ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠনই বলছে, ‘গাজায় গণহত্যা চলছে’
Published: 28th, July 2025 GMT
ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংগঠন বিটসেলেম ‘আমাদের গণহত্যা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
সোমবার (২৮ জুলাই) প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধকে কঠোরভাবে নিন্দা করা হয়েছে। চলমান যুদ্ধে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৯ হাজার ৭৩৩ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে; আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৭ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নীতি এবং এর ভয়াবহ পরিণতির বিশ্লেষণ, সঙ্গে ইসরায়েলি শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের ও সামরিক কর্মকর্তাদের এই হামলার উদ্দেশ্য নিয়ে দেওয়া বিবৃতিগুলো একত্রে বিচার করলে স্পষ্টভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে, ইসরায়েল সমন্বিতভাবে এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে যার উদ্দেশ্য গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনি সমাজকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করা।”
আরো পড়ুন:
‘আমরা মরে যাচ্ছি’, গণঅনাহারে বৈশ্বিক নীরবতায় গাজার ধিক্কার
‘আজ তুমি কিছু খেয়েছো?’ গাজায় অনাহার আর টিকে থাকার গল্প
“অন্য কথায় বলতে হয়, ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে,” বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস-নেতৃত্বাধীন হামলায় আনুমানিক ১ হাজার ১৩৯ জন ইসরায়েলি নিহত হন এবং প্রায় ২০০ জনকে জিম্মি করা হয়।
‘আমাদের গণহত্যা’
বিটসেলেমের প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সংঘটিত বিভিন্ন নিপীড়নের বিশ্লেষণ করা হয়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই নিপীড়ন শুরু হয়।
“এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন পুরো অঞ্চলে ইহুদি গোষ্ঠীর প্রাধান্য স্থাপন করা,” বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এতে আরো বলা হয়েছে, “এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল রাষ্ট্র উপনিবেশবাদী বসতি স্থাপন-ভিত্তিক কাঠামোর বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে, যার মধ্যে রয়েছে ব্যাপকভাবে বসতি স্থাপন, উচ্ছেদ ও জমি দখল, জনসংখ্যাগত প্রকৌশল, জাতিগত নির্মূল এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর সামরিক শাসন চাপিয়ে দেওয়া।”
প্রতিবেদনটিতে দেখানো হয়েছে, ইসরায়েল কীভাবে ‘ইহুদি আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে আইনের শাসনের মিথ্যা ছদ্মাবরণ ব্যবহার করেছে, অথচ বাস্তবে ফিলিস্তিনিদের অধিকারগুলো রক্ষা করা হয়নি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর এসব প্রচেষ্টা আরো ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত হয়েছে।”
‘গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিস্তৃত ও সমন্বিত আক্রমণের’ কথা তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। যেখানে বলা হয়েছ, “অধিকাংশ ইহুদি-ইসরায়েলিদের পাশাপাশি ইসরায়েলের আইনগত ব্যবস্থাও নানাভাবে সমর্থন, বৈধতা ও স্বাভাবিকীকরণের গ্যারান্টি পেয়েছে।”
২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের প্রচেষ্টা আরো জোরদার করা হয়েছে।
“উত্তর গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে অনেক বিশেষজ্ঞ জাতিগত নির্মূলের প্রচেষ্টা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বাস্তবে ২০২৪ সালের নভেম্বরের মধ্যে উত্তর গাজায় বসবাসকারী প্রায় ১ লাখ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে,” তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বলেছে বিটসেলেম।
প্রতিবেদনটি শুধু গাজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এতে বলা হয়েছে, “৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েল দখলকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে তাদের সহিংস অভিযান জোরদার করেছে এতটা ভয়ংকর মাত্রায়, যা ১৯৬৭ সালে পশ্চিম তীর দখলের পর থেকে আর দেখা যায়নি।”
বিটসেলেম প্রথম ২০২১ সালে ‘বর্ণবৈষম্যমূলক শাসন’ শব্দটি ব্যবহার করে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের জন্য ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনে বিরাজমান দ্বৈত বাস্তবতাকে তুলে ধরে।
কথায় ও কাজে গণহত্যা
বিটসেলেমের এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের পরপর। ওই প্রবন্ধে হলোকাস্ট-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যামোস গোল্ডবার্গ গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। একইসঙ্গে ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ আন্দোলন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তবে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরোধিতা এখনো ইসরায়েলি সমাজে ব্যাপকভাবে বিতর্কিত। জুন মাসে পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপ অনুযায়ী, মাত্র ১৬ শতাংশের কাছাকাছি ইহুদি-ইসরায়েলি মনে করেন, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব।
জেরুজালেম সেন্টার ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ফরেইন অ্যাফেয়ার্স (জেসিএফএ) এর একটি জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ৬৪ শতাংশ ইহুদি ইসরায়েলি মনে করেন, ইসরায়েলের উচিত গাজা উপত্যকা সাময়িকভাবে দখলে নেওয়া।
ইসরায়েলের প্রচলিত মনোভাবের সমালোচকদের মধ্যে রয়েছেন দেশটির রাজনৈতিক ভাষ্যকার, সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ওরি গোল্ডবার্গ, যিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে ‘ঘৃণ্য’ বলে মন্তব্য করেছেন।
ওরি গোল্ডবার্গের মন্তব্যের বিষয়ে লেখক, গবেষক এবং ‘দ্য ফায়ার দেজ টাইমস’ পডকাস্টের প্রতিষ্ঠাতা এলিয়া আয়ুব আলজাজিরাকে বলেন, “আমি একমাত্র এই উপসংহারেই পৌঁছাতে পারি যে, ইসরায়েলি সমাজের ভেতরের চাপ সত্যিই ওরি গোল্ডবার্গ সম্প্রতি যেভাবে উল্লেখ করেছেন, ঠিক ততটাই গভীর।”
তিনি আরো বলেন, “ইসরায়েলি সমাজ প্রায় দুই বছর ধরে একটি গণহত্যাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে এবং এটি তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূলে থাকা এক গভীর নৈতিক পচনের প্রমাণ।”
ইসরায়েলের সরকারি কর্মকর্তারাও গাজার জনগণের বিরুদ্ধে তাদের সহিংস আহ্বান রেখে যাচ্ছেন।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলি রেডিওতে হেরিটেজ মন্ত্রী আমিচাই এলিয়াহু বলেন, “সরকার গাজাকে নিশ্চিহ্ন করার কাজ করছে এবং ঈশ্বরের কৃপায় আমরা এই ‘পাপময়তা’ (গাজার বাসিন্দারা) নিশ্চিহ্ন করছি। গাজার সব অঞ্চল ইহুদিদের হবে।”
অনেক দেরিতে হলেও সাংবাদটিকে স্বাগত
বিটসেলেমের প্রতিবেদনটি ৭৯ পৃষ্ঠাবিশিষ্ট এবং এতে গাজায় গত ২২ মাস ধরে চলমান হামলার মধ্যে থাকা অসংখ্য ফিলিস্তিনির সাক্ষাৎকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ইসরায়েলের সবচেয়ে প্রখ্যাত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর একটি বিটসেলেম। সংগঠনটি গাজায় ইসরায়েলের কার্যকলাপকে গণহত্যা বলে বর্ণনা করায় দেশের ভেতরে তারা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গাজায় নিজেদের দেশের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা অনেক ইসরায়েলি এরইমধ্যে তাদের দেশের নাগরিকদের কাছ থেকে কঠোর নিন্দার মুখোমুখি হয়েছেন।
এই কারণে বিটসেলেমের ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহারের গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়, যদিও কিছু লোক মনে করেন এটি আগেই হওয়া উচিত ছিল।
এ বিষয়ে এলিয়া আয়ুব বলেন, “এই সংবাদকে আমি স্বাগত জানাই, যদিও এটি গণহত্যার অনেক পরে এসেছে।”
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে বলে মামলা করে। ব্রাজিল, স্পেন, তুরস্ক ও আইরিশ প্রজাতন্ত্রসহ কয়েকটি দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে মিলিত হয়ে আইসিজেতে মামলায় যোগ দিয়েছে।
ঢাকা/রাসেল
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গণহত য ইসর য় ল ব টস ল ম র গণহত য প রক শ কর ছ ন ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
সুদানে ‘গণহত্যা’ হয়েছে
সুদানের এল-ফাশের শহর ও এর আশপাশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চলছে। কৃত্রিম ভূ–উপগ্রহের ছবি বিশ্লেষণ করে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা এমন দাবি করেছেন। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানকার পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশটির আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সসের (আরএসএফ) লড়াই চলছে। গত রোববার তারা এল-ফাশের দখল করে। এর মাধ্যমে প্রায় দেড় বছরের দীর্ঘ অবরোধের পর পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে সেনাবাহিনীর সর্বশেষ শক্ত ঘাঁটিটিও ছিনিয়ে নেয় তারা।
শহরটি পতনের পর থেকে সেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যা, যৌন সহিংসতা, ত্রাণকর্মীদের ওপর হামলা, লুটপাট এবং অপহরণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেখানকার যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।
এল-ফাশের থেকে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী তাওইলা শহরে জীবিত বেঁচে ফেরা কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে এএফপির সাংবাদিক কথা বলেছেন। সেখানে গণহত্যা হয়েছে জানিয়ে তাঁরা বলেন, শহরটিতে মা-বাবার সামনেই শিশুদের গুলি করা হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে পালানোর সময় সাধারণ মানুষকে মারধর করে তাঁদের মূল্যবান সামগ্রী লুট করা হয়েছে।
পাঁচ সন্তানের মা হায়াত শহর থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের একজন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে থাকা তরুণদের আসার পথেই আধা সামরিক বাহিনী থামিয়ে দেয়। আমরা জানি না, তাদের কী হয়েছে।’
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাব বলেছে, গত শুক্রবার পাওয়া কৃত্রিম উপগ্রহের ছবিতে ‘বড় ধরনের কোনো জমায়েত চোখে পড়েনি।’ এ কারণে মনে করা হচ্ছে, সেখানকার জনগণের বড় একটি অংশ হয় ‘মারা গেছে, বন্দী হয়েছে কিংবা লুকিয়ে আছে।’ সেখানে গণহত্যা অব্যাহত থাকার বিভিন্ন ইঙ্গিত স্পষ্টভাবে দেখা গেছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, আল-ফাশের থেকে এখন পর্যন্ত ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ পালিয়েছে। এখনো কয়েক হাজার মানুষ শহরটিতে আটকা পড়েছে। আরএসএফের সর্বশেষ হামলার আগে সেখানে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ বসবাস করত।
শনিবার বাহরাইনে এক সম্মেলনে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োহান ভাডেফুল বলেন, সুদান একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। আরএসএফ নাগরিকদের সুরক্ষার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু তাদের এই কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে।