বিরোধীদের ওজর–আপত্তি ও তাঁদের আনা কোনো সংশোধনী গ্রহণ না করেই বিজেপির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার ওয়াক্‌ফ (সংশোধনী) বিল পেশ করতে চলেছে। সংসদের বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্বে তা পেশ করা হবে। খসড়া বিলে সরকারপক্ষের আনা ১৪টি সংশোধনী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়েছে।

এই বিল পাস হয়ে গেলে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনায় সরকারের ভূমিকা থাকবে। গত বছরের আগস্টে এই বিল সংসদে পেশ করা হয়েছিল। বিরোধীরা তখনই আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, বিলটি অসাংবিধানিক ও মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের শামিল।

বিরোধীদের আপত্তির মুখে আরও আলোচনার জন্য সরকার বিলটি যুগ্ম সংসদীয় কমিটির (জেপিসি) কাছে পাঠায়। বিজেপি সাংসদ জগদম্বিকা পাল সেই কমিটির নেতা মনোনীত হয়েছিলেন। জেপিসির বৈঠকে সরকারপক্ষ থেকে ২৩টি ও বিরোধীদের পক্ষে ৪৪টি সংশোধনী জমা পড়েছিল। আলোচনার পর ভোটাভুটিতে (জেপিসিতে সরকারপক্ষের সদস্যসংখ্যা সব সময় বেশি থাকে) বিরোধীদের সব সংশোধনী খারিজ হয়ে যায়। সরকারপক্ষের সংশোধনীগুলো থেকে ১৪টি গৃহীত হয়। মন্ত্রিসভা সেগুলোই অনুমোদন করেছে।

জেপিসির প্রতিবেদনটি বাজেট অধিবেশনের প্রথম দফায় গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সংসদে পেশ করা হয়েছিল। রাজ্যসভার বিরোধী নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে তখন অভিযোগ করেছিলেন, বিরোধীদের আপত্তিগুলো বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রতিবেদনে রাখা হয়নি। সংসদীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু অবশ্য সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন।

সংসদের বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হচ্ছে ১০ মার্চ। চলবে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত। ওই সময় বিলটি সংসদের উভয় কক্ষে পাস হলে ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেলে ওয়াক্‌ফ আইনের নতুন নাম হবে ‘ইউনাইটেড ওয়াক্‌ফ ম্যানেজমেন্ট, এমপাওয়ারমেন্ট, ইফিশিয়েন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্ট’।

মন্ত্রিসভা অনুমোদিত সরকারপক্ষের সংশোধনীগুলোতে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য পর্যায়ে ওয়াক্‌ফ বোর্ডে দুজন করে নারী সদস্য রাখতে হবে। মুসলিমদের মধ্যে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের একজন সদস্য রাখতে হবে রাজ্য ওয়াক্‌ফ বোর্ডে। ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির নিবন্ধন হবে অনলাইন মারফত। ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত আয়ের একটা অংশ বিধবা ও বিবাহবিচ্ছিন্ন নারী এবং অনাথদের জন্য খরচ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে ওয়াক্‌ফ বোর্ডে একজন করে অমুসলিম প্রতিনিধি রাখা যাবে।

ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির অর্থ সেসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি, যা দান করে দেওয়া হয়েছে। এই বোর্ড গোটা দেশে ৯ দশমিক ৪০ লাখ একরজুড়ে ৮ দশমিক ৭০ লাখ সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করে, যার আনুমানিক দাম ১ দশমিক ২০ লাখ কোটি রুপি। ওয়াক্‌ফ বোর্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বেআইনিভাবে জমি দখল ও ক্ষমতার অপপ্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে। গত দুই বছরে দেশের বিভিন্ন হাইকোর্টে ওয়াক্‌ফসংক্রান্ত ১২০টি আবেদন জমা পড়ে। এরপর কেন্দ্রীয় সরকার আইন সংশোধনে উদ্যোগী হয়।

বিরোধীদের আপত্তির অন্য অনেক কারণের মধ্যে একটি হলো—অন্য ধর্মাবলম্বীদের নিয়ন্ত্রক বোর্ডে যখন ভিন্নধর্মাবলম্বীদের কোনো স্থান নেই, তখন ওয়াক্‌ফ বোর্ডে অমুসলিমকে রাখার সিদ্ধান্ত কেন? মুসলমান সমাজের দাবি, এই বিল আইন হলে তা অসাংবিধানিক বলে গণ্য হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব র ধ দ র আপত ত সরক রপক ষ র মন ত র অন ম দ প শ কর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা

লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।

সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।

আরো পড়ুন:

আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র

মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা

চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।

তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।

শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।

তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।

তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।

ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।

রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।

“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”

“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”

“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”

টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”

“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।” 

সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ