদের আমলাতন্ত্র যদি সেটি আমলে নিয়ে চর্চা করে, তাহলে স্বাধীনতা অর্থবহ হবে। মেধার সাথে বিবেক আর দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার চর্চা না থাকলে কিছুই টেকসই হবে না টিকবে না।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক
[email protected]