প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হলো। বৈঠকে ২৭টি দল ও জোটের প্রায় ১০০ রাজনীতিক অংশ নেন। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর এটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় তৎপরতা। আগামী ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের কাজ শেষ করবে। সমকাল জানাচ্ছে, ‘আগে সংসদ, না স্থানীয় সরকার নির্বাচন– প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রথম বৈঠকেই ভিন্নমত দেখা গেছে। বিএনপি এবং সমমনারা জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্য যে কোনো নির্বাচনের ঘোর বিরোধী। তবে ছাত্র নেতৃত্ব ছাড়াও জামায়াতে ইসলামী ও গণঅধিকার পরিষদ আগে স্থানীয় নির্বাচন চাইছে’ (১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫)।

আগে সংস্কার, না আগে নির্বাচন– এ রকম একটি বিতর্ক গণঅভ্যুত্থানউত্তর রাজনীতিতে চলমান ইস্যু হয়ে আছে। গত ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, যদি ন্যূনতম সংস্কার করে নির্বাচন দিতে হয়, তবে ’২৫ সালের ডিসেম্বরে তা হতে পারে। আর যদি পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করে নির্বাচন দিতে হয়, তবে তা ’২৬ সালের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে। ড.

ইউনূসের ঘোষণায় বোঝা যায়, সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সমান্তরালভাবেই দেখছে সরকার; সেভাবেই সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক। তবে প্রথম বৈঠকেই স্থানীয় সরকার প্রশ্নে মতবিরোধ কয়েকটি বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে।

গত সপ্তাহে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। তাঁর মতে, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি কাউন্সিলর, পৌর কাউন্সিলর পদগুলোয় জনপ্রতিনিধি নেই। জনগণের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের এই দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা নেই। এতে জনসেবামূলক ও দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত হলেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। 
জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে বৈঠক করে সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য তাদের পরামর্শ দেয়। দলটির এই মতামতের প্রতিক্রিয়ায় সেদিনই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাওয়াকে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেশকে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছাড়া কিছুই নয়।’ 
এই মতবিরোধ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠকেও প্রকাশিত হয়। দেশে সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন। সারাদেশে ধাপে ধাপে সবক’টি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন করতে হলে এক বছরের মতো সময় লাগবে বলে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে ইসি জানিয়েছে।  

২.
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হওয়া সত্ত্বেও এটা আগে করবার পক্ষপাতী যারা, তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেদের দল গোছানোর জন্য আরও সময় সন্ধান করছেন। নইলে দেশের যে অনিয়ন্ত্রিত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, তাতে সংসদ নির্বাচনের আগে এক বছর ধরে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন অবশ্যই উচ্চাভিলাষী চিন্তা। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তার ন্যূনতম বাস্তবায়ন করে সারাদেশে প্রান্তিক পর্যায়ে বছরব্যাপী নির্বাচনের হাঙ্গামা সামাল দেবার মতো সামর্থ্য অন্তর্বর্তী সরকারের আছে বলে মনে হয় না। দেশব্যাপী একের পর এক অসহিষ্ণু ঘটনার পেছনে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদী সরকারের অনুচরেরা নেই, তা যেমন বলা যাবে না; একই সঙ্গে এ-ও বলা যাবে না যে, অনেক পক্ষই চায় না– দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক সরকার আসুক। তাই নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় সবার আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানেই অন্তর্বর্তী সরকারের মনোযোগ দেওয়া উচিত।

৩.
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরুণ তুর্কিরা চাইতেই পারেন। দীর্ঘ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দেশজুড়ে তৃণমূলের সঙ্গে নিজেদের মিথস্ক্রিয়া হবে, এই চিন্তা নতুন দলের দিক থেকে নেতিবাচক কিছু নয়; বরং ঠিকই আছে। কিন্তু জামায়াত? পোড়খাওয়া এই রাজনৈতিক দলের অজানা নয় দেশের ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা। তৃণমূলের নির্বাচনে যে হানাহানি ঘটে, এটিও দলটি ভালোই জানে। তারপরও জাতীয় নির্বাচনের আগে তারা কেন স্থানীয় নির্বাচন চাইছে? পরাজিত আওয়ামী লীগের বিশাল কর্মী বাহিনীকে নিজেদের বলয়ে নিয়ে আসার সুপ্ত চিন্তা তাদের মধ্যে যে কাজ করছে না, তা সহজে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী অনেকে পরিচয় লুকিয়ে ছাত্রলীগে মিশে ছিলেন। এবার কি তবে শিবির-জামায়াতের বলয়ে আশ্রয় নেবে আওয়ামী লীগাররা? জামায়াত এই সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করলে অবাক হবার কিছুই থাকবে না। একই সমীকরণ মেলাতে চাইতে পারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও। যে তুমুল উদ্যোগ ও আয়োজনে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করবার দাবি জানায় জামায়াত ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন; তাতে এ প্রশ্ন নিশ্চিতভাবে জাগে– গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের মূল নেতৃবৃন্দ দোষী। তাদের আইনানুগ শাস্তি হতে হবে; কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে কেন নিষিদ্ধ করতে হবে? দেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দলটি তাদের অপরিণামদর্শী নেতৃত্বের অপশাসনের কারণে নিষিদ্ধ হয়ে যাবে? 
নিজেদের রাজনৈতিক সম্প্রসারণের চিন্তা থেকেই কি এই নিষিদ্ধ চিন্তা?

৪.
দেশের গণতান্ত্রিক বিকাশ নিশ্চিত করবার জন্য সকল মত ও পথের সহাবস্থান একান্তভাবে জরুরি। আওয়ামী লীগ আমলে শেষ তিনটি ছলচাতুরীর নির্বাচনে যেভাবে বিরোধীদলীয় মতকে বাতিল করা হয়েছে, তাতে দেশ একনায়কতান্ত্রিক শাসনে অবরুদ্ধ হয়ে ওঠে। তারই চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান। এর ফলে বহুমতের গণতান্ত্রিক সমাজ তৈরির যে অসামান্য সুযোগ উপস্থিত হয়েছে, তাতে নানা ছলচাতুরীতে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে সে-ই শূন্যস্থানে নিজেদের স্থাপন করবার চেষ্টা গণতান্ত্রিক আচরণ হতে পারে না। নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশ নিতে দিন। জনগণই জানিয়ে দিক, তারা দলগতভাবে কতটা খারাপ কাজ করেছিল! জনতার রায়কে নিজের হাতে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যে ভুল আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ করে আজ দেশ থেকে বিতাড়িত, সেই একই ধরনের আত্মম্ভরী, কর্তৃত্ববাদী আচরণ মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রত্যাশিত নয়। ডান-বাম-মধ্যপন্থি-উদার– সব রাজনৈতিক মত পাশাপাশি বিরাজ করুক বহুমতের বাংলাদেশে। 
দলীয় আদর্শ, নেতাদের ত্যাগ ও পরিশ্রম একটি রাজনৈতিক দলকে জনগণের সামনে নিয়ে আসে। ছলচাতুরী কিংবা সংক্ষিপ্ত রাস্তায় উল্লম্ফনের চেষ্টা আত্মধ্বংসী প্রক্রিয়া; জনতার দরবারে তা কোনোভাবেই টেকে না। ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, সংস্কারসহ প্রাসঙ্গিক সব বিষয়ে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ওয়েবসাইটে তুলে দেবেন। জনসাধারণ সরাসরি রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত জানতে পারবেন।

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, আপাতভাবে এটি শুভ পদক্ষেপ মনে হলেও এর ভেতরে শুভঙ্করের ফাঁকি চোখে পড়ে। ২৭টি রাজনৈতিক দল নিয়ে আপনার নেতৃত্বে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে কয়টি দলের জনসম্পৃক্ততা রয়েছে? সব ক’টি দলই একই মনোভঙ্গি ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে জনমানুষের সঙ্গে কাজ করে অভ্যস্ত, নাকি সুযোগ বুঝে অনেকেই আসন পেতেছে?
রাজনীতির এই জটিল গোলকধাঁধায় জাতি যাতে বিভ্রান্ত না হয়, তার লাগাম তাই প্রধান উপদেষ্টার হাতেই রাখতে হবে। সুযোগ অনেকেই সন্ধান করবেন, দেশকে সহনশীল উদার গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জে নেতৃত্ব তাঁকেই দিতে হবে।

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল ও সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক র জন য অন ষ ঠ আওয় ম ইসল ম করব র

এছাড়াও পড়ুন:

আলী রীয়াজের সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএ পরিচালকের বৈঠক

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সাথে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেক্টোরাল অ্যাসিস্ট্যান্সের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভিত্তিক কর্মসূচির পরিচালক লীনা রিখিলা তামাংয়ের সাথে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সোমবার (২৮ এপ্রিল) রাজধানীর সংসদ ভবনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যালয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএ এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার গ্রেইস প্রিয়েটো উপস্থিত ছিলেন।

কমিশনের পক্ষে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “সংস্কার সংক্রান্ত ৫টি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ সম্পর্কে  রাজনৈতিক দলগুলোর সুনির্দিষ্ট  মতামত জানতে ইতোমধ্যে সুপারিশমালা স্প্রেডশিট আকারে তাদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩৫টি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে আমরা মতামত পেয়েছি এবং তার ভিত্তিতে ২০টি দলের সাথে প্রাথমিকভাবে আলোচনা করেছে কমিশন। আগামী দিনগুলোতেও এ আলোচনা অব্যাহত থাকবে।”

আরো পড়ুন:

জ্বালানি উপদেষ্টার পিএসকে বদ‌লি

পুলিশ সপ্তাহ শুরু মঙ্গলবার, নির্বাচনী নির্দেশনা পাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এমন একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে চায় কমিশন, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পথরেখা তৈরি করবে।”

বৈঠকে ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএর পরিচালক লীনা রিখিলা তামাং কমিশনের কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

ঢাকা/এএএম/এসবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অনির্বাচিত সরকারের করিডোর দেওয়ার এখতিয়ার নেই: বিএনপি
  • অনির্বাচিত সরকারের করিডোর দেওয়ার এখতিয়ার নেই
  • ‘মানবিক করিডর’ প্রতিষ্ঠার আগে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে হবে: চরমোনাই পীর
  • এই প্রথম সকলে মিলে রাষ্ট্র বিনির্মাণের সুযোগ তৈরি হয়েছে: আলী রীয়াজ
  • প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক
  • মানবিক করিডরের সিদ্ধান্ত হলেও শর্ত নিয়ে চলছে আলোচনা
  • ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক
  • প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি পর্যালোচনা
  • প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত
  • আলী রীয়াজের সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএ পরিচালকের বৈঠক