বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘এস আলমসহ বড় কয়েকজন ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে কে কত টাকা নিয়েছেন, তা তাঁরা নিজেরাও জানেন না। আমরাও এখনো পুরোটা জানতে পারিনি। তবে ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান যাচাই শুরু হয়েছে। পাশাপাশি ফরেনসিক নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এতে বেরিয়ে আসবে কে কত টাকা নিয়েছেন, সুবিধাভোগী কারা ছিল।’

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এ কথা বলেন। আজ সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সংবাদ সম্মেলনে গভর্নরের কাছে প্রশ্ন ছিল, এস আলমসহ ১০টি শিল্প গ্রুপ ও শেখ পরিবার নিয়ে যৌথ তদন্ত হচ্ছে, তারা আসলে কত টাকা নিয়েছে? জবাবে গভর্নর বলেন, ‘প্রাথমিক হিসাবে এস আলম একা ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসা করলেও বলতে পারবে না, কত টাকা নিয়েছে। জাভেদ (সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী) বিদেশে সাড়ে ৩০০ বাড়ি কিনেছেন। এত বাড়ির ঠিকানা তিনি দিতে পারবেন না।’

সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো সম্পর্কে গভর্নর বলেন, তাদের তারল্য–সহায়তা দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনে আরও দেওয়া হবে। ইসলামী ব্যাংক ও ইউসিবি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের আর সহায়তার প্রয়োজন হবে না। আমানতকারীদের স্বার্থ দেখা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ, সেটা করা হচ্ছে। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে সংস্কার করা হবে, এর ফল পেতে সময় লাগবে। সব প্রক্রিয়া শেষে পুরো ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী ভিত্তি দিতে তিন-চার বছর সময় লাগবে।

শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও বাংলাদেশ কেন পারছে না—এ প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল। খাবার ও তেলের জন্য সেখানে লাইন পড়েছিল। বাংলাদেশ সেই পরিস্থিতিতে পড়েনি। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে না। বাংলাদেশের চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাব ইতিবাচক। বিনিময় হার স্থিতিশীল, রিজার্ভও বাড়ছে।

অনিয়মে জড়িত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, ‘কী অনিয়ম হয়েছে, তা সবাই জানি। কে সহায়তা করেছে, তা খুঁজে সময় নষ্ট করতে চাই না। ব্যাংক খাতের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি জোরদার করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে খারাপ ঋণ আর বিতরণ না হয়। অনিয়মের ঋণ উদ্ধারে দেশি-বিদেশি সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। পাচার করা অর্থ উদ্ধারে কাজ চলছে।’

মুদ্রানীতির কারণে বিনিয়োগ কমে কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘আমি আগে থেকেই বলে আসছি, ২০২৪ ও ২০২৫ সাল প্রবৃদ্ধি অর্জনের বছর নয়। এই দুই বছর অর্থনীতি মেরামত করার বছর। রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে এমনিতেও বিনিয়োগ হবে না। সবকিছু মুদ্রানীতি দিয়ে হবে না। আমাদের প্রধান লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে কেউ বাধা দিচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বাধা দিচ্ছে না। তবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমার বিরুদ্ধেও তারা কাজ করছে।’

ডলারের দাম কবে বাজারভিত্তিক হবে, জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, ‘এখনো সে সুসময় আসেনি। এখনো ডলারের দাম বাড়ানোর জন্য কিছু মধ্যস্বত্বভোগী কাজ করে যাচ্ছে। তারা প্রবাসীদের ডলার কিনে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমরা ব্যাংকগুলোকে বলে দিয়েছি তাদের থেকে ডলার না কেনার জন্য। ডলারের দাম মধ্যস্বত্বভোগীরা ঠিক করতে পারে না, এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক করবে।’

ব্যাংক পরিচালকদের বিষয়ে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘স্বতন্ত্র পরিচালকদের একটা তালিকা করা হবে। সেখান থেকে পরিচালক নিয়োগ করতে হবে। আমি মনে করি, অর্ধেক পরিচালক স্বতন্ত্র হওয়া উচিত। ২ শতাংশ শেয়ার দিয়ে পরিচালক হওয়া বন্ধ ও পরিচালকদের মেয়াদ কমিয়ে আনা দরকার। এ জন্য আমরা আইন পরিবর্তনের প্রস্তাব করব।’

নীতি সুদহার কমানোর বিষয়ে গভর্নর বলেন, ‘সুদহারের ওপর নির্ভর করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ কাজে আসছে। এখন সব দেশ নীতি সুদহার কমিয়ে আনছে। আমাদের সেই সময় এখনো আসেনি। সময় হলে সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার, হাবিবুর রহমান, জাকির হোসেন চৌধুরী ও মো.

কবির আহম্মদ, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান এ এফ এম শাহিনুল ইসলাম, গভর্নরের উপদেষ্টা আহসান উল্লাহ প্রমুখ।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র বল ন কত ট ক

এছাড়াও পড়ুন:

ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা

বছর পাঁচেক আগেও ধান কাটার শ্রমিকেরা বৈশাখ মাসের অপেক্ষায় থাকতেন। বৈশাখে হাওরের বুকজুড়ে সবুজ ধান যখন সোনালি রঙ ছড়াতে শুরু করে, তখন থেকেই দূরদূরান্ত থেকে হাওরে আসতে থাকেন ধান কাটার শ্রমিকেরা। কিন্তু, এই চিত্র দ্রুত বদলাচ্ছে। হাওরের কৃষক এখন ধান কাটার জন্য বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করেন। ফলে কৃষকের শ্রম এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হচ্ছে। তবে, কর্মহীন হয়ে পড়ছেন কৃষি শ্রমিকেরা। বাধ্য হয়ে তারা পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।

তিন বছর হলো ধান কাটার পেশা ছেড়েছেন মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের মো. মকবুল মিয়া। এখন তিনি সারাবছর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান।

আরো পড়ুন:

খুলনার বরফশ্রমিক
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মকবুল মিয়া বলেন, ‘‘আগে বছরের ছয় মাস বর্ষায় নৌকা বাইতাম, আর হুগনা সিজন আইলে নিজের জমি চাষ করতাম, আবার মাইনষের জমিতেও কামলা দিতাম। যা আয় অইতো তাই দিয়া আমরার ছয়জনের সংসার চইল্যা যাইতো। কিন্তু, যহন থেইক্যা নতুন নতুন মেশিন হাওরে আইতাছে, তহন থেইক্যা আমরার আর বেইল নাই।’’

‘‘কেউ আর আমরারে আগের মতন দাম দেয় না। কাম করলেও ঠিকমতো টেহা পাই না, তাই পুষায় না,’’ বলেন এই কৃষিশ্রমিক।

মকবুলের মতো ধান কাটা, মাড়াই, রোদে শুকানো, ঝাড়া, কাঁধে বহন করার মতো স্বাধীন পেশা ছেড়েছেন অষ্টগ্রামের ফয়জুল, ইটনার শামছুল মিয়া, নিকলীর ফরিদ উদ্দিনসহ অসংখ্য শ্রমিক। এক সময় যারা এ পেশায় দলবেঁধে কাজ করতেন, এখন দৃশ্যপট পুরোটাই ভিন্ন। ধান কাটার পেশা বদলে তারা এখন কেউ রিকশাচালক, কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ চটপটি-ফুচকার দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

তারা বলছেন, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির গতির সঙ্গে তারা কখনো তাল মেলাতে পারবেন না। কৃষকরাও তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছেন না। বেশি জমি যাদের আছে তারাও আধুনিক পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। যে কৃষক অল্প জমিতে চাষাবাদ করেছেন, তারাও আর পয়সা খরচ করে কৃষিশ্রমিকের ওপর নির্ভর করছেন না। তারা পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা নিচ্ছেন। ফলে খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা পড়েছেন বিপাকে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সনাতন পদ্ধতিতে এক বিঘা জমির ধান কাটতে প্রচুর সময় লাগে। ফসল কাটার পরে বহন ও মারাই করা, তারপর বস্তায় সংরক্ষণ করার জন্যও অনেক শ্রমিকের দরকার। এটুকু ৬ থেকে ৭ জন শ্রমিকের সারা দিনের কাজ। তার জন্য মজুরি গুনতে হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কিন্তু, এ কাজে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করলে সময় এবং অর্থ দুটোই কম লাগে।

বৈশাখে বর্ষার পানি ও বৈরী আবহাওয়া না থাকায় কৃষকেরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটছেন। বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে ঝড়-তুফান শুরু হলে পাকা ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে তারা যে পদ্ধতিতে ধান কাটা সহজ এবং দ্রুত হয় সেই পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবার পুরো জেলায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওর এলাকাতেই আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলন ভালো হওয়ায় এই ধান থেকে এবার প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। ধান কাটতে এ বছর হাওর অঞ্চলে ৩৫ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। এই সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কম। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধান কাটতে কৃষক কম্বাইন্ড হারভেস্টারসহ ৪১৩টি ধান কাটার যন্ত্র ব্যবহার করছেন। 

জেলা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ উদ্দিন বলেন, ‘‘মানুষের পেশা পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের বিভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়। কিন্তু, কৃষি এমন একটা পেশা, যারা এ পেশা রপ্ত করেছেন তাদের জন্য নতুন পেশায় আসা খুব কঠিন। বর্তমানে কৃষিকাজে যেভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, তাতে কৃষিশ্রমিকেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।’’

‘‘শুধু কৃষিতেই নয়, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে,’’ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারকেই সুদৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান, মাঠে যদি কৃষক ও শ্রমিক ন্যায্য শ্রমমূল্য না পান, তাহলে কৃষিও একদিন হুমকির মুখে পড়বে।’’

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত নিবন্ধ