নান্নু মার্কেট: যেখানে কম দামে কেনা যায় নামী ‘ব্র্যান্ডের’ পোশাক
Published: 20th, March 2025 GMT
দোকানটিতে পাশাপাশি দুটি টি-শার্ট ঝুলিয়ে রাখা। কলারওয়ালা আর হাফহাতা টি-শার্ট দুটির একটিতে দাম লেখা ১ হাজার ৫০ টাকা, আরেকটিতে ৬৫০ টাকা। আরও রয়েছে নামী একটি ব্র্যান্ডের ট্যাগ। ঘেঁটেঘুঁটে দেখে একজন ক্রেতা টি-শার্ট দুটি পছন্দ করলেন। দোকানির কাছে জানতে চাইলেন, ‘দাম কি ফিক্সড?’ দোকানি ডানে-বাঁয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে জানালেন, না, দরদাম করা যাবে। ব্যাপক দরদামের পর ওই ক্রেতা টি-শার্ট দুটি কিনে নিলেন। প্রথমটির দাম পড়ল ৫৫০ টাকা। অন্যটি ৪০০ টাকা।
কেনাবেচার এই দৃশ্য দেখা গেল রাজধানীর মিরপুর-১১ নম্বর সেকশনের পল্লবী এ ব্লক এলাকার একটি মার্কেটে। এটা স্থানীয় লোকজনের কাছে ‘নান্নু মার্কেট’ নামে পরিচিত। মার্কেটের র্যাপিড ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে দোকানটির বিক্রয়কর্মী সিফাত রহমানের কাছে জানতে চাই, একদরে বিক্রি না করলে টি-শার্টের গায়ে দাম লেখা রয়েছে কেন?
জবাবে সিফাত বললেন, নামীদামি অনেক বিপণিবিতান বা বিক্রয়কেন্দ্রে (শোরুম) এসব টি-শার্ট একদরে বিক্রি হয়। তাই ওগুলোতে দাম উল্লেখ রয়েছে। কারখানা থেকেই সরাসরি এসব টি-শার্ট তাঁদের কাছে আসে। তাই তাঁরা কম দামে বিক্রি করতে পারেন।
শুধু মিরপুরের মানুষ নন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই কেনাকাটার জন্য নান্নু মার্কেটে আসেন। এমনকি ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে সময় করে এখানে আসেন, কেনাকাটা করেন। নান্নু মার্কেট মূলত বিদেশি ক্রেতাদের কাছে রপ্তানির জন্য দেশের বিভিন্ন কারখানায় তৈরি পোশাক সাশ্রয়ী দামে বিক্রির জন্য বেশ জনপ্রিয়। স্থানীয় বাজারের জন্য তৈরি পোশাকও এখন দোকানে দোকানে বিক্রি হয়। এখানে প্রায় ১৭০টি দোকান রয়েছে।
যেভাবে গোড়াপত্তন
নাম নান্নু মার্কেট হলেও এই বিপণিবিতানের যাত্রা কোনো পরিকল্পিত বাণিজ্যিক প্রকল্প হিসেবে শুরু হয়নি। ধাপে ধাপে একটি উন্মুক্ত পার্কের জায়গায় এই মার্কেট গড়ে উঠেছে। জায়গাটি একসময় স্থানীয় শিশু-কিশোরদের খেলার জায়গা এবং খোলা স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরে ওই জায়গায় ছোটখাটো দোকান গড়ে উঠতে শুরু করে।
১৯৯৮ সালের দিকে এই জায়গায় ব্যবসায়ীরা অস্থায়ী দোকান বসাতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে এটি একটি স্থায়ী মার্কেটে রূপ নেয়। মার্কেটটি নিয়ন্ত্রণ করতেন তৎকালীন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুর রউফ নান্নু। তাঁর নামেই ওই মার্কেট ‘নান্নু মার্কেট’ নামে পরিচিতি পায়। পরে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় লোকজনের অনেকে পার্ক দখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও শেষ পর্যন্ত মার্কেটটি থেকে যায়। ক্রমেই ব্যবসায়িক কার্যক্রম জমে ওঠে।
নান্নু মার্কেটে নারী, পুরুষ ও শিশুদের জন্য জিনস ও গ্যাবার্ডিন প্যান্ট, টি-শার্ট, শার্ট, পাঞ্জাবি, পায়জামা, পালাজ্জো, টপস, লেগিংসসহ বিভিন্ন পোশাক পাওয়া যায়। গাজীপুর, আশুলিয়া বা সাভার এলাকায় বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানা থেকে এসব পোশাক আনা হয়।
মিরপুরের নান্নু মার্কেটে শিশুদের পোশাক দেখছেন একজন ক্রেতা.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ