আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার আদলে ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন করতে পারি
Published: 27th, January 2025 GMT
কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক ফরহাদ মজহার দেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা-উবিনীগ এবং নয়াকৃষি আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। সম্পাদনা করছেন ‘চিন্তা’। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঔষধশাস্ত্রে স্নাতক এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চ থেকে অর্থশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন’, ‘মোকাবিলা’, ‘এবাদতনামা’, ‘সাম্রাজ্যবাদ’, ‘মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত’, ‘ক্ষমতার বিকার’ ইত্যাদি। ফরহাদ মজহারের জন্ম ১৯৪৭ সালে নোয়াখালীতে। সম্প্রতি পাবনার ঈশ্বরদীর মুলাডুলির হাজারীপাড়ায় উবিনীগের আরশিনগর বিদ্যাঘরে ফরহাদ মজহারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন সমকালের প্রতিনিধি সেলিম সরদার।
সমকাল: ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ কোন পথে এগোচ্ছে?
ফরহাদ মজহার: আমি ভালোই দেখছি। আমরা যদি জনগণের ইমোশন, তারা কী চায় তা প্রপারলি অনুধাবন করতে পারি তাহলে ইতিবাচকভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনেক সম্ভাবনা আছে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার আন্তরিকতা এবং তা সমাধানের জন্য জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ওপর থেকে অগণতান্ত্রিকভাবে চাপিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হবে। গণঅভ্যুত্থানের মৌলিক অভিপ্রায় হচ্ছে, বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করতে হবে। কাটাছেঁড়া করা বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট সংবিধান অবশ্যই বাতিল করতে হবে। নতুন গঠনতন্ত্রের জন্য গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। বাতিলের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। বাহাত্তরের সংবিধান মানা হলে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী সংবিধানকে সমর্থন দেওয়া হবে। ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, বাহাত্তরের সংবিধান কার্যত পাকিস্তানি আমলের জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা তৈরি। কারণ সত্তরের নির্বাচনে যারা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের মাধ্যমেই গণপরিষদ গঠন করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন গণপরিষদ নির্বাচন ছাড়া সেই পাকিস্তান আমলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। স্বাধীন দেশে নতুনভাবে গণপরিষদ গঠন না করে সংবিধান তৈরি করা যায় না।
সমকাল: আপনি যে গঠনতন্ত্রের কথা বলছেন, সেখানে আপনি কী কী দেখতে চান?
ফরহাদ মজহার: প্রথমত, ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ বা আইন প্রণয়নের অধিকার রাষ্ট্রের থাকবে না। ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, মানুষের জানমাল-জীবিকা বিনষ্ট করে এমন কোনো আইন বা নীতি রাষ্ট্র প্রণয়ন করতে পারবে না। তৃতীয়ত, আমাদের প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণ , প্রাণবৈচিত্র্যসহ প্রাকৃতিক যত সম্পদ আছে, সামষ্টিকভাবে জনগণ সেসব সম্পদের মালিক। প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্র্য বিনষ্ট ও বিষাক্ত করার কোনো আইন বা নীতি রাষ্ট্র গ্রহণ করতে পারবে না। আমাদের আবাস এবং সম্পদ যেন কোনোভাবে বিষাক্ত না হয়, নষ্ট না হয়, বিদেশি শক্তি লুট করতে না পারে– তা নিশ্চিত করতে হবে। এই সম্পদকে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং অবাধ বাজার ব্যবস্থার বিপরীতে শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে রূপান্তর করাই এখনকার কাজ। আইন, আদালত, প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জনগণের আর্থসামাজিক, আত্মিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে শক্ত গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। এই দেখুন, কত অল্প কথায় আমরা নতুন বাংলাদেশের গঠনতান্ত্রিক রূপকল্প নির্ণয় করতে পারি। আগামীর বাংলাদেশ কীভাবে চলবে, সেটা এভাবেই ঠিক করতে হবে।
সমকাল: জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতি নিয়ে আপনার অভিমত কী?
ফরহাদ মজহার: জনগণ ও রাজনৈতিক দল এক না। নতুন গঠনতন্ত্রে জনগণই নির্ণয় করে দেবে কারা আসলে রাজনৈতিক দল, কারা মাফিয়া আর লুটেরা শ্রেণির লুটপাটের জবাব। গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সব ক্ষেত্রেই নতুন করে শুরু করতে হবে। বিশেষত তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কথা শুনতে হবে– তারা কেমন বাংলাদেশ চায়। এই ঈশ্বরদীর জনগণকেও বলতে দিতে হবে– দেশের আইনকানুন কীভাবে থাকলে তারা বাঁচতে পারবে। জনগণের কথা শুনতে হবে। কমিশন বানিয়ে ওপর থেকে এলিট বা অভিজাত শ্রেণির কথাবার্তার তামাশা করে লাভ নেই। জনগণের মনের ভাষা বুঝতে হবে।
সমকাল: অন্তর্বর্তী সরকার প্রায় ছয় মাস পূরণ করেছে। এদের নিয়ে কিছু বলবেন?
ফরহাদ মজহার: আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এই সরকার সাংবিধানিক সরকার নয়। বর্তমান সংবিধানে এ রকম কোনো সরকার গঠনের নিয়ম নেই। এ সরকার অসাংবিধানিক। তা ছাড়া বিদ্যমান সংবিধান রক্ষায় শপথ নিয়ে গঠিত সরকার সংবিধান বাতিল বা সংস্কার করতে পারে না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মূলত সেনাবাহিনীর সমর্থনের ভিত্তিতে কাজ করছে। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোকেও শুরু থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের পেছনে সহায়ক শক্তি হিসেবে যুক্ত করা যেত। তারা ন্যাশনাল গার্ডিয়ান কাউন্সিলের ভূমিকা রাখতে পারত। সেটা হলে এখন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসা সহজ হতো। মনে রাখতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকার কিছু সময়ের জন্য এ দেশ পরিচালনা করছে। কিন্তু শুধু সেনাবাহিনীর সমর্থনে কোনো সরকার ব্যবস্থাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সোসাইটিতে পাওয়ারফুল অ্যাক্টিভিস্ট না থাকলে দেশ এগোবে না।
সমকাল: এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর কী করার আছে?
ফরহাদ মজহার: গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সেই সামষ্টিক অভিপ্রায়কে মান্য করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা। কিন্তু বিএনপি এখন ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর করণীয় প্রসঙ্গে বিএনপির কথা যদি বলি, তাহলে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে, বিএনপি এখন যা করছে তা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হওয়া জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিএনপি সতর্ক না হলে এ দেশ ক্রমেই গৃহযুদ্ধের দিকে এগোবে।
সমকাল: আপনি নয়াকৃষি আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশে কৃষকদের পরিস্থিতি কী?
ফরহাদ মজহার: আমরা প্রায় তিন লাখ কৃষক পরিবার নিয়ে কাজ করি। দীর্ঘকাল ধরে বিপুল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা অগ্রসর হয়েছি। একেকটা পর্যায়ে আমাদের কাজ বেড়ে গেছে। যদি আমরা জনগণের সরকার গঠন করতে সক্ষম হই তাহলে এই কৃষকদের নিয়ে অনেক বড় কাজ করার ইচ্ছা আছে। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে। কারণ ড.
সমকাল: দেশে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে এই সরকারকে কতদিন সময় দেওয়া দরকার বলে আপনি মনে করেন?
ফরহাদ মজহার: এটা আগে থেকে বলা মুশকিল। আমি যতটুকু জানি, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীতে চিন্তাশীল নেতা আছেন, যারা জনগণ নিয়ে ভাবেন। অনেকে বলেন, আমরা জনগণের জন্য কাজ করি, তাদের ভালোর জন্য কাজ করি। ফলে এ সরকার যতদিন ভালো কাজ করবে, আমরা তাদের সঙ্গে থাকব। আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাইনি। হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, এই সরকারকে তারা সমর্থন, সহযোগিতা করবেন। এটা বিচক্ষণ নীতি। আমরা ইসলামী সরকার চাইছি বলে ভারত যে ক্যাম্পেইন করছে, এটা ভুল ধারণা। যতটকু বুঝি, চরমোনাই পীরের যে দল, তারাও চাইছে এই সরকার দীর্ঘকাল থাকুক।
সমকাল: নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে কী বলবেন?
ফরহাদ মজহার: নির্বাচনের জন্য যখনই কোনো দল অযথা চাপ দেবে তখন আপনি বুঝবেন, সেই দলের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। আমরা কেমন দেশ চাই– জনগণের কাছ থেকে তার রায় নিতে হবে। গঠনতন্ত্র জনগণের ইচ্ছাকে ধারণ করে, আর আইন জনগণের ইচ্ছাকে আইনি ভাষায় ব্যক্ত করে।
সমকাল: আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মূল্যায়ন করুন। ঐতিহ্যবাহী একটি রাজনৈতিক দল এভাবে ধসে পড়ল কেন?
ফরহাদ মজহার: পপুলারিজমে ভর করে যে ফ্যাসিজম গড়ে উঠেছিল, এটা যে দুর্বল এবং ঠুনকো, তা শেখ হাসিনার মাথায় ছিল না। ছাত্রদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, তাদের যে রাজনৈতিক কৌশল, এর শক্তি সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে ছাত্রদের এই প্রজ্ঞা ও কৌশলের হাতে; পরাস্ত হয়েছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কারণে। বাকশাল থেকে হাসিনা সরকার পর্যন্ত আমরা দীর্ঘকাল থেকে এই ফ্যাসিজমের সমালোচনা করছি। ছাত্র-তরুণদের সচেতন করার চেষ্টা করেছি। পলিটিক্যাল এডুকেশন যে এ রকম একটি পরিস্থিতিতে যেতে পারে– এটা শেখ হাসিনা অনুমানই করতে পারেননি।
সমকাল: শেখ হাসিনাকে অনেক ঝানু রাজনীতিবিদ বলা হতো। তিনি বুঝতে পারলেন না কেন?
ফরহাদ মহজার: শেখ হাসিনা যখন ড. ইউনূসের সঙ্গে ব্যক্তিগত ইগোতে গেছেন, যখন ড. ইউনূস নোবেল পেয়েছেন বলে তাঁকেও নোবেল পেতে হবে, এমন হাস্যকর বিষয় সামনে আসে; তখন তাঁর প্রজ্ঞা সম্পর্কে সাধারণ মানুষও বুঝতে পেরেছে। তিনি রাজনৈতিক দল, ব্যবস্থা, ক্ষমতা প্রভৃতি সামষ্টিক বিষয়কে ব্যক্তিগত বিষয়ে পরিণত করেছিলেন। এর পরিণতি এখন তিনি ভোগ করছেন।
সমকাল: আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আবার ফিরে আসা সম্পর্কে কিছু বলুন। আমরা কি সংশোধিত আওয়ামী লীগ দেখতে পাব?
ফরহাদ মজহার: আমি মানুষে বিশ্বাস করি। এটা সংশোধনের ব্যাপার না। যখনই সিস্টেমটা আমরা শক্ত করব, তখন এই শক্ত ব্যবস্থার সুফল আওয়ামী লীগ নিজেও দেখবে। আওয়ামী লীগেরও অনেকের মধ্যে পরিবর্তন হবে।
সমকাল: আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিও উঠছে।
ফরহাদ মজহার: আওয়ামী লীগ দল ও দলটির নেতৃত্বাধীন সরকারের মধ্যে অপরাধীদের অবশ্যই শনাক্ত করতে হবে ও শাস্তি দিতে হবে। গত দেড় দশকে যেসব অপরাধ হয়েছে, তার ন্যায়বিচার হতে হবে। তবে আমি একতরফা বিচারের পক্ষপাতী নই। তারা যেন মনে বল পায়, ন্যায়বিচারে আস্থা রাখে, সেই পরিবেশ তৈরি করা দরকার। তাদের মব ট্রায়ালের কাছে ছেড়ে দেওয়া ভুল হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বিগত শাসনামলে অপরাধের জন্য আওয়ামী লীগের কোনো অনুশোচনা নেই।
সমকাল: একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের অপরাধীদের শাস্তি হবে এবং দলটির মধ্যে অনুশোচনাও আসবে– এমন বিচার কি সম্ভব?
ফরহাদ মজহার: বিচারের আগে আমরা নেলসন ম্যান্ডেলার স্ট্র্যাটেজি একটু ভাবতে পারি। আমি বিনয়ের সঙ্গে চিন্তা করতে বলব, আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের আদলে একটি ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন করতে পারি কিনা। আওয়ামী লীগের নেতা যারা ভুল করেছেন, তাদের বলব– আসেন, আমরা ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশনে যাই। আমি একতরফা বিচারের পক্ষে না। সত্য যখন আমরা জানি, তখনই কিন্তু ন্যায়বিচার হয়। আর যখন আমরা সত্য জানি না, তখন আপনাকে আমি যতই শাস্তি দিলাম, মনে হয় শাস্তিটা ঠিক হয়নি। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সেই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
সমকাল: তরুণদের কি এ ব্যাপারে ধারণা রয়েছে?
ফরহাদ মজহার: বাংলাদেশের তরুণরা একটি বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। তার মানে সমাজ, ইতিহাস ও বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি ও জানাশোনা অনেক গভীর। তা ছাড়া বাংলাদেশের তরুণরা তো একটি অ্যান্টি কলোনিয়াল, অ্যান্টি ইম্পেরিয়ালিস্ট মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘকাল তারা ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।
সমকাল: আপনি এখন সারাদেশে ঘুরছেন। সাধারণ মানুষ আগের চেয়েও বেশি আগ্রহ নিয়ে আপনার কথা শুনছে। তার আগে দীর্ঘদিন ধরে প্রায় নিয়মিত বিরতিতে আপনি ঈশ্বরদী এসেছেন। এখানকার মানুষ, এখানকার পরিবেশ নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
ফরহাদ মজহার: দেখুন, ঈশ্বরদীতে আমরা বহু বছর ধরে উবিনীগের মাধ্যমে চলাফেরা, বসবাস করি। আমরা তো এখন এই সমাজেরই একজন। এখানকার ভূমি খুবই উর্বর। এই অঞ্চলের মাটি ও মানুষের জন্য যথাসম্ভব ভালো কিছু করার প্রচেষ্টা আগেও যেমন ছিল, এখনও রয়েছে। দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যদি গণমুখী হয়, তাহলে ঈশ্বরদীর মাটি ও মানুষের জন্য আরও ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।
সমকাল: অনেক ব্যস্ততার মাঝেও এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ফরহাদ মজহার: আমার মতো নগণ্য মানুষের সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ করার জন্য আপনাকে ও সমকালকে ধন্যবাদ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন গঠনতন ত র ব যবস থ জনগণ র র র জন ক ত কর পর ব শ র জন য ক জ কর ন র জন আওয় ম অপর ধ ব এনপ আগস ট ক ষমত সমক ল
এছাড়াও পড়ুন:
‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান
ইদানীং কিছু ভদ্রলোক ইনিয়ে-বিনিয়ে, এমনকি সুযোগ বুঝে সরাসরিও বলে ফেলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের চেয়ে শেখ হাসিনার শাসনেই দেশ ভালো চলছিল। দু–একজন এ-ও বলছেন, গত ৪০ বছরে এখনকার মতো খারাপ অবস্থা নাকি তাঁরা দেখেননি।
এই ‘মহামানবদের’ কথা মান্য করলে প্রশ্ন এসেই যায়, কী লাভ হলো গণ–অভ্যুত্থান করে, এত জীবন বিসর্জন দিয়ে, এত রক্ত ঝরিয়ে?
আওয়ামী লীগের শত্রুরা উত্তর দিক: সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে হাসিনা পতনের এক দফা দাবিতে রূপান্তরের কী প্রয়োজন ছিল? গণবিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেড় দশকে গড়ে ওঠা এক শক্তিশালী ব্যবস্থাকে ভেঙে খান খান করে ফেলার কী এমন প্রয়োজন ছিল?
হাসিনা-পরবর্তী এই ‘ভগ্ন হৃদয়ের’ যুগে ভারতীয় শিল্পী কবির সুমনের সে গানটি ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই...শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’ শুনি আর ভাবি, ২০২৪-এর ‘ডামি’ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাকে আজীবন ক্ষমতায় দেখতে চাওয়া অলিগার্কদের কী যে আকুতি ছিল!
মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে নেত্রীর পতন দেখে হয়তো সেদিন তাঁরা শুনেছেন কিংবা গেয়েছেন অন্য কোনো গান। হতে পারে আরেক ভারতীয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া সেই গান তাঁরা গেয়েছিলেন, ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...আমার বলার কিছু ছিল না।’
আক্ষেপ কেন, কমরেড, জীবন নিয়ে পালিয়ে তো তিনি নিরাপদেই আছেন দিল্লিতে!
তবু ‘সে কি ভোলা যায়, তুমি আমারই ছিলে’ হে বাংলাদেশ সাম্রাজ্য! সত্যিই তো তাঁর এবং তাঁদের একচেটিয়া অধিকার ছিল যেভাবে খুশি যত বেশি ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তি ভোগের।
একটি অভিজাত গোষ্ঠীকে (অলিগার্কি) হাসিনা-প্রদত্ত সেই লাভজনক স্থিতাবস্থা হারিয়ে কীভাবে চুপ করে বসে থাকবে এর ‘ভাগ্যবান’ সদস্যরা! নতুন রাজনৈতিক বিনিয়োগও কিছু দরকার হবে যদি ভবিষ্যৎ মুনাফার আশা করতে হয়।
টাকাওয়ালাদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বিনা ভোটে বা জালিয়াতির মাধ্যমে সংসদ সদস্য পদ বা মন্ত্রিত্ব উপহার, তাঁর চামচাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতি এবং দলীয় অনুগতদের মিডিয়ার লাইসেন্স প্রদানসহ কত ধরনের দান-দক্ষিণার ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ‘ষোলো কোটি মানুষকে খাওয়ানোর’ দাবিদার বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগপ্রধান হাসিনার সরকার।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতু থেকে গভীর সমুদ্রবন্দর, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল রোড, ডজন ডজন নতুন ব্যাংক থেকে শত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি—এ রকম বড় বড় ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণে তাঁর কোনো তুলনাই হয় না।
একটু–আধটু দুর্নীতি হলেও অন্তত মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন তো দেখাচ্ছিলেন তাঁর সভাসদরা। এই ধরুন, লাখো কোটি টাকার ব্যাংকঋণ জালিয়াতি, খেলাপি, দলীয় নেতা মাস্তানদের হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি ও সম্পদ লুণ্ঠন, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার ইত্যাদি বিষয় দেড় দশকের স্থিতিশীলতার তুলনায় এমনকি বাড়াবাড়ি!
যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?জনগণকে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন জনদরদি হাসিনা সরকার। ২০১৪ সালের ১৫৪ সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত, ২০১৮ সালে নৈশকালীন ভোট এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন করে হাসিনা তাঁর বাবা শেখ মুজিবের তৈরি একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার নতুন মডেল দাঁড় করান পৃথিবীর সামনে।
যাঁরা এই আওয়ামী শাসনের ‘স্থিতিশীলতা’ নস্যাৎ করতে চেয়েছে তাদের ‘ঠ্যাং ভেঙে’ দিতে একটুও দ্বিধা করেনি হাসিনা সরকার। সরকারের ধারাবাহিকতা নষ্টের চেষ্টাকারীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া হয়েছে গুম, খুন, সহিংসতা, জঙ্গিনাটক, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, প্রতিবাদ দমন ও বাক্স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে। সে জন্য আপনারা তাঁকে ফ্যাসিবাদী বলার সাহসও পাননি তখন।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে হাজারো তরুণ ও সাধারণ মানুষ নিহত (শহীদ) হওয়ার দায় নিতে চাননি হাসিনা। উল্টো তাঁর দাবি, ৫ আগস্ট তাঁকে মারতেই লক্ষ জনতা গণভবন অভিমুখে যাত্রা করেছিল।
আরও পড়ুন‘আমি কী অপরাধ করেছি’— সবাই জানেন শিরোনামটা...৩০ জুলাই ২০২৫আরও রক্তপাত এড়াতেই নাকি তাঁর নিজের লোকদের মায়া ছেড়ে ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্বন করে ভারতে পাড়ি জমান শেখ হাসিনা।
তাই আজ তাঁর ফেরার অপার ইচ্ছা যেন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি গানের মতোই, ‘তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথি হতে আজকের চেষ্টা আমার।’
যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?
যেন এত সব বিষয় নিয়ে জনমনে কোনো ক্ষোভই ছিল না হাসিনার আমলে। এটি সেই বিস্মৃত অতীত, যেটি নিয়ে কল্পিত সংগীত রচিত হয়: ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।
আরও পড়ুনশেখ হাসিনা স্বৈরশাসকদের টিকে থাকার দুটি মূলমন্ত্রেই ব্যর্থ২২ আগস্ট ২০২৪তার মানে, তাঁর শাসনকালই জাতির জন্য ছিল আদর্শ। এটা প্রমাণ করার এক অদৃশ্য প্রচেষ্টা রয়েছে আজ এখানে, আমাদের চারপাশে, আশপাশে।
সত্য, মিথ্যা মিশিয়ে এমন দাবি করেন কারা এবং কেন—সেটা আমাদের একটু বোঝা দরকার।
হাসিনার চামচা ও সুবিধাভোগী, তাঁর ঘরানার অসৎ বুদ্ধিজীবী, তাঁর হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতি নিয়ে নির্বিকার নেতা-কর্মী-সমর্থক, বর্তমান আমলে বিশেষ কিছু না পেয়ে প্রবলভাবে হতাশ কতিপয় সুশীল অথবা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বোধ ব্যক্তির পক্ষেই ফ্যাসিবাদী শাসনামলকে উত্তম বলা সম্ভব।
এতে হাসিনার লোকদের বড় লাভ হতে পারে দায় স্বীকার না করে বা ক্ষমা না চেয়েই তাঁদের হাত ও নামসমূহকে দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের রক্তের দাগ থেকে মুক্ত করা।
এ প্রচেষ্টা ঘটে যাওয়া সত্যকে অস্বীকার, শহীদদের আত্মত্যাগ অগ্রাহ্য, আহত ব্যক্তিদের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং মজলুমদের অনুভূতির সঙ্গে মশকরা ছাড়া আর কিছুই না।
এগুলোই আবার জুলাই বিপ্লবের পক্ষের শক্তির বয়ান তৈরিতে ব্যর্থতা প্রমাণ করে।
আরও পড়ুনহাসিনা শাসনের উন্নয়নের বানোয়াট গল্প০৩ অক্টোবর ২০২৪পরিবর্তনের পক্ষে জনগণের প্রবল আকাঙ্ক্ষার কোনো কমতি ছিল না এবং হত্যা-দুর্নীতিসহ ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের লক্ষ্যে কমবেশি সংস্কারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক চিন্তা, গণতান্ত্রিক ভাবনা, কিংবা আমলাতান্ত্রিক কর্মসূচিকে জনমত তৈরির জন্য সেভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একটা একটা করে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উত্তম বিকল্প জনগণের সামনে আনলে গণমানুষকে নতুন ধারণা ও আশাবাদ উপহার দেওয়া যেত।
কয়েকটি মডেল নির্বাচন দিয়ে, তরুণদের পরিবেশ রক্ষার মতো সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে, রাজনৈতিক দলসমূহকে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে অংশীদার বানিয়ে এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাক করে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে হাসিনার কুশাসনকে যথাযথভাবে চিত্রিত করা যেত।
ধারণা করি, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগে ঘাটতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগগুলো সম্পর্কে জনসম্পৃক্ততার অভাব হাসিনার উপকারভোগীদের নিজস্ব গান গাওয়ার পরিসর দিয়েছে।
ফ্যাসিবাদী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং ২০২৪-এর আন্দোলনে পুরোভাগে থাকা ছাত্র ও অন্য শক্তিগুলো পরস্পরের মধ্যে লজ্জাজনক কুতর্কে জড়িয়ে পড়ায় গণ–অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনের এজেন্ডা এবং উপযোগী বয়ান যথেষ্ট মার খেয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণও কিছুটা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়েছে।
বাংলাদেশিদের বর্তমান হতাশা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়াটাই কাম্য ছিল পরাজিত শক্তির। হাসিনা বিহনে আওয়ামী উপকারভোগী বা অন্ধ সমর্থকেরা গোপালগঞ্জ বা অন্য কোনো অঞ্চলে নিরালায় বসে যেন গুনগুন করে গাইছে গগন হরকরার গান, ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে...।’ তারা বুঝতে পারছে না জাতির জীবনে শেখ হাসিনা এমন এক জুলুমশাহি শাসকের নাম ও ফ্যাসিবাদের প্রতিমূর্তি; যার শাসন পুরো দেশকে বানিয়ে ফেলেছিল ‘জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ’।
নিজেদের বাইরে জনগণের অন্য যেকোনো গোষ্ঠীকে ক্ষমতার ভাগ দিতে না চাওয়া সেই ফ্যাসিবাদী ধারায় ছেদ টেনেছে জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার গঠন, যেটিও আশা করি বাংলাদেশের শেষ সরকার নয়।
বিদায় নেওয়া ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে যেকোনো দেশেই অনেকটা পুরোনো দিনের গান। এই গান অবশ্যই স্মৃতিজাগানিয়া কিন্তু চলমান বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। ভবিষ্যতে আবারও ফ্যাসিবাদকে সহ্য করবে, এমন প্রজন্ম এ দেশে সেকেলে এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তরুণেরা এবং অভিজ্ঞ বিবেকবানেরা এখন অজানা এক নতুন বাংলাদেশের অপেক্ষায়।
ফলে ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’ গান বাদ দিয়ে হাসিনার মানসপুত্রদের এখন নিরালা নিঝুম ও যথাযথ ভাবগম্ভীর পরিবেশে বসে মুদ্রিতনেত্রে মন্দ্রসপ্তক কণ্ঠে ভক্তিভরে গাওয়া উচিত, ‘মা, আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা... ।’
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক
*মতামত লেখকের নিজস্ব