তিন বছরে কাজ হয়েছে ৫৫ শতাংশ, দ্রুত চালুর দাবি এলাকাবাসীর
Published: 2nd, March 2025 GMT
নির্ধারিত সময় শেষে এক বছর সময় বাড়িয়েও ময়মনসিংহে শেষ করা যাচ্ছে না হাইটেক পার্ক নির্মাণের কাজ। ৫৫ শতাংশ কাজ হওয়ার পর গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বন্ধ হয়ে যায় প্রায় দেড় শ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য হাইটেক পার্ক নির্মাণের কাজ। ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাজ না করায় নির্মাণসামগ্রী নষ্ট হচ্ছে। দ্রুত হাইটেক পার্কের কাজ শেষ করে এটি চালুর দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে দেখভালের জন্য উপসহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান প্রকল্পটিতে রয়েছেন। আজ রোববার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাততলাবিশিষ্ট হাইটেক পার্কের মূল কাজ হবে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ভারতে চলে যাওয়ায় পুরো প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে শ্রমিকসংকটে কাজ বন্ধ রয়েছে। তবে ধীরে ধীরে কাজ চালুর চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে প্রকল্পটির ৫৫ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। আমরা এক বছর সময় পেলে কাজ সম্পন্ন করে হস্তান্তর করতে পারব।’
প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ২০২২ সালের ২২ জুন ময়মনসিংহ নগরের কিসমত এলাকায় হাইটেক পার্কের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন তৎকালীন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক। ভারত সরকারের অর্থায়নে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের অধীন জেলা পর্যায়ে হাইটেক পার্ক স্থাপন প্রকল্পের আওতায় ময়মনসিংহে পার্কটি হচ্ছে। ৬ দশমিক ১ একর জমির ওপর প্রায় ১৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে এটি। এই ভবনের প্রতি তলায় ১৫ হাজার বর্গফুট জায়গা থাকবে। পার্কটি চালু হলে প্রতিবছর অন্তত এক হাজার তরুণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও তিন হাজার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
স্থানীয় বাসিন্দা শহীদুল আলম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার পালানোর পর হাইটেক পার্কের কাজও বন্ধ রয়েছে। আমরা চাই দ্রুত পার্কটি বাস্তবায়িত হোক। এটি চালু হলে আমাদের এলাকার চিত্র বদলে যাবে। আমাদের এলাকার ছেলেমেয়েরা এই প্রতিষ্ঠান থেকে উপকৃত হবে।’
২০২২ সালের জুনে ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন হলেও কাগজপত্রে কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালের জুনে। কাজটি বাস্তবায়ন করছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লারসেন অ্যান্ড টুব্রো (এলঅ্যান্ডটি) কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে ভয়েন্টস সলিউশন প্রাইভেট লিমিটেড নামে ভারতীয় অপর একটি প্রতিষ্ঠান। কাজটি ২০২৪ সালের জুনে শেষ না হওয়ায় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আরও এক বছর সময় বাড়ানো হয় বলে জানিয়েছেন প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কাজের বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লারসেন অ্যান্ড টুব্রো (এলঅ্যান্ডটি) কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের কর্মকর্তা রাজীব ঘোষ বলেন, তিনি ভারত থেকে প্রকল্পটিতে নতুন যোগ দিয়েছেন। এ নিয়ে কিছু বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন তিনি।
ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম বলেন, ‘হাইটেক পার্ক প্রকল্পটির কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে ইতিমধ্যে কথা বলেছি। এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আশা করছি, খুব দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: হ ইট ক প র ক র প রকল প সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
‘রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই’
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর আনন্দিপুর গ্রামের মামুন মিয়া (২২) ছোটবেলা থেকে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। প্রায় প্রতি মাসেই তাঁর একাধিক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এক সময় রক্তের জোগাড় বেশ কষ্টসাধ্যই হয়ে ওঠে। মানুষ বিনা স্বার্থে রক্ত দিতে চাইতেন না। ২০১৬ সাল থেকে পরিবারটিকে রক্তের জন্য আর কাউকে অনুরোধ করতে হচ্ছে না। মামুনের পাশে দাঁড়িয়েছে জেলার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
সম্প্রতি মামুনের মা মাজেদা বেগম অতীতের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘পোলার রক্তের লাইগ্গা মাইনষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কেউ রক্ত দিতে চাইতো না। মানুষ টাকা ভিক্ষা চায়, আর আমি মানুষের কাছে আমার পোলার জন্য রক্ত ভিক্ষা করছি। শইল্যে রক্ত না ভরলে আমার পোলা মইরা যাইতো।’
দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ব্যক্তি, জরুরি বা সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার, ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়া কিংবা কিডনি আক্রান্ত রোগীর জন্য প্রায়ই প্রয়োজন হয় রক্তের। আত্মীয়স্বজন বা চেনাজানা কারও কাছে প্রয়োজনমাফিক রক্ত না পেয়ে অনেকেই ছুটে যান স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের কাছে। খবর পেয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা দ্রুততার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রক্তদাতাকে খুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর মানুষের জীবন বাঁচানোর মতো মহৎ এই কাজেই তাঁদের আনন্দ বলে জানান ময়মনসিংহের ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কয়েকজন কর্মী।
শুধু রক্তদান নয়, সমাজ পরিবর্তনে নানা কাজও করে চলেছে তরুণদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট এটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন পায়। তবে এর দু-এক বছর আগেই সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয় বলে জানান সংগঠনটির মূল পরিকল্পনাকারী মমিনুর রহমান। তাঁর বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ এলাকায়।
সম্প্রতি মমিনুর রহমান বলেন, ‘শুধু রক্তের অভাবে একটি মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে না, এই চিন্তা থেকে কাজ শুরু করি। ময়মনসিংহে রক্তদান নিয়ে কাজ করে—এমন কোনো সংগঠন ছিল না। তখন স্থানীয়ভাবে মানুষকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাম্পেইন করে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর ৩৯ জনকে নিয়ে প্রথম সভা করি। পরে সেখান থেকে রক্তদানের এই সংগঠন করার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। যেহেতু ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বসে ওই সভা হয়েছিল, তাই সংগঠনটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’। ‘আর্তের মুখে হাসি ফোটানোই হয় যদি মানবতা, তবে তার শ্রেষ্ঠ সেবক হলো প্রতিটি রক্তদাতা’, এই স্লোগান সামনে রেখে শুরু হয় এর যাত্রা।
সংগঠনটি থেকে জানানো হয়েছে, রক্তদাতা তরুণেরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সংগঠনটির একটি কমিটি ও ফেসবুক পেজ আছে। এর মাধ্যমে কিংবা মুঠোফোনে খবর পেয়েই রক্ত দিতে ছুটে যান তরুণেরা। তরুণদের তৎপরতায় দিন দিন সংগঠনটির পরিসর বাড়ছে। বর্তমানে এই সংগঠনের প্রায় ৫০ হাজার সদস্য আছেন, যাঁরা নিজেরা রক্তদান করেন এবং রক্তদানে অন্য তরুণদের উৎসাহিত করেন। ২০ বারের বেশি রক্ত দিয়েছেন, এমন রক্তদাতা আছেন ৮০ জন, যার ৬০ জনই শিক্ষার্থী। শুধু ময়মনসিংহ শহরেই ইতিমধ্যে ৩৫ হাজার ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন সংগঠনটির তরুণেরা। এর মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ২০১৮ সাল থেকে ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। এ পর্যন্ত তিনি ২৬ বার রক্ত দিয়েছেন। অন্যদের উৎসাহী করতে তিনি বলেন, ‘মুমূর্ষু অবস্থায় মানুষ রক্তের কারণে মারা যাবে, এটি কখনো হতে পারে না। তাই অসুস্থ জটিল রোগীর খবর পেলেই রক্ত দিতে যাই। রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই।’
সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি আবিদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সুমন রাহাত। স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত আবিদুর রহমান বলেন, ‘যাঁদের রক্তের প্রয়োজন, তাঁরা আমাদের ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করেন। অথবা রক্তের প্রয়োজন ফেসবুকে কারও স্ট্যাটাস দেখলেই আমরা নিজে থেকে যোগাযোগ করে রক্তের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। আমরা রক্তদানের মাধ্যমে অন্যের জীবন বাঁচিয়ে আনন্দিত হই। আমরা মানুষ বাঁচানোর এই আনন্দ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। গ্রামে, পাড়ায় মহল্লায় রক্তের জন্য মানুষ যেন না মরে, এটিই আমাদের লক্ষ্য।’