‘শানু ভাই।’

‘আন্নে কই?’

‘আঁই গুলি খাইছি, গুলি খাইছি, গুলি খাইছি।’

‘ইন্নালিল্লাহ!’

‘আঁই গুলি খাইছি, গুলি খাইছি।’

‘কোনঠে আপনি। আপনে আছেন কই?’

মোবাইল ফোনের অন্য প্রান্তে এবার কান্না মেশানো কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে আসে, ‘ও শানু ভাই।’

‘আন্নে কই, আন্নে কই? আন্নে কোন জাগায় আছেন?’

ওইপার থেকে আর কোনো জবাব আসে না। কণ্ঠ নিভে গেছে। নীরবতার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ।

যে দুটি চরিত্রের মধ্যে ওপরের সংলাপগুলো বিনিময় হলো, তাঁদের নাম রিটনউদ্দীন আর আলী সামাদ শানু। তবে এটি কোনো চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য নয়, সত্যিকারের নিষ্করুণ মৃত্যুনাট্য। ঘটনার দৃশ্যপট গত বছরের ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী মহাসড়ক। পুলিশ তখন মরিয়া হিংস্রতায় নিরস্ত্র জনতাকে এলোপাতাড়ি গুলি করে মারছে। তাদের ছোঁড়া তিনটি বুলেট রিটনের শরীর ভেদ করে চলেও গেছে। বাঁচার আর্তি জানিয়ে রিটন ফোন করেছেন তাঁর সহকর্মী শানুকে। গুলি খাওয়া আর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার মাঝখানে এটাই তাঁর জীবনের শেষ কথা।

গত বছরের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের সময় শেখ হাসিনার রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক বাহিনীর লোক যে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায়, সেটি শুধু বড় একটি সংখ্যা নয়। সেই বিমূর্ত সংখ্যার মধ্যে লুকিয়ে আছে রিটনের মতো অজস্র মানুষের আলাদা আলাদা মর্মান্তিক ঘটনা।

রিটনের এই কাহিনিটি আমরা তুলে ধরলাম ‘রক্তাক্ত মহাসড়ক: যাত্রাবাড়ী হত্যাকাণ্ড’ নামে প্রথম আলোর তৈরি করা একটি প্রামাণ্যচিত্র থেকে। প্রামাণ্যচিত্রটি তৈরি করতে আমাদের সহকর্মী আব্দুল্লাহ আল হোসাইনকে যাত্রাবাড়ীর সেই ঘটনার শত শত ফুটেজ সংগ্রহ করতে হয়েছে—আন্দোলনকারীদের ফুটেজ, সিসিটিভির ফুটেজ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ফুটেজ। সেগুলো পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে ৩৫ মিনিটের যে প্রামাণ্যচিত্রটি তৈরি হয়েছে, তাতে ধারণ করা আছে রিটনের মতো হত্যার শিকার একেকটি মানুষের করুণ কাহিনি। এভাবে প্রামাণ্যচিত্রটি হয়ে উঠেছে সেদিনের হত্যাযজ্ঞের মহাফেজখানাতুল্য এক নথির সংগ্রহ।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পরে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আব্দুল্লাহ আল হোসাইন তৈরি করেছেন আরও দুটো প্রামাণ্যচিত্র—একটি সাভারের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে ‘সাভার গণহত্যা: হাসিনা পালানোর পরের ৬ ঘণ্টা’, আরেকটি আন্দোলনের সময় মোহাম্মদপুরে আওয়ামী লীগের কর্মীদের চালানো হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘আন্দোলনে মোহাম্মদপুরে আওয়ামী লীগ নেতাদের তাণ্ডব’। এই সব কটি প্রামাণ্যচিত্র দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত—প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে এবং ইউটিউবে।

ঘটনা যখন ঘটছে

এই তিনটি প্রামাণ্যচিত্রের বাইরেও জুলাই গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে প্রথম আলো বেশ কিছু অর্থবহ কর্তব্য পালন করেছে। অবশ্য এটা বিচ্ছিন্ন কিছু ছিল না, ছিল অভ্যুত্থানের সময় প্রথম আলোর দায়বদ্ধ সাংবাদিকতার এক ধারাবাহিক কার্যক্রম। গত বছরের জুলাই–আগস্ট মাসে দেশ যখন হয়ে উঠেছিল যুদ্ধক্ষেত্রের মতো, গণমাধ্যমের ওপর চেপে বসেছিল বিগত স্বৈরাচারী সরকারের দুর্বিষহ চাপ, সেই কঠিন সময়ে প্রথম আলো হয়ে উঠেছিল পাঠকের যথাযথ সংবাদের এক ভরসার স্থান।

১৬ জুলাই থেকে সরকারের বাহিনী ও সন্ত্রাসীদের গুলিতে আন্দোলনরত সাধারণ মানুষের প্রাণহানির ঘটনা শুরু হয়। প্রথম আলো এ সময়ে আন্দোলনের তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়—প্রতিটি মৃত্যুর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নিয়মিত প্রকাশ করে যাওয়া, মারণাস্ত্রের আঘাতে অঙ্গহীন মানুষের তথ্য নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন করা, নিহত ব্যক্তিদের নিয়ে মানবিক প্রতিবেদন করা, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে নির্যাতন–নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করা ইত্যাদি। ইতিহাসের সেই কঠিন সময়ে প্রথম আলো সাহস ও যত্নের সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করে গেছে।

প্রথম আলো অনলাইনে সে সময়ের ৩৫ কোটি পেজ ভিউর সংখ্যাই বলে দেয় পাঠকের আস্থা কোন উচ্চতায় উঠেছিল। ১৮ জুলাই সরকার ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট করে দেয়; বন্ধ করে দেয় সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। পাঠক তখন বস্তুনিষ্ঠ খবরের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায়। পত্রিকার প্রচারসংখ্যা বেড়ে যায় অতিরিক্ত আরও দেড় লাখ।

সত্যনিষ্ঠ ও সাহসী সাংবাদিকতা প্রথম আলোকে এনে দেয় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। গণমাধ্যমের প্রকাশকদের বৃহত্তম সংগঠন ওয়ান-ইফরার কাছ থেকে এ বছর প্রথম আলো পায় ‘আগামী প্রজন্মের পাঠক সম্পৃক্ততা’ ক্যাটাগরিতে বিশ্বসেরার পুরস্কার। গণমাধ্যমের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সংগঠন ইনমার বিচারেও ‘পাঠক সম্পৃক্ততা বাড়াতে সেরা ধারণা’ ক্যাটাগরিতে সারা বিশ্বে প্রথম হয়।

আন্দোলনের অন্দরে

বিপুল গণরোষের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। ছাত্র–জনতার অপরিসীম ত্যাগ অবশেষে সফল হয়। এই পটভূমিতে প্রথম আলো জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের তথ্য সংগ্রহ করার, গণ–অভ্যুত্থানকে বোঝার এবং রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনৈতিক দল নিয়ে মতামত ও নাগরিক বিতর্ক আয়োজনের উদ্যোগ নেয়।

‘বিদ্রোহে–বিপ্লবে’ নামে সে বছরেরই ২২ আগস্ট প্রকাশিত হয় জুলাই গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে প্রথম আলোর প্রথম ক্রোড়পত্র। অভ্যুত্থান নিয়ে সেটিই ছিল প্রথম কোনো ক্রোড়পত্র।

গত বছরের ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী থেকে শুরু হয় গণ–অভ্যুত্থানকে বোঝার এবং মানুষের মধ্যে এর মর্ম ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নেওয়া হয় একাধিক উদ্যোগ। ২০২৪ সালের ৪ থেকে ৭ নভেম্বর পরপর চার দিন প্রকাশিত হয় অভ্যুত্থান নিয়ে চারটি ক্রোড়পত্র এবং ‘মুক্ত করো ভয়’ শিরোনামে আন্দোলনের ছবির অ্যালবাম। দেশের বিশিষ্ট শিল্পী শহীদ কবির প্রথম আলোর অনুরোধে শহীদ আবু সাঈদকে নিয়ে ছাপচিত্র রচনা করে দেন। প্রথম আলো সেটি উপহার হিসেবে তুলে দেয় দেশের বিশিষ্ট মানুষদের হাতে।

জাগ্রত জুলাই

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে প্রথম আলোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রথমা প্রকাশন এ পর্যন্ত বের করেছে সাতটি বই। প্রতিটি বইয়ের বিষয় ও উদ্দেশ্য আলাদা। এর মধ্যে আলতাফ পারভেজের লাল জুলাই: চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পথপরিক্রমা, সাজ্জাদ শরিফের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সাক্ষ্য এবং আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু গণ–অভ্যুত্থানের তথ্য, ঘটনা, উপাদান ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিবরণ। এই অভ্যুত্থান জনগণের মধ্যে যে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ ঘটিয়েছে, তা নজরুল ইসলামের স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধের পথ: রাষ্ট্র সংস্কার ও সংবিধান সংশোধন আর আল মাসুদ হাসানউজ্জামানের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান: নতুন পথে বাংলাদেশ বই দুটোর বিষয়বস্তু। আলী রীয়াজের আমিই রাষ্ট্র: বাংলাদেশে ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র ও আসিফ নজরুলের শেখ হাসিনার পতনকাল মূলত শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার পথরেখার পর্যালোচনা।

এটা অনুমান করা যায় যে ভবিষ্যতে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের ইতিহাস রচনায় এই বইগুলোর গুরুত্ব অপরিহার্য হবে।

এ বছরের ২৪ থেকে ৩১ জানুয়ারি ‘জুলাই–জাগরণ’ শিরোনামে প্রথম আলো শিল্পকলা একাডেমিতে একটি বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। এতে প্রদর্শবস্তু হিসেবে ছিল অভ্যুত্থানের সময় প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখা ও ছবি, প্রথমা প্রকাশিত বই, অভ্যুত্থান নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র, শহীদ কবিরের শিল্পকর্ম এবং ছবির অ্যালবাম ‘মুক্ত করো ভয়’। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের বিভিন্ন স্মারক এবং সে সময়ে আত্মদান করা শহীদদের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি এ প্রদর্শনীর দর্শকদের আবেগময় করে তোলে।

শিল্পকলা একাডেমিতে সেই প্রদর্শনী জানুয়ারিতে শেষ হলেও প্রথম আলো সেটিকে চিরস্থায়ী করে রেখেছে একটি ওয়েবসাইটে। ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থান ২০২৪’ (july36.

prothomalo. com) নামে ওয়েবসাইটে গিয়ে এখনো যে কেউ ভার্চ্যুয়াল ট্যুর দিয়ে সেই প্রদর্শনীটি দেখে আসতে পারেন। সেখানে দেখে আসতে পারেন সেই আন্দোলনে প্রথম আলোর সাহসী সাংবাদিকতার নজির হিসেবে রাখা সব প্রতিবেদন আর ছবি; বস্তুত ওপরে যা কিছুর আলোচনা করেছি, প্রায় তার সবই। জুলাই গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে প্রথম আলোর যাবতীয় কর্মকাণ্ড এই ওয়েবসাইটে উপস্থাপন করা হয়েছে। 

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান যেন কষ্টিপাথরের মতো আমাদের সাংবাদিকতার দায়দায়িত্বের পরীক্ষা নিতে এসেছিল। আমাদের কর্ম ও কীর্তি ইতিহাসের কাছে গচ্ছিত রইল। 

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ছ ত র জনত র প রথম আল র গত বছর র ব দ কত র প রক শ ত ন র সময় র প রথম র টন র সরক র আগস ট

এছাড়াও পড়ুন:

প্রথম নারী জেলা প্রশাসক পেল ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলমকে বদলি করা হয়েছে। পাশাপাশি নড়াইলের জেলা প্রশাসক শারমিন আক্তারকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পৃথক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাঁদের বদলির আদেশ দেওয়া হয়।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলটি আগে কুমিল্লা জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে ১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জেলা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার চার দশকে প্রথম নারী জেলা প্রশাসক পেল ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আমিনুল ইসলামের সই করা এক প্রজ্ঞাপনে শারমিন আক্তারকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক পদে বদলির আদেশ দেওয়া হয়। তিনি বিসিএস (প্রশাসন) ২৫ ব্যাচের কর্মকর্তা। ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি নড়াইলের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগ দেন।

অন্যদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব জেতী প্রুর সই করা আরেকটি প্রজ্ঞাপনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক দিদারুল আলমকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে বদলি করা হয়েছে। তিনি বিসিএস (প্রশাসন) ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগ দেন।

এ বিষয়ে জেলার সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি আব্দুন নূর বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই প্রথম কোনো নারীকে জেলা প্রশাসক পদে পদায়ন করা হয়েছে। জনগণের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করছি।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গতবার আলোচনায় ছিলেন, এবার উধাও সাত্তার ভূঁইয়া ও আমিনীর ছেলে
  • জলবায়ু বিপর্যয়ে এক দশকে ২৫ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত
  • প্রথম নারী জেলা প্রশাসক পেল ব্রাহ্মণবাড়িয়া
  • তিস্তা আন্দোলনের মশালমিছিলও চালানো হচ্ছে আওয়ামী লীগের নামে
  • সালমান এফ রহমানসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র অনুমোদন সিআইডির
  • ইবিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিসের তথ্য-অনুসন্ধান নিয়ে সেমিনার
  • এসএ পোর্টের মুনাফা এক বছরে ৬৩ শতাংশ বেড়েছে
  • মেক্সিকোতে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ কতটা সত্য
  • বিএনপির ৩১ দফা: পাঠ ও বিবেচনা