আমাদের জাতীয় জীবনে বায়ান্নর ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে এবং মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্ব হিসেবে যেমন উদযাপিত হয়, একইভাবে ২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক মাইলস্টোন হয়ে গিয়েছে। এই ঐতিহাসিক সময়কালের ঘটনা শিল্প-সাহিত্যের বিষয় হবে, এটা অবধারিত। কেননা, কলাকৈবল্যবাদী আদর্শও সমকালের বিশাল পরিবর্তনকে স্বীকৃতি দেয় দেরিতে হলেও। দৃশ্যশিল্প এবং সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান এক শক্তিময় প্রেরণার উৎস হয়ে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
কবিতায়, গানে এবং দৃশ্যশিল্পে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান বিষয় হিসেবে এসেছে সম-সময়ে অর্থাৎ পরিণতিতে পৌঁছানোর আগেই। তবে গান এবং গ্রাফিতি শিল্প যেমন সেই পর্বে প্রাধান্য পেয়েছে, কবিতা বা নাটক তেমন নয়। লেখার বিষয় চোখে বা অনুভবে দেখা দিলেও আন্দোলন চলাকালে গল্প-উপন্যাস লেখা হয় না, সেসবের ‘প্রয়োজন’ অনুভূত না হওয়ার কারণে। এই ‘প্রয়োজন’ নির্ধারণ করে মানুষের (পাঠকের) চাহিদা, যা ঘটনার সমকালে প্রচ্ছন্নই থাকে। গল্প, উপন্যাসের লেখকও মনে করেন যে বিশাল ঘটনা নিয়ে তারা লিখবেন, তার সঙ্গে সময়ের একটা দূরত্ব থাকা প্রয়োজন, যেন যুক্তি দিয়ে কাহিনি এবং ন্যারেটিভ নির্ধারণ করা যায়। বলা বাহুল্য, গান এবং কবিতার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়, যেহেতু তাৎক্ষণিক আবেগ-অনুভবই তাদের সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট।
সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম করে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে এখনই, সময়ের পরিমাপে দূরত্ব না রেখে, উপন্যাস লিখেছি এই জন্য যে আমি প্রতিদিনের ঘটনার উল্লেখ করে ইতিহাসের মোড় ফেরানো এই ‘কাহিনি’ বলতে চেয়েছি। কিন্তু ৫ আগস্টের আগে আমি এই উপন্যাস লেখার কথা ভাবিনি, যে জন্য প্রথম থেকেই তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কথা মনে হয়নি। স্বৈরাচারের পতনের পর যখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে প্রতিদিনের ঘটনা উল্লেখ করে উপন্যাস লিখব, তারপর আমাকে ১ জুলাই থেকে প্রতিদিনের ঘটনাবলি সংগ্রহ করতে হয়েছে।
এর জন্য লাইব্রেরিতে গিয়ে সংবাদপত্রের পুরোনো সংখ্যা পড়ে দিনওয়ারি ঘটনা সাজাতে হয়েছে। প্রায় তিন সপ্তাহ সময় নিয়েছে এই কাজ।
তথ্য সংগ্রহের পর আমার পরিকল্পনা ছিল দুই থেকে তিন মাস সময় নিয়ে উপন্যাসটি লেখার। কিন্তু প্রকাশক এই বইমেলাতেই উপন্যাসটি প্রকাশ করার জন্য চাপ দিলে আমাকে তা মেনে নিতে হয়। ফলে উপন্যাসটি শেষ করার জন্য আমাকে দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়েছে। পৃষ্ঠার দিক দিয়ে এটাই আমার সবচেয়ে বড় উপন্যাস (৩২০ পৃ), যা আমি পরিকল্পিত তিন মাসের জায়গায় দেড় মাসে করেছি।
এই উপন্যাসে দুটি অংশ আছে। প্রথম অংশে রয়েছে বাস্তব ঘটনার বর্ণনা, যার জন্য আমি ব্যবহার করেছি সংবাদপত্র থেকে সংগৃহীত তথ্য। দ্বিতীয় অংশ দেখা যায় কল্পিত চরিত্রের আচরণে এবং কথাবার্তায়। কল্পিত চরিত্রের আচরণ এবং কথা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তবের ঘটনাকেন্দ্রিক। সুতরাং বাস্তব ঘটনাই এই উপন্যাসে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বাস্তব ঘটনার মানবিক মাত্রা সংযোজনের জন্যই কল্পিত চরিত্রের অবতারণা। কল্পিত চরিত্র কেবল বাস্তব ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে জড়িয়ে নেই, তারা মাঝে মাঝে সেইসব ঘটনার ওপর মন্তব্যও করে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মিছিলে, অবরোধ সমাবেশের প্রাণবন্ততা রক্ষায় এবং শক্তির প্রকাশে স্লোগান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে স্লোগান পরিবর্তিত হয়েছে। আন্দোলন যতই ক্রমে তীব্রতা লাভ করেছে তার সঙ্গে সংগতি রেখে স্লোগান এগ্রেসিভ হয়েছে। উপন্যাসে ব্যবহৃত স্লোগানের এই বিবর্তন দেখাতে স্লোগানগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে আন্দোলনে যেসব গান গাওয়া হয়েছে, নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ থেকে র্যাপার হান্নানের ‘আওয়াজ উডা বাংলাদেশ’, সেগুলো যথাস্থানে এসেছে। দৃশ্যশিল্প, বিশেষ করে গ্রাফিতি, সম্বন্ধে লেখা হয়েছে এই শিল্পের ইতিহাস বর্ণনা করে।
এখন সবারই জানা যে জুলাই অভ্যুত্থানের দুটো দিক রয়েছে। প্রথম দিকটি দৃশ্যমান এবং স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে প্রথম থেকে। দ্বিতীয় দিক ছিল অনুল্লিখিত এবং এখনও অফিসিয়ালি তাই। কিন্তু ওয়াকিবহাল যারা; তাদের সবাই জেনে গিয়েছেন এই দ্বিতীয় দিকের তাৎপর্য কী? উপন্যাসে প্রথম দিক যেমন সহজেই আনা যায়, দ্বিতীয় দিক সম্পর্কে একই কথা বলা যায় না। বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে কেউ হয়তো প্রথম দিক নিয়ে লিখেই সন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু যারা এই শ্রেণিতে পড়েন না, তাদের জন্য দ্বিস্তরের এই পরিচিতি বর্ণনা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। আমি এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করেছি, সেই সিক্রেট এখন না-ই বললাম। যারা জানতে আগ্রহী, তাদের বলব উপন্যাসটি পড়তে। এই উপন্যাস লিখতে যে পরিশ্রম করেছি, তার সঙ্গে তুলনীয় দৃষ্টান্ত কিছু নেই। লেখার পর যে তৃপ্তি লাভ করেছি সেটিও অনন্য, অসাধারণ।
উপন্যাস : ‘জুলাই ক্যালাইডোস্কোপ’, প্রকাশক : আগামী প্রকাশনী, বইমেলা : ২০২৫।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন উপন য স ল খ র জন য প রথম র ঘটন ঘটন র
এছাড়াও পড়ুন:
লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠককে স্বাগত জানাল জেএসডি
লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের আলোচনা ও ঐকমত্যের সূচনাকে স্বাগত জানিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। দলটি বলেছে, আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জনগণ শুধু কথায় নয়, বাস্তবে সংস্কার ও বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতির পদক্ষেপ দেখতে চায়।
শুক্রবার জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন।
তারা বলেন, এই উচ্চপর্যায়ের সংলাপ দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের কাঙ্ক্ষিত অভিপ্রায় অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
বিবৃতিতে নেতারা বলেন, অধ্যাপক ইউনূস এবং তারেক রহমানের বৈঠক ও বিবৃতিতে আগামী বছরের পবিত্র রমজানের আগেই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ এবং তার পূর্বশর্ত হিসেবে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচারের প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জনের ঘোষিত প্রত্যয়ে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, গণমানুষের রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম দাবি- গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কাঠামোগত মৌলিক সংস্কার এবং গণহত্যাকারী ফ্যাসিবাদী শক্তির বিচারের ব্যবস্থা। এই বিষয় দুটির দৃশ্যমান অগ্রগতিই কেবল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভিত্তি রচনা করতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সমাজের শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও পেশাজীবীদের মতামত, আকাঙ্ক্ষা ও অংশগ্রহণে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির মৌলিক সংস্কারের লক্ষ্যে দ্রুত ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়নের আহ্বান জানায় জেএসডি।