ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক হতে হবে সম্মান ও সমতার
Published: 8th, April 2025 GMT
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে শুক্রবার দ্বিপক্ষীয় যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো, তা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। গত জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ঠিক আগের মতো নেই। আমরা দেখছি, এখন কিছু স্তরে সম্পর্ক চলমান, আবার কিছু স্তরে বিশেষ করে রাজনৈতিক পর্যায়ে এ সম্পর্ক এক ধরনের জড়তার মধ্যে পড়েছে। এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে আমি মনে করি, সেই জড়তা কাটানো গেল। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড.
অস্বীকার করা যাবে না, নিকটতম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ-ভারত পরস্পরের ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল। তবে বিগত সময়ে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের সম্পর্ক ছিল, সেখান থেকে প্রতিবেশী হিসেবে সম্মানজনক ও সমতার সম্পর্কে উত্তরণ গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রত্যাশাও তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু নীতিগতভাবে বিষয়টি সেই প্রত্যাশাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য কাজ করতে হবে। এ জন্য একটি ভিশন তৈরি করতে হবে, সে আলোকে একটি কাঠামো তৈরি করতে হবে এবং সেখানে সমন্বয় থাকতে হবে। পাশাপাশি এর সপক্ষে জনমর্থনও গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমাদের প্রত্যাশা আছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নিজেও বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক হবে ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে। একে আমরা জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন হিসেবেই দেখছি। কিন্তু এটি বাস্তবায়নের জন্য আমাদের অভ্যন্তরীণ কাজ করতে হবে। যেমন আমি ভিশনের কথা বলেছি। এই ভিশন হতে হবে ‘কনসিস্ট্যান্ট’।
ভারতের সঙ্গে আমাদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক; যেখানে বাণিজ্য, সীমান্ত, নিরাপত্তা, অভিন্ন নদী আছে। এই বিষয়গুলোর ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে আমরা সমন্বয় করতে পারছি কিনা, তা গুরুত্বপূর্ণ। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমাদের জনগণের মধ্যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেই জনপ্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, অর্থাৎ সমতা ও ন্যায্যতার নীতি কাজে লাগাতে সৃজনশীল, টেকসই ও দক্ষ উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে এই বৈঠকের আগে আমরা দেখেছি, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফর করেছেন। বাংলাদেশের বাস্তবতার কারণেই আমাদের সবার সঙ্গে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে যেমন ভারতের সম্পর্ক; তেমনি চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গেও সম্পর্ক বিদ্যমান। আমাদের দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয় যেসব অংশীদার আছে, সবার সঙ্গেই আমাদের স্বার্থে কাজ করতে হবে। চীনের সঙ্গে ভারতের এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। সেটা তাদের সম্পর্কের বিষয়। তাদের মতপার্থক্য আমাদের দেখার কিছু নেই। আগে আমরা দেখেছি, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অনেকটা একপক্ষীয় ছিল; সেই অর্থে স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল না। এখন বাংলাদেশের বাস্তবতায় বলা চলে, সম্পর্ক স্বাভাবিক দিকে যাচ্ছে। কাজেই স্বাভাবিক হিসেবে দেশের স্বার্থে সবার সঙ্গে আমরা সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি।
রোহিঙ্গা সংকট আমাদের বড় সমস্যা। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় চীনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলেই দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের এক ধরনের ত্রিপক্ষীয় যোগাযোগ আছে। প্রধান উপদেষ্টার বেইজিং সফরের সময়েও চীন রোহিঙ্গা বিষয়ে সহযোগিতা করবে– এ রকম একটি ইঙ্গিত দিয়েছে। তারা বলেছে, আমরাও যেন রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করি। রোহিঙ্গা সংকট একটি জটিল সমস্যা। মিয়ানমারে সাত-আট বছরে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা যখন নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসে তখন সেখানে এক ধরনের গণতান্ত্রিক শাসন ছিল; অং সান সু চির দল ছিল ক্ষমতায়। এর পর ২০২১ সালে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান হওয়ার পর বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী বিদ্রোহ করে। তারই অংশ হিসেবে আমরা দেখেছি, সম্প্রতি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইনের বড় অংশ দখল করেছে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। এ কারণেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরও বেশি জটিল হয়েছে। এ বিষয়ে অগ্রসর হতে গেলে আমাদের কৌশলী হতে হবে এবং মানবিকতার বিষয়ও দেখতে হবে।
মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হয়েছে বিমসটেক সম্মেলনকে কেন্দ্র করে। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বিমসটেক আঞ্চলিক সহযোগিতার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে; যেখানে ভারতও এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আগামী দুই বছরের জন্য বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলোর এ আঞ্চলিক সহযোগিতা জোটের চেয়ারের দায়িত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের নেতৃত্বে বিমসটেকের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য কতটা সফলভাবে সামনে এগিয়ে যাবে, তা দেখার বিষয়। আমরা যদি আঞ্চলিক দেশগুলোর সহায়তায় বিমসটেকে ভালো কিছু করতে পারি, তাও নিঃসন্দেহে মানুষ স্মরণ করবে।
যা হোক, ইউনূস-মোদি বৈঠক প্রসঙ্গে আসি। সেখানে অনেক কথাই হয়েছে। ভারতের দিক থেকে স্থিতিশীলতা, উদার নীতি, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের প্রত্যাশা প্রকাশ পেয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রত্যাশাও গুরুত্বপূর্ণ। গত দেড় দশকে এর অনুপস্থিতিতেই স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব। চব্বিশের পরিবর্তনের পর স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বর্তমান সরকারও কাজ করে যাচ্ছে। টেকসই একটি সমাজ আমরা গড়তে চাই। আমাদের অন্য অংশীদারদেরও প্রত্যাশা, সবাইকে নিয়ে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে টেকসই শাসন কাঠামো তৈরি। যাদের জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে, তারা যেন জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন। সেটাই এখনকার অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। সেভাবে আমাদের কাজ করতে হবে। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ যতটা বলিষ্ঠভাবে জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে দায়িত্বশীল সরকার তৈরি করতে পারবে এবং সমাজ কাঠামোতে যতই শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থা কায়েম হবে ততই আমরা ভারতসহ সবার সঙ্গে সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারব।
এম হুমায়ুন কবির: যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এক ধরন র ও সমত র ক জ করত সহয গ ত ব মসট ক আম দ র ক জ কর র পর ব ন র পর
এছাড়াও পড়ুন:
লন্ডন বৈঠকে অবিশ্বাস দূর, সরকারের সম্মানজনক প্রস্থানের পথ সুগম হবে: সাইফুল হক
লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক দেশে আগামী সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক অচলাবস্থা, সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর করবে বলে আশা করছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। আজ শনিবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এ কথাগুলো বলেন তিনি।
লন্ডনে দুই নেতার বৈঠকের বিস্তারিত সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করারও আহ্বান জানিয়েছেন সাইফুল হক।
সরকারের এই উদ্যোগ বিলম্বিত বোধদয়ের ফল বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। সাইফুল হক বলেন, আরও আগে সরকারের এই বোধদয় হলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক ও রাজনৈতিক বিরোধ এড়িয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতিসহ মৌলিক কাজে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া যেত।
সব অংশীজনকে আস্থায় নিয়ে সরকারকে কাজ করার আহ্বান জানান সাইফুল হক। তিনি বলেন, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্মানজনক প্রস্থানের রাস্তা সুগম হলো।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সাইফুল হক বলেন, দেশের মানুষের অধিকার ও মুক্তি অর্জনে তাঁর দল জনগণের ভালোবাসা নিয়ে আগামীতে আপসহীন ধারায় সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে।
সংক্ষিপ্ত সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য বহ্নিশিখা জামালী, আকবর খান, আবু হাসান টিপু, আনছার আলী দুলাল ও মীর মোফাজ্জল হোসেন মোশতাক। সমাবেশে সংহতি জানান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিষদের আহবায়ক শেখ আবদুর নূর।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম মীর, রেজাউল আলম, ফিরোজ আলী, কেন্দ্রীয় সংগঠক আইয়ুব আলী, বাবর চৌধুরী, ঢাকা মহানগর কমিটির নেতা মো. সালাউদ্দীন, মিজারুল রহমান ডালিম, আরিফুল ইসলামসহ পার্টির ঢাকা মহানগরের নেতারা।