Samakal:
2025-06-16@08:28:33 GMT

বৈশাখী মেলা:স্মৃতিতে সৌরভে

Published: 13th, April 2025 GMT

বৈশাখী মেলা:স্মৃতিতে সৌরভে

আজ পহেলা বৈশাখ– এসে গেছে ১৪৩২-এর পহেলা বৈশাখ। বাংলাদেশ বরণ করে নিচ্ছে নববর্ষকে। আজ পহেলা বৈশাখে দেশের আনাচ-কানাচ রং আর রেখায় ভরে গেছে। রং উঠে আসছে মেয়েদের শাড়িতে, ছেলেদের পাঞ্জাবিতে, নানান ফুলের সমাহারে, তোরণের বর্ণচ্ছটায়। রেখা তার স্থান করে নিয়েছে দেয়ালে, আলপনায়, প্রতিচিত্রে। 
ঢাকার রাস্তায় আলপনা পড়েছে, দেয়ালচিত্র শেষ হয়েছে, নানান রঙের আর ঢঙের মুখোশ বানানো হয়েছে, রঙিন কাগজের প্রতিমূর্তি গড়েছে প্রভাতের শোভাযাত্রার জন্য। উন্মাদনা, উৎসাহের জোয়ার দেখা যাচ্ছে চারদিকে– আনন্দ, স্ফূর্তি আর উৎসবের আমেজ অনুভব করা যাচ্ছে আকাশে-বাতাসে। বরণ করে নেওয়া হচ্ছে নতুন বছরকে প্রীতি-সম্ভাষণে, গানে, আমোদে আর মুখরোচক খাদ্যে। মেলা বসেছে নানান জায়গায়, বসেছে গানের আসর, চিরায়ত বাঙালি খাবার উঠে এসেছে আমাদের রসনায়। নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো, শিশুদের কলকাকলিতে ঘন হয়ে আসছে আকাশ-বাতাস। 
এই চালচিত্র থেকেই উঠে আসে স্মৃতি-অতীতের স্মৃতি। সেই স্মৃতির আলপনা-রেখার পথ ধরে মন চলে যায় সূদূর অতীতে। মনে পড়ে কত কথা– ৬৫ বছর আগের কথা। ছবির মতো বরিশাল শহরের বেশির ভাগ রাস্তাই ছিল লাল সুরকির। ব্রজমোহন কলেজসংলগ্ন আমাদের দোতলা কাঠের বাড়ির ধার ঘেঁষে যে পথটি চলে গেছে, তা শহর পেরিয়ে কাশীপুর হয়ে চলে গেছে। ওই পথ ধরেই বাস যেত রহমতপুর, ভূরঘাটা, গৌরনদী, চাখার– আরও কত জায়গায়! যতবার বাস যেত ততবারই একটি লাল ধূলার ঘূর্ণি উঠত রাস্তার ওপরে ক্ষণিকের জন্য। তারপর তা মিলিয়ে যেত। 
কিন্তু একদিন সেই লাল ধূলার ঘূর্ণি ঘন হয়ে বসে যেত বাতাসে। এবং সেটা ওই পহেলা বৈশাখেই। সারা বরিশাল শহরের মানুষ ওই পথ ধরে রওনা হতো পশ্চিমে বেলা ৩টায় শুরু হওয়া কাশীপুরের বৈশাখী মেলার দিকে। রিকশায়, সাইকেলে, পদব্রজে লোকের যাত্রা শুরু হয়ে যেত সেই দুপুর ১২টা থেকেই। সে জনস্রোতের একটা বিরাট অংশই ছিল শিশুরা– ওই যে মেলার মাটির পুতুলের জন্য। গরুর খুরের সৃষ্ট ধূলি থেকে ‘গোধূলি’ শব্দটি এসেছে, কিন্তু আমাদের বরিশালে পহেলা বৈশাখে মানুষের হেঁটে চলার পায়ে পায়ে যে মনুষ্যধূলির সৃষ্টি হতো, তার কাছে গোধূলি তো নস্যি। 
বেশ মনে আছে, ছোটবেলায় বড় কারও হাত ধরে আমরা দুই ভাই-বোন প্রতিবছরই যেতাম সেই বৈশাখী মেলায়। বাবা না যেতে পারলেও পাঠিয়ে দিতেন বড় কারও সঙ্গে। আমাদের দু’জনের হাতে দেওয়া হতো একটি করে টাকা পুতুল বা যা খুশি তা কেনার জন্য। সেই সঙ্গে মিলত মাটির বটুয়ায় জমানো আমাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়। মায়ের নিষেধাজ্ঞা ছিল বাইরের খাবার না কেনার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মেলার ধূলিমিশ্রিত নকুলদানা কিংবা চৌকো করে কাটা তিলের খাজা অথবা ঝুরঝুরে ঝুরিভাজার স্বর্গীয় স্বাদ কি ঘরের বানানো খাবারে হয়? সুতরাং মায়ের নিষেধাজ্ঞা তত্ত্বেই থাকত, বাস্তবে নয়। 
মেলায় গিয়ে পড়তে হতো এক কঠিন সমস্যায়। এত সুন্দর সুন্দর মাটির পুতুল– ঘোড়া, বর-বৌ, গরু, হাতি, পাখি– কোনটা ছেড়ে কোনটা নিই! পোড়ামাটির ওপরে সুন্দর উজ্জ্বল রঙে চোখ-মুখ আঁকা ওইসব পুতুলের দিকে তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হতো, দু’হাতে আঁকড়ে ধরে সব পুতুল নিয়ে নিই– কিন্তু সাধ আর সাধ্যে যে বিরাট ফারাক। তারই মধ্যে ছোট্ট মাথা খাটিয়ে পছন্দ করতাম কিছু পুতুল। কুমোরেরা যখন তাদের ডালি থেকে পুতুলগুলো আমাদের কচি হাতে তুলে দিতেন, তখন মনে হতো, হাতে স্বর্গ পাওয়া গেল। 

বাড়ি ফিরে সেই সব ঘোড়া, হাতি আর পাখিদের উল্টেপাল্টে কতবার যে দেখা হতো। রাতে ঘুমোনো হতো ওইসব পুতুল বালিশের পাশে সাজিয়ে। দুটো ঘটনার কথা মনে আছে। একবার নিজের সঞ্চয় থেকে মায়ের জন্য একটা শিশু কোলে মা-পুতুল নিয়ে এসেছিলাম। সেদিন মায়ের মুখে যে খুশির আভা দেখেছিলাম, তা কখনও ভুলব না। আরেকবার আমার হাত থেকে পড়ে ঘোড়া পুতুলটা ভেঙে গিয়েছিল। আমার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বোন তার ঘোড়াটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। তার মূল্য তখন হয়তো বুঝিনি, আজ বুঝি। 


সন্ধ্যার দিকে আবার শুরু হতো আরেক পালা– হালখাতা। বাবা আমাকে নিয়ে বের হতেন মাখন কাকা আর হারাধন জেঠার বইয়ের দোকানে, জহুর চাচার কাপড়ের প্রতিষ্ঠান চিটাগং বস্ত্রালয়ে, অশ্বিনীদার কাঠের কারখানায়। সুবেশ বিপণি মালিকেরা আমাদের যত্ন করে বসাতেন, সুস্বাদু সব খাবার আসত। তাকিয়ে দেখতাম লাল রঙের নতুন হালখাতা। যতদূর মনে পড়ে বাবা একটা রুপোর টাকা প্রতীকী হিসেবে তাদের হাতে তুলে দিতেন। 
সেই সব কর্মকাণ্ডে আমার যে কী যত্ন-আত্তি! কাকা-দাদারা হাঁক দিচ্ছেন তাদের কর্মচারীদের গরম গরম রসালো মিষ্টান্ন আনার জন্য, পরম যত্নে তুলে দিচ্ছেন আমার পাতে, জোর করছেন এটা-ওটা খাবার জন্য। তারই ফাঁকে ফাঁকে বাবার কাছে আশীর্বাদ চাইছেন, যাতে সারাবছর ভালো যায়। খাবার শেষে পিতলের ঘটি-গেলাসে জল আসত, বাবা একটা পান তুলে নিতেন হাতে, বিপণি মালিকেরা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন। 
কিন্তু সব সময় যা আমার দৃষ্টি কাড়ত তা হচ্ছে, ওই হালখাতা। সাদা সুতোয় বাঁধা লাল খাতাটা এলিয়ে থাকত টাকা-পয়সার বাক্সের পাশে। অদূরেই পিতলের ঘটিতে জলে পাঁচটি আমপাতা মুখ উঁচিয়ে থাকত। তার পাশেই কলম আর দোয়াত হিসাব লেখার জন্য। আমি প্রায়ই ওই লাল খাতাটির ওপরে হাত বোলাতাম। লাল সালুর ওই খাতাটি দেখতে দেখতে কেমন যেন ঘোর লেগে যেত। 
তারপর সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসত। বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নেমে চোখে পড়ত, পাশের বাড়ির বন্দনা মাসিমা ওঁদের উঠোনের মাঝখানে তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে। সামনে মাটির প্রদীপ জ্বলছে আর তার আভায় সিঁদুররাঙা সিঁথি আর জ্বলজ্বলে টিপে মাসিমাকে দেবীর মতো মনে হতো। তাঁর গলায় জড়ানো লাল-সাদা শাড়ির আঁচলে আর তাঁর নিমগ্নতায় কী যে সুন্দর লাগত তাঁকে। বাবা খুব নরম করে বলতেন, ‘যাও, মাসিকে প্রণাম করে এসো।’
আমি ওঁদের উঠোনের দিকে যেতে যেতে মনে হতো, কাল রাতে আমার ঘরের জানালা থেকে দেখেছি, বন্দনা মাসি তাঁদের তুলসীতলা নিকিয়েছেন, বারান্দায় আলপনা এঁকেছেন চালের গুঁড়োর, মঙ্গলঘট বসিয়েছেন সিঁড়ির দু’ধারে। আজ খুব ভোরে ঘুমচোখে দেখেছি, ওঁদের বাড়ির পেছনের ছোট্ট পুকুরটা একডুবে পার হয়ে ওপাড়ের ছোট্ট আমগাছটা থেকে দুটো কচি আম তুলে আবার একডুবে ফিরে এসেছেন এ পাড়ের ঘাটে। 
আমার পায়ের সাড়া পেয়ে বন্দনা মাসিমার তন্ময়তা ভেঙে যেত। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলতেন, ‘কী রে, বাবার সঙ্গে গিয়ে পেটপূজো সেরে এলি?’ আমি কিছু না বলে বন্দনা মাসিমার পায়ের কাছে প্রণত হই। টের পেতাম, মাসিমার স্নেহময় হাত আমার পিঠে। আজ মনে হয়, ওই আশীর্বাদ, ওই মমতা আর মায়াই তো ঘিরে রেখেছে আমাকে– শুধু বছরের প্রথম দিনে নয়, সারাবছর এবং সারাজীবনও বটে। v

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আম দ র স ন দর র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

রাজশাহীতে ঢাকাগামী টিকিটে বাড়তি ভাড়া আদায়, ৩ কাউন্টারকে জরিমানা

রাজশাহীতে ঈদফেরত যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে তিন বাস কাউন্টারকে জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় উপস্থিত যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেওয়া হয়।

শুক্রবার দুপুরে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় রাজশাহী বিআরটিএর পক্ষ থেকে এই অভিযান চালানো হয়। বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আলপনা ইয়াসমিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন।

অভিযানে দেশ ট্রাভেলস, গ্রামীণ ট্রাভেলস ও ন্যাশনাল ট্রাভেলসের প্রত্যেক কাউন্টারকে পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।

জানা গেছে, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়টি কয়েকজন যাত্রী গোপনে সেনাবাহিনীকে অভিযোগ করেন। পরে কাউন্টার থেকে আদায় করা অতিরিক্ত টাকা তাদের ফেরত দেওয়া হয়েছে।

বিআরটিএর ম্যাজিস্ট্রেট আলপনা ইয়াসমিন বলেন, কথা ছিল ঈদ উপলক্ষে পরিবহন মালিক সমিতি নতুন করে ভাড়া নির্ধারণ করবে। ভাড়া ঈদের আগে ও পরে একইরকম হওয়ার কথা। কিন্তু এই তিনটি গাড়ির কাউন্টারের এসি গাড়ির ভাড়া অতিরিক্ত আদায় করা হয়েছে। ঈদের আগে তাদের এসি গাড়ির ভাড়া ছিল ১ হাজার ১০০ টাকা। কিন্তু ঈদের পরে তা বাড়িয়ে ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা নেওয়া হচ্ছিল। এ অপরাধের জন্য আইনে সর্বোচ্চ জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। কাউন্টারগুলোকে ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।

এর আগে গত বুধবার হিমাচল ট্রাভেলস ও হানিফ ট্রাভেলস নন এসি ভাড়া বেশি আদায় করেছিল। হানিফ ট্রাভেলসের চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকার ভাড়া ছিল ৮৩০ টাকা। কিন্তু তারা রাজশাহী থেকেই ওই পরিমাণ ভাড়া আদায় করছিল। হিমাচল ট্রাভেলসের কোনো কাউন্টার ছিল না। তারা অন্য বাসের সঙ্গে মিলে যাত্রী পরিবহন করছিল। এই দুটি বাসকে ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।

শুক্রবার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় সম্পর্কে জানতে চাইলে দেশ ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা বলেন, সারা বছর ডিসকাউন্ট দিয়ে ১ হাজার ১০০ টাকায় যাত্রী পরিবহন করেন। ঈদ উপলক্ষে তারা সেই ডিসকাউন্ট উঠিয়ে দিয়েছেন। সেই কারণেই ভাড়া ১ হাজার ৭০০ টাকা হয়েছে।

এ ব্যাপারে ম্যাজিস্ট্রেট আলপনা ইয়াসমিন বলেন, তারা মিটিংয়ের সময় এই কথাটা বলেননি। তাই তাদের জরিমানা করা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রাজশাহীতে ঢাকাগামী টিকিটে বাড়তি ভাড়া আদায়, ৩ কাউন্টারকে জরিমানা
  • রাজশাহীতে ঈদফেরত যাত্রীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে ভাড়ার অতিরিক্ত অর্থ