‘আগের ঈদেও দুই মেয়ের জন্য দুই সেট করে জামা কিনে দিল যে মানুষটা, সে আর নাই।
এহন আমাগো ঈদ নাই। ঈদডা এহন পাথরের মতো ভারী একটা বোঝা।’ এভাবেই নিজের কষ্টের কথা বলছিলেন জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে শহীদ ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক আকাশ বেপারির স্ত্রী লাকী আক্তার। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরার রাজলক্ষ্মীতে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় তাঁর স্বামীর। সেই থেকে দুঃসহ স্মৃতির বোঝা বয়ে বেড়ানো শুরু। সেই সঙ্গে তিন সন্তানকে নিয়ে
খেয়েপরে বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই এখন তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী।
অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতরা সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেলেও আকাশ বেপারির জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকা-সংক্রান্ত জটিলতায় পরিবারটি জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে কোনো অর্থ পায়নি। গত বৃহস্পতিবার উত্তরার বাউনিয়া বটতলা এলাকার বাসায় কথা হয় লাকী আক্তারের সঙ্গে। ঈদের কেনাকাটা কিছু হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলছিলেন, ‘সেমাই-চিনি কিনতে পারিনি এখনও। আমার বড় ছেলেটা প্রতিবন্ধী, আর দুই মেয়ে আছে। বাসা ভাড়া, ভরণপোষণ করে এই সংসার চালানো কঠিন, ঈদের কেনাকাটা করার অবস্থা আমার নাই।’
আকাশ বেপারির বড় মেয়ে কণা আক্তার (১৫) বলছিল, ‘ঈদের আগে আব্বু গভীর রাত করে বাসায় ফিরতেন, বেশি টাইম ভাড়া মারতেন। গত ঈদেও আমরা সবাই উত্তরার রাজলক্ষ্মীতে গিয়ে জামা কিনেছিলাম। আমরা জামাকাপড় কিনলেও বাবা কিছু কিনতে চাইতেন না। গত ঈদে বলছিলাম, তুমি না নিলে আমি কিছু কিনব না। তখন বললেন, আমার পাঞ্জাবিটা তো এখনও নতুনই আছে। অথচ ওই পাঞ্জাবিটা আরও দুই ঈদ আগে কেনা।’
ধানমন্ডির সায়েন্সল্যাব এলাকায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের সামনে গত বছরের ১৯ জুলাই হেলিকপ্টার থেকে আসা গুলিতে শহীদ হন ১৯ বছর বয়সী আল আমিন শুভ। শুভর মা রেণু বেগমের সঙ্গে কথা হয় বৃহস্পতিবার ইফতারের আগে। তিনি বলেন, ‘শুভ রিকশা চালায়ে ২৫ রোজার আগেই ভাই-বোনদের জামা কিনা দিত। গত ঈদে ওদের সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও কাপড় কিনা দিছে। এতদিন অনেক অর্থকষ্টে ভুগেছি। তবে কয়দিন আগে আমি চার লাখ এবং শুভর বাবা ১ লাখ টাকা জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাইছে। বড় ছেলে সোহানকে একটা অটোরিকশা কিনে দেব ভাবছি।’
রাজধানীর পান্থপথে গত বছর ১৯ জুলাই আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালালে প্রাণ হারায় ১৩ বছরের শিশু মোবারক হোসাইন। কাঁঠালবাগানের বক্স কালভার্ট রোডে মোবারকের বাবা রমজান আলী ও মা ফরিদা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। ঈদ প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রমজান আলী বলেন, ‘আমরা তো বড়, আমাদের তো পোশাক-আশাক কেনার তেমন তাড়া থাকে না। কিন্তু মোবারককে ঈদের কয়েকদিন আগেই কিনে দিতাম যতটুকু পারতাম।’
অশ্রুসজল চোখে রমজান আলী বলেন, ‘ঈদের দিন মোবারক গরুর মাংস খেতে পছন্দ করত। নতুন জামাকাপড় পরে বন্ধুদের নিয়ে ঘোরাঘুরি করত। সন্তানের আনন্দ দেখতেই ভালো লাগে। এইবার আমার কলিজার টুকরা আজিমপুর কবরস্থানে ঘুমায়। আমাদের জীবনে আর কীসের ঈদ।’
আন্দোলনকালে হতাহতের তথ্য সংগ্রহ, তালিকা প্রস্তুত ও প্রামাণ্যচিত্র তৈরিতে কাজ করছে ‘জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স’। সংগঠনটির আহ্বায়ক সালেহ মাহমুদ রায়হান সমকালকে বলেন, ‘শহীদ পরিবার ও আহতদের প্রাপ্য সম্মানটুকু বুঝিয়ে দিতে সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনকে আরও তৎপর হতে হবে। এমনও পরিবার আছে, যারা নিরুপায় হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। ফাউন্ডেশন ও সরকার যা করছে, এর গতি আরও বাড়ানো সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিছু পরিবারের ক্ষেত্রে এমন আছে– কাগজপত্র ঠিকমতো নেই, তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। অনেক পরিবারে হয়তো শহীদের বাবা-মায়ের সঙ্গে শহীদের স্ত্রীর বোঝাপড়া ভালো নেই। স্ত্রী-সন্তান অর্থ পাচ্ছে, সেটা তাদের প্রাপ্য। কিন্তু অসহায় বাবা-মা থাকলে তাদের জন্যও একটা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অভ য ত থ ন পর ব র বলছ ল সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
অটোরিকশার ধাক্কায় ছিটকে বাসের নিচে, দুই বন্ধু নিহত
রাজধানীতে অটোরিকশার ধাক্কায় ছিটকে বাসের নিচে পড়ে দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। গতকাল বুধবার বনশ্রীর এফ ব্লক সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এদিন মতিঝিলের ফকিরাপুল মোড়ে প্রাইভেট কারের চাপায় আব্দুল মতিন (৩৬) নামে এক রিকশাচালক নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া পাঁচ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ছয়জন প্রাণ হারিয়েছেন।
বনশ্রীতে নিহত দু’জন হলেন– আব্দুল্লাহ আল নোমান (২১) ও পাভেল মিয়া (২০)। নোমানের মামা আব্দুল হামিদ জানান, নিহতরা পরস্পর বন্ধু। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে ঢাকায় ঘুরতে যাওয়ার সময় দু’জন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। তারা রূপগঞ্জের নামারমুসুরি এলাকায় থাকতেন। নোমান মুড়াপাড়া ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। পাভেল তেমন কিছুই করতেন না। এ ঘটনায় নোমানের পরিবারের পক্ষ থেকে সড়ক নিরাপত্তা আইনে খিলগাঁও থানায় মামলা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী মোটরসাইকেল চালক টিপু সুলতান বলেন, সড়কটি যানবাহনে ঠাসা ছিল। এ কারণে গাড়ি চলছিল ধীরগতিতে। হঠাৎ একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা পাশ থেকে এসে নোমানের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এতে দু’জন সড়কের ওপর ছিটকে পড়েন। পরে মিয়ামি পরিবহনের একটি বাস তাদের চাপা দেয়। নোমান ঘটনাস্থলেই মারা যান। মোটরসাইকেল আরোহী পাভেলকে গুরুতর আহত অবস্থায় ফরাজী হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
খিলগাঁও থানার ওসি দাউদ হোসেন জানান, বাসটি জব্দ করা হয়েছে। চালক ও তার সহকারী পালিয়ে গেছে। অটোরিকশা চালককেও আটক করা যায়নি। মরদেহ দুটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পাঠানো হয়েছে।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফকিরাপুল মোড়ে প্রাইভেটকারের চাপায় প্রাণ হারান রিকশাচালক আব্দুল মতিন। তাঁর বাড়ি রংপুরে। তিনি মুগদার মাণ্ডা এলাকায় একটি রিকশার গ্যারেজে থাকতেন। মতিঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাইমিনুল ইসলাম জানান, প্রাইভেটকারের চালক আল আমিনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়েছে। ময়নাতন্ত শেষে পরিবারের কাছে মতিনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার রাতে বিমানবন্দর থানার সিভিল এভিয়েশন কোয়ার্টার গেটের (সি-টাইপ) সামনের ফুটপাত থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার বয়স আনুমানিক ২৫ বছর। বিমানবন্দর থানার এসআই আমিনুল ইসলাম বলেন, ওই যুবকের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে। মরদেহ ঢামেক মর্গে রাখা হয়েছে।
সড়কে ঝরল আরও ছয় প্রাণ
খুলনার ডুমুরিয়ায় তেলবাহী লরির চাপায় দুই নারী নিহত হয়েছেন। গতকাল বিকেলে উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের নরনিয়া মহিলা মাদ্রাসার কাছে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন– রোকেয়া বেগম (৫৫) ও রশিদা বেগম (৪৫)।
গতকাল সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাছে সেলফি পরিবহনের বাসের ধাক্কায় শামসুল হক নামে এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন। তিনি গাজীপুরের শ্রীপুরে গণস্বাস্থ্য উপকেন্দ্রের নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন। সাভার থেকে অবসরের পাওনাদি নিয়ে ফেরার পথে তিনি প্রাণ হারান। শামসুলের বাড়ি চাঁদপুরে। ঘটনার পর গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মচারীরা সেলফি পরিবহনের পাঁচটি বাস আটক করেন।
এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অটোরিকশা ও পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষে নয়ন মিয়া (৩৭) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১০ জন। গতকাল বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়া ইউনিয়নের রতনদী এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে দুই মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে শান্ত ইসলাম (১৮) নামে এক তরুণ নিহত হয়েছেন। গতকাল উপজেলার কুষ্টিয়া-প্রাগপুর সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। শান্ত মথুরাপুর পশ্চিমপাড়া গ্রামের রিপন মণ্ডলের ছেলে।
রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মৃগী বাজারে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কে ছিটকে পড়ে স্বপন শীল নামে এক স্যালুন ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। গতকাল ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র বিলি করতে বেরিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি।