ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটা দিকের জন্য আমরা তাঁকে ধন্যবাদ দিতে পারি। তিনি একেবারে পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে আমেরিকা কখনোই ‘নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা’ টিকিয়ে রাখার উপযুক্ত পুলিশ ছিল না।

আমেরিকাকে বরং এক গ্যাংস্টার সাম্রাজ্যের প্রধান বলাই ভালো। সারা বিশ্বে তাদের আট শতাধিক সামরিক ঘাঁটি আছে। স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে তারা ‘বিশ্বের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ’ চায়।

আপনি যদি আমেরিকাকে মেনে চলেন, তাহলে ঠিক আছে। আর যদি তা না করেন, তাহলে আপনাকে সরিয়ে দেওয়া হবে। গত শুক্রবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাঁকে প্রকাশ্যে অপমান করা হয়েছে হোয়াইট হাউসে। সাংবাদিকদের সামনেই।

অনেকে ভাবছেন, এটা তো খুব খারাপ হলো। কিন্তু এর চেয়েও খারাপ তো হয়ে গেছে আগেই। আর তা হলো ইউক্রেন ও রাশিয়ার লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু। এই যুদ্ধ একদমই দরকার ছিল না। আমেরিকাই এই যুদ্ধ তৈরি করেছে গত বিশ বছর ধরে ন্যাটোর মাধ্যমে। এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল একটাই—বিশ্বকে দেখানো, আমেরিকাই বস। ঠিক যেমন তারা ইরাকে করেছিল।

হেনরি কিসিঞ্জার একবার বলেছিলেন, আমেরিকার শত্রু হওয়া বিপজ্জনক, কিন্তু আমেরিকার বন্ধু হওয়া আরও ভয়ংকর।

জেলেনস্কি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। গ্যাংস্টারদের সাম্রাজ্য এমনই হয়। আপনাকে তারা কাজ করাবে। এরপর যখন দরকার ফুরাবে, ছুড়ে ফেলে দেবে। ঠিক যেমন হলিউড সিনেমায় দেখা যায়।

জো বাইডেনের আমলে জেলেনস্কিকে আমেরিকা কাজে লাগিয়েছে। রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে আমেরিকার একটা কাজের লোক দরকার ছিল। এখন তার পরিণতি কী হলো, সবাই দেখছে।

ন্যাটো বারবার ইউক্রেনকে নিজেদের আওতায় নেওয়ার চেষ্টা করেছে। রাশিয়া বারবার সতর্ক করেছে যে এটি তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হতে পারে। রাশিয়া কখনোই চাইবে না আমেরিকা তার সীমান্তে ক্ষেপণাস্ত্র বসাক। ঠিক যেমন ১৯৬০-এর দশকে কিউবার সীমান্তে সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র বসানোকে আমেরিকা একেবারে বরদাশত করেনি।

ইউক্রেনে শান্তিচুক্তি হলে আমেরিকা রাশিয়াকে নিজের পক্ষে এনে নতুন এক নিরাপত্তা–কাঠামো তৈরি করবে, যা চীনের একক প্রভাবকে আরও দুর্বল করে দেবে।

এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের জনগণ নিজেদের শান্তির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত করেছিল ভলোদিমির জেলেনস্কিকে। তাঁর মূল প্রতিশ্রুতি ছিল দেশে গৃহযুদ্ধ বন্ধ করা। এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। পশ্চিম ইউক্রেনের রাশিয়াবিরোধী ‘জাতীয়তাবাদী’ গোষ্ঠী এবং পূর্ব ইউক্রেনের রুশভাষী জনগণের মধ্যে বিরোধের মধ্য দিয়ে এর সৃষ্টি। কিন্তু শিগগিরই জেলেনস্কি তাঁর সেই শান্তির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প জেলেনস্কিকে ‘একজন স্বৈরশাসক’ বলেছিলেন। এ অভিযোগ কিছুটা সত্য হতেও পারে। কারণ, আমেরিকা চেয়েছিল, জেলেনস্কি সেই ধরনের নেতা হোক যে তাদের প্রয়োজনে কাজ করবে। যদিও অনেক ইউক্রেনীয় চেয়েছিল অন্য কিছু।

এখন বাইডেন চলে গেছেন। নতুন প্রশাসন এসেছে। নতুন মাফিয়া ‘ডন’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে জেলেনস্কি দিয়ে কাজ হচ্ছে না। কিন্তু এর পেছনে খরচ হচ্ছে অনেক বেশি। ওদিকে রাশিয়া কোনোভাবে দুর্বল হয়নি। বরং শক্তিশালী হয়েছে। এখন নতুন কৌশল দরকার।

জেলেনস্কি মনে করছিলেন যে তিনি আমেরিকার প্রিয় ‘গুন্ডা’। আর তখনই তিনি হোয়াইট হাউসে গিয়ে এক কঠিন পাঠ শিখলেন—মাফিয়া শিষ্টাচারের শিক্ষা। জানলেন যে তিনি ঠিকমতো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেন না।

ট্রাম্প এখন ইউক্রেনে শান্তিচুক্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। শান্তি আসুক আর না সুক, আসল কথা হলো এই চুক্তির পেছনে আছে মূলত অর্থনৈতিক লাভের হিসাব। ট্রাম্পের মতে, রাশিয়া এই যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। অবশ্য পশ্চিম বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে চাইলে অন্য কথা। বাস্তবে, এই যুদ্ধের পেছনে যে শক্তি কাজ করছে, তা হলো টাকা।

এখন ট্রাম্পের চাপে একটা শান্তিচুক্তি হয়তো হবে। সেই চুক্তির ভিত্তি হবে ইউক্রেনের সম্পদ—বিরল খনিজ, কৃষিজমি এবং অন্যান্য খাত। আর এই সবই ব্যবহৃত হবে একটি শক্তিশালী দেশের প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য। জেলেনস্কি এখন এটা বুঝতে পেরেছেন। বুঝতে পেরেছেন যে তিনি এবং ইউক্রেনের জনগণ এক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। মাফিয়া সংগঠনের সঙ্গে হাত মেলালে এ রকমই হয়।

ট্রাম্পের পূর্বসূরিরা যেখানে ইউক্রেন এবং গাজা সমস্যা সমাধানকে বিশ্বশান্তি বা এরকম সব গালভরা নামে ডাকত। ট্রাম্প সেখানে সরাসরি বলেছিলেন যে এই অঞ্চলগুলো শুধু আমেরিকার ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ। তিনি কোনো রকম আড়াল না রেখেই পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে ইউক্রেন এবং গাজা তার দেশের বৈশ্বিক স্বার্থের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ।

হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কির সঙ্গে কথোপকথনে ট্রাম্প একথা আবার বলেছেন, ‘আমরা ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ ব্যবহার করব। এসব ব্যবহৃত হবে আমাদের বিভিন্ন কাজে, যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অস্ত্র ব্যবস্থাপনা ও সামরিক ক্ষেত্রে। এগুলো আমাদের দরকার।’

এই বক্তব্যে ট্রাম্পের লক্ষ্য পরিষ্কার—যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধ শেষ করা এবং রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি ঠেকানো। রাশিয়া ইউক্রেনের যত বেশি অঞ্চল দখল করবে, আমেরিকার ভাগে তত কম জায়গা থাকবে খনিজ সম্পদ লুট করার জন্য। এ জন্যই ট্রাম্প যুদ্ধ শেষ করতে এমন মরিয়া।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ন্যাটোর এই যুদ্ধ একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে খনিজ সম্পদ নিয়ে লড়াইয়ের গভীর কৌশলের অংশ। গত বছর মার্কিন কংগ্রেসের একটি কমিটিতে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য ‘সামরিক খনিজের প্রাধান্য’ নিয়ে আলোচনা করেছিল। আমেরিকার মূল লক্ষ্য ছিল চীনের প্রভাব রুখে দেওয়া এবং ইউক্রেনের মাধ্যমে রাশিয়াকে আরও একবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা।

এখানে ট্রাম্পের লক্ষ্য হচ্ছে ইউক্রেনের ভূখণ্ড কাজে লাগিয়ে পশ্চিমে একটি নতুন নিরাপত্তা–কাঠামো তৈরি করা। তা করে রাশিয়াকে আমেরিকার পক্ষে আনা যাবে। আবার চীনের একচেটিয়া প্রভাবকেও চাপের মধ্যে ফেলা যাবে। রাশিয়া ও চীন একত্র হয়ে নতুন এক শক্তিশালী জোট তৈরি করেছে। এই জোটের নাম ব্রিকস। এতে আছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা।

ব্রিকস আমেরিকার বৈশ্বিক আধিপত্যের বিপরীতে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়তে চাচ্ছে। ইউক্রেনে শান্তিচুক্তি হলে আমেরিকা রাশিয়াকে নিজের পক্ষে এনে নতুন এক নিরাপত্তা–কাঠামো তৈরি করবে, যা চীনের একক প্রভাবকে আরও দুর্বল করে দেবে।

ট্রাম্পের আচরণ অশালীন হতে পারে। কিন্তু তিনি যে সাম্রাজ্য পরিচালনা করছেন, তা আগেও দুনিয়াজুড়ে ক্ষমতার লড়াই চালিয়েছে। ট্রাম্পও সেই কাজ করছেন। তবে আরও খোলামেলাভাবে।

জোনাথন কুক লেখক, সাংবাদিক

মিডিল ইস্ট আই থেকে নেওয়া ইংরেজির সংক্ষেপিত অনুবাদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউক র ন র এই য দ ধ আম র ক র র জন য ক জ কর দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান

ইদানীং কিছু ভদ্রলোক ইনিয়ে-বিনিয়ে, এমনকি সুযোগ বুঝে সরাসরিও বলে ফেলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের চেয়ে শেখ হাসিনার শাসনেই দেশ ভালো চলছিল। দু–একজন এ-ও বলছেন, গত ৪০ বছরে এখনকার মতো খারাপ অবস্থা নাকি তাঁরা দেখেননি।

এই ‘মহামানবদের’ কথা মান্য করলে প্রশ্ন এসেই যায়, কী লাভ হলো গণ–অভ্যুত্থান করে, এত জীবন বিসর্জন দিয়ে, এত রক্ত ঝরিয়ে?

আওয়ামী লীগের শত্রুরা উত্তর দিক: সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে হাসিনা পতনের এক দফা দাবিতে রূপান্তরের কী প্রয়োজন ছিল? গণবিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেড় দশকে গড়ে ওঠা এক শক্তিশালী ব্যবস্থাকে ভেঙে খান খান করে ফেলার কী এমন প্রয়োজন ছিল?

হাসিনা-পরবর্তী এই ‘ভগ্ন হৃদয়ের’ যুগে ভারতীয় শিল্পী কবির সুমনের সে গানটি ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই...শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’ শুনি আর ভাবি, ২০২৪-এর ‘ডামি’ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাকে আজীবন ক্ষমতায় দেখতে চাওয়া অলিগার্কদের কী যে আকুতি ছিল!

মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে নেত্রীর পতন দেখে হয়তো সেদিন তাঁরা শুনেছেন কিংবা গেয়েছেন অন্য কোনো গান। হতে পারে আরেক ভারতীয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া সেই গান তাঁরা গেয়েছিলেন, ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...আমার বলার কিছু ছিল না।’

আক্ষেপ কেন, কমরেড, জীবন নিয়ে পালিয়ে তো তিনি নিরাপদেই আছেন দিল্লিতে!

তবু ‘সে কি ভোলা যায়, তুমি আমারই ছিলে’ হে বাংলাদেশ সাম্রাজ্য! সত্যিই তো তাঁর এবং তাঁদের একচেটিয়া অধিকার ছিল যেভাবে খুশি যত বেশি ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তি ভোগের।

একটি অভিজাত গোষ্ঠীকে (অলিগার্কি) হাসিনা-প্রদত্ত সেই লাভজনক স্থিতাবস্থা হারিয়ে কীভাবে চুপ করে বসে থাকবে এর ‘ভাগ্যবান’ সদস্যরা! নতুন রাজনৈতিক বিনিয়োগও কিছু দরকার হবে যদি ভবিষ্যৎ মুনাফার আশা করতে হয়।

টাকাওয়ালাদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বিনা ভোটে বা জালিয়াতির মাধ্যমে সংসদ সদস্য পদ বা মন্ত্রিত্ব উপহার, তাঁর চামচাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতি এবং দলীয় অনুগতদের মিডিয়ার লাইসেন্স প্রদানসহ কত ধরনের দান-দক্ষিণার ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ‘ষোলো কোটি মানুষকে খাওয়ানোর’ দাবিদার বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগপ্রধান হাসিনার সরকার।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতু থেকে গভীর সমুদ্রবন্দর, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল রোড, ডজন ডজন নতুন ব্যাংক থেকে শত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি—এ রকম বড় বড় ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণে তাঁর কোনো তুলনাই হয় না।

একটু–আধটু দুর্নীতি হলেও অন্তত মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন তো দেখাচ্ছিলেন তাঁর সভাসদরা। এই ধরুন, লাখো কোটি টাকার ব্যাংকঋণ জালিয়াতি, খেলাপি, দলীয় নেতা মাস্তানদের হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি ও সম্পদ লুণ্ঠন, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার ইত্যাদি বিষয় দেড় দশকের স্থিতিশীলতার তুলনায় এমনকি বাড়াবাড়ি!

যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?

জনগণকে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন জনদরদি হাসিনা সরকার। ২০১৪ সালের ১৫৪ সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত, ২০১৮ সালে নৈশকালীন ভোট এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন করে হাসিনা তাঁর বাবা শেখ মুজিবের তৈরি একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার নতুন মডেল দাঁড় করান পৃথিবীর সামনে।

যাঁরা এই আওয়ামী শাসনের ‘স্থিতিশীলতা’ নস্যাৎ করতে চেয়েছে তাদের ‘ঠ্যাং ভেঙে’ দিতে একটুও দ্বিধা করেনি হাসিনা সরকার। সরকারের ধারাবাহিকতা নষ্টের চেষ্টাকারীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া হয়েছে গুম, খুন, সহিংসতা, জঙ্গিনাটক, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, প্রতিবাদ দমন ও বাক্‌স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে। সে জন্য আপনারা তাঁকে ফ্যাসিবাদী বলার সাহসও পাননি তখন।

জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে হাজারো তরুণ ও সাধারণ মানুষ নিহত (শহীদ) হওয়ার দায় নিতে চাননি হাসিনা। উল্টো তাঁর দাবি, ৫ আগস্ট তাঁকে মারতেই লক্ষ জনতা গণভবন অভিমুখে যাত্রা করেছিল।

আরও পড়ুন‘আমি কী অপরাধ করেছি’— সবাই জানেন শিরোনামটা...৩০ জুলাই ২০২৫

আরও রক্তপাত এড়াতেই নাকি তাঁর নিজের লোকদের মায়া ছেড়ে ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্বন করে ভারতে পাড়ি জমান শেখ হাসিনা।

তাই আজ তাঁর ফেরার অপার ইচ্ছা যেন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি গানের মতোই, ‘তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথি হতে আজকের চেষ্টা আমার।’

যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?

যেন এত সব বিষয় নিয়ে জনমনে কোনো ক্ষোভই ছিল না হাসিনার আমলে। এটি সেই বিস্মৃত অতীত, যেটি নিয়ে কল্পিত সংগীত রচিত হয়: ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।

আরও পড়ুনশেখ হাসিনা স্বৈরশাসকদের টিকে থাকার দুটি মূলমন্ত্রেই ব্যর্থ২২ আগস্ট ২০২৪

তার মানে, তাঁর শাসনকালই জাতির জন্য ছিল আদর্শ। এটা প্রমাণ করার এক অদৃশ্য প্রচেষ্টা রয়েছে আজ এখানে, আমাদের চারপাশে, আশপাশে।

সত্য, মিথ্যা মিশিয়ে এমন দাবি করেন কারা এবং কেন—সেটা আমাদের একটু বোঝা দরকার।

হাসিনার চামচা ও সুবিধাভোগী, তাঁর ঘরানার অসৎ বুদ্ধিজীবী, তাঁর হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতি নিয়ে নির্বিকার নেতা-কর্মী-সমর্থক, বর্তমান আমলে বিশেষ কিছু না পেয়ে প্রবলভাবে হতাশ কতিপয় সুশীল অথবা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বোধ ব্যক্তির পক্ষেই ফ্যাসিবাদী শাসনামলকে উত্তম বলা সম্ভব।

এতে হাসিনার লোকদের বড় লাভ হতে পারে দায় স্বীকার না করে বা ক্ষমা না চেয়েই তাঁদের হাত ও নামসমূহকে দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের রক্তের দাগ থেকে মুক্ত করা।

এ প্রচেষ্টা ঘটে যাওয়া সত্যকে অস্বীকার, শহীদদের আত্মত্যাগ অগ্রাহ্য, আহত ব্যক্তিদের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং মজলুমদের অনুভূতির সঙ্গে মশকরা ছাড়া আর কিছুই না।

এগুলোই আবার জুলাই বিপ্লবের পক্ষের শক্তির বয়ান তৈরিতে ব্যর্থতা প্রমাণ করে।

আরও পড়ুনহাসিনা শাসনের উন্নয়নের বানোয়াট গল্প০৩ অক্টোবর ২০২৪

পরিবর্তনের পক্ষে জনগণের প্রবল আকাঙ্ক্ষার কোনো কমতি ছিল না এবং হত্যা-দুর্নীতিসহ ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের লক্ষ্যে কমবেশি সংস্কারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক চিন্তা, গণতান্ত্রিক ভাবনা, কিংবা আমলাতান্ত্রিক কর্মসূচিকে জনমত তৈরির জন্য সেভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একটা একটা করে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উত্তম বিকল্প জনগণের সামনে আনলে গণমানুষকে নতুন ধারণা ও আশাবাদ উপহার দেওয়া যেত।

কয়েকটি মডেল নির্বাচন দিয়ে, তরুণদের পরিবেশ রক্ষার মতো সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে, রাজনৈতিক দলসমূহকে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে অংশীদার বানিয়ে এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাক করে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে হাসিনার কুশাসনকে যথাযথভাবে চিত্রিত করা যেত।

ধারণা করি, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগে ঘাটতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগগুলো সম্পর্কে জনসম্পৃক্ততার অভাব হাসিনার উপকারভোগীদের নিজস্ব গান গাওয়ার পরিসর দিয়েছে।

ফ্যাসিবাদী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং ২০২৪-এর আন্দোলনে পুরোভাগে থাকা ছাত্র ও অন্য শক্তিগুলো পরস্পরের মধ্যে লজ্জাজনক কুতর্কে জড়িয়ে পড়ায় গণ–অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনের এজেন্ডা এবং উপযোগী বয়ান যথেষ্ট মার খেয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণও কিছুটা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়েছে।

বাংলাদেশিদের বর্তমান হতাশা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়াটাই কাম্য ছিল পরাজিত শক্তির। হাসিনা বিহনে আওয়ামী উপকারভোগী বা অন্ধ সমর্থকেরা গোপালগঞ্জ বা অন্য কোনো অঞ্চলে নিরালায় বসে যেন গুনগুন করে গাইছে গগন হরকরার গান, ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে...।’ তারা বুঝতে পারছে না জাতির জীবনে শেখ হাসিনা এমন এক জুলুমশাহি শাসকের নাম ও ফ্যাসিবাদের প্রতিমূর্তি; যার শাসন পুরো দেশকে বানিয়ে ফেলেছিল ‘জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ’।

নিজেদের বাইরে জনগণের অন্য যেকোনো গোষ্ঠীকে ক্ষমতার ভাগ দিতে না চাওয়া সেই ফ্যাসিবাদী ধারায় ছেদ টেনেছে জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার গঠন, যেটিও আশা করি বাংলাদেশের শেষ সরকার নয়।

বিদায় নেওয়া ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে যেকোনো দেশেই অনেকটা পুরোনো দিনের গান। এই গান অবশ্যই স্মৃতিজাগানিয়া কিন্তু চলমান বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। ভবিষ্যতে আবারও ফ্যাসিবাদকে সহ্য করবে, এমন প্রজন্ম এ দেশে সেকেলে এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তরুণেরা এবং অভিজ্ঞ বিবেকবানেরা এখন অজানা এক নতুন বাংলাদেশের অপেক্ষায়।

ফলে ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’ গান বাদ দিয়ে হাসিনার মানসপুত্রদের এখন নিরালা নিঝুম ও যথাযথ ভাবগম্ভীর পরিবেশে বসে মুদ্রিতনেত্রে মন্দ্রসপ্তক কণ্ঠে ভক্তিভরে গাওয়া উচিত, ‘মা, আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা... ।’

খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদে আমাদের যে সম্মতি সেটি আইনের ঊর্ধ্বে: সালাহউদ্দিন
  • সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও মাদকমুক্ত বন্দর গড়তে চাই : সাখাওয়াত
  • বিএনপির ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রূপগঞ্জে লিফলেট বিতরণ 
  • জুলাই আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়াবেন না: টুকু
  • সবাই অপেক্ষা করছে একটা নির্বাচনের জন্য
  • ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান
  • সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে দেশে ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে: তারেক রহমান
  • সরকারের একটি অংশ অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে: তারেক রহমান
  • ট্রাম্পের প্রতি মার্কিন জনগণের সমর্থন ৪০ শতাংশে ঠেকেছে
  • জাতিসংঘে সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান বৈঠক, ফিলিস্তিন ইস্যুতে উদ্বেগ