ফাইব্রোমাইলজিয়া: যে ব্যথার কারণ বোঝা দুষ্কর
Published: 8th, April 2025 GMT
ফাইব্রোমাইলজিয়া একটি ক্রনিক অবস্থা, যেখানে রোগীর শরীরে বিস্তৃত ব্যথা, ক্লান্তি ও ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়। রোগীর মধ্যে প্রায়ই মানসিক অসুস্থতা যেমন উদ্বেগ ও বিষণ্নতা থাকে। এই রোগ সাধারণত নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। অবশ্য পুরুষেরাও আক্রান্ত হতে পারেন।
ফাইব্রোমাইলজিয়া একটি দীর্ঘস্থায়ী, জটিল ব্যথা ও ক্লান্তিজনিত অসুস্থতা, যা সাধারণত শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা ও সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করে।কেন হয়
ফাইব্রোমাইলজিয়ার সঠিক কারণ এখনো পুরোপুরি শনাক্ত হয়নি। তবে গবেষণায় কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ চিহ্নিত হয়েছে—
ব্যথাপ্রক্রিয়া: মস্তিষ্কে ব্যথার সংকেতপ্রক্রিয়ায় অস্বাভাবিকতা থাকলে এই রোগ দেখা দিতে পারে।
জেনেটিক প্রভাব: পরিবারের ইতিহাস থাকলে রোগটি হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
পরিবেশগত ও মানসিক চাপ: শারীরিক আঘাত, মানসিক চাপ অথবা দীর্ঘমেয়াদি স্ট্রেস রোগের উদ্রেক ঘটাতে পারে।
উপসর্গ
ব্যথার ধরন: ফাইব্রোমাইলজিয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়া ব্যথা, যা সাধারণত পেশি ও সংযোগস্থলে (জয়েন্ট) অনুভূত হয়।
অতিমাত্রায় ক্লান্তি: রোগী প্রচুর ক্লান্তি ও শক্তিহীনতা অনুভব করেন, যা তাঁদের দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করে।
ঘুমের সমস্যা: অনেক সময় রোগীরা পর্যাপ্ত বা গভীরভাবে ঘুমাতে পারেন না, ফলে দিনের শুরুতেই তাঁদের ক্লান্তি বাড়ে।
মস্তিষ্কে অস্পষ্টতা (ফাইব্রো ফগ): কখনো কখনো স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ ও চিন্তাশক্তিতে সমস্যা অনুভব করেন, যা ‘ফাইব্রো ফগ’ নামে পরিচিত।
মাথাব্যথা: ফাইব্রোমাইলজিয়ায় আক্রান্ত অনেক রোগী মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনের সমস্যায় ভোগেন।
মানসিক ও আবেগীয় পরিবর্তন: দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা ও ক্লান্তির কারণে রোগীদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও মানসিক চাপ দেখা দেয়।
অন্যান্য
শব্দ বা আলোয় অতিসংবেদনশীলতা, হজমজনিত সমস্যা, যেমন ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (আইবিএস) দেখা দিতে পারে।
ফাইব্রোমাইলজিয়ার উপসর্গগুলো ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন হতে পারে এবং একাধিক উপসর্গ একসঙ্গে উপস্থিত থাকতে পারে।
চিকিৎসা কী
ফাইব্রোমাইলজিয়া পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব নয়। তবে বিভিন্ন পন্থায় উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ ও রোগীর জীবনমান উন্নত করা যায়। রোগটি নির্ণয় বা শনাক্ত করা কঠিন। একজন অভিজ্ঞ বাতরোগ বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার পরিকল্পনা করা উচিত।
মনস্তাত্ত্বিক থেরাপি (সাইকোথেরাপি): উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক। কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (সিবিটি) রোগীর মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে ব্যথা ও ক্লান্তির সঙ্গে মোকাবিলা করতে সাহায্য করে। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা কিছু রোগীর ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে।
জীবনধারার ইতিবাচক পরিবর্তন যেমন—নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এম ইয়াছিন আলী, চেয়ারম্যান ও চিফ কনসালট্যান্ট, ঢাকা সিটি, ফিজিওথেরাপি হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
গবাদিপশু থেকে মানুষের শরীরে ‘তড়কা’ রোগ, প্রতিরোধে যা করবেন
অ্যানথ্রাক্স রোগটি‘তড়কা’ নামেই বহুল পরিচিত। গ্রীক শব্দ ‘অ্যানথ্রাকিস’ বা কয়লা থেকে উদ্ভূত এই নামটি হয়তো অনেকেই জানেন না। তবে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ ঠিকই অবগত।
অ্যানথ্রাক্স নামের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগটি শুধু বন্য বা গৃহপালিত পশুকে নয়, বরং মানুষের জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে বারবার।
আরো পড়ুন:
১৬ দিন ধরে অচলাবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ বাকৃবি ছাত্রশিবিরের
দ্রুত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালুর দাবি বাকৃবি শিক্ষার্থীদের
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, দেশের অ্যানথ্রাক্স পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক। সাধারণত গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়াকে আক্রান্ত করে এই ব্যাকটেরিয়া। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই রোগে মারা গেছে অন্তত ১ হাজার গবাদিপশু। আর আক্রান্ত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
সম্প্রতি রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্তের রিপোর্ট করেছেন অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ। এরইমধ্যে এ রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন দুইজন, যা নিশ্চিত করেছেন রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০টিরও বেশি মানব অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার সবগুলোই ছিল ত্বকের অ্যানথ্রাক্স। তবে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৬ হাজার ৩৫৪টি পশুর অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯৯৮টি পশুর মৃত্যু হয়েছে। সে হিসাবে মোট মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ১৫.৭ শতাংশে।
গবেষণার তথ্য মতে, বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ১৯৮০ সালে। এরপর থেকে এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বারবার ফিরে এসেছে। বিশেষ করে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও মেহেরপুর জেলাকে ‘অ্যানথ্রাক্স বেল্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে এ রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা ময়মনসিংহ, পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলাকে যথাক্রমে উচ্চ, মাঝারি ও নিম্ন-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে, বিশেষত এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।
অ্যানথ্রাক্সের মূল কারণ হলো- ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামের একটি ব্যাকটেরিয়া, যা সাধারণত মৃত পশুর দেহে পাওয়া যায়। এটি এতই শক্তিশালী যে, জৈবিক অস্ত্র হিসেবেও এর ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে। এই ব্যাকটেরিয়া বাতাসে উড়ন্ত স্পোর তৈরি করতে পারে, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
অ্যানথ্রাক্স নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের স্নাতক রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট অর্ণব সাহা।
তিনি বলেন, “মানুষ তিনভাবে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে— ত্বকের মাধ্যমে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এবং খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে। এর মধ্যে ত্বকের অ্যানথ্রাক্স সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এবং এর সুপ্তিকাল সাধারণত দুই থেকে ছয়দিন।”
অন্যদিকে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংক্রমিত অ্যানথ্রাক্সের সুপ্তিকাল গড়ে চারদিন, যা ১০-১১ দিন পর্যন্তও হতে পারে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট আক্রান্তের ৯১.৩ শতাংশ মানুষই ত্বকের অ্যানথ্রাক্সে ভুগেছে, যেখানে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল এবং উভয় ধরনের সংক্রমণ ছিল যথাক্রমে ৬.৫২ শতাংশ ও ২.৬৬ শতাংশ।
ত্বকীয় অ্যানথ্রাক্সের ক্ষেত্রে চামড়ায় প্রথমে একটি চুলকানিযুক্ত লাল ফোঁড়া দেখা যায়, যা পরবর্তীতে কালো কেন্দ্রযুক্ত ব্যথাহীন ঘা হিসেবে প্রকাশ পায়। উলের কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যাওয়ায় এটি ‘উল-সর্টার্স ডিজিজ’ নামেও পরিচিত।
সবচেয়ে মারাত্মক ধরণ হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের অ্যানথ্রাক্স। ব্যাকটেরিয়ার স্পোর শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে ঠান্ডা, জ্বর ও কাশির মতো উপসর্গ দেখা যায়, যা দ্রুত শ্বাসকষ্ট, শক এবং উচ্চ মৃত্যুহারের দিকে নিয়ে যায়।
অর্ণব বলেন, “প্রাণীদের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স হলে হঠাৎ মৃত্যু সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ। মৃত পশুর নাক, মুখ ও মলদ্বার থেকে কালচে, জমাট না বাঁধা রক্ত বের হয় এবং পেট ফুলে যায়।”
রোগটির প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিষয়ে বাকৃবি মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম কারণ হলো জনসচেতনতার অভাব। অসুস্থ পশু জবাই করে তার মাংস কম দামে বিক্রি করার একটি প্রবণতা আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান। অনেক বিক্রেতা ও সাধারণ মানুষ জানেনই না যে, এই মাংস থেকে মানুষের শরীরেও রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
“পাশাপাশি, মৃত পশুর দেহ সঠিক উপায়ে অপসারণ না করে খোলা মাঠে, নদী, খাল বা বন্যার পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। এর ফলে এই জীবাণু পরিবেশ ও পশুপালনের জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, যা নতুন করে সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করে,” যুক্ত করেন ড. গোলজার।
তিনি বলেন, “অ্যানথ্রাক্সের বিস্তার রোধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ এই রোগের বিস্তার রোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম- জনসচেতনতা বৃদ্ধি। পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধে জনশিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো গবাদি পশুর মধ্যে নিয়মিত এবং ব্যাপক হারে টিকাদান নিশ্চিত করা। সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত টিকাদান কর্মসূচিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে। আমদানি করা ও জবাই করা পশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টাইন করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।”
ড. গোলজার বলেন, “এছাড়া মৃত পশুর দেহ ও দূষিত পদার্থ সঠিকভাবে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে এবং অনুমোদিত মাংস বিক্রেতাদের মাধ্যমে এবং পশু চিকিৎসকের পরীক্ষা করা মাংস বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।”
ঢাকা/মেহেদী