পরাক্রমশালী ও কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর পারস্পরিক দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে; পত্রিকার খবর– ‘অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো ঐক্যের প্রতিশ্রুতি দিলেও, বিভেদে জড়িয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির মতবিরোধ প্রকাশ্যে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বেড়েছে তিক্ততা। সব ইস্যুতেই ছাত্রনেতৃত্বের বিপরীত অবস্থান বিএনপির (সমকাল, ১২ জানুয়ারি ২০২৫)।’ 
দমবন্ধ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থানের পাঁচ মাসের মধ্যে সক্রিয় রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বিরোধ কয়েকটি প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসছে। বিগত দেড় দশক আওয়ামী লীগ যেভাবে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তম্ভকে দলীয়করণ করে স্বেচ্ছাচারের মাধ্যমে দেশকে লুটপাটের আখড়া হিসেবে গড়ে তুলেছিল; সেই স্বৈরাচারী কুহক থেকে বের হওয়ার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবি ৫ আগস্টের পর প্রবলভাবেই ওঠে। চব্বিশের অভ্যুত্থানের প্রধান শক্তি শিক্ষার্থীসহ সব রাজনৈতিক পক্ষ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দাবি তোলে। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি তাদের ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচিতে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত তুলে ধরে। অন্যদিকে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা ৩ আগস্ট, ২০২৪ শেখ হাসিনার পতনের এক দফা দাবি তোলার দিনই ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ দাবি উত্থাপন করেন। 

অন্তর্বর্তী সরকার জনদাবিকে সামনে রেখে শুরুতে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। শিগগিরই কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। তারপর সরকার অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করে সংস্কারে অগ্রসর হবে। এদিকে আন্দোলনকারী ছাত্ররা জুলাই ঘোষণাপত্রের দাবিতে দেশজুড়ে লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি শুরু করে, শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার ৩০ ডিসেম্বর জানায়, সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জুলাই ঘোষণাপত্র দেবে। ১০ জানুয়ারি এ ঘোষণা থেকে সরে এসে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, সরকার ঘোষণাপত্র দেবে না, প্রক্রিয়াগত সহায়তা করছে মাত্র। ঘোষণাপত্র আসবে ঐকমত্যের ভিত্তিতে।
আমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, ৪ ডিসেম্বর সব রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড.

মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় ঐকমত্যের ঘোষণা দেন। ৬ সংস্কার কমিশনের প্রধানদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্য কমিটির প্রধান তিনি নিজেই। যখন জাতীয় ঐকমত্য নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা; সংস্কার কমিশন যখন প্রতিবেদন জমা দিতে তৎপর; তখনই জুলাই ঘোষণাপত্র উপস্থাপনের দাবির মধ্য দিয়ে বোঝা যায়– আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য বা বিভেদ রয়েছে। এমনকি শিক্ষার্থীদের এই দাবির সঙ্গে সরকারেরও মতপার্থক্য স্পষ্ট। কারণ, সংবিধান-নির্বাচনসহ ছয়টি বিষয়ে কমিশন যে সংস্কার প্রস্তাব দেবে, জুলাই ঘোষণাপত্রে সেসব নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে বৈকি।

অবশ্য ছাত্রনেতারা সরকারের কয়েকটি পদক্ষেপ সম্পর্কে এরই মধ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। বিশেষত রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন সম্পর্কে সরকার ও ছাত্রদের অবস্থান বিপরীতমুখী ছিল। অপরদিকে বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলের দাবি তোলে ছাত্রনেতৃত্ব। সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠনের মাধ্যমে বোঝা যায়, ছাত্রদের দাবির সঙ্গে সরকার একমত নয়। যদিও সরকার শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় তোলা বেশির ভাগ দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল; পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপে ছাত্রনেতৃত্বের মতামত যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে।  

২.
জুলাই-আগস্টে ৩৬ দিনের আন্দোলনেই শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়ে গেছে– এই ন্যারেটিভ যুক্তিসংগত কারণেই মানতে রাজি নয় বিএনপি। ইতোমধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্রে তাদের ১৬ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের স্বীকৃতি দাবি করেছে। নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপের দাবি জানিয়ে বিএনপি বারবারই বলছে, সংস্কার দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। যে ক’টি কার্যক্রম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন, সেগুলো দ্রুত সম্পন্ন করে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে তারা। 
ছাত্রনেতৃত্ব ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে নতুন দলের ঘোষণা আসতে পারে বলে পত্রিকান্তরে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংগঠিত হওয়ার অভিযোগ তুলে আসন্ন রাজনৈতিক দলটিকে ‘কিংস পার্টি’ অভিহিত করছেন অনেকে। জেলায়-উপজেলায় জাতীয় নাগরিক কমিটি বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি এত বিদ্যুৎ গতিতে গঠিত হচ্ছে যে, নেপথ্যের অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক জোগানের উৎস নিয়ে প্রশ্ন ওঠা যৌক্তিক। একদিকে দল গোছানো, অন্যদিকে বিএনপি-বিরোধিতা– ছাত্রনেতৃত্বের সাম্প্রতিক কাজকর্ম মোটাদাগে এভাবেই চিহ্নিত করা যায়। নির্বাচন প্রশ্নে পরস্পরের অবস্থান মেরুপ্রতিম দূরত্বে। 

৩.
গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের অমিত সাহস ও লড়াকু মনোভাব কোনো বাধাই মানেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর অগণতান্ত্রিক কাঠামো, পরিবারতন্ত্র, স্বজনতোষণ গণঅভ্যুত্থানের পরে যৌক্তিক প্রশ্নের মুখে পড়েছে। রাজনৈতিক দলে নতুন বন্দোবস্তের দাবি তাই ‘জনদাবি’ হিসেবেই গণ্য করতে হয়। তবে বাস্তব কিছু প্রশ্নের উত্তরও ছাত্রনেতৃত্বকে খুঁজতে হবে। যে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কথা বলে তারা জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছে; সেটি যতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক, তার চেয়ে বেশি ‘বিএনপি ঠেকাও’ কৌশল কিনা– সে প্রশ্ন উঠেছে। আওয়ামী লীগের গণহত্যা নিয়ে সোচ্চার চব্বিশের ছাত্রনেতৃত্ব একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে নিশ্চুপ কেন? মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলকে নিয়ে ছাত্রদের অনাপত্তির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে আড়ালের উদ্যোগও খুবই চোখে লাগে। পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যার নতুন বিন্যাস, চব্বিশকে একাত্তরের সঙ্গে তুলনা– এগুলো উচিত নয়। একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী শাসকবিরোধী লড়াইকে এক করে দেখা উদ্দেশ্যমূলক। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে নিজস্ব সম্পত্তি করে তুলেছেন বলে মুক্তিযুদ্ধের সত্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব ম্লান হয়নি; হতে পারে না।

চব্বিশের আন্দোলনেও আমরা মুক্তিযুদ্ধের আলো দেখেছি তরুণ-তরুণীদের চোখে-মুখে; মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী গানগুলোতে কণ্ঠ মিলিয়েই রাজপথে প্রতিরোধের ব্যূহ তৈরি করেছে কোটি মানুষ। বরং জুলাই-আগস্টে জামায়াত বা শিবিরের কোনো চিহ্ন ছিল না কোথাও। ৫ আগস্টের পরই কেবল দেখা যাচ্ছে, ছাত্রলীগ হিসেবে বছরের পর বছর দাপট ও আরাম-আয়েশের জীবন কাটিয়ে শিবির নেতারা আত্মপ্রকাশ করছে।
হায়, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ! আমরা কোদালকে কোদাল, সাদাকে সাদা, কালোকে কালো, শিবিরকে শিবির, জামায়াতকে জামায়াত, গণহত্যাকে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধকে যুদ্ধাপরাধ, গণঅভ্যুত্থানকে গণঅভ্যুত্থান বলব না? 

সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক যে মানুষগুলো আক্রান্ত হয়েছে, হচ্ছে– রাষ্ট্রকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান কখনই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পক্ষে ছিল না; এই অভ্যুত্থানের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষা জাতি-বর্ণ-ধর্ম-লিঙ্গ ও রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রত্যেক নাগরিক সমান মর্যাদায় বিবেচিত হবেন। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে তাই সবার আগে প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখতে হবে। 
৫ আগস্টের পর অস্থির পরিস্থিতির সুযোগে কোনো কোনো গোষ্ঠী মাজারে হামলা করছে। হামলা হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর, আক্রান্ত হয়েছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, নারীদের হেনস্তা করা হয়েছে। এসব ঘটনা দেশকে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো।

ছাত্রনেতৃত্বকে বুঝতে হবে– ছাত্রদের গড়ে উঠবার সময় নিতে হবে, দিতে হবে। অবশ্যই রাজনীতিতে তাদের অংশ থাকবে, তবে তা দখল করবার কিছু নেই। গণঅভ্যুত্থানের অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতায় স্নাত এই প্রজন্মের তরুণদের কোনো প্রলোভনে মাথা নোয়ানো চলবে না। জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ীরা দেশ পরিচালনা করবেন; এবং কেউই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়– এই সত্য মাথায় রেখে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। জনগণের কাঠগড়ায় যাওয়ার কোনো সংক্ষিপ্ত বা চোরা রাস্তা নেই।
 
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
[email protected]

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে পথে নেমেছি: নাহিদ ইসলাম

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছন, “আমরা বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি থেকে মুজিববাদ বিতাড়নের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। যারা মুজিববাদে বিশ্বাসী, তাদের বিচার করা হবে। আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে পথে নেমেছি।”

মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুরে ‘জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে আয়োজিত শহীদদের স্মরণে দোয়া মাহফিল ও গণঅভ্যুত্থান সমাবেশে এসব কথা বলেন।

গাজীপুরের স্থানীয় প্রশাসনের দিকে ইঙ্গিত করে নাহিদ ইসলাম বলেন, “গাজীপুরের সন্ত্রাসীরা মহড়া দিয়ে আমাদের ভয় দেখাতে চায়। কিন্তু, গোপালগঞ্জের মাটিতে যেমন বাধা টপকে গেছি, তেমনই গাজীপুরের মাটিতেও আমরা এসেছি। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় আমাদের পদযাত্রা চলবে।”

এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমসহ অন্য নেতারা তাদের বক্তব্যে ‘গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের’ স্মরণ করে উপস্থিত জনতাকে তাদের পাশে থাকার আহ্বান জানান।

দোয়া মাহফিলে এনসিপির স্থানীয় নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকে শুধু একনজর দেখতে এসেছিলেন নাহিদ ইসলাম ও সারজিস আলমকে।

দোয়া মাহফিল শেষে এনসিপি নেতারা গাজীপুর জেলার রাজবাড়ি মাঠে আয়োজিত পরবর্তী কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার উদ্দেশে রওনা হন।

ঢাকা/রফিক সরকার/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তিতুমীর কলেজে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী
  • হাসিনাকে ১০ বার ফাঁসিতে ঝোলালেও তার অপরাধ কমবে না: নাহিদ 
  • ফিলিস্তিনি জনগণকে গণহত্যা থেকে রক্ষায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আহ্বান
  • নরসিংদীতে আজ এনসিপির পদযাত্রা 
  • ফিলিস্তিনি জনগণকে গণহত্যা থেকে রক্ষা করতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আহ্বান
  • গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৬০ হাজার ছাড়াল
  • পাবিপ্রবিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে প্রজেক্ট শো
  • গণহত্যার বিচারের পর পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবি রেজাউল করীমের
  • নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে পথে নেমেছি: নাহিদ ইসলাম
  • শেখ হাসিনা যে অপরাধ করেছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও তা করে নাই: আসিফ নজরুল