অন্য দেশের সংস্কৃতি বলবেন না এটিকে। এভাবে সংস্কৃতিকে আলাদা করা যায় না। এটি একটি নদীর মতো চলমান প্রক্রিয়া
শফিক রেহমান সাংবাদিক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। বাংলাদেশে নব্বই দশকের আগে কখনও ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ উদযাপনের কথা শোনা যায় না। বাংলাদেশে এই দিনটিকে ‘ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে উদযাপনের রীতি চালু করার কৃতিত্ব দেওয়া হয় শফিক রেহমানকে। তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক যায়যায়দিন ১৯৯৩ সালে প্রথম এ দিনটিকে উপলক্ষ করে বিশেষ ‘ভালোবাসা সংখ্যা’ বের করেছিল। দিনে দিনে বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস রীতিমতো উৎসবে রূপ নিয়েছে। এসব নিয়ে তিনি বিস্তারিত কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের সহকারী সম্পাদক এহ্সান মাহমুদ
সমকাল: আপনাকে ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা। কেমন আছেন?
শফিক রেহমান: তোমাকেও শুভেচ্ছা।
সমকালের পাঠকদেরও শুভেচ্ছা জানাই। এক প্রকার ভালো আছি। সারাদেশের মানুষ যে রকম আছে, আমিও সে রকম আছি। অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। দেশবাসী যেমন অনিশ্চিত সময়ের মধ্যে আছে, আমিও তেমন অনিশ্চিত সময়ের মধ্যে আছি।
সমকাল: কেমন অনিশ্চয়তা? স্থিতিশীলতা কেন নয়?
শফিক রেহমান: বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা বোঝাতে আমি দুটি জিনিসের দিকে খেয়াল রাখি। প্রথমত, ডলারের বিনিময় মূল্য। দ্বিতীয়টি হচ্ছে স্বর্ণের দাম। যে যা-ই প্রচারণা করুক না কেন, এ দুটি জিনিসের দাম দিয়ে আমি স্থিতিশীলতার আসল চিত্র বুঝতে পারি। এখন রাজনীতি হয়ে গেছে ভূরাজনীতি। এটি কিন্তু ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তানের দেশভাগের রাজনীতি কিংবা ১৯৭১ সালের পাকিস্তান বনাম পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে নেই। এটি কিন্তু ২০২৫ সালের বাংলাদেশ। আবার এখানে আন্তর্জাতিক বাজার কীভাবে নিয়ন্ত্রিত করে রাখা হয়, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। ডলারের দাম বেড়ে গেলে, আমাদের ক্রয়সীমা অতিক্রম করে ফেললে সবকিছু থমকে যাবে। তখন সাধারণ মানুষ বলবে, হাসিনার আমলেই ভালো ছিলাম! যেমনটা পাকিস্তান আমলে লোকে বলত, ব্রিটিশ আমলেই ভালো ছিলাম। আবার বাংলাদেশ পর্বেও কেউ কেউ বলতে পারে, পাকিস্তান আমলেই ভালো ছিলাম। সাধারণ মানুষ চায়, তাদের নিত্যদিনের খাবার সস্তায় কিনতে। এটি না পেলে তখন তার মনে হতে পারে, আগেই ভালো ছিলাম! আমাদের দেখতে হবে যে, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা যেন এই দেশে স্থাপিত হয়। এ জন্য আমি মনে করি, বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের যিনি প্রধান উপদেষ্টা আছেন, তিনি একমাত্র যোগ্য; যাঁর হাত ধরে এই দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসতে পারে। যারা নির্বাচনের কথা বলছেন, তারা এখনই যদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে রাখতে করণীয় বিষয়ে কাজ না করেন, তাহলে ভোগান্তি হবে। বাংলাদেশে ব্যাংকে পাঁচ লাখ টাকা তুলতে গেলে বসে থাকতে হয়, এটি আমাদের সবার বুঝতে হবে।
সমকাল: বাংলাদেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিবসটি ঘিরে এখন এক প্রকার উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। যখন আপনি দিবসটি নিয়ে প্রথমে ভাবতে শুরু করেছিলেন, তখন কী মনে হয়েছিল?
শফিক রেহমান: এতটা যে হবে, তা কিন্তু ভাবিনি। এখন আমার ধারণা, এটি আরও বড় হবে ভবিষ্যতে। এর অবশ্য কারণও আছে। বাংলাদেশে অন্য যেসব উৎসব হয়, সেগুলো হয় ধর্মীয়, নয়তো কোনো রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। এর বাইরে রয়েছে নববর্ষ। সব দিক থেকে ভালোবাসা দিবস একেবারেই আলাদা। আমি ভেবেছিলাম, এই দেশের মানুষের এত দুঃখ, দেশের মানুষ এত সহিংসতার মধ্যে থাকে, এ কারণে ভালোবাসার বাণী প্রচার করতে হবে। ভালোবাসা দিয়ে একজন আরেকজনের পাশে থাকবে। এখন জানা যাচ্ছে, ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বহু লোক বিয়ে করছে। এ দিনটি বাংলাদেশে অনেক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। যশোরে একদিনেই নাকি বিক্রি হয় কোটি টাকার ফুল!
সমকাল: জি। দিবসটি ঘিরে অর্থনৈতিক কার্যক্রমও কম নয়.
শফিক রেহমান: উৎসব যখন হয়, তখন বাণিজ্যিক বিষয় অটোমেটিক চলে আসে। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।
সমকাল: ভালোবাসার জন্য একটি আলাদা দিবসের ভাবনাটি কীভাবে পেলেন?
শফিক রেহমান: আমার প্রিয় শিল্পী মান্না দে। শুধু তিনি নন, আরও অনেক প্রিয় শিল্পী আর গীতিকারের গানের কিছু কলি আমি আমার বাড়ির দেয়ালে লিখে রেখেছিলাম। একদিন দেখি, এক বয়স্ক ফেরিওয়ালা দাঁড়িয়ে লেখাগুলো পড়ছেন। আমি তখন বাইরে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি যে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই লেখাগুলো পড়লেন, বলুন তো, কোন লেখা আপনার সবচেয়ে ভালো লাগল। তখন তিনি বললেন, ‘হৃদয় আছে যার, সেই তো ভালোবাসে/ প্রতিটি মানুষের জীবনে প্রেম আসে’– এই কথাগুলো তাঁর সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে। তাঁর মুখে এ কথা শুনে আমি অবাক হলাম। এর মানে তাঁরও জীবনে নিশ্চয়ই প্রেম এসেছিল। সাধারণ মানুষের জীবনে কীভাবে প্রেম আসে– এই ভাবনাটা তখন আমার পরিষ্কার হলো। তখন আমি ঠিক করলাম, বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসার মানে বোঝাতে হবে। ১৯৯২ সালে আমি যায়যায়দিন পত্রিকাটি আবার প্রকাশ করেছি। পরের বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডে সামনে রেখে আমরা একটি বিশেষ সংখ্যা বের করার পরিকল্পনা করি। আমরা পাঠকদের কাছে লেখা আহ্বান করি। আমি তখন বলেছিলাম, একটি দিনে প্রত্যেক মানুষের অন্তত সবার কাছে ভালোবাসাটা প্রকাশ করা উচিত। তখন ভেবেছিলাম, এই যে আমাদের দেশে এবং উপমহাদেশে এত সহিংসতা ঘটছে, এর অবসান ঘটাতে ভালোবাসা দরকার। বিলেতে যেমন ভালোবাসা দিবসটি প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই থাকে, সেখান থেকে আমি মনে করলাম ভালোবাসা দিবস শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নয়, সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। মা-বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়ের, দাদা-দাদি, নানা-নানির সঙ্গে নাতি-নাতনির, মানুষের মানুষের। পুলিশের সঙ্গে নাগরিকের। আমি মনে করেছি, এতে দেশে সহিংসতা কমে আসবে। আমরা তখন পাঠকদের কাছে অভিজ্ঞতা চেয়ে বিজ্ঞাপন দিলাম। পাঠকদের কাছ থেকে বিপুল সাড়া পেলাম। বস্তা বস্তা লেখা আসতে শুরু করল। বলতেই হবে, বাঙালি প্রেমিক। নইলে এত লেখা আমরা কেমন করে পেতাম! প্রথম ভালোবাসা সংখ্যা ছিল ৩২ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে ১৬ পৃষ্ঠা বরাদ্দ পাঠকদের জন্য। আমি ব্যাখ্যা করেছিলাম সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে বিষয়ে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ দিবসটি কীভাবে উদযাপন হওয়া উচিত– এ বিষয়ে আমরা মতামত জানতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম, সব ধরনের ভালোবাসার সম্পর্ক যেন এ ভালোবাসার দিবসটিতে স্মরণ করা হয়।
সমকাল: সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা বলেছেন, ‘ভালোবাসা দিবস’ আমাদের সংস্কৃতি নয়। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
শফিক রেহমান: এ ধরনের কথা যারা বলছেন, তাদের উদ্দেশে আমার একটি উপদেশ– তারা দয়া করে মোবাইল, কম্পিউটার, ফেসবুক ব্যবহার করা বন্ধ করে দিন। এমনকি নিউজ পেপার পড়াও বন্ধ করে দিতে পারেন। কারণ, এটি তো আপনার দেশে আগে ছিল না। এটি আপনার নয়। এসব অন্য দেশের সংস্কৃতি। এটি অন্য দেশের আবিষ্কার। অন্য দেশের সংস্কৃতি বলবেন না এটিকে, এভাবে সংস্কৃতিকে আলাদা করা যায় না। এটি একটি নদীর মতো চলমান প্রক্রিয়া। এটি গতিশীল থাকলেই দুনিয়া এগিয়ে যায়।
সমকাল: এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
শফিক রেহমান: সমকালকেও ধন্যবাদ। আমি এই দেশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি– আপনারা স্থিতিশীলতা বজায় রাখুন। শান্তি বজায় রাখুন। সহনশীলতা বজায় রাখুন। ভালোবাসাময় হয়ে উঠুক আমাদের দেশ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অন য দ শ র র জন ত কর ছ ল এই দ শ আম দ র অন শ চ আপন র দ বসট সমক ল
এছাড়াও পড়ুন:
যে কারণে সালাহ-ফন ডাইকদের কাছে এই শিরোপা বিশেষ
একসময় ইংলিশ ফুটবলের রাজা তারাই ছিল। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত তো বলতে গেলে লিভারপুলেরই একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ইংল্যান্ডের শীর্ষ লিগে। তখন অবশ্য নামটা প্রিমিয়ার লিগ ছিল না, ছিল প্রথম বিভাগ লিগ। ১৯৯২ সালে প্রিমিয়ার লিগ নাম হওয়ার পর থেকে যেন লিভারপুলের দুর্ভাগ্যের শুরু। প্রথম বিভাগ যুগে ১৮টি লিগ জেতা লিভারপুল প্রিমিয়ার লিগ যুগে এসে জিততেই ভুলে গেল!
প্রিমিয়ার লিগে শুরু হলো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের একচ্ছত্র রাজত্ব। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের অধীন ১৩বার লিগ জিতে ইউনাইটেডের মোট লিগ শিরোপা হয়ে গেল ২০টি। লিভারপুলকে পেরিয়ে তারা হয়ে গেল ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ক্লাব।
ইউনাইটেডের সেই আধিপত্যও শেষ হলো ২০১৩ সালে ফার্গুসনের অবসরের পর। কিন্তু রাজত্ব ফিরে পেল না লিভারপুল। ইংলিশ ফুটবলের নতুন রাজা হয়ে ওঠল ম্যানচেস্টার সিটি। পেপ গার্দিওলার অধীন সর্বশেষ সাত মৌসুমে ছয়বার শিরোপা জিতে সিটি একের পর এক নতুন রেকর্ড গড়তে থাকল।
আরও পড়ুনলাল সমুদ্রে গোল উৎসবে চ্যাম্পিয়ন লিভারপুল১১ ঘণ্টা আগেমাঝে ২০১৯-২০ মৌসুমে ৩০ বছর পর লিভারপুল পেল ইংলিশ লিগের শিরোপার স্বাদ। তবে পৃথিবী তখন করোনা মহামারি চলছে। শিরোপা উৎসব হলো না লিভারপুলের মনের মতো।
এবার আর্নে স্লটের অধীন প্রথম মৌসুমেই আবার চ্যাম্পিয়ন লিভারপুল। সেটাও কী রাজকীয়ভাবে! চার ম্যাচ হাতে রেখে, নিজেদের মাঠ অ্যানফিল্ডে, ভরা গ্যালারির সামনে। লিভারপুলের এটি ২০তম লিগ শিরোপা, ইউনাইটেডের সঙ্গে যৌথভাবে তারাও এখন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে সফল ক্লাব।
ইতিহাস গড়া এই ট্রফি জেতার পর কী বলছেন লিভারপুলের খেলোয়াড়েরাকোডি গাকপোর উদ্যাপন