ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের (মসিক) সড়ক উন্নয়ন ও ড্রেনেজ নেটওয়ার্কসহ নাগরিক সেবা উন্নতকরণ প্রকল্পের বিভিন্ন সড়ক ও ড্রেনের নির্মাণ কাজের অনিয়মের অভিযোগে সিটি করপোরেশনে আকস্মিক অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
প্রাথমিকভাবে রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, “বিষয়টি লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।”
রবিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শুরু হওয়া অভিযান চলে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। অভিযানের নেতৃত্ব দেন দুদকের সহকারী পরিচালক রাজু মো.
এসময় তাদের সঙ্গে ছিলেন সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোফাখখারুল ইসলাম।
রবিবার সকালে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীর রফিকুল ইসলাম মিঞার কাছ থেকে তিনটি প্যাকেজের কাজের বিভিন্ন নথি সংগ্রহ করার পর সেগুলো নিয়ে সরেজমিনে তদন্ত শুরু করে দুদক।
এসময় আমলাপাড়া এলাকায় নির্মিত সড়ক ও ড্রেনের নির্মাণকাজ যাচাই-বাছাই করেন কর্মকর্তারা। পরে নগরীর বাঘমারা ও ব্রাহ্মপল্লী এলাকার আরও দুই প্যাকেজের উন্নয়ন কাজ তদন্ত করে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
দুদকের সহকারী পরিচালক রাজু মো. সারওয়ার হোসেন জানান, ২০২৪ সালের ২১ মার্চ আলী আহাম্মদ নামের একজন বাসিন্দা দুদকের ময়মনসিংহ কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে বলা হয়, উন্নয়নের প্রকল্পের কাজ যতটুকু হয়েছে, তার চেয়ে বেশি দেখিয়ে বিল উত্তোলন করা হয়েছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক প্রধান কার্যালয় থেকে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়।
তিনি আরো জানান, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের আমলাপাড়া, ব্রাহ্মপল্লী ও বাঘমারা ড্রেন ও সড়ক নির্মাণ এই তিনটি প্রকল্পের দুই কোটি ৭৮ লক্ষ টাকার কাজের অনিয়মের অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। প্রাথমিকভাবে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
দুদকের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ হিসেবে থাকা ময়মনসিংহ সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোফাখখারুল ইসলাম বলেন, “ফিতা টেনে রাস্তা পরিমাপ করে কমবেশি পাওয়া গেছে। সকলের সম্মিলিত স্বাক্ষরে প্রতিবেদন দেয়া হবে। মাপঝোঁকের সময় সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাও ছিলেন।”
সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) আজহারুল হক বলেন, “যে অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদক অভিযান চালিয়ে সেখানে কোন প্রকার দুর্নীতি হয়নি। ক্ষোভ বশত কেউ অভিযোগ দায়েরে করেছে, এটি সিটি করপোরেশনের সম্মানহানি ছাড়া কিছু নয়।”
সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মিঞা বলেন, “দুদক অভিযান করবে ভালো কথা কিন্তু অবগত না করে হুটহাট করে আসা ঠিক হয়নি। আমাদের কোন কাজে তারা কখনও অনিয়ম খুঁজে পাবে না। কারণ, আমরা স্বচ্ছতার মধ্য থেকে কাজ করার চেষ্টা করি।”
২০১৮ সালে সিটি করপোরেশন গঠিত হওয়ার পর ২০২০ সালের ৭ ডিসেম্বর সরকার উন্নয়ন প্রকল্পে ১ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করে। সিটি করপোরেশন গঠনের দীর্ঘ বছরেও কাঙ্খিত উন্নয়ন হয়নি নগরবাসীর। এ নিয়ে মানুষের ক্ষোভ রয়েছে।
ঢাকা/মিলন/এস
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ল ইসল ম প রকল প সড়ক ও
এছাড়াও পড়ুন:
‘রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই’
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর আনন্দিপুর গ্রামের মামুন মিয়া (২২) ছোটবেলা থেকে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। প্রায় প্রতি মাসেই তাঁর একাধিক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এক সময় রক্তের জোগাড় বেশ কষ্টসাধ্যই হয়ে ওঠে। মানুষ বিনা স্বার্থে রক্ত দিতে চাইতেন না। ২০১৬ সাল থেকে পরিবারটিকে রক্তের জন্য আর কাউকে অনুরোধ করতে হচ্ছে না। মামুনের পাশে দাঁড়িয়েছে জেলার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
সম্প্রতি মামুনের মা মাজেদা বেগম অতীতের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘পোলার রক্তের লাইগ্গা মাইনষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কেউ রক্ত দিতে চাইতো না। মানুষ টাকা ভিক্ষা চায়, আর আমি মানুষের কাছে আমার পোলার জন্য রক্ত ভিক্ষা করছি। শইল্যে রক্ত না ভরলে আমার পোলা মইরা যাইতো।’
দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ব্যক্তি, জরুরি বা সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার, ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়া কিংবা কিডনি আক্রান্ত রোগীর জন্য প্রায়ই প্রয়োজন হয় রক্তের। আত্মীয়স্বজন বা চেনাজানা কারও কাছে প্রয়োজনমাফিক রক্ত না পেয়ে অনেকেই ছুটে যান স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের কাছে। খবর পেয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা দ্রুততার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রক্তদাতাকে খুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর মানুষের জীবন বাঁচানোর মতো মহৎ এই কাজেই তাঁদের আনন্দ বলে জানান ময়মনসিংহের ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কয়েকজন কর্মী।
শুধু রক্তদান নয়, সমাজ পরিবর্তনে নানা কাজও করে চলেছে তরুণদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট এটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন পায়। তবে এর দু-এক বছর আগেই সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয় বলে জানান সংগঠনটির মূল পরিকল্পনাকারী মমিনুর রহমান। তাঁর বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ এলাকায়।
সম্প্রতি মমিনুর রহমান বলেন, ‘শুধু রক্তের অভাবে একটি মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে না, এই চিন্তা থেকে কাজ শুরু করি। ময়মনসিংহে রক্তদান নিয়ে কাজ করে—এমন কোনো সংগঠন ছিল না। তখন স্থানীয়ভাবে মানুষকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাম্পেইন করে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর ৩৯ জনকে নিয়ে প্রথম সভা করি। পরে সেখান থেকে রক্তদানের এই সংগঠন করার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। যেহেতু ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বসে ওই সভা হয়েছিল, তাই সংগঠনটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’। ‘আর্তের মুখে হাসি ফোটানোই হয় যদি মানবতা, তবে তার শ্রেষ্ঠ সেবক হলো প্রতিটি রক্তদাতা’, এই স্লোগান সামনে রেখে শুরু হয় এর যাত্রা।
সংগঠনটি থেকে জানানো হয়েছে, রক্তদাতা তরুণেরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সংগঠনটির একটি কমিটি ও ফেসবুক পেজ আছে। এর মাধ্যমে কিংবা মুঠোফোনে খবর পেয়েই রক্ত দিতে ছুটে যান তরুণেরা। তরুণদের তৎপরতায় দিন দিন সংগঠনটির পরিসর বাড়ছে। বর্তমানে এই সংগঠনের প্রায় ৫০ হাজার সদস্য আছেন, যাঁরা নিজেরা রক্তদান করেন এবং রক্তদানে অন্য তরুণদের উৎসাহিত করেন। ২০ বারের বেশি রক্ত দিয়েছেন, এমন রক্তদাতা আছেন ৮০ জন, যার ৬০ জনই শিক্ষার্থী। শুধু ময়মনসিংহ শহরেই ইতিমধ্যে ৩৫ হাজার ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন সংগঠনটির তরুণেরা। এর মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ২০১৮ সাল থেকে ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। এ পর্যন্ত তিনি ২৬ বার রক্ত দিয়েছেন। অন্যদের উৎসাহী করতে তিনি বলেন, ‘মুমূর্ষু অবস্থায় মানুষ রক্তের কারণে মারা যাবে, এটি কখনো হতে পারে না। তাই অসুস্থ জটিল রোগীর খবর পেলেই রক্ত দিতে যাই। রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই।’
সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি আবিদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সুমন রাহাত। স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত আবিদুর রহমান বলেন, ‘যাঁদের রক্তের প্রয়োজন, তাঁরা আমাদের ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করেন। অথবা রক্তের প্রয়োজন ফেসবুকে কারও স্ট্যাটাস দেখলেই আমরা নিজে থেকে যোগাযোগ করে রক্তের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। আমরা রক্তদানের মাধ্যমে অন্যের জীবন বাঁচিয়ে আনন্দিত হই। আমরা মানুষ বাঁচানোর এই আনন্দ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। গ্রামে, পাড়ায় মহল্লায় রক্তের জন্য মানুষ যেন না মরে, এটিই আমাদের লক্ষ্য।’