প্রতিবেশীকে বাঁচাতে গিয়ে যেভাবে ‘ফেঁসে’ গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
Published: 18th, April 2025 GMT
চট্টগ্রামে প্রতিবেশীকে অপহরণকারীদের কাছ থেকে রক্ষা করতে এসে উল্টো ফেঁসে গেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। ভুক্তভোগী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা পুলিশকে বারবার বলার পরও ওই শিক্ষার্থীকে করা হয় মামলার আসামি। যান কারাগারে। গ্রেপ্তার তিন আসামিও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই। ভুক্তভোগীর পরিবারের ফোন পেয়ে ওই ছাত্র ঘটনাস্থলে এসেছিলেন। তবে পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থলের ক্লোজ সার্কিট (সিসিটিভি) ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তাঁকে ধরা হয়েছে।
ছয় দিন কারাভোগের পর জামিন পেয়ে বেরিয়ে এলেও ট্রমায় রয়েছেন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ সেমিস্টারের এই শিক্ষার্থী। বের হচ্ছেন না বাসা থেকে। শিক্ষার্থীর পাশাপাশি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তাঁর পরিবারও। পুলিশের যাচাই-বাছাইয়ে সতর্ক না হওয়ায় তাঁদের দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে।
৬ মার্চ রাতে নগরের আকবর শাহ থানার প্রভাতি স্কুলের বিপরীতে অবস্থিত বাসা থেকে আবেদীন আল মামুন ও তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িচালক মো.
ঘটনার শিকার আবেদীন আল মামুন চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) তৈরি পোশাক কারখানা প্যাসিফিক জিনসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক। তিনি সীতাকুণ্ড থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। এই ঘটনায় তাঁর গাড়িচালক শহীদুল ইসলাম বাদী হয়ে ১০ জনের নাম উল্লেখ করে আকবর শাহ থানায় অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে মামলা করেন। ঘটনার দিন রাতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে নাজমুল আবেদীন, নইমুল আমিন, আরাফাত হোসেন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে।
মামলার বাদী শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এজাহারে আমি শুধু সই করেছি। বাকি সব পুলিশ করেছে।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থী ফোন পেয়ে এসেছিলেন। তিনি জড়িত নন।’
প্রতিবেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে অপহরণকারীরা আসার পর ফোন করে ডেকে আনা হয় বলে জানান ঘটনার শিকার আবেদীন আল মামুন। তিনি বলেন, ‘অপহরণকারীরা আমাকে যখন বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল তখন আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর হাত ধরেছিলাম। তাঁকে আমি নিজেই আমার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম।’
প্রতিবেশীর বিপদে সাড়া দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মামলায় জড়ালেন বলে জানান আবেদীন আল মামুনের স্ত্রী চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী আয়শা আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসায় আমার স্বামীকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি পরিচয়ে অপহরণ করতে লোকজন এলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে আমি ফোন করি। আমার ফোন পেয়ে তিনি বাসায় আসেন। তিনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন আমার স্বামীকে বাঁচাতে। শেষে অপহরণকারীরা যখন আমার স্বামীকে নিয়ে যান, তখন তাঁকেও আমার স্বামী সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থী ঘটনার সময় কেন পুলিশকে ফোন করেননি, প্রশ্নের উত্তরে আয়শা আক্তার বলেন, ‘অপহরণকারীরা আমার স্বামীকে পুলিশে দিতে চেয়েছিলেন, সেই কারণে আমরাই পুলিশকে ফোন দিতে নিষেধ করেছি। সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ দেখে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে ধরে থানায় আনার পর আমরা থানায় গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, তিনি নির্দোষ। এরপরও পুলিশ তাঁকে ছাড়েনি।’
উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার ওপর হামলার অভিযোগের নগরের কোতোয়ালি থানার একটি মামলার আসামি আবেদীন আল মামুন।
৩ আসামির জবানবন্দিতেও নাম নেই শিক্ষার্থীর
আদালত সূত্র জানায়, অপহরণও মুক্তিপণ আদায়ের মামলায় গ্রেপ্তার তিন আসামি নাজমুল আবেদীন, নইমুল আমিন ও আরাফাত হোসেন ৮ মার্চ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মোস্তফার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এতে তাঁরা তিনজনই বলেছেন, তাঁদের সঙ্গে গ্রেপ্তার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ঘটনার সময় ভুক্তভোগীর স্ত্রী ফোন করার পর ওই শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলে আসেন। তাঁকে তাঁরা কেউ ডাকেননি। ১০ থেকে ১৫ দিন আগে পরিকল্পনা করে তাঁরা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। আবেদীন আল মামুনকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও টাকার লোভে পড়ে অপহরণ করেন তাঁরা।
এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ১২ মার্চ জামিনে মুক্তি পান। আদেশে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু বক্কর সিদ্দিক উল্লেখ করেন, তিন আসামির ১৬৪ ধারার জবানবন্দি অনুযায়ী এই আসামি (বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী) জড়িত নন। এ ছাড়া ভুক্তভোগী, তাঁর স্ত্রী, মামলার বাদীও আদালতে হাজির হয়ে জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীকে তাঁরা ডেকে এনেছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আকবর শাহ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাজ্জাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে ভালো ছেলে হিসেবে জানি।’
ভুক্তভোগীর পরিবার তাকে ডেকে এনেছেন থানায় গিয়ে বলার পরও কেন আসামি করা হয়েছে জানতে চাইলে আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ফুটেজে ছিল তাই ধরা হয়েছে। প্রাথমিক যাচাই-বাছাই কেন করা হয়নি উত্তরে ওসি বলেন, তদন্তে যা হওয়ার হবে।
ট্রমায় শিক্ষার্থী
প্রতিবেশীকে বাঁচাতে এসে মামলায় ফেঁসে গিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বাসা থেকে বের হতে পারি না। মানুষকে মুখ দেখাতে পারি না।’
শিক্ষার্থীর ব্যবসায়ী বাবা বলেন, ‘পুলিশকে ভুক্তভোগী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বারবার বলার পরও শোনেনি। প্রতিবেশীর বিপদে এগিয়ে গিয়ে ছেলে আমার নিজেই বিপদে পড়ে গেছে। হয়েছে মামলার আসামি। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক।’
জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপকমিশনার (গণমাধ্যম) রইছ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে দোষী প্রমাণিত না হলে মামলা থেকে ওই শিক্ষার্থীকে বাদ দেওয়া হতে পারে।
আসামি আটকের পর যাচাই-বাছাইয়ে পুলিশকে আরও সতর্ক হওয়া উচিত বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখা গেলেও কার কী ভূমিকা ছিল, তা দেখার দরকার ছিল পুলিশের।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আকবর শ হ থ ন অপহরণক র র আম র স ব ম ক প রথম আল ক র পর ব র ফ ন কর তদন ত ইসল ম ঘটন র
এছাড়াও পড়ুন:
গাইবান্ধায় বাবা-মাকে মারধর করে এসএসসি পরীক্ষার্থীকে অপহরণ, অভিযুক্ত আটক
বাড়ির ভেতর ঢুকে বাবা-মাকে মারধরের পর এক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) দুপুর ২টার দিকে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কামারদহ ইউনিয়নের বেপারীপাড়ায় ঘটনাটি ঘটে। বিকেল ৫টার দিকে ভুক্তভোগীকে উদ্ধার ও মূল অভিযুক্ত আটক করে পুলিশ।
অভিযুক্ত সঞ্চয় (২০) উপজেলার ফাঁসিতলা এলাকার মোঘলটুলী গ্রামের রাফিউল ইসলাম রাফির ছেলে।
ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, মঙ্গলবার দুপুরে গোবিন্দগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরেন ওই শিক্ষার্থী। কিছুক্ষণ পর সঞ্চয়সহ ১৫-২০ জন লাঠি নিয়ে বাড়িতে হামলা চালায়। তারা ঘরের দরজা-জানালাসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করে এবং মালামাল লুট করে। এসময় বাধা দিতে গেলে হামলাকারীরা ওই শিক্ষার্থীর বাবা-মাকে মারধর ও কুপিয়ে আহত করে। পরে তারা শিক্ষার্থীকে টেনেহিঁচড়ে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যায়।
আরো পড়ুন:
ধামরাইয়ে চালক-হেলপারকে মারধর করে তেলবাহী ট্রাক ছিনতাই
সিরাজগঞ্জে সহপাঠীদের মারধরে আহত এসএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু
পুলিশ বিকেল ৫টার দিকে পার্শ্ববর্তী কামারদহ ফেলুপাড়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে চাঁন মিয়ার বাড়ি থেকে অপহৃত শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে। এসময় অভিযুক্ত সঞ্চয়কে আটক ও তার কাছে থাকা মোটরসাইকেল জব্দ করে পুলিশ।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরে স্কুলে যাওয়া আসার পথে তাকে উত্ত্যক্ত করাসহ বিভিন্ন হুমকি দিচ্ছিলেন সঞ্চয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত সঞ্চয়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন তিনি।
ঘটনাটি নিশ্চিত করে গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি বুলবুল ইসলাম বলেন, “খবর পেয়ে পুলিশ উদ্ধার অভিযান চালায়। একটি বাড়ি থেকে শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করা হয়। অভিযুক্ত সঞ্চয়কে আটক করা হয়েছে। মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।”
ঢাকা/মাসুম/মাসুদ