সম্প্রতি জাপানে মারাত্মক এক ঘটনা ঘটেছে। জাপানি লেখক ইয়োশিমোতো বানানার নামে একটি বই অ্যামাজনে ছাড়া হয়েছে, যেটি তিনি লেখেননি। তাহলে এই বইটির লেখক কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই? জালিয়াতির বলয় কি মানুষের সৃজনশীলতার জগৎকেও প্রভাবিত করছে? এসব প্রশ্নের জবাবের আগে চকিতে ইয়োশিমোতো বানানার দিকে নজর দেওয়া যাক।

ইয়োশিমোতো বানানা জাপানের আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত লেখকদের একজন। ৬০ বছর বয়সী এই নারী ঔপন্যাসিক নিজের ব্যক্তিগত জীবন আড়ালে ঢেকে রাখতে পছন্দ করেন। ১৯৮৮ সালে ‘কিচেন’ উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সাহিত্যের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও হারুকি মুরাকামির মতো সে রকম ব্যাপক জনপ্রিয়তা তিনি পাননি। তবে সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় তিনি ব্যাকুল ছিলেন, এমন অভিযোগও তাঁর বেলায় খাটে না। হয়তো এ কারণেই সৃজনশীল রচনার গভীরতা ভিন্ন এক আঙ্গিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে তাঁকে। রান্নাঘরের জাপানি একটি প্রতিশব্দ থাকলেও জাপানের আধুনিক বাড়িঘরে রান্নাঘর ‘কিচেন’ নামেই পরিচিত। আর ইয়োশিমোতোর প্রথম উপন্যাস সেই শিরোনাম নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে। জাপানে এই উপন্যাসের ৬০টির বেশি মুদ্রণ হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাসটির অনুবাদ। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে এটি শিক্ষাক্রমেরও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইয়োশিমোতো এ পর্যন্ত ১২টি উপন্যাস ছাড়াও অন্যান্য রচনার ৭টি সংকলন প্রকাশ করেছেন, জাপানে যেসব বইয়ের সম্মিলিত বিক্রির সংখ্যা ৬ কোটির বেশি।

বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার বাইরে ব্যক্তির ওপর রয়েছে পরিবার ও গৃহের প্রভাব এবং মানবচেতনার অবক্ষয়ের প্রতিক্রিয়া, মোটাদাগে এগুলোই ইয়োশিমোতো লেখার বিষয়বস্তু। খোলামেলা অর্থে রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে তিনি নিজের লেখায় উপস্থিত না হলেও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের ভিন্ন একটি বলয় তাতে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।

ইয়োশিমোতো বানানার জীবনের ব্যতিক্রমী একটি দিক হচ্ছে তাঁর পারিবারিক পরিচয়। পিতা তাকাআকি ইয়োশিমোতো কবি ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবে পরিচিত। বোন হারুনো ইয়ুইকো হলেন জাপানের পরিচিত একজন কার্টুনশিল্পী। সাহিত্যিক-জীবনের শুরুতে বানানা নাম তিনি গ্রহণ করেছেন কলাগাছের ফুলের সৌন্দর্য দেখার পর থেকে। যদিও জন্মের সময় থেকে পরিবারের সদস্যদের রাখা নাম মাহোকো আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা তিনি বজায় রেখেছেন। স্বামী হিরোইয়োশি তাহাতা এবং এক পুত্রসন্তান নিয়ে টোকিওতে তাঁর বসবাস। সমকালীন জাপানে তরুণদের অনুভব করা ক্লান্তি তাঁর উপন্যাসের অন্যতম প্রধান একটি বিষয় হলেও জীবনের চলার পথে সামনে দেখা দেওয়া ব্যতিক্রমী ও ভয়ংকর অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত জীবনে কীভাবে ছাপ রেখে যায়, তা-ও লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি।

জাপানের সুপরিচিত এই নারী লেখক সম্প্রতি ভিন্ন যে কারণে সংবাদ শিরোনামে এসেছেন, তা হলো তাঁর নাম ব্যবহার করে লেখা বানোয়াট এক উপন্যাসের আত্মপ্রকাশ এবং সারা বিশ্বে অনলাইনে পণ্য বিক্রির বৃহত্তম মাধ্যম অ্যামাজনে বইটির ব্যাপক বিক্রয়। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে নিজের পরিচিত কিছু লোকজনের কাছ থেকে ‘পৃথিবীর সময় ফুরিয়ে আসছে’ নামের সেই বই সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন। এরপর কালবিলম্ব না করে বইয়ের বিক্রি জব্দ করার অনুরোধ তিনি জানান অ্যামাজনকে। অ্যামাজন অবশ্য দ্রুতই ইয়োশিমোতো অনুরোধে সাড়া দিয়ে বিক্রির তালিকা থেকে তুলে নিয়েছে বইটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরা বার্তায় ই-বুক সংস্করণে প্রকাশিত সেই উপন্যাস না কেনার জন্য পাঠকদের সতর্ক করে দিয়েছেন ইয়োশিমোতো। ওই বার্তায় তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ভিন্নমাত্রার নতুন জালিয়াতি বন্ধ করার জন্য আইনি পদক্ষেপ নেব আমি।’ জাপানের নেতৃস্থানীয় দৈনিক ‘আসাহি শিম্বুন’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ব্যক্তির সৃজনশীলতা নিয়ে এমন জালিয়াতি এবং এতটা খোলামেলাভাবে বইটি যে বিক্রি হবে, তা ছিল তাঁর কল্পনার বাইরে।

আধুনিক বিশ্বে এমন জোচ্চুরি কল্পনাতীত হলেও সাহিত্যিক জোচ্চুরির শুরু অবশ্য প্রাচীন গ্রিস থেকে, যা থেমে থেমে সব যুগেই কিছু না কিছু ঘটেছে। এই জালিয়াতি থেকে বাদ পড়েননি উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারও। ১৭৯৬ সালে ১৯ বছর বয়সী উইলিয়াম হেনরি আয়ারল্যান্ড নামে একজন ‘ভর্টিজার্ন অ্যান্ড রোওয়ানা’ নামক নিজের লেখা ও প্রকাশিত এক ঐতিহাসিক নাটককে শেক্‌সপিয়ারের অনাবিষ্কৃত লেখা বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ১৯৮০ দশকে ষাট খণ্ডের দিনলিপি দিয়ে সাজানো ‘হিটলারের ডায়েরি’র উল্লেখও এখানে করা যেতে পারে। যদিও এটি সরাসরি সাহিত্যকর্ম নয়, তবু হিটলারের সেই ডায়েরি পশ্চিম জার্মানির ‘স্টার্ন’ ম্যাগাজিন কিনে নিয়েছিল প্রায় ৩৭ লাখ ডলারে। পরে ব্রিটেনের ‘দ্য সানডে টাইমস’ অনুসন্ধান করে বের করে এটি ছিল ভুয়া একটি ডায়েরি, যার আসল লেখক অ্যাডলফ হিটলার নন, বরং পূর্ব জার্মানির কনরাড কুজাউ নামের এক ব্যক্তি।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক জায়গায় কপিরাইট ফাঁকি দিয়ে বিখ্যাত লেখকের নানা বই হুবহু প্রকাশ করা হলেও নিজে লিখে অন্য কোনো বিখ্যাত লেখকের নামে চালিয়ে দেওয়ার মতো অপকর্মের ঘটনা আধুনিক বিশ্বে এখন অবশ্য কিছুটা কঠিনই বটে। তবে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগেও অ্যামাজনের মতো বিশ্ববিখ্যাত বিক্রয় প্ল্যাটফর্মে এ ধরনের প্রতারণার শিকার হলেন জাপানি লেখিকা ইয়োশিমোতো বানানা। বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ হলেও সাম্প্রতিক কালে অতি জনপ্রিয় এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির এতে ভূমিকা থাকার বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একদিকে এআইয়ের সৃজনশীল ব্যবহার যেমন মানুষের জীবিকার ওপর আঘাত হানতে শুরু করেছে, অন্যদিকে জোচ্চুরির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর সামর্থ্য বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারের রয়েছে। যেকোনো বিখ্যাত শিল্পীর মতো ছবি আঁকা, গান গাওয়া কিংবা বিখ্যাত লেখকের ঢংয়ে লেখা দাঁড় করানো এখন প্রযুক্তির কল্যাণে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক সহজ। কিন্তু দেখার বিষয় হলো, ইয়োশিমোতো বানানার নামে বই জালিয়াতির নেপথ্যে থাকা ব্যক্তি বা চক্র, উইলিয়াম হেনরি আয়ারল্যান্ড কিংবা কনরাড কুজাউর মতো নিজস্ব পরিশ্রমে এই লেখা লিখেছেন নাকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির শরণাপন্ন হয়েছেন। উত্তর যা–ই হোক না কেন, ইয়োশিমোতো বানানা যে দ্রুত এই জালিয়াতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছেন, সেটিই আপাতত লেখক এবং পাঠক উভয়ের জন্যই স্বস্তি ও সতর্কতার বিষয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অ য ম জন উপন য স জনপ র য় স জনশ ল পর চ ত

এছাড়াও পড়ুন:

মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সিরাত বা জীবনী শুধু ইসলামের ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং এটি একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানশাখা, যার কেন্দ্রে রয়েছেন তিনি এবং তাঁর যুগের ঘটনাবলি, মূল্যবোধ, নীতি, মুজিজা এবং সম্পর্ক।

নবীজির সিরাত প্রতিষ্ঠিত কোরআন, হাদিস এবং সাহাবিদের জীবনাচরণের আলোকে। তবে এই জীবনী নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা এবং তথ্য বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

প্রামাণিক উৎস

মহানবী (সা.)–এর জীবন সম্পর্কে অধ্যয়নের সবচেয়ে প্রামাণিক উৎস হলো কোরআন মাজিদ। কোরআনে তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়, তাঁর রিসালাত, হিজরত, যুদ্ধ এবং তাঁর মানবিক গুণাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সুরা মুহাম্মদে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে (আয়াত: ২)।

সুরা আলে ইমরানেও এসেছে (আয়াত: ১৪৪), সুরা আহজাবে তাঁকে ‘খাতামুন নাবিয়্যিন’ বা নবীদের সিলমোহর (মানে শেষ নবী) বলা হয়ে (আয়াত: ৪০) এবং সুরা ফাতহে তাঁকে বলা হয়েছে ‘আল্লাহর রাসুল’ (আয়াত: ২৯)।

মহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

এ ছাড়া চরিত্র, কাজ, অবস্থান সম্পর্কে বহু আয়াত আছে কোরআনে।

হাদিস গ্রন্থগুলোও সিরাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ইমাম মালিকের মুয়াত্তা, সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে ইবনে মাজা, সুনানে তিরমিজি এবং সুনানে নাসাইতে তাঁর বাণী, কাজ ও সম্মতির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এবং সিরাতের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।

এই গ্রন্থগুলোর সনদ (বর্ণনা পরম্পরা ও বিষয়বস্তু যাচাইয়ের জন্য মুহাদ্দিসগণ কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগ করেছেন, যা ‘জার্‌হ ও তাদিল’ নামে পরিচিত।

এ ছাড়া ইবনে ইসহাকের সিরাতু রাসুলিল্লাহ সিরাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলোর একটি, ইবনে হিশাম, যার একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেছেন এবং আস-সুহাইলি তা নিয়ে আর-রওদুল উনুফ নামে একটি ব্যাখ্যা রচনা করেছেন।

এ ছাড়া ইবনে শিহাব জুহরি ও মুসা ইবনে উকবার মাগাজি মহানবী (সা.) রাসুলুল্লাহর নির্ভরযোগ্য জীবনীগ্রন্থ। কাজি ইয়াজের আশ-শিফা বি তা’রিফ হুকুকিল মুস্তফা তাঁর গুণাবলি ও অধিকারের ওপর বিশদ আলোচনা করেছে, যা পূর্ব ও পশ্চিমের পণ্ডিতদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।

আরও পড়ুনমহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনী রচনার হাজার বছর১১ নভেম্বর ২০২০ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও তথ্য বিকৃতি

মহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

মহানবীর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পায় হজ্জাতুল বিদা বা বিদায় হজের সময়। তিনি আরাফাতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমার কাছ থেকে তোমাদের হজের রীতি গ্রহণ করো। কারণ, এ বছরের পর আমি হয়তো আর হজ করতে পারব না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,২৯৭)

সুরা নাসর অবতীর্ণ হলে তিনি বলেন, ‘এটি আমার মৃত্যুর ঘোষণা।’ (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/২০৮, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শিরা ছিঁড়ে যাবে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮

রাসুল (সা.) মসজিদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর একজন বান্দাকে দুনিয়া ও আল্লাহর নৈকট্যের মধ্যে পছন্দ করতে বলেছেন, আর সেই বান্দা আল্লাহর নৈকট্য পছন্দ করেছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৫০৪)

তাঁর অসুস্থতার সময় তিনি আয়েশা (রা.)-এর ঘরে থাকতে পছন্দ করেন। আয়েশা বলেন, ‘তিনি জান্নাতুল বাকি (কবরস্থান) থেকে ফিরে এসে আমাকে মাথাব্যথায় কাতর দেখে বললেন, “বরং আমি বলি, হায় আমার মাথা”!’ (মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, সিরাতু রাসুলিল্লাহ, পৃ. ৬৭৮, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ১৯৭৮)

তিনি তীব্র জ্বরে ভুগছিলেন এবং বলেন, ‘আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শ ছিঁড়ে যাবে’ (সহিহ আল-বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮)। তিনি নির্দেশ দেন সাতটি মশকের পানি তাঁর ওপর ঢালার জন্য, যা তাঁর জ্বর কমাতে সাহায্য করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৪২, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার (৭ জুন, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আয়েশা (রা.)–এর ঘর থেকে মসজিদে উঁকি দিয়ে মুসল্লিদের দিকে তাকিয়ে হাসেন এবং বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমাকে মৃত্যুর যন্ত্রণায় সাহায্য করো।’ (আবু বকর আল-বাইহাকি, দালাইলুন নুবুওয়া, ৭/২৪৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৫)

তাঁর মৃত্যুর পর আবু বকর (রা.) ঘোষণা দেন, ‘যে মুহাম্মদের ইবাদত করত, সে জানুক, মুহাম্মদ মারা গেছেন। আর যে আল্লাহর ইবাদত করে, সে জানুক আল্লাহ চিরজীবী, তিনি মরেন না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২৪১)

আরও পড়ুননবীজি (সা.)–র কোন জীবনী পড়বেন২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫খিলাফতের প্রতিষ্ঠা: সাকিফা বনু সায়েদা

মহানবী (সা.)–এর মৃত্যুর পর ‘সাকিফা বনু সায়েদা’য় সাহাবিরা খিলাফত নির্বাচনের জন্য সমবেত হন। আনসাররা সাদ ইবন উবাদার নেতৃত্বে দাবি করেন যে তারা ইসলামের প্রথম দিন থেকে রাসুলকে সমর্থন করেছেন, তাই তাদের মধ্য থেকে আমির নির্বাচিত হওয়া উচিত।

আবু বকর (রা.) মুহাজিরদের পক্ষে বলেন, ‘কুরাইশরা ইসলামে প্রথম ইমান এনেছে এবং তারা আরবের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত গোত্র। আমি তোমাদের জন্য উমর বা আবু উবাইদাহর মধ্যে একজনকে প্রস্তাব করছি।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৫৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

আনসাররা প্রস্তাব করেন, ‘একজন আমির মুহাজিরদের থেকে এবং একজন আনসারদের থেকে হবে।’ তবে এই প্রস্তাব ঐক্য রক্ষার জন্য প্রত্যাখ্যাত হয়। উমর ইবনে খাত্তাব আবু বকরের হাত ধরে বায়আত করেন এবং আনসাররাও তাঁকে সমর্থন দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৮৩০)

আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।হজরত আবু বকর (রা.)

পরদিন মসজিদে সাধারণ বায়আত অনুষ্ঠিত হয়। আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। আমি যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৫৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

কয়েকজন সাহাবি, যেমন আলী (রা.) এবং জুবাইর ইবন আওয়াম, ফাতিমা (রা.)-এর ঘরে মহানবীর দাফনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তাই সাকিফায় উপস্থিত ছিলেন না। কেউ কেউ মনে করেন, খিলাফতের জন্য আলী (রা.) বা আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব উপযুক্ত ছিলেন।

তবে মহানবী কাউকে স্পষ্টভাবে খলিফা মনোনয়ন করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে কাগজ দাও, আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দেব, যার পর তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।’ কিন্তু উমর বলেন, ‘নবীজি এখন প্রবল যন্ত্রণায় ভুগছেন, (তাকে বিরক্ত করব না) আমাদের জন্য কোরআনই যথেষ্ট।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৪)।

রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মহানবীর ভূমিকা

‘আবু বকর (রা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন’ বলে হালা ওয়ার্দি যে দাবি করেছেন, তা ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।

মহানবী (সা.) নিজেই ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি মদিনায় একটি জাতি গঠন করেন, যারা কোরআনের নির্দেশনা অনুসরণ করে ঐক্যবদ্ধ হয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধরো এবং বিচ্ছিন্ন হোয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩)

তিনি মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন, যা মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/৫০১, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

তিনি বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে চুক্তি, যুদ্ধে নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রদূত প্রেরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাঠামো গড়ে তোলেন। যেমন রোমের সম্রাট হেরাক্লিয়াস, পারস্যের কিসরা এবং মিসরের মুকাউকিসের কাছে পত্র প্রেরণ করেন, যা তাঁর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/২৬৯, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় ন্যায়বিচার ও শুরার নীতি প্রয়োগ করেন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচারের সঙ্গে রায় দাও।’ (সুরা সাদ, আয়াত: ২৬)

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৭৮৭)।

তিনি শুরার বাস্তবায়ন করেন, কেননা কোরআন বলেছে, ‘তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)

তিনি বলেন, ‘আমি একজন মানুষ। ধর্মীয় বিষয়ে আমার নির্দেশ গ্রহণ করো, কিন্তু পার্থিব বিষয়ে তোমরা আমার চেয়ে বেশি জানো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩৬৩)

হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।শেষ কথা

মহানবীর ‘সিরাত’ ইসলামের ইতিহাস ও মূল্যবোধের একটি জীবন্ত দলিল। কোরআন, হাদিস এবং প্রামাণিক সিরাত গ্রন্থগুলো তাঁর জীবনের সঠিক চিত্র তুলে ধরেছে। তবে হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।

মহানবী (সা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যিনি ন্যায়বিচার, শুরা এবং ঐক্যের ভিত্তিতে এটি গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নির্বাচনের ঘটনাগুলো তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছে। এই সিরাত আমাদের শিক্ষা দেয় যে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা এবং ঐক্যের মাধ্যমে সমাজ গঠন করা সম্ভব।

সূত্র: আল-মালুম আন আল-জাদওয়াল আত-তারিখি লি-সিরাতির রাসুল

আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–এর জন্মকালের অলৌকিক ঘটনাবলি১৯ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফ্রান্সজুড়ে কৃচ্ছ্রতা বিরোধী বিক্ষোভ
  • চিমামান্দা এনগোজি আদিচির নারীবাদ
  • ভোররাতে রণক্ষেত্র: নরসিংদীতে নিহত ১, গুলিবিদ্ধ ৫
  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • আপনার এত সাহস হয় কী করে, সাংবাদিককে নায়িকা
  • দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
  • মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে