বঙ্গোপসাগরের বুকে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বীপটিতে বন্ধ রয়েছে পর্যটকদের যাতায়াত। পর্যটক না থাকায় দ্বীপটির জনশূন্য সৈকতে এখন বেড়েছে শামুক-ঝিনুকের বিচরণ। দ্বীপের দক্ষিণ পাশের দিয়ারমাথা ও ছেঁড়াদিয়াতেও সবুজ প্যারাবন ও কেয়াগাছ জাগছে।

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় অবস্থিত দ্বীপটিতে অন্য বছরগুলোতে ৩১ মার্চ পর্যন্ত পর্যটকেরা যাতায়াতের সুযোগ পেতেন। তবে এবার সুযোগ রাখা হয় ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। আগে প্রতিদিন পাঁচ হাজার পর্যটক দ্বীপটিতে ভ্রমণের সুযোগ পেলেও এবার ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এর আগের দুই মাসে প্রতিদিন দুই হাজার করে পর্যটক যেতে পেরেছেন।

সেন্ট মার্টিনে প্রবাল, শৈবাল, কাছিম, শামুক, ঝিনুক, সামুদ্রিক মাছ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, কাঁকড়াসহ ১ হাজার ৭৬ প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। বিলুপ্তপ্রায় জলপাই রঙের কাছিমের ডিম পাড়ার স্থানও এই দ্বীপের বালিয়াড়ি। তবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, বিপুলসংখ্যক পর্যটকের সমাগম ও পরিবেশদূষণের কারণে দ্বীপটি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে।

পর্যটক যাতায়াত বন্ধের পর দ্বীপটিতে সম্প্রতি বর্জ্য অপসারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্যোগে দুই দিনের বিশেষ কর্মসূচি পালন করা হয়। ড্রোনের সাহায্যে পুরো দ্বীপে জমে থাকা বর্জ্য শনাক্ত করে অপসারণ করা হয়েছে। দুই দিনের অভিযানে ৯৩০ কেজি বর্জ্য অপসারণ করেন স্বেচ্ছাসেবীরা।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক মো.

জমির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ৫ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি দল সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পৌঁছে একাধিক ড্রোনের মাধ্যমে বর্জ্য পড়ে থাকার স্থান শনাক্ত করে। ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে এসব বর্জ্য অপসারণ শুরু হয়। বর্জ্যের মধ্যে ৯০ শতাংশই ছিল চিপসের প্যাকেট, পলিথিন ও বিস্কুটের প্যাকেট। এর আগে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশ অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে সৈকতসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, পর্যটকদের বিচরণ এবং ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক-টমটম ও মোটরসাইকেলের দৌড়ঝাঁপ বন্ধ থাকায় এরই মধ্যে দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব ও পশ্চিম অংশের অন্তত ৭-৮ কিলোমিটার সৈকতে শামুক-ঝিনুকের আস্তর জমতে শুরু করেছে। শামুক-ঝিনুক সৈকতের বালুর ক্ষয় রোধ করে এবং বালিয়াড়ি বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা করে। আগে লোকজন সৈকত থেকে শামুক-ঝিনুক আহরণ করে মিয়ানমারে পাচার করত। শামুক-ঝিনুক দিয়ে আসবাব, মালা ইত্যাদি তৈরি হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৯ সালে দ্বীপটিকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী সেন্ট মার্টিন দ্বীপসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। এর আগে ২০১৬ সালে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা জারি করা হয়।

সেন্ট মার্টিনের স্থানীয় ব্যবসায়ী নুর মোহাম্মদ (৫০) বলেন, কাজ না থাকলে স্থানীয় মানুষ সৈকতে নামেন না। ছেঁড়াদিয়া, দিয়ারমাথার দিকেও কারও পা পড়ে না। কিন্তু পর্যটকেরা দ্বীপে এলে বিভিন্ন যানবাহনে পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখেন। দ্বীপের মধ্যভাগে যানবাহন চলাচলের কয়েক কিলোমিটার পাকা সড়ক থাকলেও দিয়ারমাথা, ছেঁড়াদিয়া যেতে হলে সৈকতের বালুচর দিয়ে যেতে হয়। তাতে শামুক-ঝিনুক, কড়ি, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু হয়। ধ্বংস হয় প্রবাল-শৈবালসহ জীববৈচিত্র্য। তিনি আরও বলেন, দিয়ারমাথা, গলাচিপাসহ দ্বীপে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন ও ভ্রমণ নিষিদ্ধ এলাকায় অনেক হোটেল-রিসোর্ট-কটেজ তৈরি হয়েছে। এসব হোটেলের অতিথিদের যাতায়াত করতে হয় সৈকত দিয়ে। এখন পর্যটক না থাকায় সামুদ্রিক প্রাণী-জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষা হচ্ছে। আয়রোজগারের জন্য স্থানীয় লোকজন সাগরে মাছ ধরছেন, কেউ মাছ শুঁটকি করছেন, কেউ আবার সবজি-তরমুজ চাষে ব্যস্ত।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নাজির হোসেন বলেন, দিয়ারমাথাসহ দক্ষিণাংশে পাথরের স্তূপে ভরপুর এক একরের বেশি সৈকতে সবুজ প্যারাবন সৃজিত হচ্ছে। গাছগুলো দ্রুত মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। স্থানীয় লোকজন যাতে প্যারাবন উজাড় করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।

দ্বীপের দক্ষিণ পাড়ার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, আগে পর্যটকবাহী জাহাজের প্রপেলারের ঘূর্ণিপাকে বালু মিশে সমুদ্রের নীলজল ঘোলাটে হয়ে পড়ত। পানির বোতল, পলিথিন, চিপসের প্যাকেট সাগরের পানিতে ভাসত। জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় সমুদ্রের পানি এখন স্বচ্ছ নীল রং ধারণ করেছে। সমুদ্রের পানিতে এখন প্লাস্টিক বর্জ্য চোখে পড়ে না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ২ ফেব্রুয়ারি এক বৈঠকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রথম ধাপে দ্বীপের বর্জ্য শনাক্ত এবং অপসারণ করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা, জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ ও বেকার লোকজনকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম জিহাদী প্রথম আলোকে বলেন, দ্বীপে হোটেল-রিসোর্ট-কটেজ রয়েছে ২৩০টির বেশি। তবে এর কোনোটিরই পরিবেশ ছাড়পত্র নেই।

পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল বলেন, প্রথমবারের মতো পর্যটক সীমিত করার উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশের উন্নতি ঘটেছে। ভ্রমণের সময়টুকুতে (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) কঠোর নজরদারির কারণে সমুদ্র থেকে প্রবাল আহরণ হয়নি। সৈকতে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় না থাকায় মা কাছিমের ডিম পাড়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। লাল কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকেরও বংশবিস্তার ঘটেছে।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

হামলার পর আশা ও আতঙ্কের মধ্যে পেহেলগামে ধীরে ধীরে ফিরছেন পর্যটকেরা

ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পাহাড়ি পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামের কাছে এক প্রাণঘাতী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার এক সপ্তাহ পর শহরটিতে এখনো থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। অবশ্য সেখানে অল্প অল্প করে পর্যটক ফিরতে শুরু করেছেন।

গত সপ্তাহে শহরের প্রধান মহাসড়ক একেবারে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, খালি হয়ে গিয়েছিল হোটেলগুলো। এখন সেখানে আবার অল্প অল্প করে প্রাণ ফিরছে।

গত মঙ্গলবার পেহেলগাম থেকে তিন মাইল (৫ কিলোমিটার) দূরে পাহাড়চূড়ার উপত্যকা বৈসারানে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের ওপর গুলি চালায় একদল বন্দুকধারী। এই বৈসারানকে অনেক সময় ‘ভারতের সুইজারল্যান্ড’ বলা হয়।

বৈসারানের হামলাকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, যা অনেক পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়েছে এবং ভারতজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

হামলার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্কে উত্তেজনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। উভয় দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কাশ্মীরের দুই অংশ দুই দেশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তরে পুরো অঞ্চলকে দুই দেশই নিজেদের বলে দাবি করে থাকে।

দিল্লি এ হামলার কোনো সামরিক জবাব দেবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা বাড়ছে।

১৯৮৯ সালে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরুর পর থেকে কাশ্মীরে প্রায়ই হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এসব ঘটনায় কখনো নিরাপত্তা বাহিনী আবার কখনো বেসামরিক নাগরিকদের নিশানা করা হয়েছে। কিন্তু পর্যটকদের এভাবে প্রকাশ্যে হত্যার ঘটনা বিরল এবং তা স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের হতবাক ও আতঙ্কিত করেছে।

১৯৮৯ সালে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরুর পর থেকে কাশ্মীরে প্রায়ই হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এসব ঘটনায় কখনো নিরাপত্তা বাহিনী আবার কখনো বেসামরিক নাগরিকদের নিশানা করা হয়েছে। কিন্তু পর্যটকদের এভাবে প্রকাশ্যে হত্যার ঘটনা বিরল এবং তা স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের হতবাক ও আতঙ্কিত করেছে।

পেহেলগামের মতো এলাকার অর্থনীতি পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। হামলার জেরে সেখানে বহু মানুষের জীবিকা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুনকাশ্মীরে ব্যাপক ধরপাকড়, ভাঙা হচ্ছে বাড়ি: ‘আমার ভাই জড়িত থাকলেও পরিবারের অপরাধ কী’১৮ ঘণ্টা আগেহামলার পরদিন (২৩ এপ্রিল) ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা পেহেলগামের বৈসারান এলাকায় তল্লাশি অভিযান চালান

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কাপ্তাই হ্রদের ‘দ্বীপে’ রিসোর্ট-কটেজ, টানছে পর্যটক
  • ভারতে অনলাইনে ছড়ানো হচ্ছে মুসলিমবিদ্বেষী গান, কনটেন্ট
  • হামলার পর আশা ও আতঙ্কের মধ্যে পেহেলগামে ধীরে ধীরে ফিরছেন পর্যটকেরা
  • কাশ্মীর সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে চতুর্থ দিনের মতো গোলাগুলি