মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বাড়ানোর দুই সপ্তাহের মধ্যে ১০টি পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমাল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ তালিকায় রয়েছে মোবাইল ফোন সেবা, রেস্তোরাঁ, ওষুধ, নিজস্ব ব্র্যান্ডের পোশাক, মিষ্টি, নন-এসি হোটেল, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি।
গতকাল বুধবার এ-সংক্রান্ত চারটি আদেশ জারি করেছে এনবিআর। এনবিআরের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এর ফলে এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে না। এর আগে গত ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পেতে কর বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো হয়। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে হঠাৎ এত পণ্য ও সেবায় বাড়তি কর আরোপের সিদ্ধান্তে বিভিন্ন মহলে নানা সমালোচনা হয়। বর্ধিত কর প্রত্যাহারের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধন করে।
ওষুধের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাটের হার ২ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছিল। এখন বাড়তি ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ফলে নতুন করে ওষুধের দাম বাড়বে না বলে মনে করে এনবিআর। গত ৯ জানুয়ারি মোবাইল ফোনের সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে টেলিফোন সেবায় (টকটাইম, ইন্টারনেট ব্যবহার ইত্যাদি) সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়। এই হার এখন আগের জায়গায় ফেরত নেওয়া হয়েছে। দেশে ইন্টারনেট সেবাদাতা সংস্থার (আইএসপি) সেবার ওপর কোনো সম্পূরক শুল্ক ছিল না। গত ৯ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়। গতকাল তা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
রেস্তোরাঁ ও হোটেল
সাধারণ রেঁস্তোরার খাবারের বিলের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। বাড়তি ভ্যাট হার প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে আগের মতোই রেস্তোরাঁর খাবারের বিলের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হবে। এ ছাড়া নন-এসি হোটেলের ওপর ভ্যাট হার ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। তবে ৯ জানুয়ারির আগে এ হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। অর্থাৎ নন-এসি হোটেলে ভ্যাট আড়াই শতাংশ বেড়েছে।
তৈরি পোশাক ও অন্যান্য
নিজস্ব ব্র্যান্ডের পোশাক ব্যতীত অন্যান্য পোশাক বিক্রির ক্ষেত্রে ভ্যাট হার আগের মতোই সাড়ে ৭ শতাংশ থাকছে। গত ৯ জানুয়ারি যা বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছিল। তবে নিজস্ব ব্র্যান্ডের পোশাকের ক্ষেত্রে বাড়তি ভ্যাট দিতে হবে। এসব পোশাকে আগে ভ্যাট হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। ৯ জানুয়ারি দ্বিগুণ বাড়িয়ে করা হয় ১৫ শতাংশ। এখন ৫ শতাংশ কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ১০ শতাংশ। অর্থাৎ এ ধরনের পোশাকে ভ্যাট আড়াই শতাংশ বেড়েছে।
মিষ্টির ওপর ভ্যাট হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। ৯ জানুয়ারি তা দ্বিগুণ বাড়িয়ে করা হয়েছিল ১৫ শতাংশ। এখন ৫ শতাংশ কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ শতাংশ। সেই হিসাবে মিষ্টিতে আড়াই শতাংশ ভ্যাট বাড়ল। অন্যদিকে মোটর গাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপের ভ্যাটেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখানে আগের মতোই ১০ শতাংশ ভ্যাট বহাল রাখা হয়েছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।