সেন্ট মার্টিনের সৈকতজুড়ে শামুক-ঝিনুকের বিচরণ, মাথা তুলছে গাছপালা
Published: 19th, February 2025 GMT
বঙ্গোপসাগরের বুকে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বীপটিতে বন্ধ রয়েছে পর্যটকদের যাতায়াত। পর্যটক না থাকায় দ্বীপটির জনশূন্য সৈকতে এখন বেড়েছে শামুক-ঝিনুকের বিচরণ। দ্বীপের দক্ষিণ পাশের দিয়ারমাথা ও ছেঁড়াদিয়াতেও সবুজ প্যারাবন ও কেয়াগাছ জাগছে।
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় অবস্থিত দ্বীপটিতে অন্য বছরগুলোতে ৩১ মার্চ পর্যন্ত পর্যটকেরা যাতায়াতের সুযোগ পেতেন। তবে এবার সুযোগ রাখা হয় ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। আগে প্রতিদিন পাঁচ হাজার পর্যটক দ্বীপটিতে ভ্রমণের সুযোগ পেলেও এবার ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এর আগের দুই মাসে প্রতিদিন দুই হাজার করে পর্যটক যেতে পেরেছেন।
সেন্ট মার্টিনে প্রবাল, শৈবাল, কাছিম, শামুক, ঝিনুক, সামুদ্রিক মাছ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, কাঁকড়াসহ ১ হাজার ৭৬ প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। বিলুপ্তপ্রায় জলপাই রঙের কাছিমের ডিম পাড়ার স্থানও এই দ্বীপের বালিয়াড়ি। তবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, বিপুলসংখ্যক পর্যটকের সমাগম ও পরিবেশদূষণের কারণে দ্বীপটি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে।
পর্যটক যাতায়াত বন্ধের পর দ্বীপটিতে সম্প্রতি বর্জ্য অপসারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্যোগে দুই দিনের বিশেষ কর্মসূচি পালন করা হয়। ড্রোনের সাহায্যে পুরো দ্বীপে জমে থাকা বর্জ্য শনাক্ত করে অপসারণ করা হয়েছে। দুই দিনের অভিযানে ৯৩০ কেজি বর্জ্য অপসারণ করেন স্বেচ্ছাসেবীরা।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক মো.
পরিবেশ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, পর্যটকদের বিচরণ এবং ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক-টমটম ও মোটরসাইকেলের দৌড়ঝাঁপ বন্ধ থাকায় এরই মধ্যে দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব ও পশ্চিম অংশের অন্তত ৭-৮ কিলোমিটার সৈকতে শামুক-ঝিনুকের আস্তর জমতে শুরু করেছে। শামুক-ঝিনুক সৈকতের বালুর ক্ষয় রোধ করে এবং বালিয়াড়ি বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা করে। আগে লোকজন সৈকত থেকে শামুক-ঝিনুক আহরণ করে মিয়ানমারে পাচার করত। শামুক-ঝিনুক দিয়ে আসবাব, মালা ইত্যাদি তৈরি হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৯ সালে দ্বীপটিকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী সেন্ট মার্টিন দ্বীপসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। এর আগে ২০১৬ সালে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা জারি করা হয়।
সেন্ট মার্টিনের স্থানীয় ব্যবসায়ী নুর মোহাম্মদ (৫০) বলেন, কাজ না থাকলে স্থানীয় মানুষ সৈকতে নামেন না। ছেঁড়াদিয়া, দিয়ারমাথার দিকেও কারও পা পড়ে না। কিন্তু পর্যটকেরা দ্বীপে এলে বিভিন্ন যানবাহনে পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখেন। দ্বীপের মধ্যভাগে যানবাহন চলাচলের কয়েক কিলোমিটার পাকা সড়ক থাকলেও দিয়ারমাথা, ছেঁড়াদিয়া যেতে হলে সৈকতের বালুচর দিয়ে যেতে হয়। তাতে শামুক-ঝিনুক, কড়ি, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু হয়। ধ্বংস হয় প্রবাল-শৈবালসহ জীববৈচিত্র্য। তিনি আরও বলেন, দিয়ারমাথা, গলাচিপাসহ দ্বীপে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন ও ভ্রমণ নিষিদ্ধ এলাকায় অনেক হোটেল-রিসোর্ট-কটেজ তৈরি হয়েছে। এসব হোটেলের অতিথিদের যাতায়াত করতে হয় সৈকত দিয়ে। এখন পর্যটক না থাকায় সামুদ্রিক প্রাণী-জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষা হচ্ছে। আয়রোজগারের জন্য স্থানীয় লোকজন সাগরে মাছ ধরছেন, কেউ মাছ শুঁটকি করছেন, কেউ আবার সবজি-তরমুজ চাষে ব্যস্ত।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নাজির হোসেন বলেন, দিয়ারমাথাসহ দক্ষিণাংশে পাথরের স্তূপে ভরপুর এক একরের বেশি সৈকতে সবুজ প্যারাবন সৃজিত হচ্ছে। গাছগুলো দ্রুত মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। স্থানীয় লোকজন যাতে প্যারাবন উজাড় করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।
দ্বীপের দক্ষিণ পাড়ার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, আগে পর্যটকবাহী জাহাজের প্রপেলারের ঘূর্ণিপাকে বালু মিশে সমুদ্রের নীলজল ঘোলাটে হয়ে পড়ত। পানির বোতল, পলিথিন, চিপসের প্যাকেট সাগরের পানিতে ভাসত। জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় সমুদ্রের পানি এখন স্বচ্ছ নীল রং ধারণ করেছে। সমুদ্রের পানিতে এখন প্লাস্টিক বর্জ্য চোখে পড়ে না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ২ ফেব্রুয়ারি এক বৈঠকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রথম ধাপে দ্বীপের বর্জ্য শনাক্ত এবং অপসারণ করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা, জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ ও বেকার লোকজনকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম জিহাদী প্রথম আলোকে বলেন, দ্বীপে হোটেল-রিসোর্ট-কটেজ রয়েছে ২৩০টির বেশি। তবে এর কোনোটিরই পরিবেশ ছাড়পত্র নেই।
পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল বলেন, প্রথমবারের মতো পর্যটক সীমিত করার উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশের উন্নতি ঘটেছে। ভ্রমণের সময়টুকুতে (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) কঠোর নজরদারির কারণে সমুদ্র থেকে প্রবাল আহরণ হয়নি। সৈকতে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় না থাকায় মা কাছিমের ডিম পাড়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। লাল কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকেরও বংশবিস্তার ঘটেছে।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কক্সবাজারে পর্যটকের ঢল, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ
রাজধানী ঢাকা থেকে ছুটিতে পরিবার নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছেন হাবিবুল আউয়াল। ভালো হোটেলে রুম না পাওয়ায় শহরের কলাতলী এলাকায় মধ্যমমানের একটি আবাসিক হোটেলে উঠেছেন। তাঁর কাছে এক রাতের জন্য হোটেলটির দুটি রুমের ভাড়া নেওয়া হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। যদিও অন্য সময়ে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকায় এই মানের হোটেলে রুম ভাড়া পাওয়া যায়। ঈদ মৌসুমে চাহিদা বাড়ায় অন্য সময়ের তুলনায় ১২ গুণের বেশি ভাড়া নেওয়া হয়েছে তাঁর কাছ থেকে।
কোরবানির ঈদ ও পরবর্তী ছুটির সময়ে অতিরিক্ত পর্যটক আসায় কক্সবাজার শহর ও এর আশপাশের পাঁচ শতাধিক আবাসিক হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস ও রিসোর্টের প্রায় প্রতিটিতেই অন্য সময়ের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ গুণ বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। শুধু আবাসিক হোটেল নয়, রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে পর্যটনসংশ্লিষ্ট সব সেবা খাতেই অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, প্রতিটি ছুটির মৌসুমে কক্সবাজারে পর্যটকদের সংখ্যা একটু বাড়লেই তাদের কাছ থেকে ‘গলাকাটা’ টাকা নেওয়া হয়।
ঈদুল আজহার লম্বা ছুটি শেষ হচ্ছে আজ। গতকাল শুক্রবার কক্সবাজার সৈকতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। লাবণী পয়েন্ট থেকে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকায় ছিল পর্যটকের ভিড়। সাগরতীর পরিণত হয়েছিল উৎসবের বেলাভূমিতে। শুক্রবার সকাল থেকে তীব্র গরম থাকলেও পর্যটকে পূর্ণ ছিল কক্সবাজার সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট, লাবণী, কলাতলী, হিমছড়ি, ইনানী, পাতুয়ারটেক থেকে মেরিন ড্রাইভ পর্যন্ত পুরো এলাকা।
রাজধানীর মতিঝিল থেকে ঘুরতে আসা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এখন সমুদ্রে গোসল করছি। বিকেলে মেরিন ড্রাইভে ঘুরব, এরপর শনিবার রাতে ঢাকায় ফিরে যাব।’ নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা আসিফ আহমেদ বলেন, ‘অনেক মানুষ, তবুও পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দ করছি, ছবি তুলছি, বিচ বাইক ও ঘোড়ায় চড়েছি।’
কক্সবাজার শহরের পাঁচতারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইস লিমিটেডের বিপণন ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ নুর সোমেল সাংবাদিকদের বলেন, শুক্রবার পর্যন্ত তাদের হোটেলের ৭০-৮৫ শতাংশ রুম বুকিং রয়েছে। যদিও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক হোটেল ব্যবসায়ী জানান, ১৩ জুন পর্যন্ত অধিকাংশ আবাসিক হোটেল সম্পূর্ণ বুকিং হয়ে গেছে। তবে প্রশাসন, কর ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের ফাঁকি দিতে তারা বিষয়টি স্বীকার করতে চান না।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের এএসপি নিত্যানন্দ দাস বলেন, এবার কোরবানির ঈদের পর গত সাত দিনে আট লাখের বেশি মানুষ কক্সবাজার ভ্রমণ করেছেন। তিনি বলেন, অতীতের মতো এবারও শহর ও সমুদ্রসৈকতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রোধে ওয়াচ টাওয়ার থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া সৈকতের প্রতিটি গোলঘরে সার্বক্ষণিক পুলিশের অবস্থান এবং মোবাইল টিমসহ কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পর্যটন স্পটগুলোতে সাদা পোশাকেও দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ সদস্যরা।
আবাসিক হোটেলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে এএসপি জানান, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গত কয়েকদিন এমন পাঁচটি অভিযোগ পাওয়া গেছে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাহিদুল আলম বলেন, পর্যটকদের হয়রানি রোধে তিনজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত মাইকিং করা হচ্ছে।