আমেরিকার মোড়লগিরির ট্রাম্প আরও খোলামেলা করে দিলেন
Published: 7th, March 2025 GMT
ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটা দিকের জন্য আমরা তাঁকে ধন্যবাদ দিতে পারি। তিনি একেবারে পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে আমেরিকা কখনোই ‘নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা’ টিকিয়ে রাখার উপযুক্ত পুলিশ ছিল না।
আমেরিকাকে বরং এক গ্যাংস্টার সাম্রাজ্যের প্রধান বলাই ভালো। সারা বিশ্বে তাদের আট শতাধিক সামরিক ঘাঁটি আছে। স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে তারা ‘বিশ্বের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ’ চায়।
আপনি যদি আমেরিকাকে মেনে চলেন, তাহলে ঠিক আছে। আর যদি তা না করেন, তাহলে আপনাকে সরিয়ে দেওয়া হবে। গত শুক্রবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাঁকে প্রকাশ্যে অপমান করা হয়েছে হোয়াইট হাউসে। সাংবাদিকদের সামনেই।
অনেকে ভাবছেন, এটা তো খুব খারাপ হলো। কিন্তু এর চেয়েও খারাপ তো হয়ে গেছে আগেই। আর তা হলো ইউক্রেন ও রাশিয়ার লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু। এই যুদ্ধ একদমই দরকার ছিল না। আমেরিকাই এই যুদ্ধ তৈরি করেছে গত বিশ বছর ধরে ন্যাটোর মাধ্যমে। এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল একটাই—বিশ্বকে দেখানো, আমেরিকাই বস। ঠিক যেমন তারা ইরাকে করেছিল।
হেনরি কিসিঞ্জার একবার বলেছিলেন, আমেরিকার শত্রু হওয়া বিপজ্জনক, কিন্তু আমেরিকার বন্ধু হওয়া আরও ভয়ংকর।
জেলেনস্কি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। গ্যাংস্টারদের সাম্রাজ্য এমনই হয়। আপনাকে তারা কাজ করাবে। এরপর যখন দরকার ফুরাবে, ছুড়ে ফেলে দেবে। ঠিক যেমন হলিউড সিনেমায় দেখা যায়।
জো বাইডেনের আমলে জেলেনস্কিকে আমেরিকা কাজে লাগিয়েছে। রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে আমেরিকার একটা কাজের লোক দরকার ছিল। এখন তার পরিণতি কী হলো, সবাই দেখছে।
ন্যাটো বারবার ইউক্রেনকে নিজেদের আওতায় নেওয়ার চেষ্টা করেছে। রাশিয়া বারবার সতর্ক করেছে যে এটি তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হতে পারে। রাশিয়া কখনোই চাইবে না আমেরিকা তার সীমান্তে ক্ষেপণাস্ত্র বসাক। ঠিক যেমন ১৯৬০-এর দশকে কিউবার সীমান্তে সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র বসানোকে আমেরিকা একেবারে বরদাশত করেনি।
ইউক্রেনে শান্তিচুক্তি হলে আমেরিকা রাশিয়াকে নিজের পক্ষে এনে নতুন এক নিরাপত্তা–কাঠামো তৈরি করবে, যা চীনের একক প্রভাবকে আরও দুর্বল করে দেবে।এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের জনগণ নিজেদের শান্তির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত করেছিল ভলোদিমির জেলেনস্কিকে। তাঁর মূল প্রতিশ্রুতি ছিল দেশে গৃহযুদ্ধ বন্ধ করা। এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। পশ্চিম ইউক্রেনের রাশিয়াবিরোধী ‘জাতীয়তাবাদী’ গোষ্ঠী এবং পূর্ব ইউক্রেনের রুশভাষী জনগণের মধ্যে বিরোধের মধ্য দিয়ে এর সৃষ্টি। কিন্তু শিগগিরই জেলেনস্কি তাঁর সেই শান্তির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প জেলেনস্কিকে ‘একজন স্বৈরশাসক’ বলেছিলেন। এ অভিযোগ কিছুটা সত্য হতেও পারে। কারণ, আমেরিকা চেয়েছিল, জেলেনস্কি সেই ধরনের নেতা হোক যে তাদের প্রয়োজনে কাজ করবে। যদিও অনেক ইউক্রেনীয় চেয়েছিল অন্য কিছু।
এখন বাইডেন চলে গেছেন। নতুন প্রশাসন এসেছে। নতুন মাফিয়া ‘ডন’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে জেলেনস্কি দিয়ে কাজ হচ্ছে না। কিন্তু এর পেছনে খরচ হচ্ছে অনেক বেশি। ওদিকে রাশিয়া কোনোভাবে দুর্বল হয়নি। বরং শক্তিশালী হয়েছে। এখন নতুন কৌশল দরকার।
জেলেনস্কি মনে করছিলেন যে তিনি আমেরিকার প্রিয় ‘গুন্ডা’। আর তখনই তিনি হোয়াইট হাউসে গিয়ে এক কঠিন পাঠ শিখলেন—মাফিয়া শিষ্টাচারের শিক্ষা। জানলেন যে তিনি ঠিকমতো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেন না।
ট্রাম্প এখন ইউক্রেনে শান্তিচুক্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। শান্তি আসুক আর না সুক, আসল কথা হলো এই চুক্তির পেছনে আছে মূলত অর্থনৈতিক লাভের হিসাব। ট্রাম্পের মতে, রাশিয়া এই যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। অবশ্য পশ্চিম বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে চাইলে অন্য কথা। বাস্তবে, এই যুদ্ধের পেছনে যে শক্তি কাজ করছে, তা হলো টাকা।
এখন ট্রাম্পের চাপে একটা শান্তিচুক্তি হয়তো হবে। সেই চুক্তির ভিত্তি হবে ইউক্রেনের সম্পদ—বিরল খনিজ, কৃষিজমি এবং অন্যান্য খাত। আর এই সবই ব্যবহৃত হবে একটি শক্তিশালী দেশের প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য। জেলেনস্কি এখন এটা বুঝতে পেরেছেন। বুঝতে পেরেছেন যে তিনি এবং ইউক্রেনের জনগণ এক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। মাফিয়া সংগঠনের সঙ্গে হাত মেলালে এ রকমই হয়।
ট্রাম্পের পূর্বসূরিরা যেখানে ইউক্রেন এবং গাজা সমস্যা সমাধানকে বিশ্বশান্তি বা এরকম সব গালভরা নামে ডাকত। ট্রাম্প সেখানে সরাসরি বলেছিলেন যে এই অঞ্চলগুলো শুধু আমেরিকার ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ। তিনি কোনো রকম আড়াল না রেখেই পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে ইউক্রেন এবং গাজা তার দেশের বৈশ্বিক স্বার্থের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ।
হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কির সঙ্গে কথোপকথনে ট্রাম্প একথা আবার বলেছেন, ‘আমরা ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ ব্যবহার করব। এসব ব্যবহৃত হবে আমাদের বিভিন্ন কাজে, যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অস্ত্র ব্যবস্থাপনা ও সামরিক ক্ষেত্রে। এগুলো আমাদের দরকার।’
এই বক্তব্যে ট্রাম্পের লক্ষ্য পরিষ্কার—যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধ শেষ করা এবং রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি ঠেকানো। রাশিয়া ইউক্রেনের যত বেশি অঞ্চল দখল করবে, আমেরিকার ভাগে তত কম জায়গা থাকবে খনিজ সম্পদ লুট করার জন্য। এ জন্যই ট্রাম্প যুদ্ধ শেষ করতে এমন মরিয়া।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ন্যাটোর এই যুদ্ধ একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে খনিজ সম্পদ নিয়ে লড়াইয়ের গভীর কৌশলের অংশ। গত বছর মার্কিন কংগ্রেসের একটি কমিটিতে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য ‘সামরিক খনিজের প্রাধান্য’ নিয়ে আলোচনা করেছিল। আমেরিকার মূল লক্ষ্য ছিল চীনের প্রভাব রুখে দেওয়া এবং ইউক্রেনের মাধ্যমে রাশিয়াকে আরও একবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা।
এখানে ট্রাম্পের লক্ষ্য হচ্ছে ইউক্রেনের ভূখণ্ড কাজে লাগিয়ে পশ্চিমে একটি নতুন নিরাপত্তা–কাঠামো তৈরি করা। তা করে রাশিয়াকে আমেরিকার পক্ষে আনা যাবে। আবার চীনের একচেটিয়া প্রভাবকেও চাপের মধ্যে ফেলা যাবে। রাশিয়া ও চীন একত্র হয়ে নতুন এক শক্তিশালী জোট তৈরি করেছে। এই জোটের নাম ব্রিকস। এতে আছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
ব্রিকস আমেরিকার বৈশ্বিক আধিপত্যের বিপরীতে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়তে চাচ্ছে। ইউক্রেনে শান্তিচুক্তি হলে আমেরিকা রাশিয়াকে নিজের পক্ষে এনে নতুন এক নিরাপত্তা–কাঠামো তৈরি করবে, যা চীনের একক প্রভাবকে আরও দুর্বল করে দেবে।
ট্রাম্পের আচরণ অশালীন হতে পারে। কিন্তু তিনি যে সাম্রাজ্য পরিচালনা করছেন, তা আগেও দুনিয়াজুড়ে ক্ষমতার লড়াই চালিয়েছে। ট্রাম্পও সেই কাজ করছেন। তবে আরও খোলামেলাভাবে।
জোনাথন কুক লেখক, সাংবাদিক
মিডিল ইস্ট আই থেকে নেওয়া ইংরেজির সংক্ষেপিত অনুবাদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন র এই য দ ধ আম র ক র র জন য ক জ কর দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদ নিয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে
ফরাসি বিপ্লবের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলা হয়ে থাকে ‘বিপ্লব তার সন্তানদেরই খেয়ে ফেলে’। আধুনিক যুগের বিপ্লব প্রায়ই পুরোনো সংবিধানকে খেয়ে ফেলে। ব্রিটিশ রাজকবি আলফ্রেড টেনিসনের ভাষায়, পুরোনো বন্দোবস্ত সরে গিয়ে স্থান করে দেয় নতুন ব্যবস্থাকে। জার্মান আইনবিদ কার্ল স্মিটের ভাষায়, ‘স্টেট অব এক্সেপশন’ অর্থাৎ ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’র উদ্ভব ঘটে। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা এবি সিয়েসের মতে, জনগণের গাঠনিক ক্ষমতার উন্মেষ ঘটে।
স্মিটের মতে, ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় যে বা যাঁরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তিনি বা তাঁরাই সার্বভৌম। এই সার্বভৌম শক্তি আইনের বাইরে ও আইনের ঊর্ধ্বে। পুরোনো আইনব্যবস্থা, শাসনতন্ত্র, ক্ষমতাকাঠামো বা বিধিবিধান, কোনো কিছু দিয়েই এই পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করা যায় না; সেসব থেকে এর চূড়ান্ত বৈধতার নিদান খোঁজাও যায় না। পুরোনো ব্যবস্থা সেই সমাধান দিতেও সক্ষম নয়। বিদ্যমান সবকিছুই পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায় নয়া সার্বভৌম শক্তির সব সিদ্ধান্তের অধীনে প্রয়োগ হয়।
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামোয় যে অবস্থা বিরাজ করছে, সেটাকে এক ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’ বলা যায়। কারণ, বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় এটাকে ব্যাখ্যা করা ও সেই ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না; কোনো না কোনো অধিসাংবিধানিক প্রক্রিয়ার শরণ নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
বাস্তবে ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ পুরোনো ব্যবস্থার পদ্ধতি মেনেই নেওয়া হয়। কারণ, পদ্ধতিগুলো প্রায় সব জায়গাতেই একই থাকে। পার্থক্য থাকে শুধু কোন সার্বভৌম শক্তি সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, কেন, কীভাবে, কখন, কাকে দিচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে।
আরও একটি কারণে আগের মতো করেই কাজগুলো করা হয়, সেটা হলো, এ পদ্ধতিগুলো শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা, সার্বভৌম শক্তিকে সাধারণ জনগণের কাছে সহজে অনুভূত বা আবির্ভূত হওয়া ও অনুকরণযোগ্য সবচেয়ে ভালো শাসনতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রয়োগ করা সুবিধাজনক। কিন্তু যত যা–ই হোক না কেন, সব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপই নতুন সার্বভৌম শক্তির সিদ্ধান্তের অধস্তন হয়ে যায়।
২.২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আমরা যে ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় ঢুকে গিয়েছি, তা ছাত্র–জনতার দাবি ও সক্রিয় আন্দোলনের মুখে সাংবিধানিক পদাধিকারী বিভিন্ন ব্যক্তির পদত্যাগ বা অব্যাহতির ঘটনা থেকে আঁচ করা যায়। স্বাভাবিক সাংবিধানিক অবস্থায় ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ বা জাতীয় সংসদে অভিশংসনের প্রক্রিয়া ছাড়া এদের পদচ্যুত করার সুযোগ নেই; কিন্তু সবই হয়েছে আর তা হয়েছে পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায়, যেখানে অভ্যুত্থানে বিজয়ীদের অভিপ্রায়ই প্রাধান্য লাভ করে।
তত্ত্বে যেভাবেই থাক না কেন, আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার ইতিহাসে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৯৫৮ সালের পাকিস্তানে আইয়ুব খান সংবিধান রদ করে ‘আইন (বলবৎকরণ) আদেশ, ১৯৫৮’ জারি করেন। তাতে ১৯৫৬ সালের সংবিধানকে মৃত সংবিধান অভিহিত করে রদ করা হলেও সেটিকেই আবার ‘ভেন্টিলেশন’–এ আনা হয়। বলা হয়, রাষ্ট্রীয় সব কর্মকাণ্ড যত দূর সম্ভব ‘মৃত সংবিধান’ অনুযায়ীই চলবে, তবে সামরিক আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে।
১৯৬৯ সালে আইয়ুব নিজেই যখন মসনদ ছাড়তে বাধ্য হন, তখন ইয়াহিয়া খান মার্শাল ল জারি করে সংবিধান রদ করে হুবহু একই পদ্ধতি অবলম্বন করেন ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৬৯’ দিয়ে।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে মতভেদ এত প্রবল কেন?৩০ আগস্ট ২০২৫বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্টে জারি করা মার্শাল ল প্রোক্লেমেশনের ঙ ও চ—দফার মাধ্যমে ঘোষণাপত্র ও সামরিক আইন বিধিমালা ও আদেশ সাপেক্ষে সংবিধান বলবৎ রাখা হয়। এই অধিসাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনেই ১৯৭৫-৭৯ পর্যন্ত প্রণীত অনেকগুলো ‘প্রোক্লেমেশন অর্ডার’ বলেই সংবিধান সংশোধন করা হয়।
এসব সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন ঘটানো সাংবিধানিক কাঠামো দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করে ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সেই সাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনেই সম্পন্নের পর গঠিত জাতীয় সংসদে সেগুলো অনুমোদিত হয়। ভুলে গেলে চলবে না যে পঞ্চম সংশোধনী দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে সংবিধানে কোনো সংশোধনীই আনা হয়নি, শুধুই অধিসাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনে আনা সংশোধনীগুলোই অনুমোদন করা হয়।
১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সংবিধান স্থগিত করে দেন এবং আরেক কাঠি সরেস হয়ে ২৪ মার্চ ১৯৮২ জারি করা মার্শাল ল প্রোক্লেমেশনকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে ঘোষণা করে এর অধস্তন হিসেবে পূর্ববর্তী সব আইনকানুন, ব্যবস্থা চালু রাখেন। এর অধীনে তিনিও ‘প্রোক্লেমেশন অর্ডার’ জারি করে সংবিধানে সংশোধনী আনেন, যেগুলো পরে সপ্তম সংশোধনী হিসেবে অনুমোদিত হয়।
১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশ সরকার একটি আইন জারি করে ‘আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ, ১৯৭১’ নামে। এ আইনের বলে ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত বিদ্যমান সব আইন, বিধিবিধানকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অধীনে কার্যকর রাখা হয়। এরও আগে ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির সময়েও দেখা যায়, নতুন বন্দোবস্তের আলোকে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ এর ১৮(৩) ধারাতেও উভয় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আগের সব আইন কার্যকর রাখা হয়।
এসব দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায়, যারাই একটা নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করে, তারা পূর্বের সংবিধান বা আইনি কাঠামোর যেটুকু মানতে চায়, সেটুকুই নিতে পারে। চাইলে পুরোটাই নিতে পারে, না চাইলে পুরোপুরি বাদও দিতে পারে। একবার পূর্ববর্তী সংবিধানের কিছু নিয়েছে বলেই তা সব সময় মেনে চলতে হবে, এ রকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
প্রকৃতপক্ষে এটা অভ্যুত্থানের একটা মূলনীতি; পূর্বের কাঠামো থেকে যত দূর সম্ভব বেরিয়ে আসা। কিন্তু যত দিন পর্যন্ত পুরোপুরি বেরিয়ে আসা সম্ভব না হয়, তত দিন আগের রাষ্ট্রকাঠামোর কলকবজাগুলো প্রয়োজনমতো গৃহীত বা বর্জিত হয়। তাদের এই ম্যান্ডেট দেয় অভ্যুত্থানকারী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী।
৩.এমন পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের রাজনৈতিক পরিসরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা আরেকটা বয়ান নিয়ে দুটো কথা না বললেই নয়। এটি প্রথম প্রকাশ্যে আনেন কবি, লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তাঁর মতে, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী শপথ নেওয়ার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘বিপ্লবী চরিত্র’ নষ্ট হয়ে গেছে।
ফরহাদ মজহারের এ রকম বক্তব্যে যুক্তি আছে কি নেই, তাঁর চেয়ে বড় কথা হলো, গণ–অভ্যুত্থানের রাজনীতি, সরকারের বৈধতা, শাসনতান্ত্রিক পরম্পরার ব্যাপারগুলোতে এটাই একমাত্র বা শেষ কথা নয়। এর কারণটি হলো, কাঠামো বদলে গেলেই বৈধতার নতুন পথ তৈরি হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানিরা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী অনেক জাতীয় পার্লামেন্ট সদস্যকে (এমএনএ) অযোগ্য ঘোষণা করে। তারপর সেসব আসনে উপনির্বাচন দিয়ে বেশির ভাগ আসনে পছন্দের প্রার্থীদের একতরফাভাবে জিতিয়ে আনে।
কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী পূর্বের পার্লামেন্ট সদস্যরাই গণপরিষদের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেন। একই সময় পাকিস্তানেও একটি গণপরিষদ গঠিত হয় ’৭০–এর নির্বাচনে বিজয়ীদের নিয়ে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত দুজন এমপি ছিলেন নুরুল আমীন ও রাজা ত্রিদিব রায়। বাংলাদেশের গণপরিষদে আবার এই দুজনকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
এ থেকে বোঝা যায়, জনগণের অভিপ্রায় বদলে গিয়েছিল বলেই নতুন কাঠামোর জন্ম হয়েছিল, বৈধতার নতুন নতুন নিয়ম ও পদ্ধতি তৈরি হয়েছিল।
বিশুদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া পরবর্তী সংসদকেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য করার সুযোগ নেই। কারণ, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সেই সংসদও নিজেদের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ম্যান্ডেট পাবে। তখন তারা নতুন আরেকটি সাংবিধানিক কাঠামোর জন্ম দেবে। তারা যদি জুলাই সনদের আংশিক বাস্তবায়ন করে, তখন তাদের বাধ্য করার ক্ষমতা সংবিধানে থাকবে না; শুধুই রাজপথই হতে পারে তার সমাধান।৪.আধুনিক কালে সরকার বা কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈধতার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পথ হলো সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ভূখণ্ডের নাগরিক, সামাজিক–রাজনৈতিক সংগঠন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ। শুরুতেই জনগণ ও বহির্বিশ্বের স্বীকৃতির ভেতর দিয়ে জুলাই-উত্তর নয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা তার সার্বভৌম ক্ষমতা সুসংহত করেছে।
এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে চলতি সংবিধানের আওতায় শপথ নিলেও তাতে অন্তর্বর্তী সরকারের বিপ্লবী চরিত্র ক্ষুণ্ন হয়নি বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ, ৩৬ জুলাই এখানে জনগণের গাঠনিক ক্ষমতার উন্মেষ ও একটা ‘পরম ব্যতিক্রমী অবস্থা’র জন্ম দিয়েছে।
‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’ সার্বভৌম ক্ষমতাকে বাছাই করার ম্যান্ডেট দেয়, কী করতে হবে আর কী না করলেও চলবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে আদালতের মতামত নেওয়া এবং বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণকে ‘অবৈধ’ বলার সুযোগ নেই।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে কিছু ভাবনা১৮ আগস্ট ২০২৫৫.তাহলে জুলাই সনদ নিয়ে কি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে? এর জবাব হলো, সেটা হতেও পারে, আবার না–ও হতে পারে। এটাও সার্বভৌম ক্ষমতার সিদ্ধান্তের বিষয়। এ রকম প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন হলো, আগামী নির্বাচন কি গণপরিষদ নির্বাচন হবে? সেখানে কি জুলাই সনদ অনুযায়ী সংবিধান পুনর্লিখন করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত?
লক্ষণীয়, ১৯৭২ সালে গঠিত গণপরিষদ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তারা পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য রায় পেয়েছিলেন। আবার সেই নির্বাচনে জয়ী দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে ভোট পেয়েছিল ৭৫ দশমিক ১১ শতাংশ। ফলে অঙ্কের হিসাবেই এখানকার ২৫ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্বও সেই গণপরিষদের ছিল না।
আবার গণপরিষদ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে গণপরিষদের সদস্যদের সদস্যপদ বাতিল আদেশ পাস করে এর তাঁদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মতপ্রকাশের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এভাবে ২০ জনকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। ফলে ওই গণপরিষদের পক্ষে স্বাধীনভাবে জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা সম্ভব ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
সর্বোপরি ওই গণপরিষদের দ্বারা প্রণীত সংবিধান অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি; এ দেশে বারবার ঘটা গণ–অভ্যুত্থান, সংবিধান স্থগিত, সংবিধান পুনর্লিখনের মতো ঘটনাগুলো থেকেই তা বোঝা যায়। এর ফলে জনগণকে স্বাধীনভাবে তাদের অভিপ্রায় প্রকাশের সুযোগ দিতে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিকে ইতিবাচক বলেই প্রতীয়মান হয়।
এ রকম পটভূমিতে জুলাই সনদের আইনগত অবস্থান বা এর বাস্তবায়নের পদ্ধতিকে বিবেচনায় নিতে হবে। ৫ আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় থাকা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা। আর এই পুরো কর্মযজ্ঞের প্রতিভূ হিসেবেই ধরতে হবে জুলাই সনদকে। সে ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বন্দোবস্তের ভেতর দিয়েই এর বাস্তবায়ন হওয়াই মানানসই হয়।
আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে গতানুগতিক সাংবিধানিক বন্দোবস্তে ফেরত আসার পর জুলাই সনদের বাস্তবায়নকে বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে বা এর মুখাপেক্ষী করা হলে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা তার কর্তৃত্ব হারাবে। এতে যে সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে উৎখাত করে জুলাই সংঘটিত হয়েছিল, সেই ব্যবস্থার অধীনেই জুলাই অভ্যুত্থানের বৈধতা-অবৈধতার বিচার বা পর্যালোচনার বিষয়টি উন্মুক্ত হয়ে পড়বে।
আরও পড়ুনজুলাই ঘোষণাপত্র: জন-আকাঙ্ক্ষা এবং রাষ্ট্রের অভিপ্রায়০৮ আগস্ট ২০২৫আবার পরবর্তী সংসদই কেবল এগুলো বাস্তবায়ন করার আইনগত ক্ষমতার অধিকারী, এটাও অলঙ্ঘনীয় কোনো ব্যাপার নয়।
পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর ক্ষেত্রে এ রকম দেখা গেছে; একইভাবে জুলাই সনদ আগে বাস্তবায়ন করে পরে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে অনুমোদন নেওয়া যেতে পারে।
বিশুদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া পরবর্তী সংসদকেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য করার সুযোগ নেই। কারণ, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সেই সংসদও নিজেদের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ম্যান্ডেট পাবে। তখন তারা নতুন আরেকটি সাংবিধানিক কাঠামোর জন্ম দেবে। তারা যদি জুলাই সনদের আংশিক বাস্তবায়ন করে, তখন তাদের বাধ্য করার ক্ষমতা সংবিধানে থাকবে না; শুধুই রাজপথই হতে পারে তার সমাধান।
কিন্তু সব রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা রাজপথে হওয়া রাজনৈতিক পরিপক্বতার লক্ষণ নয়। কিছু ফয়সালা জাতীয় ঐকমত্য, কিছু নির্বাচনে আর কিছু সংসদে নেওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে রাষ্ট্রের স্থিতিশীতলতা। জুলাই সনদ প্রশ্নে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে।
মিল্লাত হোসেন আইন–আদালত, সংবিধান বিষয়ে লেখক ও গবেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব