ভাসানচর হাতিয়ার নাকি সন্দ্বীপের, কেন এই দ্বীপ নিয়ে বিরোধ
Published: 11th, April 2025 GMT
মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা ‘ভাসানচর’ দ্বীপের নাম মানুষ জানতে পারে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের সরকারি সিদ্ধান্তের পর। তবে সম্প্রতি দ্বীপের মালিকানা নিয়ে নোয়াখালীর হাতিয়া ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপবাসীর বিরোধের কারণে আবারও আলোচনায় এসেছে ভাসানচর। সন্দ্বীপবাসীর দাবি, দ্বীপটি ওই উপজেলার অংশ। অপর দিকে হাতিয়াবাসী দাবি করছে, দ্বীপ জেগে ওঠার পর থেকে বনায়ন থেকে শুরু করে দ্বীপের উন্নয়ন নোয়াখালী থেকেই হয়েছে। সে কারণে দ্বীপটি প্রশাসনিকভাবে নোয়াখালীর সঙ্গে যুক্ত।
সন্দ্বীপের দক্ষিণ উপকূলের কাছাকাছি গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ভাসানচর জেগে উঠতে শুরু করে বলে বন বিভাগের তথ্য সূত্রে জানা গেছে। এরপর কয়েক দশক দ্বীপের ভূমির পরিমাণ বাড়তে থাকে। ২০১৭ সালের দিকে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের আলোচনার মধ্যেই সেটির নামকরণ হয় ভাসানচর। একই বছর দিয়ারা জরিপের মাধ্যমে সেটিকে নোয়াখালীর অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ সেখানে ‘ভাসানচর থানা’ গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেই প্রজ্ঞাপনেও ভাসানচরকে হাতিয়া ও নোয়াখালীর অংশ বলে উল্লেখ করা হলে সন্দ্বীপের ছাত্র, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ তখন বিক্ষোভ করেন।
সম্প্রতি সন্দ্বীপের বিভিন্ন স্তরের মানুষের দাবির মুখে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সীমানা জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করে। ‘চট্টগ্রাম-নোয়াখালী জেলার সীমানা জটিলতা নিরসন কমিটি’ নামের এই কমিটিতে সন্দ্বীপ ও হাতিয়ার নির্বাহী কর্মকর্তার পাশাপাশি পেশাজীবীদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ৯ মার্চ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভায় সিদ্ধান্তের আলোকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখা ভাসানচরকে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার অন্তর্গত দেখিয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়।
ভাসানচরের সীমানা বিরোধ নিরসনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই এ নিয়ে নোয়াখালীর হাতিয়া ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মানুষজন নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। ৭ এপ্রিল এ নিয়ে নাগরিক কমিটির নেতা আবদুল হান্নান মাসউদ ফেসবুকে ভাসানচরকে হাতিয়ার দাবি করে একটি পোস্ট দেন। গত বুধবার ভাসানচরকে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করার ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ তুলে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে হাতিয়া দ্বীপ সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন করা হয়। একই দিন চট্টগ্রামেও হাতিয়াবাসীর পক্ষ থেকে মানববন্ধন করা হয়।
যা বলছে নোয়াখালী বন বিভাগ
ভাসানচরে প্রথম বনায়ন শুরু করে নোয়াখালী বন বিভাগ। নথিপত্র অনুযায়ী ২০০০ সাল থেকে জালিয়ারচরে বনায়ন শুরু করে নোয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগ। প্রথম দিকে চরের আয়তন ছিল কম। পরে ধীরে ধীরে দ্বীপের আয়তন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে বনায়নের আয়তনও। ২০১৫ সাল পর্যন্ত দ্বীপটিতে বন বিভাগের বনায়নের পরিমাণ ৬ হাজার ৫২০ হেক্টর।
বন বিভাগের নথি অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের দিকে জেগে ওঠা এই দ্বীপের নাম ছিল জালিয়ারচর। ১৯৯৮ সাল থেকে সেখানে সরকারিভাবে বনায়নও শুরু হয়। হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে জালিয়ারচরের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। চরের অবস্থান হাতিয়ার মূল ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্ব দিকে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের সময় দ্বীপের নাম বদলে রাখা হয় ভাসানচর।
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর উপলক্ষে ভূমি উন্নয়ন, বাঁধ ও ভবন নির্মাণের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল নোয়াখালী জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে। ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর ভাসানচরে প্রথমবারের মতো পা রাখে রোহিঙ্গারা। এ পর্যন্ত ২২ দফায় কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয়শিবির থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে ৩২ হাজার রোহিঙ্গাকে।
ভাসানচরকে হাতিয়ার দাবি করে মানববন্ধন করে হাতিয়া যুব কল্যাণ সোসাইটি। গত বুধবার বিকেল ৪টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নিয়ে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানি শেষ, আদেশ ৬ আগস্ট
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নিয়ে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আবেদনের (রিভিউ) ওপর আদেশের জন্য আগামী ৬ আগস্ট তারিখ ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ।
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের বেঞ্চ আজ বুধবার শুনানি শেষে আদেশের এই তারিখ ধার্য করেন।
গত ১৮ মে শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য ১ জুলাই তারিখ ধার্য করেছিলেন। ধার্য তারিখে বিষয়টি শুনানির জন্য রিভিউ আবেদনকারীপক্ষের আইনজীবীর সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ ১৫ জুলাই পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল মঙ্গলবার ও আজ বুধবার শুনানি হয়।
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন করে ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রায় দেন। পরে ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদধারীদের পদক্রম ওপরের দিকে রাখা ও অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়; পাশাপাশি জেলা জজদের পদক্রম আট ধাপ উন্নীত করে সচিবদের সমান করা হয়।
আপিল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতির পদক্রম এক ধাপ উন্নীত করে জাতীয় সংসদের স্পিকারের সমান এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণ করে যে মুক্তিযোদ্ধারা বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন) পদক্রমে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে উল্লেখ করা হয়।
ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তৎকালীন চেয়ারম্যান ২০১৭ সালে পৃথক আবেদন করেন। রিভিউ আবেদনে রাষ্ট্রের ৯০ জন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পক্ষভুক্ত হন। পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আবেদনের ওপর গত ২৭ এপ্রিল শুনানি শুরু হয়।
আজ আদালতে রিভিউ আবেদনকারী মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সালাহ উদ্দিন দোলন শুনানি করেন। রিট আবেদনকারীপক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলদের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম শুনানিতে অংশ নেন। এ ছাড়া ইন্টারভেনার (ব্যাখ্যাকারী) হিসেবে শুনানিতে অংশ নেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরি করে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তা জারি করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে তা সংশোধন করা হয়।
সর্বশেষ সংশোধন করা হয় ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে। সংশোধিত এই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরির ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদ, সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত ও সংজ্ঞায়িত পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিচের ক্রমিকে রাখা হয়েছে—এমন উল্লেখ করে এর বৈধতা নিয়ে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মো. আতাউর রহমান ২০০৬ সালে রিট করেন।
রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট আট দফা নির্দেশনাসহ ১৯৮৬ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (সংশোধিত) অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ২০১১ সালে আপিল করে। এ আপিলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রায় দেন। এ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০১৭ সালে করা আবেদনের ওপর আজ শুনানি শেষ হলো।