দেশের খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি প্রবন্ধ আছে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে। প্রবন্ধের শিরোনামটি ছিল, ‘যে ঋণ পরিশোধ না করাই ভালো।’ এ প্রবন্ধের প্রথমাংশে তিনি লিখেন, ‘ঋণ তো আছেই, থাকবেই। ক্ষুদ্র ঋণ যাদের তারা সেটা শোধ করেন, বড় ঋণীরা করতে চান না, কিন্তু সমষ্টিগতভাবে আমাদের অনেক ঋণ আছে। যেগুলো শোধ করা কখনোই সম্ভব নয় এবং যেগুলো আমাদের নত না করে ধনী করে। এমনি একটি ঋণ আমাদের কাজী নজরুল ইসলামের কাছে। এ ঋণ সাংস্কৃতিক।’
এমনই সাংস্কৃতিক ঋণের আবহে দেশবাসীকে ঋণের প্রবাহে দোলাচ্ছে বাংলা ভাষাবাদীরা। এ ঋণও শোধ করা যাবে না। তা বরং বাড়লেই মঙ্গল।
‘বাংলা ভাষা’ বিশ্বের ভাষাভাষীর মধ্যে চতুর্থ থেকে এখন পঞ্চম স্থানে অবস্থান করছে। ‘ম্যান্ডারিন’ হলো প্রথম, দ্বিতীয় অবস্থানে ইংরেজি, তৃতীয় অবস্থানে ‘স্প্যানিস’, চতুর্থ অবস্থানে আছে ‘হিন্দি’। ফলে সংখ্যা ও গুরুত্বের দিক দিয়ে বেশ তাৎপর্যময় ‘বাংলা’।
রাজনীতিতে কর্তৃত্ববাদ জায়গা পেলে তা কৃষ্টি-সংস্কৃতিতেও প্রভাব ফেলে। প্রাচীন বাংলায় বেগ পেতে হয়েছে সুনিপুণ নির্মাণকারীদের, যারা বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিয়েছেন। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বৈষ্ণব সহজিয়ারা মুখোমুখি হয়েছেন গৌড়ীয় গোস্বামীদের। বৈষ্ণব সহজিয়ারা এদের রোষানলে পড়েছেন বাংলায় লেখার কারণে। কৃষ্ণদাস কবিরাজ ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ বাংলায় লিখেছেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর বইটি যমুনা নদীতে ফেলে দেন শ্রীজীব গোস্বামী। তারপরও সহজিয়া বৈষ্ণবরা বাংলায় সাহিত্য রচনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। বাংলা ভাষায় লেখাকে এগিয়ে নিয়েছেন এ দেশের সুফিসাধক কবিরা। কিন্তু এখানেও বাদ সাধে গোঁড়া মুসলমান। তারা বাংলাকে হিন্দুয়ানি ভাষা হিসেবে দেখেছেন। গোড়া হিন্দু ও মুসলমানদের তোপের মুখে সবসময় বাংলা ভাষাকে থাকতে হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কবি কায়কোবাদের বক্তব্য তুলে ধরা যাক। কায়কোবাদ বলেন, ‘বঙ্গভাষা যে বঙ্গীয় মুসলমানদের মাতৃভাষা, এ-সমন্ধে বোধ হয় এখন আর দ্বিমত নাই। অন্তত অধিকাংশ বঙ্গীয় মুসলমানই এ কথা একবাক্যে স্বীকার করেন। অল্পসংখ্যক যাহারা করেন না, তাঁহারা এখনও উর্দুর স্বপ্নে বিভোর হইয়া আছেন। .
বাংলা ভাষার কোনো জাতিভেদ নেই। সব হিন্দু-মুসলমান মানুষের ভাষা বাংলা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষা’ কেবল আমাদের মাতৃভাষা নয়, আমাদের জন্মভূমির ভাষা। ইহা হিন্দুরও ভাষা, মুসলমানেরও ভাষা। ইহার উপর হিন্দু-মুসলমানের তুল্য অধিকার।’
উপরোক্ত বক্তব্যসমূহ তিনি ১৯৩২ সালের ২৫-২৬ ডিসেম্বর ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মিলন’-এ সভাপতির ভাষণে তুলে ধরেন। সম্মেলনের এ বক্তব্যটি আরও স্পষ্ট করে দেয়, ‘ ... যাহারা মুসলমানের জন্য এক প্রকারের বাংলা ভাষা এবং বাঙ্গালি হিন্দুর জন্য আর এক প্রকারের বাংলা ভাষার প্রচলন দেখিতে চান, আমি তাঁহাদের কেহ নহি। আমি বাংলার হিন্দু এবং বাংলার মুসলমানের জন্য এক মিলিত ভাষা চাই।’
অথচ ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর বাংলাকে রীতিমতো উপেক্ষা করা হয়েছে। অন্তত আরবির আদলেও যাতে বাংলা লেখা হয় সে ষড়যন্ত্র হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় কাজে উর্দুকে চরম প্রাধান্য দিয়ে বাংলাকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলার তরুণ-যুবারা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, বাংলা ভাষাকে প্রাণের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এক ধরনের বকধার্মিকরা পহেলা বৈশাখকে ‘হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি’ আখ্যা দিয়ে বাঙালি জাতিকে বিভক্ত করতে চেয়েছে। এখনও ওদেরই উত্তরসূরিরা পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে অপসংস্কৃতি বলে আখ্যা দেন। কোনো ধর্মীয় উৎসব সর্বজনীন হতে পারে না। কিন্তু বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ভাষা দিবস এবং পহেলা বৈশাখের মতো উৎসব সর্বজনীন। সব পর্যায়ের মানুষ নির্বিঘ্নে ও অবলীলায় এ উৎসবে মজে যান এবং নিজস্বতা খুঁজে পান।
পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসব বাঙালি জাতির লোকায়ত উৎসব। যেটাকে আমরা লোকজ বলে থাকি। প্রান্তিক মানুষের প্রাণ এখানে আছে বলেই এ উৎসব ‘লোকজ’ বলে ধরে নেওয়া হয়। ধান কাটার মৌসুমে কৃষকের মুখে হাসি ফোটে। তখন মাড়াইকৃত ধান পেষণ করে চলে। এগুলো রূপান্তর করে পিঠা-পুলি, মুড়ি-মুড়কি, শিরনি ও পায়েস তৈরি করা হয়। এ নিয়ে আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকে না। বিভিন্ন ধর্ম অনুসারীরা যার যার মতো করে নবান্ন উৎসবে বিভিন্ন আয়োজন করে থাকেন। তাই বলে এটা কোনো ধর্মীয় সংস্কৃতি নয়।
পহেলা বৈশাখ ঘিরে মানুষের মনন জগতে স্পন্দন তৈরি হয়। তাই পুরোনো ক্লেশ, হিংসা-বিদ্বেষ, দুঃখ-বেদনাকে বিদায় ও সুখ-সমৃদ্ধকে ধন্যবাদ জানানো হয় এবং আগামী পথচলা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। অর্থাৎ এটা এক ধরনের সুখানুভূতি।
সুলতানি আমলে সোনারগাঁওয়ে সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের নেতৃত্বে ভাটিয়ালি, মারফতি, মরমি গানসহ উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে কবিতার আসরও বসত। কারণ সুলতান নিজেই একজন কবি ছিলেন। ওই সময় বিভিন্ন খানকায়ে লোকজ উৎসব জমে উঠতে। ওই সময় পীর-ফকিরদের বিভিন্ন খানকায় ও দরবার শরিফে ওরস অনুষ্ঠানকালে পালাগান ও কাওয়ালি আসর জমানো হতো।
লোকজ উপাদানের নিদর্শন হচ্ছে ‘মসলিন’। চতুর্দশ শতকে সোনারগাঁয়েও ‘মসলিন’ শিল্প বেশ সমৃদ্ধ ছিল। এ সংস্কৃতির ঐতিহ্য ধরে রাখতে শিল্পাচার্য জয়নাল আবেদিন ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের আর্থিক অনুদানে সোনারগাঁয়ে গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন’।
এখানে যুক্তগ্রাহ্য যে, কুটিরলিপি থেকে বাংলালিপির উদ্ভব হয়েছে বলে ভাষাবিদরা মনে করেছেন সেই দশম শতকে। কম্বোজরাজা ন্যায়পালদের ‘ইর্দার’ দানপত্রে এবং মহিপালদের ‘বানগড়’ দানপত্রের লিপিতে আদি বাংলা বর্ণমালা খচিত লেখা দেখা যায়। সে থেকেই বাংলা বর্ণমালার পথচলা শুরু। তাই বাংলার স্বকীয়তা খুবই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
কবি শামসুর রাহমানের একটি গানের প্রথম স্তবক দিয়েই লেখার সমাপ্তি টেনে দিতে চাই, ‘স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে, পানি টলটল মেঘনা নদীর কাছে, আমার অনেক ঋণ আছে, ঋণ আছে। কতজন, কতকিছুর কাছে যে আমাদের ঋণ তা হিসেব করা অসম্ভব। এ ঋণ আরও বাড়বে সন্দেহ নেই। তবে তা শোধ করা যায় না, শুধু স্বীকার করা যায়।’
জাহাঙ্গীর হোসেন: কবি ও প্রাবন্ধিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম সলম ন র অবস থ ন আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
প্রার্থনার সুরে শেষ হলো ‘ফাতেমা রানীর’ তীর্থোৎসব
পাহাড়ের আঁকাবাঁকা প্রায় দুই কিলোমিটারেরও বেশি উঁচুনিচু ঢালু পথ পাড়ি দিয়ে আলোক শোভাযাত্রা করে করলেন হাজারো খৃষ্ট ভক্ত। মা মারিয়ার আশীর্বাদপ্রাপ্ত শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ‘বারোমারি সাধু লিওর খ্রিষ্টধর্মপল্লি’ তে ছিলো এ বছরের আয়োজন।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) সকাল থেকে শুরু হয় ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ‘ফাতেমা রানীর’ তীর্থোৎসব। দুই দিনব্যাপী এই তীর্থোৎসব শেষ হয়েছে গতকাল শুক্রবার জীবন্ত ক্রুশের পথ ও পবিত্র মহাখ্রিষ্টযাগের মধ্যে দিয়ে।
এ উৎসবে শুধু ক্যাথলিক খ্রিষ্টানই নন, অন্য ধর্মাবলম্বীরাও প্রতিবছর অংশ নেন। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। উৎসবের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভ্যাটিকান সিটির রাষ্ট্রদূত কেভিন এস র্যান্ডেল।
এসময় জেলা প্রশাসক (ডিসি) তরফদার মাহমুদুর রহমান ও পুলিশ সুপার (এসপি) আমিনুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আয়োজক কমিটি জানায়, প্রতিবছর অক্টোবর মাসের শেষ বৃহস্পতি ও শুক্রবারে এই তীর্থযাত্রার আয়োজন করা হয়। প্রধান পৌরহিত্যকারী ন্যুনসিওকে বরণ, তীর্থের জুবিলী উদজাপন, পুর্নমিলন সংস্কার, পবিত্র খিষ্টযাগ, জপমালার প্রার্থন, আলোক শোভাযাত্রা, সাক্রান্তের আরাধনা, নিরাময় অনুষ্ঠান, ব্যক্তিগত প্রার্থনা ও নিশি জাগরণের মধ্য দিয়ে প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষ হয়। শুক্রবার সকাল আটটায় জীবন্ত ক্রুশের পথ অতিক্রম এবং সকাল ১০টায় মহাখ্রিষ্টযোগের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এবারের তীর্থোৎসব।
১৯৪২ সালে ৪২ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় বারোমারি সাধু লিওর ধর্মপল্লি। ১৯৯৮ সালে প্রয়াত বিশপ ফ্রান্সিস এ গোমেজ স্থানটিকে ‘ফাতেমা রানীর তীর্থস্থান’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন থেকেই প্রতিবছর আয়োজিত হয়ে আসছে এই ধর্মীয় উৎসব। এ বছর প্রায় ৩০-৪০ হাজার দেশি-বিদেশি রোমান ক্যাথলিক তীর্থযাত্রী অংশ নিয়েছেন উৎসবে। সার্বিকভাবে উৎসব এলাকা ছিল আলো, প্রার্থনা ও শান্তির আবহে মোড়ানো।
রংপুর থেকে আসা তীর্থযাত্রী রিপন আরেং বলেন, “সবাই যখন মোমবাতি প্রজ্বলন করে প্রার্থনা করতে করতে পাহাড়ি আকাঁবাঁকা পথ অতিক্রম করছিলেন, তখন পাহাড় আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল। তীর্থে আমরা মা মারিয়ার কাছে প্রার্থনা করতে এসেছি।”
চট্টগ্রাম থেকে আসা রীতা নকরেক বলেন, “পুত্রবধূর সন্তান হচ্ছিল না। গতবার মানত করার পর এবার নাতী পেয়েছি। তাই এবার নাতীকে নিয়ে আবার এসেছি।”
গাজীপুর থেকে পরিবারের সঙ্গে আসা শিক্ষার্থী ঝর্ণা আরেং বলেন, “মারিয়ার কাছে এলে মনে একধরনের শান্তি পাই। আমরা প্রার্থনা করি যেন জীবনের দুঃখ-কষ্ট দূর হয়। প্রতিবছর এই সময়টার অপেক্ষায় থাকি।”
শেরপুরের পুলিশ সুপার মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, “আমরা এই তীর্থযাত্রাকে নিরাপদ ও ঝুঁকি মুক্ত রাখতে তিন স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রেখেছি। পাঁচ শতাধিক পুলিশ পোশাকে এবং সাদা পোশাকে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও র্যাব, বিজিবি, এপিবিএন ও সেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। যে কোন ঝুঁকি মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত আছি।”
শেরপুর জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, “উৎসবটি দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ব্যবস্থাপনায়। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন দীর্ঘ ১৫ দিন ধরে সহযোগীতা করে আসছে। এবারের তীর্থযাত্রায় সারাদেশের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের উৎসব পালন করেছে।”
ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের বিশপ পনেন পল কুবি সিএসসি বলেন, “এ উৎসবের মাধ্যমে বিশ্ব মানবতার কল্যাণে প্রার্থনা করা হয়েছে। ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ তীর্থে দেশ-বিদেশের হাজারো মানুষ সমবেত হয়েছেন। তাঁরা দুই দিনব্যাপী তীর্থে নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। মা ফাতেমা রানীর কাছে দেশ ও মানবজাতির কল্যাণে প্রার্থনা শেষে যার যার বাড়ি ফিরে যাবেন।”
ঢাকা/তারিকুল/এস