প্রতিবছরই ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে বিআরটিএ ও হাইওয়ে পুলিশ ঈদের আগে বিভিন্ন অংশীজনদের নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করে। এসব বৈঠকে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয় যে কোনোভাবেই ঈদযাত্রায় লক্করঝক্কড় ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলতে দেওয়া হবে না; রাজধানীর সিটি সার্ভিসের বাস কোনোভাবেই দূরপাল্লায় চলতে দেওয়া হবে না; কোনোভাবেই ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে যাত্রী বহন করতে দেওয়া হবে না। সঙ্গে আরও বলা হয় যে ঈদযাত্রায় বাড়তি ভাড়া আদায় কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে; সড়ক-মহাসড়কের চাঁদাবাজি যেকোনো মূল্যে রুখে দেওয়া হবে ইত্যাদি।

কিন্তু বাস্তবে এসবের তেমন কিছুই ঘটে না। ঘটার কথাও নয়। কারণ, ঈদযাত্রায় মাত্র তিন/চার দিনে ঢাকা থেকে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা করেন। এত অল্প সময়ে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ পরিবহন করার মতো মানসম্মত গণপরিবহন দেশে নেই। রেলসেবা তো ব্যাপকভাবে অপর্যাপ্ত। নৌপরিবহন ও নৌ রুট সুবিধাজনক নয়। সুতরাং মানুষ আপনজনের টানে ঝুঁকি নিয়ে সড়কপথেই যাত্রা করেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো এই দৃশ্য শুধু নির্বিকারভাবে দেখতে থাকে। সড়কের চাঁদাবাজি, বাড়তি ভাড়া আদায় ও অনিরাপদ যানবাহন চলাচল বন্ধে তাদের তেমন কোনো তৎপরতা দৃশ্যমান হয় না। তবে কোনো কোনো বছর আবহাওয়া ও সড়ক ভালো থাকা সাপেক্ষে পুলিশ বাহিনীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় মানুষ কিছুটা যানজটমুক্ত ঈদযাত্রা করতে পারেন।

আসলে একটি নির্বিঘ্ন-নিরাপদ ঈদযাত্রা নিশ্চিত করতে হলে ঈদের ১০/১৫ দিন বা ১ মাস আগে বৈঠক করে কর্মপরিকল্পনা সাজালে হবে না। এ জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে তিন বছরের একটি মধ্যমেয়াদি টেকসই সমন্বিত পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার অধীনে রেললাইন সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে সড়কপথের মানুষকে ট্রেনমুখী করতে হবে। নদীপথ সংস্কার ও জনবান্ধব করতে হবে। সড়কে বিআরটিসির রুট বিস্তৃত করে বাড়াতে হবে বাসের সংখ্যা। একই সঙ্গে সড়কের সব মেয়াদোত্তীর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বন্ধ করতে হবে। ঈদযাত্রায় পোশাকশ্রমিকেরা যাতে পর্যায়ক্রমে ছুটি উপভোগ করতে পারেন, সে জন্য পরিকল্পনা সাজাতে হবে। ব্যবস্থা করতে হবে পোশাকশ্রমিকদের জন্য অঞ্চলভিত্তিক যানবাহনের। এসব উদ্যোগ ঠিকমতো বাস্তবায়ন করলে ঈদযাত্রা সুস্থ, স্বাভাবিক ও নিরাপদ করা সম্ভব হবে।

মহাসড়কে দ্রুতগামী বড় যানবাহনের সঙ্গে স্বল্পগতির ছোট যানবাহন সিএনজি, অটোরিকশা, নছিমন, ভটভটি ইত্যাদির সংঘর্ষ ঘটছে অহরহ। এসব দুর্ঘটনায় অধিক প্রাণহানি ঘটছে। অনেক সময় পুরো পরিবার নিহত হচ্ছে। এ জন্য মহাসড়কে ধীরগতির ছোট যানবাহন চলাচল বন্ধ করা জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের গ্রামীণ সড়কগুলো মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এসব সড়ক যদি মহাসড়কে সংযুক্ত না হয়ে পাশ দিয়ে চলে যেত, তাহলে ছোট ছোট যানবাহনকে মহাসড়ক ব্যবহার করতে হতো না। মূলত গ্রামীণ সড়কের ধীরগতির যানবাহনগুলো স্বল্প দূরত্বে চলাচলের সময় মহাসড়ক ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। এ ছাড়া আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়কগুলোর সঙ্গে মহাসড়কের সংযোগ একেবারে সরাসরি হওয়ার কারণে ছোট যানবাহনগুলো সরাসরি মহাসড়কে উঠে পড়ছে। ফলে বড় যানবাহনগুলো হঠাৎ ব্রেক করতে না পেরে ধাক্কা বা চাপা দিচ্ছে। কাজেই গ্রামীণ সড়ককে মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত না রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আর যদি সংযুক্ত করতেই হয়, তাহলে ধীরে ধীরে করতে হবে। হঠাৎ করে সরাসরি নয়।

উল্লেখ্য যে বিকল্প সড়ক না থাকার কারণে যেসব মহাসড়কে ছোট ধীরগতির যানবাহন চলতে দিতেই হবে, সেসব মহাসড়কে সার্ভিস রোড নির্মাণ করতে হবে। রোড ডিভাইডার না থাকলে কিছুদূর অন্তর ফিতা টানিয়ে হলেও সড়কে বিভাজক তৈরি করা যায়। মোটরসাইকেলের জন্য মহাসড়কে লেন থাকতে হবে। তবে গণপরিবহন সহজ ও সাশ্রয়ী করে মোটরসাইকেলকে নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। মোটরসাইকেল কোনোভাবেই দূরপাল্লার গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে না। মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীদের মানসম্পন্ন হেলমেটের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। মানসম্পন্ন হেলমেট সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঝুঁকি ৪৮ শতাংশ রোধ করে। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়িয়ে প্রতিটি যানবাহনের গতিসীমা মানার বাধ্যতা নিশ্চিত করা দরকার। আর আইনের কঠোর প্রয়োগের ফাঁক তো রয়েই গেছে। সেই ফাঁক পূরণ করতে হবে।
সড়ক পরিবহন খাতের অস্থিরতা ও অব্যবস্থাপনার প্রধান কারণ পথেঘাটে রাজনৈতিক পোশাকের বেপরোয়া চাঁদাবাজি। এই অপকর্মের সঙ্গে পুলিশের কিছু অসাধু ব্যক্তিও জড়িত থাকেন। চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারকে কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। যদি রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের চাঁদাবাজি বন্ধ করা যায়, তাহলে পুলিশের অসাধু কর্মকর্তারাও চাঁদাবাজি করতে সাহস পাবেন না।

মোটরসাইকেল তৈরি ও বিপণন কোম্পানিগুলো যে ভাষা ও ভঙ্গিতে বিজ্ঞাপন প্রচার করে, তা সংশোধন করতে হবে। তাদের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তরুণ-যুবক শ্রেণি মোটরসাইকেলের গতির প্রতিযোগিতায় উৎসাহিত হচ্ছে। তরুণ-যুবারা গতির মধ্যে রোমাঞ্চ অনুভব করেন। তাই মোটরসাইকেলের বিজ্ঞাপন অবশ্যই জীবনমুখী হতে হবে।

সড়কে নিরাপদে চলাচলের জন্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের প্রতি দলীয় প্রধানের নির্দেশনা থাকতে হবে। মসজিদে নামাজের খুতবায় নিরাপদ সড়ক ব্যবহারের বিষয়ে বয়ান থাকতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক বিভিন্ন আয়োজন করতে হবে। এসব উদ্যোগের ধারাবাহিকতা থাকলে সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে।

পরিবহনশ্রমিকদের নিয়োগ, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকার কারণে অধিকাংশ চালক মানসিক ও শারীরিকভাবে অস্থির ও অসুস্থ থাকেন। ফলে দুর্ঘটনা বাড়ছে। তাই নিরাপদ যানবাহন চালনা নিশ্চিত করতে হলে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ অনুযায়ী পরিবহনের চালক ও শ্রমিকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

এসব উদ্যোগের পাশাপাশি গণমাধ্যমে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে আধেয় তৈরি করে নিরাপত্তা যে একটি সংস্কৃতি এবং জীবনেরই অংশ, মানুষের মধ্যে এই উপলব্ধি তৈরি করতে হবে। সচেতনতামূলক জীবনমুখী এসব কনটেন্ট বিটিআরসির মাধ্যমে এমনভাবে প্রচার করতে হবে যাতে ফেসবুক দেখার সময় স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। বিজ্ঞাপনের মতো বারবার এগুলো মানুষের সামনে আনতে হবে। সড়কের নিরাপত্তাবিষয়ক আধেয় এভাবে প্রচার করলে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি মানুষের মনে গেঁথে যাবে।

উল্লেখ্য, ঈদযাত্রা নিরাপদ করার জন্য সরকারিভাবে নেওয়া উদ্যোগগুলো ঈদপূর্ব যাত্রায় যতটা সক্রিয় থাকে, ঈদপরবর্তী ফিরতি যাত্রায় ততটা সক্রিয় থাকে না। ফলে ঈদের ফিরতি যাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। এটা প্রতি ঈদ মৌসুমের চিত্র। ঈদপূর্ব ঘরমুখী যাত্রায় মানুষের কিছুটা আর্থিক সঙ্গতি থাকে, তাঁরা মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকেন। কিন্তু ঈদপরবর্তী ফিরতি যাত্রায় ছুটি শেষ হয়ে যায়। খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষকে ফিরতে হয়। এ সময় মানুষের আর্থিক সঙ্গতি কম থাকে। মানসিক অবস্থাও থাকে বিষণ্ন। ফলে তাঁরা তাড়াহুড়া করে যেনতেনভাবে ফিরতে চান, যা দুর্ঘটনা বেশি ঘটার কারণ হিসেবে কাজ করে। তাই এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিরাপদ ঈদযাত্রা নিশ্চিত করার কর্মকৌশল সাজাতে হবে। তবে এ জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে তিন বছরের মধ্যমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনা।

সাইদুর রহমান নির্বাহী পরিচালক-রোড সেফটি ফাউন্ডেশন

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সড়ক ব যবহ র ন শ চ ত করত গ র ম ণ সড়ক ন শ চ ত কর ঈদয ত র য় সড়ক র স দ র ঘটন পর বহন র জন য ন র পদ র বহন

এছাড়াও পড়ুন:

আরও বিস্তৃত হয়েছে শ্রমিকের সংগ্রামের জমিন 

মে দিবস। পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষের দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন শ্রমিকেরা। পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ প্রাণ হারান। কিন্তু সেই রক্তের বিনিময়েই কাগজে–কলমে হলেও প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমের মর্যাদা, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি ও সংগঠনের অধিকার। একসময় এসব দাবিই রূপ নেয় আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের ভিত্তিতে।

কিন্তু ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা যখন এই দিনে ফিরে তাকাই, তখন প্রশ্ন আসে, এখনো কি সেই সব দাবি প্রাসঙ্গিক? নাকি সময় পাল্টে দিয়েছে সব? এখন তো কাজের ধরনই বদলে গেছে—একদিকে অটোমেশন, অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়যাত্রা। উৎপাদনের পদ্ধতি যেভাবে বদলেছে, তাতে পুরোনো ধরনের শ্রমিক যেন ক্রমে অদৃশ্য হয়ে পড়ছেন।

আজকের দুনিয়ায় পুঁজি এক ক্লিকে দেশান্তরিত হয়, কারখানা গড়ে ওঠে যেখানে মজুরি কম এবং আইনের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল। মানুষ এখন আর কেবল শ্রমিক নয়; তাঁদের বলা হচ্ছে ‘ফ্রিল্যান্সার’, ‘কন্ট্রিবিউটর’, ‘পার্টনার’, ‘ডেলিভারি ম্যান’। কিন্তু আসলে, এদের অনেকেই এক নতুন ধরনের দিনমজুর; যাঁদের নেই নিরাপত্তা, নেই সুনির্দিষ্ট অধিকার। কাজ করছেন তাঁরা—কখনো রাস্তায় খাবার পৌঁছে দিয়ে, কখনো কম্পিউটারে চ্যাটবট প্রশিক্ষণ দিয়ে, আবার কখনো অ্যালগরিদম পরিশোধনে; কিন্তু কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন। তাঁরা জানেন না যে তাঁদের কাজের ফল কোথায় যাবে, কীভাবে ব্যবহৃত হবে।

এই ব্যবস্থার একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে অ্যামাজন। তাদের গুদাম ও সরবরাহ চেইনে রোবট, ড্রোন ও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। শ্রমিকেরা সেখানে নির্ধারিত সময়ের বেশি কাজ করতে বাধ্য হন, মেশিনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অথচ যখন তাঁরা সংগঠিত হতে চান, তখন কোম্পানির বিরুদ্ধে ওঠে লবিং, বিরোধিতা, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ। ২০২৩ সালে অ্যামাজনের একাধিক গুদামে ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টাকে রুখে দিতে কোম্পানিটি কোটি কোটি ডলার খরচ করে আইনি দল গঠন করে।

মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়; সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে না

শুধু অ্যামাজন নয়, গোটা দুনিয়াতেই শ্রমের এক নতুন রূপ তৈরি হচ্ছে—ডিজিটাল ও প্ল্যাটফর্মভিত্তিক শ্রম। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকেরা কাজ করেন উবার, ফুডপান্ডা, আপওয়ার্ক বা ফাইভারের মতো অ্যাপে যুক্ত হয়ে। অথচ তাঁদের নেই কোনো কর্মস্থল, নেই কর্মঘণ্টার নিশ্চয়তা, নেই অসুস্থতার ছুটি বা পেনশনের মতো সামাজিক সুরক্ষা। বাস্তবে তাঁরা একা, বিচ্ছিন্ন। প্রতিযোগিতার চাপে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় অনিরাপত্তার ভেতর।

২০২৩ সালের একটি আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের অন্তত ৮০% গিগ-ওয়ার্কার দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। অথচ তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ মাস শেষে কোনো নির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি পান না। গ্লোবাল গিগ ইকোনমির এই বাস্তবতা বাংলাদেশেও দৃশ্যমান। আমাদের শহরগুলোয় এখন হাজারো বাইক বা সাইকেলচালক কাজ করছেন খাবার কিংবা পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য, কিন্তু তাঁরা কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন।

এর পাশাপাশি আরও একটি বড় পরিবর্তন এনেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান। প্রশ্ন উঠেছে, এআই কি শ্রমিকের বন্ধু, না প্রতিদ্বন্দ্বী? যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার এক গবেষণা অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরে এআই কমপক্ষে ৮০ কোটি মানুষের কাজের ধরন পাল্টে দেবে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ সম্পূর্ণভাবে কাজ হারাতে পারেন। হোয়াইট-কলার পেশাগুলো যেমন হিসাবরক্ষণ, গ্রাহকসেবা, এমনকি সাংবাদিকতার কাজও এই প্রযুক্তির কারণে সংকটে পড়ছে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২৩ সালের ‘দ্য ফিউচার অব জবস’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৮ কোটি ৫০ লাখ কাজ হারিয়ে যাবে প্রযুক্তি ও অটোমেশনের কারণে। তবে একটা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। যদি উৎপাদিত পণ্যের খরিদ্দার না থাকে, তাহলে উৎপাদন করে কীভাবে মুনাফা আসবে? আর শ্রমিক না থাকলে কিনবে কে? তবে একই সময়ে ৯ কোটি ৭০ লাখ নতুন ধরনের কাজের সৃষ্টি হতে পারে। কাজগুলো হবে ডেটা অ্যানালিটিকস, প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালনা এবং সৃজনশীল ও মানবিক দক্ষতানির্ভর কাজ। এই নতুন শ্রমিকদের অবস্থার কথা ওপরে বলা হয়েছে।

কিন্তু এই নতুন কাজের মালিকানা কার হাতে? শ্রমিকদের নয়, রাষ্ট্রেরও নয়—এই ক্ষমতা এখন করপোরেট অলিগার্কদের হাতে কেন্দ্রীভূত। যুক্তরাষ্ট্রে ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, মার্ক জাকারবার্গদের মতো প্রযুক্তি ধনকুবেররা শুধু প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রকই নন, তাঁরা রাজনীতিতেও সরাসরি প্রভাব ফেলছেন। করপোরেট লবিংয়ের মাধ্যমে আইন তৈরির পেছনে তাঁদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে; যেমন ট্যাক্স ছাড়, শ্রম আইন শিথিলকরণ বা প্রতিযোগিতা নীতির ধ্বংস।

বাংলাদেশেও দৃশ্যপট খুব আলাদা নয়। তৈরি পোশাকশিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাঁরা দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের ভিত্তি। কিন্তু তাঁরা এখনো ন্যূনতম মানবিক মজুরি পান না। গত বছর শ্রমিকেরা ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা মজুরি চাইলেও সরকার তা নামিয়ে ১২ হাজারে নিয়ে আসে। আন্দোলনের জবাবে আসে পুলিশি দমন, ধরপাকড়, ভয়ের পরিবেশ। মালিকেরা নতুন প্রযুক্তি বসিয়ে আরও কম শ্রমিক দিয়ে আরও বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করবেন। আগে–পরে এটা অবধারিত।

এই প্রেক্ষাপটে মে দিবস আজ আমাদের সামনে এক নতুন প্রশ্ন তোলে—শ্রমিক আসলে কে? তাঁর অধিকার কী? আর লড়াইটা কিসের জন্য?

যদি শ্রমিকের সংজ্ঞাই বদলে যায়, তাহলে লড়াইয়ের রূপও কি পাল্টাতে হবে না? একসময়ের আট ঘণ্টার কাজের দাবি এখন হয়তো পুরোনো মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে বহু মানুষ এখনো দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। কেউ কাজ পাচ্ছেন না, কেউ কাজ করেও মাস শেষে ঠিকমতো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। কেউ এমন এক ধরনের ডিজিটাল শ্রম করছেন, যার নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা তাঁর নয়, তিনি জানেনই না যে কার জন্য কাজ করছেন।

তাই আজ মে দিবস শুধু অতীত স্মরণের দিন নয়—এটি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনারও দিন। এটি নতুন ধরনের দাবির জায়গা—ডিজিটাল শ্রমের স্বীকৃতি, গিগ-ওয়ার্কারদের অধিকার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি। আর অবশ্যই আমাদের মতো দেশে গায়ে খাটা শ্রমের ন্যায্য মজুরির দাবি।

মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়, সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক, শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে না।

এই সত্য যত দিন থাকবে, মে দিবস তত দিন থাকবে; নতুন প্রশ্ন নিয়ে, নতুন লড়াই নিয়ে।

জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

সম্পর্কিত নিবন্ধ