রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্র সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট। সারা দিন যানবাহনে ঠাসা। পাশেই বড় মসজিদ চত্বর। দালানের চিপায় মানুষের ভিড়। শহরের গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গায় সব রকম সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দাবিদাওয়া নিয়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ নিয়ে জিরো পয়েন্টে এখনই মানুষের দম আটকে আসে। ভাবলে গা শিউরে ওঠে, ৩০ বছর পর কেমন হবে এই প্রিয় শহর।

এই ভাবনা থেকে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা ছয় বছর আগেই ‘ভবিষ্যতের রাজশাহীর নকশা’ তৈরি করেছিলেন, কিন্তু রাজশাহী শহরের উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে গেল। সুন্দর এই শহর দেখতে আসেন সারা দেশের মানুষ। নগরের ১৯টি মোড় উন্নয়ন করা হলেও এই শহরের জিরো পয়েন্ট জিরোই থেকে গেল। নগরবিদদের নকশা নিয়ে কেউ মাথা ঘামালেন না। কী বাধার কারণে সেটা হয়নি, এখন সেটা ভাবা দরকার।

এখন যেখানে রাজশাহী সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট, আগে সেখানে পুরোনো দালান ছিল। দালানেই ছিল দোকানঘর। আশির দশকের মাঝামাঝি এই দোকানঘর উড়িয়ে দিয়ে মাঝবরাবর সড়ক তৈরি করা হয়।

নগরের আলুপট্টি থেকে সোজা সেই সড়ক রাজশাহী কলেজের সামনে দিয়ে চলে গেছে। সারা দিন নগরের সব এলাকা থেকে কোনো না কোনো প্রয়োজনে কেউ একবার সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে আসবেন না, এমন প্রায় কমই হয়। এই মোড়ের পাশেই রয়েছে আরডিএ মার্কেট। এতে প্রায় তিন হাজার দোকান রয়েছে। এই মার্কেটকে কেন্দ্র করেই সারা দিন জিরো পয়েন্ট হয়ে মানুষ আসতে থাকেন। মানুষের জটে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। 

শুধু তা–ই নয়, সাহেববাজার জিরো পয়েন্টের সেই আশির দশকের সড়কের দুই পাশের ফুটপাত পুরোটাই দোকানিদের দখলে। এমনকি ফুটপাত থেকে নিচেও এক সারি দোকানপাট বসে। এরই মধ্যে ফুলের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে ক্রেতারা ফুল কিনছেন। রাস্তার দুই পাশেই রয়েছে ফুলের দোকান। একইভাবে তালামিস্ত্রির কাছে দাঁড়িয়ে কেউ তালা সারাচ্ছেন। কেউ ফলের দোকান থেকে ফল কিনেছেন, ভাজাওয়ালার দোকান থেকে ভাজা কিনছেন। কেউ গুড়ের দোকান থেকে গুড় কিনছেন। ফুটপাতের ওপর দোকান হওয়ার কারণে কেউ মোটরসাইকেলের ওপর থেকে, এমনকি কেউ রিকশায় বসেও কেনাকাটা করছেন। বলতে গেলে একেবারে নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি।

একজন বৃদ্ধ রিকশার ধাক্কা খেয়ে সম্প্রতি খেদোক্তি করে বললেন, ‘পৃথিবীর কোথাও ট্রাফিকের এমন নৈরাজ্য নেই। রাজশাহীতেও নেই। শুধু এই সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে। কিসের সুন্দর শহর!’

নগরের কুমারপাড়া থেকে মনিবাজার পর্যন্ত রাজশাহী নগরের প্রাণকেন্দ্রখ্যাত এলাকাটিতে রাতদিনই পথচারীকে এই দুর্ভোগে পড়ে থাকতে দেখা যায়। মাঝখানে সড়ক বিভাজক থাকার কারণে মানুষের চলাফেরায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। এখন সারা দিন দুই পাশে অটোরিকশা এমনভাবে ঢুকে থাকে যে ওপর থেকে ছবি তুললে মনে হবে, এই সড়ক অটোরিকশার একটি বড় বিক্রয়কেন্দ্র। বিক্রয়ের জন্য অটোরিকশা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পথচারীদের চলাচল অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার।

শহর উন্নয়নের অংশ হিসেবে রাজশাহী প্রেসক্লাবের সামনে থেকে স্টেশনে রোডের মুখটাকে প্রশস্ত করা হয়েছিল। সেখানে সম্প্রতি দোকানপাট বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে উত্তরে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে যানজট, একই জট পশ্চিমে, পুবে ও দক্ষিণে বড় মসজিদের সামনেও। সম্প্রতি এই ভিড়ের মধ্যে একজন রসিক পথচারী মোজাম্মেল হক মন্তব্য করে বসলেন, ‘এখন শহরের এই প্রাণকেন্দ্রের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সারা শহর উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে গেল। আর রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্র এই জিরো পয়েন্ট কানাগলির চেহারা পেল, জিরো পয়েন্ট জিরোই থেকে গেল।’  

অথচ রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এটিই এখন পর্যন্ত রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সর্বোচ্চ বরাদ্দ। ‘রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর উন্নয়ন’ নামের এই প্রকল্পের অধীনে প্রশস্ত সড়ক, সবুজায়ন আর আলোকায়ন করে সারা দেশে হইচই ফেলে দেয় রাজশাহী। পুরোনো রাস্তাগুলো সম্প্রসারণ করা হয়। নতুন সড়ক ওভারপাস নির্মাণ করা হয়। নগরের ১৯টি মোড়ের খোলনলচে পাল্টে ফেলা হয়। এতে শহরকে একেবারে নতুন রূপ দেওয়া হয়, কিন্তু ব্যস্ততম জিরো পয়েন্ট সেই তুলনায় একটি কানাগলির চেহারা পেয়েছে।

এই উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় জিরো পয়েন্টের আশপাশ দিয়ে নগরের আলুপট্টির মোড়, বাটার মোড়, সোনাদিঘির মোড়, জাদুঘরের মোড়সহ সব কটি মোড়ই সমাবেশস্থলের মতো প্রশস্ত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ওই সব মোড়ে রাজনৈতিক সভা–সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অথচ এই শহরের সব আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে জিরো পয়েন্ট থেকে। এই ঐতিহ্য অনুসরণ করে এখনো বড় সমাবেশ না করতে পারলেও জিরো পয়েন্টে শুধু মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। তবে যতক্ষণ অনুষ্ঠান চলে, মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকে না। বিশেষ করে এসব কর্মসূচির সময় এক পাশের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অথচ রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এটিই এখন পর্যন্ত রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সর্বোচ্চ বরাদ্দ। ‘রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর উন্নয়ন’ নামের এই প্রকল্পের অধীনে প্রশস্ত সড়ক, সবুজায়ন আর আলোকায়ন করে সারা দেশে হইচই ফেলে দেয় রাজশাহী। পুরোনো রাস্তাগুলো সম্প্রসারণ করা হয়। নতুন সড়ক ওভারপাস নির্মাণ করা হয়। নগরের ১৯টি মোড়ের খোলনলচে পাল্টে ফেলা হয়। এতে শহরকে একেবারে নতুন রূপ দেওয়া হয়, কিন্তু ব্যস্ততম জিরো পয়েন্ট সেই তুলনায় একটি কানাগলির চেহারা পেয়েছে।

এই উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় জিরো পয়েন্টের আশপাশ দিয়ে নগরের আলুপট্টির মোড়, বাটার মোড়, সোনাদিঘির মোড়, জাদুঘরের মোড়সহ সব কটি মোড়ই সমাবেশস্থলের মতো প্রশস্ত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ওই সব মোড়ে রাজনৈতিক সভা–সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অথচ এই শহরের সব আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে জিরো পয়েন্ট থেকে। এই ঐতিহ্য অনুসরণ করে এখনো বড় সমাবেশ না করতে পারলেও জিরো পয়েন্টে শুধু মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। তবে যতক্ষণ অনুষ্ঠান চলে, মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকে না। বিশেষ করে এসব কর্মসূচির সময় এক পাশের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের একজন সাবেক প্রধান প্রকৌশলী বলেন, নগরের ১৯টি মোড় উন্নয়ন করা হয়। জিরো পয়েন্টের পাশের স্থাপনা ভাঙার ব্যাপারে আপত্তি ছিল। একজন দলীয় নেতার মার্কেট উচ্ছেদ করতে হতো। এসব কারণে প্রথম দফায় জিরো পয়েন্ট উন্নয়ন করা সম্ভব হয়নি। পরে হওয়ার কথা ছিল, তা আর হয়নি।

রুয়েট শিক্ষার্থীদের নকশায় রেলগেট এলাকায় ‘ট্রান্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট’ নকশা তৈরি করা হয়। নগরের যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করে সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা করা হয়। এ ছাড়া যানজট কমানোর জন্য ভবিষ্যতে শহরজুড়ে গণপরিবহনের প্রস্তাব রাখা হয়। রাজশাহী নগরের বড় মসজিদ চত্বর, সোনাদিঘির মোড় ও বরেন্দ্র জাদুঘরের মোড়কে তাঁরা ‘প্লেস মেকিং’-এর আওতায় এনে নকশা তৈরি করেন। নকশায় এমন স্থানও ছিল, শহরের যে জায়গাগুলোতে প্রতিদিন ব্যাপক জনসমাগম হয়, নকশা অনুযায়ী এই জায়গাগুলোতে মানুষ বেড়াতে পারবেন।

এখন বেড়ানো দূরের কথা, বিশেষ প্রয়োজনে এই এলাকায় আসতেও মানুষকে ভুগতে হচ্ছে।

আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ প্রথম আলোর রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রকল প র প রশস ত এই শহর এই প র অন ষ ঠ শহর র

এছাড়াও পড়ুন:

ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ

এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।

ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।

‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।

ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।

খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।

এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী

ডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।

প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।

পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।

ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।

নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউব

ইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।

ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।

ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।

২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।

মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ