নিরাপদ ঈদযাত্রার জন্য চাই মধ্যমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনা
Published: 28th, March 2025 GMT
প্রতিবছরই ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে বিআরটিএ ও হাইওয়ে পুলিশ ঈদের আগে বিভিন্ন অংশীজনদের নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করে। এসব বৈঠকে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয় যে কোনোভাবেই ঈদযাত্রায় লক্করঝক্কড় ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলতে দেওয়া হবে না; রাজধানীর সিটি সার্ভিসের বাস কোনোভাবেই দূরপাল্লায় চলতে দেওয়া হবে না; কোনোভাবেই ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে যাত্রী বহন করতে দেওয়া হবে না। সঙ্গে আরও বলা হয় যে ঈদযাত্রায় বাড়তি ভাড়া আদায় কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে; সড়ক-মহাসড়কের চাঁদাবাজি যেকোনো মূল্যে রুখে দেওয়া হবে ইত্যাদি।
কিন্তু বাস্তবে এসবের তেমন কিছুই ঘটে না। ঘটার কথাও নয়। কারণ, ঈদযাত্রায় মাত্র তিন/চার দিনে ঢাকা থেকে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা করেন। এত অল্প সময়ে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ পরিবহন করার মতো মানসম্মত গণপরিবহন দেশে নেই। রেলসেবা তো ব্যাপকভাবে অপর্যাপ্ত। নৌপরিবহন ও নৌ রুট সুবিধাজনক নয়। সুতরাং মানুষ আপনজনের টানে ঝুঁকি নিয়ে সড়কপথেই যাত্রা করেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো এই দৃশ্য শুধু নির্বিকারভাবে দেখতে থাকে। সড়কের চাঁদাবাজি, বাড়তি ভাড়া আদায় ও অনিরাপদ যানবাহন চলাচল বন্ধে তাদের তেমন কোনো তৎপরতা দৃশ্যমান হয় না। তবে কোনো কোনো বছর আবহাওয়া ও সড়ক ভালো থাকা সাপেক্ষে পুলিশ বাহিনীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় মানুষ কিছুটা যানজটমুক্ত ঈদযাত্রা করতে পারেন।
আসলে একটি নির্বিঘ্ন-নিরাপদ ঈদযাত্রা নিশ্চিত করতে হলে ঈদের ১০/১৫ দিন বা ১ মাস আগে বৈঠক করে কর্মপরিকল্পনা সাজালে হবে না। এ জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে তিন বছরের একটি মধ্যমেয়াদি টেকসই সমন্বিত পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার অধীনে রেললাইন সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে সড়কপথের মানুষকে ট্রেনমুখী করতে হবে। নদীপথ সংস্কার ও জনবান্ধব করতে হবে। সড়কে বিআরটিসির রুট বিস্তৃত করে বাড়াতে হবে বাসের সংখ্যা। একই সঙ্গে সড়কের সব মেয়াদোত্তীর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বন্ধ করতে হবে। ঈদযাত্রায় পোশাকশ্রমিকেরা যাতে পর্যায়ক্রমে ছুটি উপভোগ করতে পারেন, সে জন্য পরিকল্পনা সাজাতে হবে। ব্যবস্থা করতে হবে পোশাকশ্রমিকদের জন্য অঞ্চলভিত্তিক যানবাহনের। এসব উদ্যোগ ঠিকমতো বাস্তবায়ন করলে ঈদযাত্রা সুস্থ, স্বাভাবিক ও নিরাপদ করা সম্ভব হবে।
মহাসড়কে দ্রুতগামী বড় যানবাহনের সঙ্গে স্বল্পগতির ছোট যানবাহন সিএনজি, অটোরিকশা, নছিমন, ভটভটি ইত্যাদির সংঘর্ষ ঘটছে অহরহ। এসব দুর্ঘটনায় অধিক প্রাণহানি ঘটছে। অনেক সময় পুরো পরিবার নিহত হচ্ছে। এ জন্য মহাসড়কে ধীরগতির ছোট যানবাহন চলাচল বন্ধ করা জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের গ্রামীণ সড়কগুলো মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এসব সড়ক যদি মহাসড়কে সংযুক্ত না হয়ে পাশ দিয়ে চলে যেত, তাহলে ছোট ছোট যানবাহনকে মহাসড়ক ব্যবহার করতে হতো না। মূলত গ্রামীণ সড়কের ধীরগতির যানবাহনগুলো স্বল্প দূরত্বে চলাচলের সময় মহাসড়ক ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। এ ছাড়া আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়কগুলোর সঙ্গে মহাসড়কের সংযোগ একেবারে সরাসরি হওয়ার কারণে ছোট যানবাহনগুলো সরাসরি মহাসড়কে উঠে পড়ছে। ফলে বড় যানবাহনগুলো হঠাৎ ব্রেক করতে না পেরে ধাক্কা বা চাপা দিচ্ছে। কাজেই গ্রামীণ সড়ককে মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত না রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আর যদি সংযুক্ত করতেই হয়, তাহলে ধীরে ধীরে করতে হবে। হঠাৎ করে সরাসরি নয়।
উল্লেখ্য যে বিকল্প সড়ক না থাকার কারণে যেসব মহাসড়কে ছোট ধীরগতির যানবাহন চলতে দিতেই হবে, সেসব মহাসড়কে সার্ভিস রোড নির্মাণ করতে হবে। রোড ডিভাইডার না থাকলে কিছুদূর অন্তর ফিতা টানিয়ে হলেও সড়কে বিভাজক তৈরি করা যায়। মোটরসাইকেলের জন্য মহাসড়কে লেন থাকতে হবে। তবে গণপরিবহন সহজ ও সাশ্রয়ী করে মোটরসাইকেলকে নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। মোটরসাইকেল কোনোভাবেই দূরপাল্লার গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে না। মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীদের মানসম্পন্ন হেলমেটের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। মানসম্পন্ন হেলমেট সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঝুঁকি ৪৮ শতাংশ রোধ করে। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়িয়ে প্রতিটি যানবাহনের গতিসীমা মানার বাধ্যতা নিশ্চিত করা দরকার। আর আইনের কঠোর প্রয়োগের ফাঁক তো রয়েই গেছে। সেই ফাঁক পূরণ করতে হবে।
সড়ক পরিবহন খাতের অস্থিরতা ও অব্যবস্থাপনার প্রধান কারণ পথেঘাটে রাজনৈতিক পোশাকের বেপরোয়া চাঁদাবাজি। এই অপকর্মের সঙ্গে পুলিশের কিছু অসাধু ব্যক্তিও জড়িত থাকেন। চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারকে কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। যদি রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের চাঁদাবাজি বন্ধ করা যায়, তাহলে পুলিশের অসাধু কর্মকর্তারাও চাঁদাবাজি করতে সাহস পাবেন না।
মোটরসাইকেল তৈরি ও বিপণন কোম্পানিগুলো যে ভাষা ও ভঙ্গিতে বিজ্ঞাপন প্রচার করে, তা সংশোধন করতে হবে। তাদের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তরুণ-যুবক শ্রেণি মোটরসাইকেলের গতির প্রতিযোগিতায় উৎসাহিত হচ্ছে। তরুণ-যুবারা গতির মধ্যে রোমাঞ্চ অনুভব করেন। তাই মোটরসাইকেলের বিজ্ঞাপন অবশ্যই জীবনমুখী হতে হবে।
সড়কে নিরাপদে চলাচলের জন্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের প্রতি দলীয় প্রধানের নির্দেশনা থাকতে হবে। মসজিদে নামাজের খুতবায় নিরাপদ সড়ক ব্যবহারের বিষয়ে বয়ান থাকতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক বিভিন্ন আয়োজন করতে হবে। এসব উদ্যোগের ধারাবাহিকতা থাকলে সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে।
পরিবহনশ্রমিকদের নিয়োগ, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকার কারণে অধিকাংশ চালক মানসিক ও শারীরিকভাবে অস্থির ও অসুস্থ থাকেন। ফলে দুর্ঘটনা বাড়ছে। তাই নিরাপদ যানবাহন চালনা নিশ্চিত করতে হলে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ অনুযায়ী পরিবহনের চালক ও শ্রমিকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
এসব উদ্যোগের পাশাপাশি গণমাধ্যমে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে আধেয় তৈরি করে নিরাপত্তা যে একটি সংস্কৃতি এবং জীবনেরই অংশ, মানুষের মধ্যে এই উপলব্ধি তৈরি করতে হবে। সচেতনতামূলক জীবনমুখী এসব কনটেন্ট বিটিআরসির মাধ্যমে এমনভাবে প্রচার করতে হবে যাতে ফেসবুক দেখার সময় স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। বিজ্ঞাপনের মতো বারবার এগুলো মানুষের সামনে আনতে হবে। সড়কের নিরাপত্তাবিষয়ক আধেয় এভাবে প্রচার করলে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি মানুষের মনে গেঁথে যাবে।
উল্লেখ্য, ঈদযাত্রা নিরাপদ করার জন্য সরকারিভাবে নেওয়া উদ্যোগগুলো ঈদপূর্ব যাত্রায় যতটা সক্রিয় থাকে, ঈদপরবর্তী ফিরতি যাত্রায় ততটা সক্রিয় থাকে না। ফলে ঈদের ফিরতি যাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। এটা প্রতি ঈদ মৌসুমের চিত্র। ঈদপূর্ব ঘরমুখী যাত্রায় মানুষের কিছুটা আর্থিক সঙ্গতি থাকে, তাঁরা মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকেন। কিন্তু ঈদপরবর্তী ফিরতি যাত্রায় ছুটি শেষ হয়ে যায়। খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষকে ফিরতে হয়। এ সময় মানুষের আর্থিক সঙ্গতি কম থাকে। মানসিক অবস্থাও থাকে বিষণ্ন। ফলে তাঁরা তাড়াহুড়া করে যেনতেনভাবে ফিরতে চান, যা দুর্ঘটনা বেশি ঘটার কারণ হিসেবে কাজ করে। তাই এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিরাপদ ঈদযাত্রা নিশ্চিত করার কর্মকৌশল সাজাতে হবে। তবে এ জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে তিন বছরের মধ্যমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনা।
সাইদুর রহমান নির্বাহী পরিচালক-রোড সেফটি ফাউন্ডেশন
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সড়ক ব যবহ র ন শ চ ত করত গ র ম ণ সড়ক ন শ চ ত কর ঈদয ত র য় সড়ক র স দ র ঘটন পর বহন র জন য ন র পদ র বহন
এছাড়াও পড়ুন:
ব্যালটে মামদানি, অদৃশ্য ‘প্রার্থী’ ট্রাম্প
নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন আগামীকাল মঙ্গলবার। ‘বিশ্বের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত এই শহরে প্রথমবার এমন একজন মেয়র পদে নির্বাচিত হতে পারেন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির চলতি ধারার একদম বিপরীতমুখী। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর রিপাবলিকান পার্টি এক ‘শ্বেতকায়, খ্রিষ্টান ও রক্ষণশীল’ আমেরিকার কথা বলছেন।
জোহরান মামদানি শ্বেতকায় নন, তিনি বাদামি রঙের দক্ষিণ এশীয়। তিনি খ্রিষ্টান নন, একজন মুসলিম। তিনি অবশ্যই রক্ষণশীল নন, তিনি খোলামেলাভাবে একজন প্রগতিশীল, যিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলতে দ্বিধা করেন না।
‘মামদানি একজন ভয়ানক মানুষ’, সাবধান করে বলেছেন অ্যান্ড্রু কুমো, মঙ্গলবারের নির্বাচনে যিনি মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী। সারা জীবন ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য থাকলেও বাছাইপর্বে পরাজিত হয়ে তিনি এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন।
ব্যালটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম না থাকলেও এই নির্বাচনে তিনি একজন অদৃশ্য প্রার্থী। কুমোর পক্ষ নিয়ে তিনিও এই নির্বাচনের একজন অংশগ্রহণকারী। বড় ব্যবধানে মামদানির বিজয় হলে অনেকেই তা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনাস্থা হিসেবেই দেখবেন।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্কের আদি বাসিন্দা। তিনি কোনোভাবেই চান না মামদানি এই শহরের মেয়র নির্বাচিত হোন। তাঁর বিবেচনায় মামদানি শুধু একজন পাক্কা কমিউনিস্টই নন, রীতিমতো উন্মাদ। এমন একজনকে নির্বাচিত করা হলে তিনি নিউইয়র্ক সিটির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল আটকে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, মামদানি একজন অবৈধ অভিবাসী। তা প্রমাণিত হলে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে। মেয়র নির্বাচিত হয়ে মামদানি যদি অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের চলতি অভিযানে বাধা দেন, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে, এমন হুমকিও দিয়েছেন ট্রাম্প।
শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি।ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়
শুধু নিউইয়র্কে নয়, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আরও অন্তত তিনটি রাজ্যে নির্বাচন হবে আগামীকাল, যার ফলাফল ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের ব্যাপারে একটি রেফারেন্ডাম বা জনরায় হবে ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়ায় গভর্নর পদে নির্বাচন। এই দুই রাজ্যে প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চ পরিষদেও ভোট গ্রহণ করা হবে। উভয় রাজ্যই ডেমোক্রেটিক রাজনীতির সমর্থক, বা ‘ব্লু স্টেট’। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দুই রাজ্যেই ট্রাম্পের হার হয়, কিন্তু ২০১৬ সালের তুলনায় তিনি অনেক ভালো ফল করেন। দেখার বিষয়, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে এই দুই রাজ্যে ট্রাম্পের জনসমর্থন এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে।
এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর গেভিন ন্যুসাম নির্বাচনী ম্যাপ পরিবর্তনের অনুমতি চেয়ে একটি গণভোটের আয়োজন করেছেন। আগামী বছরের নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে রিপাবলিকান পার্টি বড় রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তা ঠেকাতেই ট্রাম্পের নির্দেশে টেক্সাসের নির্বাচনী ম্যাপ ঢেলে সাজানো হয়েছে, যার ফলে রিপাবলিকান দল কংগ্রেসে আরও পাঁচটি আসন নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হবে ভাবা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ‘ব্লু স্টেট’ ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর ন্যুসামের নির্দেশে নির্বাচনী ম্যাপ বদলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য কংগ্রেসে পাঁচটি আসনে বিজয়ের সম্ভাবনা তৈরি হবে।
এই তিনটি নির্বাচনের প্রতিটিতেই ভোটারদের মনে থাকবেন ট্রাম্প, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আইনি বাধা উপেক্ষা করে বিভিন্ন ডেমোক্রেটিক শহরে অবৈধ অভিবাসনবিরোধী অভিযানের নামে সেনাসদস্যদের পাঠাচ্ছেন তিনি। যেসব ডেমোক্রেটিক নেতাকে শত্রু মনে করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছেন। কোনো যুক্তি বা কারণ ছাড়াই ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাঁর পক্ষে ভোট দেয়নি এমন ডেমোক্রেটিক রাজ্যের কেন্দ্রীয় অনুদান বাতিল করছেন। কংগ্রেসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই একাধিক সরকারি দপ্তর আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে মাদক পাচার বন্ধের নামে ভেনেজুয়েলার সমুদ্রসীমায় সামরিক হামলা চালাচ্ছেন। আমদানি শুল্কের নামে যে বাণিজ্যযুদ্ধ তিনি শুরু করেছেন, তার ফলে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম বাড়া শুরু হয়েছে।
গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।এসব কার্যকলাপের ফলে সারা দেশে ট্রাম্পের জনসমর্থন কমেছে। অধিকাংশ জনমত জরিপে তাঁর প্রতি সমর্থন ৪২ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি নয়। সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র ১০ মাসের মাথায় অন্য আর কোনো প্রেসিডেন্টের জনসমর্থনে এমন ধস নামেনি।
এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প কোনো রাজ্যেই ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি প্রচারে আসেননি। এমনকি রিপাবলিকান প্রার্থীদের পক্ষে সরব সমর্থনও জানাননি। এর একটা সম্ভাব্য কারণ, জয়ী হবেন এমন প্রার্থীর সমর্থন দিতেই ট্রাম্প ভালোবাসেন। আগামীকালের নির্বাচনে তেমন সম্ভাবনা কম।
এই নির্বাচন যে ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়, তার আরেক প্রমাণ নির্বাচনী প্রচারণায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অংশগ্রহণ। ডেমোক্রেটিক পার্টিতে জাতীয় নেতা বলতে তিনিই সবেধন নীলমণি। শনিবার নিউ জার্সির ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী মাইকি শেরিলকে পাশে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। একই দিন ভার্জিনিয়ায় ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী এবিগেইল স্প্যানবার্গারের পক্ষেও প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। উভয় রাজ্যেই ওবামা কঠোর ভাষায় ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেন, ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী নীতির কারণেই আমেরিকা আজ এক দুঃসময়ের মুখোমুখি।
জনমতে এগিয়ে মামদানি
ওবামা মামদানিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেননি। তবে তিনি যে মামদানির পাশে আছেন, সে কথাও গোপন রাখেননি। মামদানির ক্যাম্পেইন থেকে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি ওবামা নিজেই ফোন করে জানিয়েছেন, তাঁর (মামদানির) বিজয়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তিনি বলেছেন, মামদানির নির্বাচনী প্রচার ‘ইম্প্রেসিভ’ বা নজরে পড়ার মতো।
কুমো ক্যাম্প থেকে অহোরাত্রি তাঁকে ‘কমিউনিস্ট’ ও ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ হিসেবে প্রচার সত্ত্বেও মামদানি যেসব জনমত জরিপে এগিয়ে, তার একটি বড় কারণ মাঠপর্যায়ে তাঁর এই ‘ইম্প্রেসিভ’ প্রচারণা। শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি। এতে তিনি ফল পাচ্ছেন, গত দুই সপ্তাহে মামদানির সঙ্গে তাঁর ব্যবধান ১০ শতাংশের মতো কমে এসেছে। নিউইয়র্কের চলতি মেয়র নির্বাচন থেকে এরিক অ্যাডামস সরে দাঁড়ানোয় কুমোর লাভ হয়েছে সন্দেহ নেই, তবে এখনো মামদানির সঙ্গে যে ১৬-১৭ পয়েন্টের ব্যবধান রয়েছে, তা অতিক্রম করা কার্যত অসম্ভব, এই মত অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের।
ভূমিধস পরিবর্তন
একটা বিষয় স্পষ্ট। মেয়র নির্বাচনে মামদানি জয়ী হলে তা মার্কিন রাজনীতিতে প্রজন্মগত ও নীতিগত পরিবর্তনের সূচনা করবে। ভূমিধস পরিবর্তন আসবে ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিতে। মধ্যপন্থী ও ডানঘেঁষা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এই দল অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কম জনপ্রিয়। এই দলে যাঁরা নেতৃত্বে, তাঁদের অধিকাংশই বয়োবৃদ্ধ, করপোরেট আমেরিকার কাছে এদের হাত-পা বাঁধা। ইসরায়েল প্রশ্নে তাদের সমর্থন এখনো আগের মতো নতজানু।
পিউ রিসার্চের তথ্য অনুসারে, ইসরায়েল প্রশ্নে এখন নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে এমন আমেরিকানের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ, যা তিন বছর আগের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। একইভাবে ধনতন্ত্রের প্রতিও আমেরিকানদের সমর্থন নিম্নগামী। গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।
অন্যদিকে ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান পার্টি খোলামেলাভাবে অভিবাসনবিরোধী, দক্ষিণপন্থী, খ্রিষ্টবাদী ও রক্ষণশীল। চলতি সপ্তাহের নতুন উদ্বাস্তু নীতিতে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন শ্বেতকায় ও ইউরোপীয় আশ্রয়প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেবে। এই অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতকায় নাগরিকবৃন্দ, ট্রাম্প প্রশাসনের চোখে যারা সে দেশের সরকারের বৈষম্যের শিকার।
এই প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান পার্টির বিপরীতে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন গড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও কংগ্রেস সদস্য ওকাসিও-কর্তেজ ইতিমধ্যে এই আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। সবাই মানেন, মামদানির মতো তরুণ ও বুদ্ধিমান নেতৃত্ব এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে।
এই সম্ভাবনার কথা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন বার্নি স্যান্ডার্স। তাঁর কথায়, এই দেশ করপোরেট আমেরিকার নির্দেশে চলবে, না তার রাজনীতির কেন্দ্রে থাকবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ—এ মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ‘যদি আমরা দ্বিতীয় পথটি বেছে নিতে চাই, করপোরেট আমেরিকার বদলে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে আমাদের মামদানির পাশে দাঁড়াতে হবে।’
কোন পথ বেছে নেবে নিউইয়র্ক, মঙ্গলবারেই তা নিশ্চিত হবে।