বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ কোথাও বেড়েছে, কোথাও কমেছে
Published: 9th, February 2025 GMT
সচ্ছল বা মেধাবীরাই কেবল উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাবেন, একসময় এমনটাই ভাবা হতো। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় থেকেই শিক্ষার্থীরা পছন্দের দেশে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে পরিকল্পনা নিচ্ছে তারা। বৃত্তি ও ফান্ডিংয়ের (তহবিল) সুযোগ বাড়ছে বলে স্নাতক পর্যায় থেকেই অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষা শুরু করার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। অনেকে মাস্টার্স বা পিএইচডি করে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন।
দেশের শিক্ষার্থীরা এখন অনেক সচেতন। তাঁরা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ক্ষেত্রে গবেষণার সুযোগ ও শিক্ষার মানকে বেশ গুরুত্ব দেন, যাতে ভবিষ্যতে তাঁদের একাডেমিক ও পেশাগত দক্ষতা বাড়ে। অনেকেই বিদেশে ডিগ্রি নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ নিচ্ছেন।
করোনার কয়েক বছরে আদতে উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল কম। পরে কিছু কড়াকড়ি শিথিল হয়েছে। ফলে অনেক শিক্ষার্থীই পছন্দের দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ গ্রহণের জন্য বেশ পরিশ্রম করছেন। আবার বিশ্বের বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে চেষ্টা করছেন।
আরও পড়ুনবিদেশে পড়তে চাই, কিন্তু কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন প্রোগ্রাম আমার জন্য১৭ মিনিট আগেবিদেশে পড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সচরাচর ইংরেজিভাষী দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দেন। তাই প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা আর অস্ট্রেলিয়ায় অনেক শিক্ষার্থী পড়তে যাচ্ছেন। যুক্তরাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সুযোগ বাড়ার কারণে সংখ্যা বেড়েছে। অন্যদিকে কানাডায় সম্প্রতি নিয়মকানুন কিছুটা কঠিন হয়ে যাওয়ার ফলে সংখ্যা কমছে। অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রে সব সময়ই শিক্ষার্থীদের সুযোগ অনেক বেশি থাকে, তাই বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সংখ্যায় থাকে বেশি। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে সংখ্যার হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে যত শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল অষ্টম। তার আগের বছর বাংলাদেশ ছিল ১৩তম। যুক্তরাষ্ট্রে একেক সময় একেক ধারা দেখা যায়। সেই ধারাবাহিকতায় বোঝাই যাচ্ছে যে নতুন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগমনের পর কিছু পরিবর্তন আমরা দেখতে পাব। সাম্প্রতিক সময়ে যেমন কিছু বিধিনিষেধ চোখে পড়ছে।
ইংরেজিভাষী দেশগুলোর মধ্যে নিউজিল্যান্ড আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছে অতটা জনপ্রিয় ছিল না। তবে গত কয়েক বছরে দেখছি, অনেক শিক্ষার্থী দেশটির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ইউরোপের অনেক দেশেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত হারে আমাদের শিক্ষার্থীরা যাচ্ছেন। বেশ কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানলাম, ইউরোপে পড়াশোনার পাশাপাশি সেখানকার বেশ কিছু দেশে ভবিষ্যতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সুযোগ আছে। তাই সেখানে যেতে তাঁরা আগ্রহী।
আরও পড়ুন২০২৫ সালের ১০ ফেলোশিপের খোঁজ১২ জানুয়ারি ২০২৫পাশাপাশি বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থীই ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছেন।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগের সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। আপনি হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেন, কিন্তু ভিসা জটিলতার কারণে বিড়ম্বনায় পড়লেন। অনেক দেশের ক্ষেত্রেই এটা হতে পারে। যথাযথ তথ্যের ভিত্তিতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী এগোলে এসব সমস্যা অনেকটাই এড়ানো সম্ভব।
আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা একসময় বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যভিত্তিক বিভিন্ন বিষয়ে পড়তে দেশের বাইরে যেতেন। অনেকেই এখন তথ্যপ্রযুক্তি–সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে পড়তে যাচ্ছেন। এসব বিষয়ে ফান্ডিং ও বৃত্তি লাভের সুযোগ বেশি বলে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ও আগ্রহও বেশি। আবার অনেকেই ভবিষ্যতে বিদেশে স্থায়ীভাবে থাকতে ও নাগরিকত্ব লাভে আগ্রহী বলে তাঁরা বেশ কিছু নতুন বিষয়ে পড়তে পারেন। উদাহরণ হিসেবে নার্সিংয়ের মতো জনস্বাস্থ্য–সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়ার কথা বলতে পারি। অনেক দেশেই এ ধরনের বিষয়ে পড়তে চাইলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়ে, তেমনি ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান ও স্থায়ী আবাসের সুযোগ অনেকটাই উন্মুক্ত হয়।
যাঁরা উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে যেতে চাচ্ছেন, তাঁদের জন্য পরামর্শ থাকবে, ক্যারিয়ারসহ ভবিষ্যতের বিভিন্ন বিষয়কে মাথায় রেখে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করুন। আপনার নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা রইল।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কালিদাসের হাত ধরে যে জামুর্কীর সন্দেশের যাত্রা, তার জিআই স্বীকৃতিতে খুশি সবাই
দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে করেছিলেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার জামুর্কী গ্রামের প্রয়াত কালিদাস চন্দ্র সাহা। এ জন্য তাঁর বাবা মিষ্টি ব্যবসায়ী প্রয়াত মদনমোহন সাহা তাঁকে সংসার থেকে আলাদা করে দেন। এরপর মিষ্টির দোকানের আশপাশে বসে থাকতে থাকতে একসময় তিনি সন্দেশ বানাতে শুরু করেন। সেটা ১৯৪০ সালের কথা।
একসময় কালিদাসের বানানো এই সন্দেশ জামুর্কীর সন্দেশ হিসেবে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সন্দেশ এবার ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। গতকাল বুধবার টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরীফা হকের হাতে জামুর্কীর সন্দেশের জিআই নিবন্ধন সনদ তুলে দেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে জামুর্কীতে গিয়ে দেখা গেল, ‘কালিদাস মিষ্টান্ন ভান্ডার’ নামের চৌচালা টিনের ঘর। পুরোনো দোকান। বাড়তি কোনো চাকচিক্য নেই। সাদামাটা কাচঘেরা তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সন্দেশ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেচাকেনা বাড়ছে।
স্থানীয় কয়েকজন বলেন, কালিদাস ১৯৮২ সালে মারা যান। তারপর তাঁর বড় ছেলে সমর চন্দ্র সাহা ব্যবসার হাল ধরেন। আরেক ছেলে গৌতম সাহা লন্ডনপ্রবাসী।
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল সদরের একটি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আসাদুজ্জামান আত্মীয় বাড়ি যাচ্ছিলেন। পথে বিরতি দিয়ে সন্দেশ কিনতে ওই দোকানে আসেন। তিনি বলেন, ‘আগেও এই দোকানের সন্দেশ খেয়েছি। আজও নিচ্ছি। এর গুণগত মান সব সময় ভালো।’
জিআই পণ্যের স্বীকৃতিতে স্থানীয় লোকজনও খুশি। জামুর্কী গ্রামের ফিরোজ আলম মোক্তার বলেন, এই সন্দেশের স্বীকৃতি আরও আগেই পাওয়া উচিত ছিল। এই সন্দেশের মান যাতে বজায় থাকে, এ জন্য মালিকদের ইচ্ছা থাকতে হবে।
বর্তমান মালিক সমর চন্দ্র সাহাকে পাওয়া গেল জামুর্কী কাঁচাবাজারে। এ সময় বাজারের ব্যবসায়ীরা তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন। বাজারের মাতৃভান্ডারের মালিক প্রকাশ বাকালী বলেন, ‘বাবার মুখে যেমন শুনেছি, সন্দেশ এখনো তেমনই আছে। এটা আমাদের গর্ব। আমার বুক ভরে গেছে।’
সমর চন্দ্র সাহা বলেন, বাবার মৃত্যুর পর ছাত্রাবস্থায় তিনি দোকানে বসতে শুরু করেন। সেই থেকে এখনো আছেন। সন্দেশ খেয়ে মানুষ প্রশংসা করেন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জামুর্কী বাসস্ট্যান্ডে এক অনুষ্ঠানে এসে দোকানটিতে এসেছিলেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এসেছেন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ এসেছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মাঝেমধ্যে আসেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এক মাস আগেও এসেছিলেন। ২০১৩ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতাল পরিদর্শনে এলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে এই সন্দেশ দিয়ে আপ্যায়ন করে। তাঁর কথা, ‘ট্যাকাপয়সা কিছু না। এই স্বীকৃতি বিশাল ব্যাপার। আমরা মান ভালো করি। কাস্টমাররা আমাদের পছন্দ করেন। সন্দেশ কিনতে এসে দোকানে বসে গল্প করেন। আমার খুবই ভালো লাগে। খুশির এই সময় আমার বাবা-দাদাকে খুব মনে পড়ছে। আমি তাঁদের স্মরণ করি।’
দোকান দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রেমা সাহা বলেন, ‘আমি ৪০ বছর ধরে দোকানে আছি। কাস্টমারকে আমরা আপন মনে কইরা সেবাটা দেই। আমরা জিনিস ভালা বানাই। এ জন্য সরকারও স্বীকৃতি দিছে।’
মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আরিফুল ইসলাম বলেন, সন্দেশের জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানাভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ স্বীকৃতি মির্জাপুরবাসীর।
দোকানটিতে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সন্দেশ বিক্রি হয়। চিনি ও গুড়ের তৈরি দুই ধরনের সন্দেশের বর্তমান বাজারমূল্য প্রতি কেজি ৮০০ টাকা। দুধ থেকে ছানা তৈরির পর এলাচি, চিনি অথবা গুড় দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে সন্দেশ বানানো হয়। প্রায় প্রতি ঘণ্টায় চুলা থেকে একটি করে বড় কড়াই নামানো হয়। একটি কড়াই থেকে প্রায় ৩০ কেজি সন্দেশ বানানো যায়। দোকানটিতে সন্দেশ ছাড়াও চমচম, রসগোল্লা, রসমালাই, দই ও ঘি বিক্রি করা হয়।