মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে থাকুক জনগণের মালিকানা
Published: 24th, March 2025 GMT
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরের প্রথম মার্চ মাস এটি। স্বাধীনতার এ মাস উদ্যাপনের সময় পরিবর্তিত বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে। কর্তৃত্ববাদের চূড়ান্ত সীমায় গিয়ে জন-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতন আমাদের সামনে একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব ও গৌরব পুনরুদ্ধার করা দরকার। সেই সঙ্গে কোনো একক দল বা ব্যক্তি নয়, গণযুদ্ধের কৃতিত্ব জনগণের হাতেই ফিরে আসুক।
আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক একটি মহা বয়ান (গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ) তৈরি করেছিল, যাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, নেতৃত্ব ও ঘটনাবলির ওপর তাদের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এই মহা বয়ানে স্বাধীনতাসংশ্লিষ্ট অবদানের জন্য বাংলাদেশকে শাসন করার অধিকার আওয়ামী লীগের রয়েছে বলে এই দলের নেতারা মনে করতেন। একই সূত্র ধরে দলটির সমালোচনাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমালোচনার সমর্থক হিসেবে পরিণত করা হয়েছিল। এ প্রক্রিয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বহুবিধ মানুষের ভিন্ন ভিন্ন অবদানকে ছাপিয়ে একটি দলের একক বয়ান তৈরি করে এবং শেখ মুজিবকে ‘দেবতার’ মতো সম্মান দিয়ে একজন ‘অতুলনীয়, সর্বদা সঠিক নেতায়’ পরিণত করে।
রাজনীতিতে ন্যারেটিভ বা বয়ানের গুরুত্ব নতুন কোনো বিষয় নয়। প্লেটোর একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘দোজ হু টেল দ্য স্টোরিজ রুল সোসাইটি’, অর্থাৎ ‘যারা গল্প বলে তারাই সমাজকে শাসন করে।’
এই উক্তির মাধ্যমেই বোঝা যায়, কীভাবে গল্প বা বয়ান তৈরি শাসনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। ন্যারেটিভ বা বয়ান হচ্ছে এমন একটি গল্প, যা ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও সামাজিক রীতিনীতিকে জায়েজ করার চেষ্টা করে। বয়ান নির্মাণ তাই রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য একটি জরুরি বিষয়। বিশেষ করে রাষ্ট্রক্ষমতাকে সমুন্নত রাখতে প্রয়োজন একই ধরনের ব্যাখ্যা। যেহেতু বয়ান অনেকাংশে ইতিহাসনির্ভর, তাই ইতিহাসের ঘটনাসমূহ নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে।
জঁ ফ্রাসোঁয়া লিওটার্ড মহা বয়ানকে বর্ণনা করেন এমন একটি তত্ত্ব হিসেবে, যা ইতিহাসের ঘটনাবলি, অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘটমান বিষয়কে সর্বজনীন নিয়মের মাধ্যমে একটি সর্বাত্মক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে। তাই মহা বয়ান ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে, বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ভিন্ন ঘটনাকে সর্বজনীন নিয়মের মাধ্যমে একই সূত্রে ফেলে একধরনের বয়ান তৈরি করে। এর সমস্যা হচ্ছে এটি কেবল ইতিহাসের একটি দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরে, একই ধারার ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসে এবং কেবল এক ব্যক্তি অথবা একটি দলের অবদানকে একক বানিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ–সম্পর্কিত মহা বয়ান তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষই সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করে। গ্রাম–শহর থেকে বিভিন্ন বয়সের নানা শ্রেণির মানুষের সংমিশ্রণেই তৈরি হয় এই বাহিনী। কিন্তু যুদ্ধ শেষে মুক্তিযুদ্ধের মালিকানা আস্তে আস্তে সাধারণ জনগণের হাত থেকে হাতছাড়া হয়ে এক ব্যক্তি ও একটি দলের অধিকারে চলে যায়।
আওয়ামী লীগের শাসনে মুক্তিযুদ্ধ কোনো ইতিহাসের ঘটনা না হয়ে ধর্মের মতো অলঙ্ঘনীয় হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধের একক বয়ানকে প্রশ্নবিহীন, অলঙ্ঘনীয় করে তোলার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতা ও তাঁর পরিবারের প্রতিও প্রশ্নবিহীন আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করতে কঠোর আইন পর্যন্ত করা হয়।
মহা বয়ান তৈরির এ প্রকল্পে ইতিহাসকে শাসকের ইচ্ছেমতো নির্মাণ করা হয়। এখানে কী ঘটেছিল, সেটা নয়, বরং কী ঘটলে বয়ানের সঙ্গে যায়, সেটাই বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়। সত্য কী, তার চেয়ে কোন সত্যটি বয়ানের জন্য ‘স্বস্তিকর’, তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় মুসলিম লীগের কর্মী হিসেবে শেখ মুজিবের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং পরবর্তী সময়ে স্বপ্নভঙ্গ—এসব আলোচনা ব্রাত্য। এই অস্বস্তির জন্যই ১৯৪৭–এর ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ থেকে হঠাৎই ১৯৭১–এ আলোচনা চলে আসে।
’২৪ ও ’৭১ যে একে অপরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতা, তা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও কিছু কট্টরপন্থী ছাড়া বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলেরই ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। এই ঐকমত্যকে কাজে লাগিয়ে ও একক মহা বয়ানকে ভেঙে দিয়ে আওয়ামী লীগের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সাধারণ জনগণের হাতে তুলে দিতে হবে। এ লক্ষ্যে সাধারণ জনগণের অবদান ও ত্যাগ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা থাকা এই বয়ানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই জিয়াউর রহমানের মতো মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের অন্যতম সেনাপতিকে হয়ে যেতে হয় ‘পাকিস্তানের এজেন্ট’। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য রাজনৈতিক মতাদর্শের, গ্রাম্য ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর, এমনকি বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকেও এড়িয়ে যাওয়া হয়। কারণ, ‘প্রকৃত’ মুক্তিযোদ্ধা কারা বা কাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত বা উচিত নয়, এটা এই মহা বয়ান নির্ধারণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আসলে কী ঘটেছিল, কারা প্রকৃতই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তা অনেক সময় কম গুরুত্ব পায়। এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় কারা একক বয়ানে নির্দেশিত ইতিহাসকে মেনে নেন, সমর্থন করেন এবং সে অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলিকে বিশ্লেষণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের মহা বয়ানের অংশ হিসেবে যে শুধু মুক্তিযোদ্ধা কে, তার সীমারেখা তৈরি করা হয় তা–ই নয়, এর সঙ্গে বিভিন্ন প্রজন্মে রাজাকার কারা, সেটাও ঠিক করা হয়। এই বয়ানে দল হিসেবে যেহেতু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের ‘অভিভাবক’, তাই এই দল ও দলের নেতাদের কার্যক্রমের বিরোধিতাকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা হিসেবে সরলীকরণ করা হয়। তাই আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরোধিতা করলে ‘রাজাকার’, ‘জামায়াত-শিবির’ কিংবা ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ইত্যাদি তকমা দেওয়া হতো।
আরও পড়ুনআওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে০৩ নভেম্বর ২০২৪২০১৩ সালে দেশে দুটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে—একটি শাহবাগ আন্দোলন ও আরেকটি হেফাজত আন্দোলন। এই দুটি আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের নব্য বয়ান তৈরি ও সেই বয়ান অনুযায়ী আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক লাভ তুলে আনতে সহযোগিতা করে। এটি একটি চমকপ্রদ বিষয় যে শাহবাগ আন্দোলনের প্রকৃতপক্ষে শুরু হয়েছিল সরকারবিরোধী আন্দোলন হিসেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনকে আওয়ামী লীগের স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে রূপান্তরিত করা হয়।
এই আন্দোলনের শুরু হয় আওয়ামী সরকারের সঙ্গে জামায়াতের একধরনের আঁতাত হচ্ছে, এ সন্দেহে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীকে সহযোগিতা করা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলে এই সন্দেহের সূত্রপাত হয়।
কীভাবে একটি সরকারবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকারের মদদপুষ্ট আন্দোলনে পরিণত হলো, তা বুঝতে হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহা বয়ান ও শত্রু নির্মাণের কাঠামোটি বুঝতে হবে। যেহেতু আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের বয়ান অনুযায়ী আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র অভিভাবক বা দেখভাল করার কর্তৃত্বের অধিকারী, তাই শেষ পর্যন্ত আন্দোলন তাদের পকেটস্থ হয়। দীর্ঘ সময় ধরে যে সাংস্কৃতিক শক্তি ও লোকবল দিয়ে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে নিজেদের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে, ফলে এমনকি তাদের রাজনৈতিক বিরোধীরাও অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আওয়ামী লীগের মালিকানা মেনে নেয়।
শাহবাগ আন্দোলনে সরকার কীভাবে মিত্রে পরিণত হলো, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে যখন আলোচনা ও প্রতিবাদের দরকার ছিল, তখন কট্টর ইসলামপন্থী গোষ্ঠী হেফাজতের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হলো। হেফাজতের অপ্রয়োজনীয় আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক মূল বিষয় থেকে নজর সরিয়ে দিল। আওয়ামী লীগ সরকার শক্তি প্রয়োগ করে হেফাজতের ঢাকায় অবস্থানকে বানচাল করলেও কিছুদিনের মধ্যেই তাদেরকে কাছে টেনে নিয়েছে। প্রথম দিকে স্বঘোষিত নাস্তিক ব্লগারদের পাশে থাকলেও পরের দিকে তাদের গ্রেপ্তার ও মামলা করে হেফাজতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে আওয়ামী লীগ।
এভাবে শাহবাগ ও হেফাজত দুই আপাত পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠী কট্টর জাতীয়তাবাদ ও ধর্মকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের সমাজে ঘৃণার চর্চা বাড়ায়। তৈরি হয় বাইনারি বিভাজন এবং দুটি মেরু। সমাজের এই অসহিষ্ণু বিভাজন ‘সেক্যুলার’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া আওয়ামী লীগের ইসলামপন্থীদের প্রতিরোধের নামে যেকোনো মূল্যে বিকল্পহীন হিসেবে ক্ষমতায় টিকে থাকাকে জায়েজ করে।
৫ আগস্টের পর জুলাই অভ্যুত্থানকে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে ঢেকে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে, প্রথমে বিএনপি এবং পরে নতুন দল এনসিপি মুক্তিযুদ্ধকে ভুলিয়ে দেওয়ার এই অপচেষ্টাকে রুখে দেয়।
’২৪ ও ’৭১ যে একে অপরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতা, তা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও কিছু কট্টরপন্থী ছাড়া বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলেরই ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। এই ঐকমত্যকে কাজে লাগিয়ে ও একক মহা বয়ানকে ভেঙে দিয়ে আওয়ামী লীগের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সাধারণ জনগণের হাতে তুলে দিতে হবে। এ লক্ষ্যে সাধারণ জনগণের অবদান ও ত্যাগ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
● ড.
সাইমুম পারভেজ অসলোর নরওয়েজিয়ান স্কুল অব থিওলজি, রিলিজিয়ন ও সোসাইটির জ্যেষ্ঠ গবেষক (সহযোগী অধ্যাপক)
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জনগণ র হ ত র জন ত ক র অবদ ন ঐকমত য শ হব গ র জন য র ঘটন আওয় ম একক ব ইসল ম সরক র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলো কেন
ঐকমত্য কমিশন দেশ ও জাতির সঙ্গে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি অভিযোগ করেছেন, তাঁরা স্বাক্ষর করেছেন জুলাই সনদে।
কিন্তু ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ জমা দিয়েছে, সেখানে অনেক কিছুই বদলে গেছে। যেমন বিএনপিসহ অন্যান্য দলের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট নেই।
এর চেয়েও ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, সব দল মিলে একমত হয়েছিল—এমন বিষয়ও নাকি কমিশনের সুপারিশে বদলে দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, অফিস-আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি রাখার বিধানটি বিলুপ্ত করার বিষয়ে সব দল একমত হয়েছিল।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে জট খুলুন, সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে০১ নভেম্বর ২০২৫কিন্তু পরবর্তী সময়ে কমিশনের সুপারিশে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টাঙানোর বিধানটি বিলুপ্ত করার বিষয় সনদে রাখা হয়নি।
শুধু তা-ই নয়, এমন আরও অনেক বিষয় কমিশনের সুপারিশে যুক্ত করা হয়েছে, যা নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হয়নি।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে পরবর্তী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে।ঐকমত্য স্থাপন করতে গিয়ে এখন কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে কমিশন।
অভিযোগ উঠেছে, তারাই অনৈক্য স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কমিশন মূলত কালক্ষেপণ করেছে সংস্কারের নামে।
আদতে তাদের সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল কি না সেই প্রশ্ন উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে তারা নতুন কোনো সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারেননি, যা আসলেই কার্যকর করা যেতে পারে।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ যেন ব্যর্থ না হয়৩০ অক্টোবর ২০২৫কমিশনে যেসব বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছে তার বেশির ভাগই বিএনপির ৩১ দফার মধ্যে আছে।
যেমন বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের জন্য একাধিক কমিশন করার প্রস্তাবনা বিএনপির ৩১ দফাতেই ছিল।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনার পরিকল্পনা বিএনপি আগেই প্রচার করেছে।
নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের ক্ষমতার সম্পর্ক পুরোপুরি আলাদা করা ও ভারসাম্য আনার বিষয়ে বিএনপি একাধিকবার আলাপ করেছে।
ফলে বোঝাই যাচ্ছে, কমিশন তেমন নতুন কোনো আলাপ সামনে আনতে পারেনি। ভবিষ্যতে যে নির্বাচিত সরকার আসবে, তাদের দুর্বল করতে নানা কৌশল বাস্তবায়নই যেন ছিল এই কমিশনের লক্ষ্য।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করা। আর কাউকে ফ্যাসিবাদী হতে দেওয়া যাবে না—এ যুক্তি দিয়ে কমিশন মূলত বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে ক্ষমতার নতুন অংশীদার সৃষ্টি করতে চেয়েছিল সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের মধ্য দিয়ে।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে লুকোচুরি হলে ভালো হবে না২৭ অক্টোবর ২০২৫বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বিরোধিতার মুখে কমিশনে প্রস্তাবটি আর আলোচনায় রাখতে পারেনি। কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে যথেষ্ট অসংগতি রয়েছে বলে মনে হচ্ছে, যা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নতুন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সংবাদমাধ্যম থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, জুলাই সনদ অনুযায়ীই সংবিধান সংস্কার পরিষদকে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে।
চাইলেও আগামী জাতীয় সংসদ তাদের ইচ্ছেমতো সংবিধানে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন, সংযোজন, বিয়োজন করতে পারবে না। এ থেকে পরিষ্কার, গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রথম সংসদের কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই সংবিধান পরিবর্তন বা সংস্কারে।
এর ফলে ভিন্নমতের অংশগ্রহণ, সংসদে আলোচনার গণতান্ত্রিক পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হতে হবে দেশকে। প্রকৃতপক্ষে সংবিধান বিষয়ে আগামীর নির্বাচিত সংসদকে ঠুঁটো জগন্নাথ-এ পরিণত করতে চাইছে কমিশন।
ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ করেছে, পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সংবিধান সংস্কার পরিষদ প্রথম অধিবেশনের শুরু থেকে ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কারের কাজ শেষ করবে।
এই ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ বিষয়টিও পরিষ্কার নয়। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার সময় এটি নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
যত দূর জানি, কমিশনে এ নিয়ে আলাপই করা হয়নি। তবে এই ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ও বাধ্য থাকবে হুবহু কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে। তাদের নিজস্ব কোনো মত, পরিবর্তন-পরিমার্জনের সুযোগ থাকছে না।
অর্থাৎ ঐকমত্য কমিশনই জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পরিবর্তে একটি অনির্বাচিত প্রতিনিধিদল হিসেবে কার্যত ক্ষমতা ধারণ করবে।
কমিশন গণভোটের বিষয়টিও উল্লেখ করেছে তাদের সুপারিশে। তারা এমনকি জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করা যায় বলে মত দিয়েছে, যা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্যযোগ্য এবং বাংলাদেশের বাস্তবতায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষতির কারণ হতে পারে।
দেশের মানুষের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে গিয়ে আওয়ামী লীগ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। গণধিক্কৃত দলে পরিণত হয়েছে। রাজনীতিতে এখন নিষিদ্ধ। ইতিহাসের ট্র্যাজেডি হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানকে যারা বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে ইতিহাসের শিক্ষার কথা তাদের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।গণভোট আয়োজনে যেমন খরচের বিষয়টি আছে। তেমনি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারসহ তার মিত্রদের ষড়যন্ত্রও থেমে নেই।
এ অবস্থায় গণভোট ব্যর্থ হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তা ছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানের বড় একটি দলকে নাখোশ রেখে গণভোট আয়োজন নতুন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টিরই নামান্তর বলে মনে হচ্ছে।
কমিশনের আচরণে এমন মনে হওয়া স্বাভাবিক যে কাউকে খুশি করতে এবং কাউকে রুষ্ট করতে এসব সুপারিশ আনা হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি গ্রহণযোগ্য, কার্যকর, বিভিন্ন মতের আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে গণতান্ত্রিক সংসদ জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
শুধু কাগজে-কলমে কিছু সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উন্নতি ঘটবে না। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট এবং কার্যকর সংসদ পারে জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটাতে।
কিন্তু সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা জাতীয় নির্বাচনকে নতুন করে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। সরকার মুখে মুখে বলছে বটে ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে; কিন্তু বাধাগুলো দূর করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিচ্ছে না।
দেশের মানুষের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে গিয়ে আওয়ামী লীগ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। গণধিক্কৃত দলে পরিণত হয়েছে। রাজনীতিতে এখন নিষিদ্ধ।
ইতিহাসের ট্র্যাজেডি হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানকে যারা বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে ইতিহাসের শিক্ষার কথা তাদের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব