এই অন্তহীন রাত আগের দিনের চেয়ে অন্ধকার
Published: 21st, March 2025 GMT
বাসমান দেরাবি
যখন গণহত্যা
শেষ হবে
যখন গণহত্যা শেষ হবে
আমি হাঁটব পা টিপে টিপে
খুঁজব আমার বন্ধুদের কবর,
ভাবব ইমান, ওয়াদা আর ইসার জন্য কী লেখা যায়;
হয়তো ক্ষমা চেয়ে কিছু লিখব,
তবে দুনিয়াবাসীর পক্ষ থেকে নয়
যখন গণহত্যা শেষ হবে
আমি আমার বাকি বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করব,
আমরা কাঁদব আমাদের অসমাপ্ত কান্না
কারণ, অবশেষে মৃত্যু দূরে চলে গেছে আমাদের কাছ থেকে
অথচ প্রতিদিন ঘুমানোর আগে এই বেঁচে থাকা নিয়ে
আমরা কত অভিশাপ দিতাম!
এরপর আমরা গান গাইব
যখন গণহত্যা শেষ হবে
বাড়িতে ফিরব আমি
আমার প্রতিবেশীর সন্তানদের গুনে গুনে দেখব
আর স্মৃতি আমাকে হতাশ করে না বলে
বোকার মতো আশা করব, তারা সবাই
ঠিকঠাক আছে
তাদের সংখ্যাটি নিশ্চয়ই বদলাবে না
আমি একটি জানালার পাশে ঘুমিয়ে পড়ব
এবং স্বপ্ন দেখব
আমাকে জ্বালিয়ে মারা তাদের চিল্লাপাল্লা সব…
বাসমান দেরাবি
পেশায় ফিজিওথেরাপিস্ট। গাজার আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন, ইসরায়েলি হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন ধ্বংসস্তূপ। ৩২ বছর বয়সী
এই কবি এখনো গাজায়
রয়েছেন।
শাহাদ আলনামি
আমার বয়স জানতে চেয়ো না
তোমার বয়স কত? যুদ্ধের সময়
পাঁচ বছরের একটা বাচ্চার বয়স আর পাঁচ থাকে না
চার বছরেই তার বয়স হয়ে যায় নব্বই,
আমাকে আমার বয়স জিজ্ঞাসা কোরো না
অনুরোধ করছি
দুঃখ, বেদনা, যন্ত্রণা এবং আরও যা যা আছে
এই শব্দগুলোই কি আমার বয়স বর্ণনার জন্য
যথেষ্ট নয়
আমাদের ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপই
কেবল তা বোঝাতে সক্ষম
এবং আমাদের ভাঙা স্বপ্নগুলো, যেগুলো আজীবন লালন করেছি
আমাদের এই জীবন নিয়ে
মা–বাবারা কি আগে থেকে জানতেন?
এই গৃহহীনতা, গণহত্যা, অনাহার, এই রক্তপাত
এই অন্তহীন রাত আগের দিনের চেয়েও অন্ধকার—
আমরা যা ঘৃণা করি,
সেটিই আমাদের নিয়তি হয়ে যায়
বোঝার চেষ্টা করুন, এত খোঁজাখুঁজির কিছু নেই
বয়স নিয়ে প্রশ্নটা বন্ধ দরজার পেছনে ছুড়ে ফেলুন
বয়স এক বছর হোক, চব্বিশ বা চুয়াত্তর
একটা গণহত্যার গর্জনের তলে
সেটি কোনো ব্যাপার নয়
শাহাদ আলনামি
গাজা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করেছেন এই তরুণ কবি। গাজার ওপর ইসরায়েলি গণহত্যা থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছেন মধ্য গাজার একটি শরণার্থীশিবিরে। সেখান থেকেই প্রতিনিয়ত লিখে যাচ্ছেন গাজার ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা।
জোমানা জাকুওত
শেষ দরজা
এই দরজার পেছনে
একজন মা অপেক্ষা করছেন
হারানো ছেলে ফিরে আসবে বলে—
যেন সে কখনো মৃত্যুর মানে কী, তা না বোঝে
সে তার প্রিয় সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে থাকে
যতক্ষণ না চোখের পানি শুকিয়ে যায়
মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়
রক্তও সব বের হয়ে যায়—
যেন সে আর সে নেই, নিজেই হয়ে গেছে সন্তান
এভাবে নিজের আত্মার টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিচ্ছে
ছেলের সঙ্গে চলে যাবে বলে
দ্বিতীয় দরজার আড়ালে
এক মেয়ে স্বপ্ন দেখে
তার বাবা ফিরে আসবে কারাগার থেকে
প্রতিদিন কল্পনায় বাবাকে দেখে সে
সবকিছুতেই তাকে দেখতে পায়
প্রতিদিন;
বাবা হয়তো তাকে দেখছে না
সে বাবার সঙ্গে কথা বলে
কিন্তু বাবা কোনো সাড়া দেয় না,
সে নিজেই বন্দী হয়ে যায় শূন্যতার কারাগারে
যখন তার বাবা সত্যিই বন্দী
তা কেবল তার ভেতরেই
তৃতীয় একটা দরজার পেছনে
চিৎকার করছে এক আহত লোক
হাসপাতালের শেষ করিডোর থেকে,
তার পা কেটে ফেলা হয়েছে
কোনো অ্যানেসথেসিয়া ছাড়া
একটি বালিশ বা বিছানা ছাড়া
ব্যথা–যন্ত্রণায় সে প্রলাপ বকছে
কোনোভাবেই হাসপাতাল ছেড়ে যাবে না সে;
নিজের কাছেই এখন হয়ে গেছে বোঝা
অপেক্ষা করছে, আবার পা গজিয়ে যাবে তার,
সে একা একা চিৎকার করে যায়—
হায়, তার কান্না শোনার কেউ নেই!
কেবল গভীর দুঃখই তার ভেতরে বাড়ে আরও
কত কত দরজার আড়ালে
ছোট ছোট পাখির ঝাঁক
যুদ্ধে শহীদদের মৃতদেহ
নখে আঁকড়ে ধরে
আকাশের দিকে যায় উড়ে,
পড়ে থাকাদের বয়ে নিয়ে যেতে যেতে
আমাদের জন্য বানায় এমন সিঁড়ি
যেন বেহেশত পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারি
আরও অনেক দরজার পেছনে
আছে কত জীবত মানুষ, যেন সবাই মৃত
তারা হাঁটছে জীবনের পথে
যেন হাঁটতে অক্ষম,
একটি রাস্তা পার হতে গেলেই তারা কাঁদতে থাকে
একজন শহীদ, একজন আহত বা এক বন্দীর স্মরণে
তারা ক্লান্তিতে ডুবে যায়
পানিতে ডুবন্ত কোনো মানুষের মতো
লক্ষ্যহীনভাবে নৌকা চালিয়ে যায় তারা
একা
এই আশায়, দরজাটা যদি খুলত
একটি মুহূর্তের জন্য
একটিবারের জন্য
এই প্রবল দুঃখের মধ্যেও তারা বিশ্বাস করতে থাকে
এই দরজাই
শেষ দরজা
শহরে।
জোমানা জাকুওত
গাজা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। আরবি ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই কবিতা লেখেন। গাজার ওপর ইসরায়েলের আগ্রাসন ও যুদ্ধের নৃশংসতা কবি করে তুলেছে এই তরুণীকে। গাজা থেকে এখন তিনি আশ্রয় নিয়েছেন লেবাননের গাজে শহরে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম র বয়স আম দ র র জন য আম র ব শ ষ হব
এছাড়াও পড়ুন:
যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল
ইসরায়েল আবারও ইরানে বড় রকমের হামলা করেছে। হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। হামলা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ও আবাসিক এলাকায়। একদিন পর পাল্টা হামলা চালায় ইরান। এতে কয়েকজন ইসরায়েলি নিহত হয়। ধ্বংস হয় তেলআবিবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
ইসরায়েল তার ইরানবিরোধী এ হামলার নাম দিয়েছে ‘রাইজিং লায়ন’। এ নাম রাখা হয়েছে হিব্রু বাইবেলের একটি চরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। যে নাম ইসরায়েলের একটি শক্তিশালী ও বিজয়দীপ্ত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দেয়।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার ইহুদিদের সবচেয়ে পবিত্র উপাসনাস্থল জেরুজালেমের ওয়েস্টার্ন ওয়ালের একটি ফাটলে হাতে লেখা একটি চিরকুট রেখে আসার সময় ছবি তোলেন। এটি ছিল মূলত ইরানে ইসরায়েলের হামলার ইঙ্গিত।
শুক্রবার তার অফিস থেকে সেই চিরকুটে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়। সেখানে লেখা ছিল: ‘জনগণ সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে।’
এই বাক্যাংশটি হিব্রু বাইবেলের গ্রন্থ বুক অব নাম্বারস (গণনা পুস্তক) ২৩:২৪ পদ থেকে এসেছে। যেখানে বলা হয়েছে: ‘দেখো, এই জাতি একটি মহান সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে এবং একটি তরুণ সিংহের মতো নিজেকে উদ্দীপ্ত করবে; সে শিকার না খাওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে না এবং নিহতদের রক্ত না পান করা পর্যন্ত থামবে না।’
এই চরণটি হিব্রু বাইবেলের অ-ইসরায়েলীয় একজন নবী ও ভবিষ্যদ্বক্তা বালামের প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীর অংশ। সেখানে তিনি ইসরায়েলের শক্তি ও ক্ষমতার কথা বলেন। তাদের এমন এক সিংহের সঙ্গে তুলনা করেন যে নিজের ক্ষুধা না মেটানো পর্যন্ত বিশ্রামে যায় না।
অনেকেই মনে করেন, এই অভিযানের নাম ইরানের শেষ শাহ-এর পুত্রের প্রতি ইঙ্গিত হতে পারে। কারণ পারস্য রাজপরিবারের প্রতীক হিসেবেও সিংহ ব্যবহৃত হতো।
ইসরায়েলের ঐশ্বরিক অধিকারের দাবিইসরায়েল প্রায়শই তার সামরিক অভিযানের নাম হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টেমেন্ট থেকে নেয় বা ধর্মীয় অনুপ্রেরণা থেকে গ্রহণ করে। ফিলিস্তিনি ভূমির উপর ইহুদিদের তথাকথিত ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যুদ্ধকে ন্যায্যতা দিতে ইসরায়েল এসব ধর্মীয় বিষয় ব্যবহৃত করে বলে অনেকে মনে করে থাকেন।
উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে চালানো এক অভিযানের নাম দিয়েছিল, ‘অ্যারো অব বাশান।’ ‘বাশান’ শব্দটি ইসরায়েলিদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি দিয়ে মূলত সিরিয়ার দক্ষিণ ও জর্ডান নদীর পূর্বে অবস্থিত একটি অঞ্চলকে নির্দেশ করা হয়। বাশানের রাজাকে পরাজিত করে ইসরায়েলিরা সেই অঞ্চলকে দখল করেছিল।
গাজা উপত্যকার ওপর হামলা চালাতেও অস্ত্র ও অভিযানের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় প্রতীক বা অনুষঙ্গ ব্যবহার করছে ইসরায়েল। নেতানিয়াহু অন্তত তিনবার গাজায় আক্রমণের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় আমালেক কাহিনি ব্যবহার করেছেন।
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের গ্রন্থ ‘বুক অব ডিউটেরনমি’(২৫:১৭) এর থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:
‘আমালেক তোমার সঙ্গে যা করেছিল তা মনে রেখো, আমরা মনে রাখি এবং আমরা যুদ্ধ করি।’
এর মধ্য দিয়ে গাজাবাসীদের উপর পূর্ণাঙ্গ হামলা করা উচিত বলে নেতানিয়াহু ইঙ্গিত করেন। কারণ ডিউটেরনমির এই উদ্ধৃতি বাইবেলের স্যামুয়েল গ্রন্থে বর্ণিত আমালেকীয়দের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ধ্বংসের আহ্বান হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাইবেলের এ কাহিনিতে ইসরায়েলিদের ওপর আক্রমণকারীদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার আহ্বান জানানো হয়েছে। গাজার গোটা জনসংখ্যাকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে বাইবেলের এ কাহিনিকে হাজির করেছেন নেতানিয়াহু।
গণহত্যার মামলায় নেতানিয়াহুর বক্তব্যইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা গণহত্যার মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) প্রথম শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষের আইনজীবী হিব্রু বাইবেলের উদ্ধৃতির মাধ্যমে নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যকে গাজার জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যায় প্ররোচনা হিসেবে তুলে ধরেন।
আইনজীবী আরও জানান, নেতানিয়াহু ৩ নভেম্বর সেনাদের উদ্দেশ্যে লেখা আরেকটি চিঠিতে একই আমালেকীয় গল্প পুনরাবৃত্তি করেন।
ধর্মীয় নাম ব্যবহার করে সামরিক প্রযুক্তিইসরায়েলি সেনাবাহিনীর যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি গাজায় বোমাবর্ষণে সহায়তা করছে, তাদের নাম ‘ল্যাভেন্ডার’ এবং ‘দ্য গসপেল’, যা উভয়ই হিব্রু বাইবেলীয় ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।
টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক রাভালে মহিদিনের মতে, প্রায়ই ধর্মীয় ধর্মগ্রন্থ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রের নামকরণ করা হয়। যেমন, স্যামসন রিমোট কন্ট্রোলড ওয়েপন স্টেশন।
জেরিকো ব্যালিস্টিক মিসাইল-এর নাম রাখা হয়েছে জেরিকো শহরের নামে। হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব যশুয়া’ অনুসারে ইসরায়েলিরা এই শহর ফিলিস্তিনিদের কাছ দখল করেছিল।
ডেভিড’স স্লিং নামক আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার নাম রাখা হয়েছে বাইবেলের মেষপালক ডেভিড ও বিশাল যোদ্ধা গোলিয়াথের মধ্যকার বিখ্যাত সেই লড়াইয়ের স্মরণে, যেখানে ডেভিডের বিজয় হয়েছিল। এই কাহিনী আছে হিব্রু বাইবেল ও ওল্ট টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব স্যামুয়েল’-এ।
*দ্য নিউ আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম। টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক ও হার্ভার্ডের গবেষক রাভালে মহিদিনের একটি লেখার অবলম্বনে দ্য নিউ আরব এ বিশ্লেষণটি প্রকাশ করেছে। অনুবাদ করেছেন: রাফসান গালিব