ভ্যাট বাড়ানো অপরিণামদর্শী, প্রত্যাহার করুন
Published: 19th, January 2025 GMT
একশর বেশি পণ্যের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তকে সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত অভিহিত করে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। দলটি বলেছে, সিদ্ধান্তটি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে, বিশেষ করে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলবে, চাপ বাড়বে। এটা দেশের জনগণের জন্য কোনোভাবেই কল্যাণকর হবে না। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রাজস্ব সংগ্রহের জন্য অন্য উপায় বিবেচনা করার এবং সে অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ রয়েছে। পরোক্ষ কর না বাড়িয়ে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিন।
গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সরকারের এই নতুন করারোপের ফলে সাধারণ মানুষের ওপর কী প্রভাব পড়বে, তা তুলে ধরে তিনি বলেন, এর ফলে বর্তমানে প্রায় ১৩ শতাংশ ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাবে, পরিবারের সঞ্চয় কমবে এবং ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হারও বাড়বে। বর্তমানে নিম্নমুখী ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আছে, তা আরও কমবে। কর্মসংস্থান আরও কমে যাবে, বৃদ্ধি পাবে বেকারত্বের সংখ্যা।
শুধু তাই নয়, উচ্চমূল্যে জ্বালানি খরচ আরও বাড়বে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ বাড়বে, ব্যবসায়িক ব্যয় এবং শিল্পকারখানাগুলোতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে। ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা আরও হ্রাস পাবে, নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনধারণ আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। ব্যবসায়ে বিনিয়োগ কমবে, রপ্তানি প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হ্রাস পাবে। সর্বোপরি অর্থনীতি ও দেশের জনগণের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র বিবেচনায় এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়, নতুন করে ভ্যাট আরোপে স্বল্প আয়ের মানুষের দুর্দশা চরমভাবে বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। এই ভঙ্গুর অবস্থায় সহজ রাস্তায় হেঁটে ভ্যাটের হার তথা কর বাড়িয়ে সরকারের খরচ মেটানোর চেষ্টা করলে তা দেশের জনগণের জন্য কোনোভাবেই কল্যাণকর হবে না।
খরচ কমানোর তাগিদ
সরকারকে খরচ কমানোর তাগিদ দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকার তার উন্নয়ন বাজেট পুনর্বিবেচনা করে অপ্রয়োজনীয় ও আর্থিকভাবে অযৌক্তিক প্রকল্পগুলো বাদ দিলে প্রায় ২০ শতাংশ খরচ কমানো সম্ভব এবং এতে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে সহায়ক হবে। পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকার যদি স্থানীয় সরকারের বাজেট ও ভর্তুকি খাতে খরচ কমায় এবং সার্বিকভাবে পরিচালন ব্যয় ১০ শতাংশ কমাতে পারে, তাহলে ন্যূনতম ৫০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব। খরচ কমানোর মাধ্যমে বাজেটের ন্যূনতম ১ লাখ কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারে এবং ঘাটতি কমাতে পারে।
সরকারের সমন্বয়হীনতার অভাব
মির্জা ফখরুল বলেন, গত ডিসেম্বরে মানুষের আয় বেড়েছে ৮ ভাগ, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়েছে প্রায় ১১ ভাগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ১৪ আগস্ট আশ্বাস দিয়েছিলেন, ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সহনীয় হবে। কিন্তু বাস্তবে তা বরং বেড়েছে। অথচ প্রতিবেশী দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তার সুফল পেয়েছে। বাংলাদেশ যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি, বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। গোষ্ঠী স্বার্থ উপেক্ষা করতে পারছে না সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়াচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমাতে, অন্যদিকে সরকার কর বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। এই অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতার মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে।
মেগা প্রকল্পে আপাতত অর্থ বরাদ্দ বন্ধ রাখুন
মির্জা ফখরুল বলেন, অপ্রয়োজনীয় ও দুর্নীতিগ্রস্ত মেগা প্রজেক্টের বিপরীতে বরাদ্দকৃত অর্থ আপাতত বন্ধ রেখে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব। পতিত সরকার কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বর্তমান বাজেটে বরাদ্দ রেখেছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার পরিমাণ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নিজেদের স্বার্থে বছরের পর বছর এগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
শ্বেতপত্র কমিটির তদন্তে উঠে এসেছে, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশই লুটপাট করা হয়েছে। এ ছাড়া বাজেটের এমন অনেক খাত রয়েছে, যেমন অবকাঠামো খাতগুলোতে বরাদ্দকৃত বাজেটের অধিকাংশ অর্থই ব্যয় করা সম্ভব হয় না।
সংকট উত্তরণে অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম উচিত ছিল আওয়ামী লুটপাটের বাজেট বাদ দিয়ে একটা অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট ঘোষণা করা। কিন্তু সেটা না করে ওই লুটপাটের বাজেট বাস্তবায়ন করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটা খুব কঠিন কাজ।
মহাসচিব বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় আওয়ামী সরকারের ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি বাজেট ঘাটতি মোকাবিলা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার একদিকে খরচ কমিয়ে এবং অন্যদিকে আয় বাড়িয়ে, বর্তমান বাজেট ঘাটতির কিছুটা হলেও সমাধান করতে পারে এবং অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ পদক ষ প সরক র র র জন য ব যবস ফখর ল র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিবাদ ও প্রতিবেদকের বক্তব্য
‘কেনাকাটা আটকে দিয়েছিলেন নাহিদ, তোড়জোড় ফয়েজের’ শিরোনামে ২৭ জুলাই প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ‘৫-জি উপযোগীকরণে বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’ শিরোনামের প্রকল্প নিয়ে প্রতিবেদনটির প্রতিবাদ পাঠানো হয় ২৮ জুলাই।
প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, প্রকল্পটি নিয়ে করা প্রতিবেদনে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবকে জড়িয়ে যে ‘অভিযোগ ও ব্যাখ্যাহীন অনুমানমূলক’ মন্তব্য করা হয়েছে, তা পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর, একপক্ষীয় এবং ভিত্তিহীন। এতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করে ফয়েজ আহমদের মানহানি করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা সাংবাদিকতার নৈতিকতা বিরুদ্ধ।
টেলিযোগাযোগ বিভাগ প্রতিবাদপত্রে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছে। নিচে সেই সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো উল্লেখ করে প্রতিবেদকের বক্তব্য তুলে ধরা হলো।
আরও পড়ুনদুর্নীতির অভিযোগে কেনাকাটা আটকে দিয়েছিলেন নাহিদ, তোড়জোড় ফয়েজ আহমদের২৭ জুলাই ২০২৫এক. প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে ফয়েজ আহমদ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানাধীন একটি প্রকল্পের কার্যক্রম ‘এগিয়ে নিতে’ বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেছেন। বাস্তবতা হলো, বিটিসিএলের ৫–জি রেডিনেস প্রকল্পে ২৯০ কোটি টাকার ঋণপত্র (এলসি) পূর্ববর্তী সরকারের আমলে চূড়ান্ত হয়েছে। সেই টাকা ফেরত পাওয়ার আর কোনো বাস্তবসম্মত পথ নেই। এবং এসব যন্ত্রপাতি গ্রহণ না করলে সম্পূর্ণ অর্থই রাষ্ট্রের অপচয়ে পরিণত হবে।
টেলিযোগাযোগ বিভাগ আরও বলেছে, ফয়েজ আহমদ শুধু অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে, আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকে দুদকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করেছেন, যেখানে দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিও তিনি তুলে ধরেছেন। এটি দুর্নীতির ‘সহযোগিতা’ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষায় দায়িত্বশীল পদক্ষেপ।
প্রতিবেদকের বক্তব্য: প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে বিটিসিএল একটি বেসরকারি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দুদকের অনুসন্ধানাধীন প্রকল্পের বাকি কাজ এগিয়ে দিতে আইনগত মতামত নেয় (২৭ মার্চ, ২০২৫)। যদিও এ ধরনের আইনগত মতামত দেওয়ার জন্য বিটিসিএলের নিজস্ব আইনজীবী প্যানেল রয়েছে। বেসরকারি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রথমে ইতিবাচক মতামত দিলেও পরে (৮ এপ্রিল, ২০২৫) দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে পেরে সতর্ক করে দেয় যে তদন্তাধীন প্রকল্পে কেনাকাটার ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
দুদক চিঠি দিয়ে বিটিসিএলকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় (১৮ জুন, ২০২৫) যে তাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে ক্রয় আইনের লঙ্ঘন পাওয়া গেছে। তাই কেনাকাটার কার্যক্রম এগিয়ে নিলে আইনের ব্যত্যয় হবে এবং অর্থ ব্যয় আইনসিদ্ধ হবে না। দুদক তাদের মতামত জানানোর পরও ফয়েজ আহমদ আবার (২২ জুন) সংস্থাটির চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত মনোযোগ ও আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।
দুদকের নেতিবাচক মতামতের পরও কেনাকাটার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া টেলিযোগাযোগ বিভাগের (প্রতিবাদপত্রে উল্লেখ করা) দাবিকে সমর্থন করে না। ফয়েজ আহমদ দুদককে দ্রুত অনুসন্ধান শেষ করার অনুরোধ করতে পারতেন। অনুসন্ধান শেষ হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারতেন। বিটিসিএলের ওই প্রকল্পে দুদক গত ৯ জানুয়ারি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। এই অনুসন্ধান নিশ্চয়ই বছরের পর বছর চলবে না। কেনাকাটায় আর কিছুদিন দেরি হলে রাষ্ট্রের বিপুল ক্ষতি হয়ে যাবে, এ দাবি যৌক্তিক নয়।
‘দুর্নীতি সহায়ক’ বক্তব্যটি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের মতামত, প্রথম আলোর নয়।
দুই. প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, প্রয়োজনের চেয়ে ৫ গুণ সক্ষমতার যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নিয়ে অর্থ অপচয়ের চেষ্টার অভিযোগ অসত্য। প্রতিবাদপত্রে কারিগরি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলা হয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সমীক্ষায় বিভিন্ন ধরনের চাহিদা বিবেচনা করা হয়নি। সেসব বিবেচনায় নেওয়া হলে যন্ত্রপাতির সক্ষমতা ২৬ টিবিপিএস (টেরাবাইট পার সেকেন্ড) নয়, ১২৬ টিবিপিএসের প্রয়োজন হবে। ফাইভ-জি প্রকল্পে ১২৬ টেরাবাইট ক্ষমতা ‘রিডান্ডেন্ট’সহ নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এখানে কোনো যন্ত্রপাতি বা সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকার সুযোগ নেই।
প্রতিবাদপত্রে আরও বলা হয়, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল ২০২১ সালে প্রণীত বিটিসিএলের ফাইভ-জি প্রকল্পের একটি সমীক্ষায় মতামত দেয় যে শুধু আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ যদি ২৬ টিবিপিএস হয়, তাহলে সব মিলিয়ে ‘সিস্টেমের লাইন ক্যাপাসিটি’ ১২৬ টিবিপিএস প্রয়োজন হবে।
প্রতিবেদকের বক্তব্য: এই প্রকল্প নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়বস্তুই হলো ‘দরপত্রের শর্তানুযায়ী দরদাতাদের মূল্যায়ন না করে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি লঙ্ঘনপূর্বক শুধু প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্যের ভিত্তিতে তিনজন দরদাতাকেই কারিগরিভাবে রেসপনসিভ (যোগ্য) ঘোষণা করাসহ নন-রেসপনসিভ দরদাতাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সক্ষমতার পাঁচ গুণ বেশি যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ক্রয় করে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থের ক্ষতিসাধনের অভিযোগ।’ প্রথম আলোর প্রতিবেদনে এ ‘অভিযোগ’ই শুধু তুলে ধরা হয়েছে।
তা ছাড়া ২০৩০ সাল পর্যন্ত যে ২৬ টিবিপিএস চাহিদা নিরূপিত হয়েছিল, কিন্তু কেনা হচ্ছে ১২৬ টেরাবাইট—এটা ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত বিটিসিএলের ২১৩তম পর্ষদ সভার কার্যবিবরণীতে রয়েছে। পাশাপাশি তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে টেলিকম যন্ত্রপাতিও অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল। এ কারণে দীর্ঘ সময় যন্ত্রপাতির খুচরা যন্ত্রাংশ সহজলভ্য থাকে না। সাধারণভাবে টেলিকম যন্ত্রপাতির সর্বোচ্চ ব্যবহারযোগ্য আয়ুষ্কাল সাত বছর ধরা হয়। এই দরপত্রের ক্ষেত্রেও কারিগরি নির্দেশে যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল সাত বছর নির্ধারিত রয়েছে। তিনি সাবধান করেছিলেন যে ২০৪০ সাল পর্যন্ত চাহিদা পূরণে বেশি সক্ষমতার যন্ত্রপাতি চাওয়া হলেও বাস্তবে তা সচল থাকার নিশ্চয়তা ২০৩০ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি কেনা হবে, তার একটি বড় অংশই ২০৩০ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত হবে না এবং ব্যবহারের পূর্বেই মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।
বিগত সরকারের সময় অতিরিক্ত সক্ষমতার যন্ত্র কেনার অনুমোদন না দেওয়ার কারণেই আসাদুজ্জামানকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করা হয় এবং নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
তিন. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, দুদকের ওপর প্রভাব বিস্তারের দাবি তথ্যভিত্তিক নয়। দুদকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করা এবং চিঠি পাঠানো একটি প্রাতিষ্ঠানিক, নীতিগত এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার অংশ। এর মধ্য দিয়ে কোনোভাবেই সংস্থাটির ওপর ‘প্রভাব বিস্তার’ করা হয়নি; বরং তদন্তকাজ চলমান রাখতে এবং যন্ত্রপাতি গ্রহণের অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে একটি প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করা হয়েছে। তা ছাড়া বিশেষ সহকারীর দুদকে প্রেরিত আধা সরকারি পত্রের বক্তব্যকে প্রকল্পের কেনাকাটা করতে বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ বলে প্রচার করা হয়েছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। এটা অপসংবাদিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রতিবেদকের বক্তব্য: টেলিযোগাযোগ বিভাগের এক নম্বর পয়েন্টেও একই বিষয়ে বলা হয়েছে। সেখানেই প্রতিবেদকের বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। স্বচ্ছতার স্বার্থে টেলিযোগাযোগ বিভাগের এই বক্তব্য আবার উল্লেখ করা হলো। এখানে বলে রাখা দরকার, দুদকের স্পষ্ট মতামত পাওয়ার পরও চেয়ারম্যানকে দ্বিতীয় দফা চিঠি দেওয়া এবং অভিযোগকে ‘সত্য নয়’ বলে দাবি করা স্বাধীন সংস্থাটিকে প্রভাবিত করারই চেষ্টা। দুদকের মতামত যাতে কেনাকাটার পক্ষে পরিবর্তিত হয়, সে জন্যই ফয়েজ আহমদ দ্বিতীয় দফা আধা সরকারি পত্র দিয়েছিলেন এবং তিনি সেখানে দুদক চেয়ারম্যানের ‘ব্যক্তিগত মনোযোগ ও আন্তরিক সহযোগিতা’ কামনা করেন।
চার. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে কারখানা পরিদর্শন ও জিও (সরকারি আদেশ) জারির প্রেক্ষাপট চেপে রাখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকেই জিও অনুমোদন না হওয়ায় চীনে কারখানা পরিদর্শনের জন্য প্রতিনিধিদল পাঠানো সম্ভব হয়নি। সরকারের নির্ধারিত বিধি অনুযায়ী, যখন কারখানা পরিদর্শন সম্ভব নয়, তখন পণ্য সরবরাহ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জাহাজীকরণ করা যেতে পারে—বিষয়টি সচেতনভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
প্রতিবেদকের বক্তব্য: প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরপত্রের নিয়মানুযায়ী কারখানা পরিদর্শনে যাওয়ার কথা বিটিসিএলের চারজন প্রকৌশলীর। সেখানে নিয়মবহির্ভূতভাবে চারজনের জায়গায় পাঁচজনকে কারখানা পরিদর্শনে পাঠানোর জন্য জিও জারির অনুরোধ করা হয়। নতুন দলে বিটিসিএলের প্রকৌশলী রাখা হয় দুজন আর টেলিযোগাযোগ বিভাগের তিনজন। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টেলিযোগাযোগ বিভাগের কর্মকর্তাদের খুশি রাখতে তাঁদের চীন সফরে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। যদিও তাঁদের চীনে যাওয়া হয়নি। কারণ, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জিও (সরকারি আদেশ) জারির বিষয়টি আটকে দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে গত ৯ ডিসেম্বর বিদেশ ভ্রমণসংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করা হয়। সেখানে সাধারণভাবে বিদেশ ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে নির্দেশনার ৯ নম্বরে কেনাকাটা, জাহাজীকরণের আগে কারখানা পরিদর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কেবল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ প্রেরণের বিষয় বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ‘ফ্যাক্টরি একসেপটেন্সের’ জন্য বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ নয়। আরও উল্লেখ্য যে এই কেনাকাটার জন্য কারখানায় যন্ত্রপাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জিও গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর জারি করা হয়েছিল। কিন্তু পরে ২৪ সেপ্টেম্বর তা বাতিল করা হয়। ২৪ অক্টোবর (২০২৪) বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদ প্রকল্প নিয়ে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ বছরের ৬ জানুয়ারি সেই তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে পাঠাতে বলে।
পাঁচ. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ফয়েজ আহমদের চীন সফর নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। এতে চীন সফরের ব্যাখ্যা এবং এর সরকার অনুমোদিত বৈধতা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এটিকে ‘অপরিচিত সংস্থার অর্থে’ পরিচালিত বলে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ এটি ছিল সরকারি অনুমোদিত সফর, যার উদ্দেশ্য ছিল তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অর্জন ও অবকাঠামোগত সক্ষমতা পর্যালোচনা।
প্রতিবেদকের বক্তব্য: এ সফর সরকারের অনুমোদনহীন, তা প্রথম আলোর প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি। বলা হয়েছে, জিওতে উল্লিখিত ‘চায়নিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন মেম্বারস ইন বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনটি অপরিচিত। তবে ‘চায়নিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন রয়েছে। উল্লেখ্য, ওই সফরে বিশেষ সহকারীর একান্ত সচিব সফরসঙ্গী ছিলেন, যা সরকারের বিদেশ ভ্রমণবিষয়ক নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ নির্দেশনায় একান্ত সচিবদের জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত সঙ্গে নেওয়া পরিহার করতে বলা হয়েছে।
ছয়. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত বাস্তবতা বিশ্লেষণ না করে শুধু প্রাক্তন আমলাদের বক্তব্য, বাতিল হওয়া দরপত্র এবং অনুমাননির্ভর ব্যাখ্যা দিয়ে ফয়েজ আহমদের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে নিজের অবস্থান গণমাধ্যমে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যার কিছু অংশ প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকলেও প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের প্রতি উত্তরের অনুপস্থিতিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
প্রতিবেদকের বক্তব্য: বক্তব্য জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ১৬ জুলাই ফয়েজ আহমদ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানো হয়। পরে ফয়েজ আহমদকে ফোন করা হয় এবং খুদে বার্তা পাঠানো হয়। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ফোনে বিষয়টি জানানো হয়। ২০ জুলাই আইসিটি বিভাগে গেলে অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে জানানো হয়, ফয়েজ আহমদ অফিসে উপস্থিত নেই। তখন আইসিটি বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহম্মদ জসীম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি লিখিত বক্তব্য পাঠাবেন বলে জানান। তিনি পাঠাননি। পরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে ৭ জুলাই ফয়েজ আহমদ সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সেটাই তাঁর বক্তব্য। উল্লেখ্য, ফয়েজ আহমদের আগের বক্তব্যের চুম্বক অংশ প্রতিবেদনে রয়েছে। পাশাপাশি ৭ জুলাই তা প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে অনুমাননির্ভর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
সাত. টেলিযোগাযোগ বিভাগ জানিয়েছে, ইতিমধ্যে দুজন কারিগরি ও দুজন ক্রয় বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে ‘কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস’ (ব্যয়ের বিপরীতে সুফল পর্যালোচনা) কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রতিবেদকের বক্তব্য: ‘কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস’ করা হয়েছে কি না, সেটা প্রথম আলোকে দেওয়া বক্তব্যে জানতে চেয়েছিলেন টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান।
আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি, প্রথম আলোর প্রতিবেদন মোটেও ‘ব্যাখ্যাহীন অনুমানমূলক’ নয়, এটা ‘বিভ্রান্তিকর, একপক্ষীয় এবং ভিত্তিহীন’ও নয়; বরং প্রথম আলোর প্রতিবেদন সঠিক এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র প্রথম আলোর কাছে আছে।