না লিখলেও কেন জাপানি লেখক ইয়োশিমোতো বানানার নামে বইটি পাওয়া গেল অ্যামাজনে
Published: 8th, March 2025 GMT
সম্প্রতি জাপানে মারাত্মক এক ঘটনা ঘটেছে। জাপানি লেখক ইয়োশিমোতো বানানার নামে একটি বই অ্যামাজনে ছাড়া হয়েছে, যেটি তিনি লেখেননি। তাহলে এই বইটির লেখক কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই? জালিয়াতির বলয় কি মানুষের সৃজনশীলতার জগৎকেও প্রভাবিত করছে? এসব প্রশ্নের জবাবের আগে চকিতে ইয়োশিমোতো বানানার দিকে নজর দেওয়া যাক।
ইয়োশিমোতো বানানা জাপানের আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত লেখকদের একজন। ৬০ বছর বয়সী এই নারী ঔপন্যাসিক নিজের ব্যক্তিগত জীবন আড়ালে ঢেকে রাখতে পছন্দ করেন। ১৯৮৮ সালে ‘কিচেন’ উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সাহিত্যের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও হারুকি মুরাকামির মতো সে রকম ব্যাপক জনপ্রিয়তা তিনি পাননি। তবে সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় তিনি ব্যাকুল ছিলেন, এমন অভিযোগও তাঁর বেলায় খাটে না। হয়তো এ কারণেই সৃজনশীল রচনার গভীরতা ভিন্ন এক আঙ্গিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে তাঁকে। রান্নাঘরের জাপানি একটি প্রতিশব্দ থাকলেও জাপানের আধুনিক বাড়িঘরে রান্নাঘর ‘কিচেন’ নামেই পরিচিত। আর ইয়োশিমোতোর প্রথম উপন্যাস সেই শিরোনাম নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে। জাপানে এই উপন্যাসের ৬০টির বেশি মুদ্রণ হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাসটির অনুবাদ। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে এটি শিক্ষাক্রমেরও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইয়োশিমোতো এ পর্যন্ত ১২টি উপন্যাস ছাড়াও অন্যান্য রচনার ৭টি সংকলন প্রকাশ করেছেন, জাপানে যেসব বইয়ের সম্মিলিত বিক্রির সংখ্যা ৬ কোটির বেশি।
বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার বাইরে ব্যক্তির ওপর রয়েছে পরিবার ও গৃহের প্রভাব এবং মানবচেতনার অবক্ষয়ের প্রতিক্রিয়া, মোটাদাগে এগুলোই ইয়োশিমোতো লেখার বিষয়বস্তু। খোলামেলা অর্থে রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে তিনি নিজের লেখায় উপস্থিত না হলেও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের ভিন্ন একটি বলয় তাতে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
ইয়োশিমোতো বানানার জীবনের ব্যতিক্রমী একটি দিক হচ্ছে তাঁর পারিবারিক পরিচয়। পিতা তাকাআকি ইয়োশিমোতো কবি ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবে পরিচিত। বোন হারুনো ইয়ুইকো হলেন জাপানের পরিচিত একজন কার্টুনশিল্পী। সাহিত্যিক-জীবনের শুরুতে বানানা নাম তিনি গ্রহণ করেছেন কলাগাছের ফুলের সৌন্দর্য দেখার পর থেকে। যদিও জন্মের সময় থেকে পরিবারের সদস্যদের রাখা নাম মাহোকো আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা তিনি বজায় রেখেছেন। স্বামী হিরোইয়োশি তাহাতা এবং এক পুত্রসন্তান নিয়ে টোকিওতে তাঁর বসবাস। সমকালীন জাপানে তরুণদের অনুভব করা ক্লান্তি তাঁর উপন্যাসের অন্যতম প্রধান একটি বিষয় হলেও জীবনের চলার পথে সামনে দেখা দেওয়া ব্যতিক্রমী ও ভয়ংকর অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত জীবনে কীভাবে ছাপ রেখে যায়, তা-ও লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি।
জাপানের সুপরিচিত এই নারী লেখক সম্প্রতি ভিন্ন যে কারণে সংবাদ শিরোনামে এসেছেন, তা হলো তাঁর নাম ব্যবহার করে লেখা বানোয়াট এক উপন্যাসের আত্মপ্রকাশ এবং সারা বিশ্বে অনলাইনে পণ্য বিক্রির বৃহত্তম মাধ্যম অ্যামাজনে বইটির ব্যাপক বিক্রয়। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে নিজের পরিচিত কিছু লোকজনের কাছ থেকে ‘পৃথিবীর সময় ফুরিয়ে আসছে’ নামের সেই বই সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন। এরপর কালবিলম্ব না করে বইয়ের বিক্রি জব্দ করার অনুরোধ তিনি জানান অ্যামাজনকে। অ্যামাজন অবশ্য দ্রুতই ইয়োশিমোতো অনুরোধে সাড়া দিয়ে বিক্রির তালিকা থেকে তুলে নিয়েছে বইটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরা বার্তায় ই-বুক সংস্করণে প্রকাশিত সেই উপন্যাস না কেনার জন্য পাঠকদের সতর্ক করে দিয়েছেন ইয়োশিমোতো। ওই বার্তায় তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ভিন্নমাত্রার নতুন জালিয়াতি বন্ধ করার জন্য আইনি পদক্ষেপ নেব আমি।’ জাপানের নেতৃস্থানীয় দৈনিক ‘আসাহি শিম্বুন’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ব্যক্তির সৃজনশীলতা নিয়ে এমন জালিয়াতি এবং এতটা খোলামেলাভাবে বইটি যে বিক্রি হবে, তা ছিল তাঁর কল্পনার বাইরে।
আধুনিক বিশ্বে এমন জোচ্চুরি কল্পনাতীত হলেও সাহিত্যিক জোচ্চুরির শুরু অবশ্য প্রাচীন গ্রিস থেকে, যা থেমে থেমে সব যুগেই কিছু না কিছু ঘটেছে। এই জালিয়াতি থেকে বাদ পড়েননি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারও। ১৭৯৬ সালে ১৯ বছর বয়সী উইলিয়াম হেনরি আয়ারল্যান্ড নামে একজন ‘ভর্টিজার্ন অ্যান্ড রোওয়ানা’ নামক নিজের লেখা ও প্রকাশিত এক ঐতিহাসিক নাটককে শেক্সপিয়ারের অনাবিষ্কৃত লেখা বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ১৯৮০ দশকে ষাট খণ্ডের দিনলিপি দিয়ে সাজানো ‘হিটলারের ডায়েরি’র উল্লেখও এখানে করা যেতে পারে। যদিও এটি সরাসরি সাহিত্যকর্ম নয়, তবু হিটলারের সেই ডায়েরি পশ্চিম জার্মানির ‘স্টার্ন’ ম্যাগাজিন কিনে নিয়েছিল প্রায় ৩৭ লাখ ডলারে। পরে ব্রিটেনের ‘দ্য সানডে টাইমস’ অনুসন্ধান করে বের করে এটি ছিল ভুয়া একটি ডায়েরি, যার আসল লেখক অ্যাডলফ হিটলার নন, বরং পূর্ব জার্মানির কনরাড কুজাউ নামের এক ব্যক্তি।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক জায়গায় কপিরাইট ফাঁকি দিয়ে বিখ্যাত লেখকের নানা বই হুবহু প্রকাশ করা হলেও নিজে লিখে অন্য কোনো বিখ্যাত লেখকের নামে চালিয়ে দেওয়ার মতো অপকর্মের ঘটনা আধুনিক বিশ্বে এখন অবশ্য কিছুটা কঠিনই বটে। তবে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগেও অ্যামাজনের মতো বিশ্ববিখ্যাত বিক্রয় প্ল্যাটফর্মে এ ধরনের প্রতারণার শিকার হলেন জাপানি লেখিকা ইয়োশিমোতো বানানা। বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ হলেও সাম্প্রতিক কালে অতি জনপ্রিয় এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির এতে ভূমিকা থাকার বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একদিকে এআইয়ের সৃজনশীল ব্যবহার যেমন মানুষের জীবিকার ওপর আঘাত হানতে শুরু করেছে, অন্যদিকে জোচ্চুরির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর সামর্থ্য বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারের রয়েছে। যেকোনো বিখ্যাত শিল্পীর মতো ছবি আঁকা, গান গাওয়া কিংবা বিখ্যাত লেখকের ঢংয়ে লেখা দাঁড় করানো এখন প্রযুক্তির কল্যাণে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক সহজ। কিন্তু দেখার বিষয় হলো, ইয়োশিমোতো বানানার নামে বই জালিয়াতির নেপথ্যে থাকা ব্যক্তি বা চক্র, উইলিয়াম হেনরি আয়ারল্যান্ড কিংবা কনরাড কুজাউর মতো নিজস্ব পরিশ্রমে এই লেখা লিখেছেন নাকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির শরণাপন্ন হয়েছেন। উত্তর যা–ই হোক না কেন, ইয়োশিমোতো বানানা যে দ্রুত এই জালিয়াতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছেন, সেটিই আপাতত লেখক এবং পাঠক উভয়ের জন্যই স্বস্তি ও সতর্কতার বিষয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অ য ম জন উপন য স জনপ র য় স জনশ ল পর চ ত
এছাড়াও পড়ুন:
সিদ্দিককে মারধর ও শিল্পীদের বিরুদ্ধে মামলা, যা বললেন অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি
শোবিজের একঝাঁক একঝাঁক অভিনয়শিল্পীকে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি করা হয়েছে। প্রথমে ইরেশ যাকের, তারপর সুবর্ণা মুস্তাফা, অপু বিশ্বাস, নুসরাত ফারিয়া, নিপুণসহ ১৭ অভিনয়শিল্পীর নাম প্রকাশ্যে এসেছে। এরই মধ্যে গতকাল অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর ও লাঞ্ছিত করে রাজধানীর রমনা থানায় সোপর্দ করা হয়। এসব বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চর্চা চলছে। এ নিয়ে অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি আজাদ আবুল কালাম নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন।
সিদ্দিকের ওপর হামলা ও লাঞ্ছনা ঘটনা নিয়ে আজাদ আবুল কালাম গণমাধ্যমে বলেন, “সিদ্দিকের সঙ্গে যা ঘটেছে, এটা তো মব। এই মব ভায়োলেন্সকে তো ঠেকাচ্ছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে, মব ভায়োলেন্সকে নীরবে বলা হচ্ছে, করে যাও। আমাদের কিছুই করার নেই। একজনের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা থাকতে পারে। অভিনেতা হিসেবে সিদ্দিক সবার কাছে পরিচিত। কিছু লোক তাকে এভাবে রাস্তায় ধরে মেরে দেবে!”
প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে আজাদ আবুল কালাম বলেন, “দলবদ্ধভাবে সিদ্দিককে শারীরিকভাবে আঘাত করেছে, আক্রমণ করেছে, গায়ে থেকে জামাকাপড় খুলে ফেলেছে, এরপর থানায় সোপর্দ করেছে। থানায় যদি সোপর্দ করতেই হয়, তাহলে প্রথমে কেন আইন হাতে তুলে নিল? তাকে হেনস্তা করে আইনের হাতে তুলে দেবে— এই মব জাস্টিস, মব ভায়োলেন্স সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। এটা তো একটা সময় নানা স্তরে হবে। এসব কর্মকাণ্ড সরকারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে, যেখানে মব ভায়োলেন্স, সেখানে কঠোর হস্তে দমন করবে।”
ঢালাওভাবে অভিনয়শিল্পীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিষয়ে বিস্মিত আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, “ঢালাওভাবে হত্যা মামলা হচ্ছে! দেখে মনে হচ্ছে, সবাইকে মামলার মধ্যে ফেলতে হবে। ৩০০-৪০০ জন মামলার আসামি, এটা অবাস্তব একটা অবস্থা। একজন সুবর্ণা মুস্তাফার মতো শিল্পী রাস্তায় গিয়ে মানুষকে গুলি করবে? যে মানুষটি মামলা করেছেন, তিনি আন্দোলনের সময় আহত হয়েছেন, গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন; তিনি মামলা করেছিলেন অনেক লোকের নামে। মামলার নথিতে শিল্পীদের অনেকের নাম দেখলাম, তারা রাস্তায় নেমে মানুষকে গুলি করবে!”
সরকারিভাবে এ ধরনের মামলাকে প্রতিরোধ করা উচিত বলে মনে করেন আজাদ আবুল কালাম। তিনি বলেন, “সরকারিভাবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও উচিত হবে এ ধরনের মামলাকে প্রতিরোধ করা। নিরুৎসাহিত করা। যে ব্যক্তি মামলা করছেন, যদি প্রমাণিত হয়, শিল্পীরা কেউই গুলি করেনি, তখন তো এটা মিথ্যা মামলা হবে। এ রকম মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে, যে ব্যক্তি শিল্পীদের নামে মামলা করেছেন, তার কী শাস্তি হবে, তারও বিধান থাকতে হবে।”
“কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে, তা জানানোর একটা প্রক্রিয়া আছে। শুধু শিল্পী না, একজন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেও যদি কোনো অভিযোগ থাকে, তাহলে আপনি তার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগপর্যন্ত তাকে অপরাধী বলতে পারেন না। তাকে সামাজিকভাবে হেয় করতে পারেন না। মামলা করে তাকে সামাজিকভাবে হেয় করা শুরু করলেন, এই প্রক্রিয়া যদি চলতে থাকে, এটাই যদি আমাদের মনস্তত্ত্ব হয়, তাহলে বিভক্তি আরো বাড়বে।” বলেন আবুল কালাম আজাদ।