ঝুঁকি নিয়ে পণ্যবাহী ট্রাকের ডালায় ঘরমুখী নিম্ন আয়ের মানুষ
Published: 27th, March 2025 GMT
পবিত্র ঈদুল ফিতরে স্বজনদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে পণ্যবাহী ট্রাকসহ বিভিন্ন গাড়ির ডালায় বসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে ফিরছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। অধিকাংশই গাজীপুর ও টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় দিনমজুরি করেন। উত্তরবঙ্গগামী মহাসড়কের বিভিন্ন গাড়িতে তাঁরা চড়ে বসছেন। এ ক্ষেত্রে হাইওয়ে পুলিশের সতর্কতামূলক প্রচারণাও কোনো কাজে আসছে না।
বগুড়ার শেরপুর হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ট্রাক, লেগুনাসহ বিভিন্ন খোলা গাড়িতে মানুষ তোলার কারণে গতকাল বুধবার সকাল ছয়টা থেকে আজ বৃহস্পতিবার বেলা তিনটা পর্যন্ত ৫৮টি মামলা হয়েছে। সব মামলা সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮–এর ৮৭ ধারা (অনিরাপদ গাড়িচালনা) ও ৮৯ ধারায় (অনিরাপদ যানবাহন) করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার মহাসড়কের সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মহাসড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় টহল দিচ্ছে হাইওয়ে পুলিশ। এর মধ্যে ঢাকা থেকে আসা বিভিন্ন পণ্যবাহী ট্রাক ও লেগুনার ডালার মধ্যে ঈদে ঘরমুখী মানুষকে ফিরতে দেখা গেল। নারী-পুরুষের মধ্যে শিশুরাও আছে।
কয়েকটি গাড়ির পিছু নিয়ে দেখা যায়, গাড়ির ডালায় বসা যাত্রীদের কেউ শেরপুরের সীমাবাড়ি বাজার, ধুনট রোড, নন্দীগ্রাম রোড এলাকায় নামছেন। আবার কেউ কেউ বগুড়ামুখী সড়ক ধরে চলে যাচ্ছেন।
শেরপুরের নন্দীগ্রাম সড়কে নামা সাইফুল ইসলাম, আমজাদ হোসেন এবং ধুনটের লোকমান আলী ও লিয়াকত হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। জানান, তাঁরা সবাই দিনমজুর। টাঙ্গাইল, গাজীপুরসহ ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় কাজ করেন। ঈদের জন্য বাড়িতে যাচ্ছেন। খরচ কমাতে তাঁরা গাজীপুর থেকে এসব গাড়িতে উঠেছেন। বাসে ফিরতে হলে কয়েক গুণ ভাড়া গুনতে হতো। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও খরচ কমাতে তাঁরা প্রতিবছর এভাবেই যাতায়াত করেন।
পণ্যবাহী ট্রাকের ডালায় ফেরা নাটোর, বগুড়া ও গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকার পাঁচ যাত্রী বলেন, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে দিনমজুর হিসেবে টাঙ্গাইল, গাজীপুরসহ ঢাকার আশপাশের এলাকায় কাজ করেন। প্রতিবছর ঈদে বাড়ি ফিরতে তাঁরা এ ধরনের গাড়িতে উঠে বসেন। এতে তাঁদের খরচ অনেক কম লাগে।
বগুড়া বাস, মিনিবাস ও কোচ পরিবহন মালিক সমিতির শেরপুরের সাধারণ সম্পাদক সেলিম হোসেন বলেন, পণ্যবাহী ট্রাকে এভাবে মানুষ আসা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়লে অনেকের প্রাণহানির আশঙ্কা থেকে যায়। যেসব স্থানে তাঁরা গাড়িতে ওঠেন, সেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কঠোর হলে এভাবে ঝুঁকি নিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা কমে যাবে।
শেরপুর হাইওয়ে পুলিশের পরিদর্শক আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পণ্যবাহী ট্রাক ও লেগুনায় ঈদে ঘরমুখী মানুষের যাত্রাকে নিরুৎসাহিত করতে তাঁরা কয়েক দিন ধরে প্রচার চালিয়ে আসছেন। এ নিয়ে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এরপরও যেসব গাড়িতে এভাবে মানুষ আসছেন, তাঁদের সতর্কতামূলক পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ব ভ ন ন এল ক এল ক য়
এছাড়াও পড়ুন:
ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা
বছর পাঁচেক আগেও ধান কাটার শ্রমিকেরা বৈশাখ মাসের অপেক্ষায় থাকতেন। বৈশাখে হাওরের বুকজুড়ে সবুজ ধান যখন সোনালি রঙ ছড়াতে শুরু করে, তখন থেকেই দূরদূরান্ত থেকে হাওরে আসতে থাকেন ধান কাটার শ্রমিকেরা। কিন্তু, এই চিত্র দ্রুত বদলাচ্ছে। হাওরের কৃষক এখন ধান কাটার জন্য বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করেন। ফলে কৃষকের শ্রম এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হচ্ছে। তবে, কর্মহীন হয়ে পড়ছেন কৃষি শ্রমিকেরা। বাধ্য হয়ে তারা পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।
তিন বছর হলো ধান কাটার পেশা ছেড়েছেন মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের মো. মকবুল মিয়া। এখন তিনি সারাবছর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান।
আরো পড়ুন:
খুলনার বরফশ্রমিক
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি
ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত
মকবুল মিয়া বলেন, ‘‘আগে বছরের ছয় মাস বর্ষায় নৌকা বাইতাম, আর হুগনা সিজন আইলে নিজের জমি চাষ করতাম, আবার মাইনষের জমিতেও কামলা দিতাম। যা আয় অইতো তাই দিয়া আমরার ছয়জনের সংসার চইল্যা যাইতো। কিন্তু, যহন থেইক্যা নতুন নতুন মেশিন হাওরে আইতাছে, তহন থেইক্যা আমরার আর বেইল নাই।’’
‘‘কেউ আর আমরারে আগের মতন দাম দেয় না। কাম করলেও ঠিকমতো টেহা পাই না, তাই পুষায় না,’’ বলেন এই কৃষিশ্রমিক।
মকবুলের মতো ধান কাটা, মাড়াই, রোদে শুকানো, ঝাড়া, কাঁধে বহন করার মতো স্বাধীন পেশা ছেড়েছেন অষ্টগ্রামের ফয়জুল, ইটনার শামছুল মিয়া, নিকলীর ফরিদ উদ্দিনসহ অসংখ্য শ্রমিক। এক সময় যারা এ পেশায় দলবেঁধে কাজ করতেন, এখন দৃশ্যপট পুরোটাই ভিন্ন। ধান কাটার পেশা বদলে তারা এখন কেউ রিকশাচালক, কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ চটপটি-ফুচকার দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
তারা বলছেন, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির গতির সঙ্গে তারা কখনো তাল মেলাতে পারবেন না। কৃষকরাও তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছেন না। বেশি জমি যাদের আছে তারাও আধুনিক পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। যে কৃষক অল্প জমিতে চাষাবাদ করেছেন, তারাও আর পয়সা খরচ করে কৃষিশ্রমিকের ওপর নির্ভর করছেন না। তারা পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা নিচ্ছেন। ফলে খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা পড়েছেন বিপাকে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সনাতন পদ্ধতিতে এক বিঘা জমির ধান কাটতে প্রচুর সময় লাগে। ফসল কাটার পরে বহন ও মারাই করা, তারপর বস্তায় সংরক্ষণ করার জন্যও অনেক শ্রমিকের দরকার। এটুকু ৬ থেকে ৭ জন শ্রমিকের সারা দিনের কাজ। তার জন্য মজুরি গুনতে হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কিন্তু, এ কাজে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করলে সময় এবং অর্থ দুটোই কম লাগে।
বৈশাখে বর্ষার পানি ও বৈরী আবহাওয়া না থাকায় কৃষকেরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটছেন। বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে ঝড়-তুফান শুরু হলে পাকা ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে তারা যে পদ্ধতিতে ধান কাটা সহজ এবং দ্রুত হয় সেই পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবার পুরো জেলায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওর এলাকাতেই আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলন ভালো হওয়ায় এই ধান থেকে এবার প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। ধান কাটতে এ বছর হাওর অঞ্চলে ৩৫ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। এই সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কম। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধান কাটতে কৃষক কম্বাইন্ড হারভেস্টারসহ ৪১৩টি ধান কাটার যন্ত্র ব্যবহার করছেন।
জেলা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ উদ্দিন বলেন, ‘‘মানুষের পেশা পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের বিভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়। কিন্তু, কৃষি এমন একটা পেশা, যারা এ পেশা রপ্ত করেছেন তাদের জন্য নতুন পেশায় আসা খুব কঠিন। বর্তমানে কৃষিকাজে যেভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, তাতে কৃষিশ্রমিকেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।’’
‘‘শুধু কৃষিতেই নয়, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে,’’ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারকেই সুদৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান, মাঠে যদি কৃষক ও শ্রমিক ন্যায্য শ্রমমূল্য না পান, তাহলে কৃষিও একদিন হুমকির মুখে পড়বে।’’
ঢাকা/তারা