‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা’ মানে ট্রাম্পকে মানো
Published: 19th, April 2025 GMT
বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র এখনো একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তবে চার মাস আগের তুলনায় দেশটির গণতন্ত্র অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দেশের সংবিধান অপরিবর্তিত থাকলেও প্রেসিডেন্টের নিয়মকানুন উপেক্ষা এবং সেগুলো কার্যকর করার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা এই অবস্থা তৈরি করেছে।
প্রশ্ন হলো, কোনটা আসল যুক্তরাষ্ট্র—যেটি আইনকে সম্মান করে, নাকি যেটি আইনকে উপহাস করে? যদি দ্বিতীয়টাই বাস্তব হয়, তাহলে ব্রিটেন কি সেই যুক্তরাষ্ট্রকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে? এ প্রশ্ন ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ইউরোপ-মার্কিন বাণিজ্য চুক্তির ভেতরে লুকিয়ে আছে।
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের মতে, এই চুক্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল। তিনি বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘যুক্তরাজ্যকে সত্যি ভালোবাসেন’ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে শুধু বাণিজ্য নয়, গভীর সাংস্কৃতিক মিলও রয়েছে। এটি সেই ভ্যান্সের বক্তব্যের বিপরীত, যিনি এ বছরের শুরুতে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপকে খ্রিষ্টবিরোধী ও সেন্সরশিপপ্রবণ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।
মিউনিখে নিরাপত্তা সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ইউরোপের সবচেয়ে বড় হুমকি আসছে ‘ভেতর থেকে’ এবং তারা সেই মূল্যবোধ থেকে সরে যাচ্ছে, যা একসময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিল।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলে ভ্যান্স আবার একই অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হচ্ছে। এটি যা আমেরিকান প্রযুক্তি কোম্পানি ও নাগরিকদের ওপর প্রভাব ফেলছে।
ভ্যান্স মূলত ‘অনলাইন সেফটি অ্যাক্ট’-এর কথা বলছিলেন, যা সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ক্ষতিকর কনটেন্ট সরানোর দায়িত্ব দেয়। এই আইন ২০২২-২৩ সালে তৈরি হয় এবং এর পরিধি বারবার পরিবর্তিত হয়েছে।
বর্তমান আইনে সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ, বর্ণবিদ্বেষ, আত্মহত্যার প্ররোচনা, শিশু নির্যাতনের ছবি ইত্যাদির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এসব নিয়ন্ত্রণ করবে যুক্তরাজ্যের যোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা অফকম। এখানে আইন ভঙ্গ করলে জরিমানা বা এমনকি ফৌজদারি মামলা হতে পারে। বাস্তবে এই আইন কেমন কার্যকর হবে, তা এখন প্রশ্নের বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে হলে এই আইনকে অনেকটা শিথিল করতে হতে পারে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অফকমের সঙ্গে দেখা করে অনলাইন সেফটি অ্যাক্ট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং বলেছে, তারা বিশ্বজুড়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে চায়।
স্টারমার সংসদীয় কমিটিতে স্বীকার করেছেন, প্রযুক্তি কীভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করে, তা আলোচনার বিষয়। এমনকি কর ফাঁকি ঠেকাতে ডিজিটাল সার্ভিস ট্যাক্স নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প একটি সমঝোতা চুক্তিতে সই করেন। তাতে বলা হয়, বিদেশে মার্কিন কোম্পানিগুলোর ওপর কোনো চাপ দিলে তা সহ্য করা হবে না। তারা যেকোনো নিয়ন্ত্রণকে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ’ বলে দেখাচ্ছে। এই নীতিকে ‘সর্বজনীন অধিকার রক্ষার’ ভাষায় উপস্থাপন করা হচ্ছে। এটি একধরনের সাম্রাজ্যবাদী চাপের মতো। অন্য খাতে যেমন কৃষিপণ্যে যুক্তরাষ্ট্র এমন দাবি তুলতে পারে না, তারা এখনো বলেনি যে ক্লোরিন ধোয়া মুরগির মাংসকে ইউরোপে নিষিদ্ধ করা মতপ্রকাশের সীমালঙ্ঘন।
এটা ঠিক, অনলাইন কনটেন্ট কোনটা সহনীয় আর কোনটা নয়, তা নিয়ে যুক্তিসংগত মতপার্থক্য থাকতে পারে। তবে সবাই মানে, কিছু সীমা অবশ্যই আছে, যেমন শিশু যৌন নির্যাতনের ছবি কখনোই ‘মতপ্রকাশ’ নয়।
অনলাইন কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, সেটি ঠিক করা অনেক জটিল বিষয়। তত্ত্বে যেমন কঠিন, বাস্তবে তা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, আমরা যেসব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করি, সেগুলো আসলে ব্যক্তিগত মালিকানার লাভের জন্য চালানো ব্যবসা—সরকারি বা জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান নয়। এমন অবস্থায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব এমন এক মার্কিন প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া যুক্তরাজ্যের উচিত নয়, যাদের সঙ্গে বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানির ঘনিষ্ঠ এবং অনেক সময় দুর্নীতির সম্পর্ক রয়েছে।
ট্রাম্পের সঙ্গে সিলিকন ভ্যালির ধনকুবেরদের সম্পর্ক যে শুধু ব্যবসায়িক, তা নয়। এর মধ্যে আদর্শগত বিষয়ও জড়িত। এই ধনীরা নিজেদের ক্ষমতা ও অর্থ ব্যবহার করে ট্রাম্পকে জেতাতে সাহায্য করেছেন, এখন তাঁরা এর প্রতিদান চাইছেন।
ট্রাম্পের নীতির মধ্যে তেমন কোনো সুসংগত যুক্তি নেই। ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ মানে তাঁর মতে হলো এমন বক্তব্য, যা প্রেসিডেন্টের নিজের পক্ষপাতকে আরও জোরালো করে তোলে। আর কেউ যদি তাঁর মিথ্যা কথা সত্য তথ্য দিয়ে সংশোধন করে, তাহলে সেটা ‘সেন্সরশিপ’ বলে বিবেচিত হয়।
এই বিভ্রান্তিকর চিন্তাভাবনা শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নেই, যুক্তরাজ্যেও দেখা যাচ্ছে। দেশটির কনজারভেটিভ নেতা কেমি বাডেনোকও ঠিক এমনই ভাবেন। তিনি জেডি ভ্যান্সকে নিজের বন্ধু মনে করেন। মিউনিখে ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স যে বক্তৃতা দেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বাডেনোক বলেন, ‘তিনি আসলে বেশ কিছু সত্য কথা বলেছেন।’ বাডেনোক নিজেও প্রায়ই বলেন, ব্রিটেনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে সরকারি দপ্তর হোয়াইটহল—এখন তথাকথিত ‘উয়োক’ (অর্থাৎ অতিরিক্ত প্রগতিশীল) মতাদর্শে আক্রান্ত, যা মানুষকে দমন করে।
যুক্তরাজ্যের উচিত নয় এমন একটি দেশের কাছ থেকে গণতন্ত্র শেখা, যারা সংবাদমাধ্যমকে ভয় দেখিয়ে ও মামলা দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের কথা মানতে বাধ্য করে, একদিকে স্বৈরাচারী শাসকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখে আর অন্যদিকে গণতান্ত্রিক বন্ধুদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এমনকি তারা নির্দোষ মানুষদের ধরে নিয়ে যায়, জেলে রাখে, আর আদালত তাদের মুক্তি দিতে বললেও সে আদেশ মানে না।
এসবই সেই ‘মূল্যবোধ’, যেগুলো নিয়ে জেডি ভ্যান্স আফসোস করে বলেন, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র দূরে সরে যাচ্ছে। এই হচ্ছে সেই ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতার’ আদর্শ, যা ট্রাম্পের সঙ্গে বাণিজ্য করতে হলে মেনে নিতে হবে, রক্ষা করতে হবে। এই কি সেই ‘বাস্তব সাংস্কৃতিক মিল’, যার কারণে ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি পাওয়ার যোগ্য হবে? আমরা আশা করব, তা যেন না হয়।
● রাফায়েল বের গার্ডিয়ান পত্রিকার কলাম লেখক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
পুতিন এমন কিছু চান, যা তিনি কখনোই পাবেন না
ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই বলেছেন, তিনি কোনো সাধারণ নেতা নন, সিংহাসনে আসীন একজন আইনজ্ঞ শাসক। শুরু থেকেই তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের পরিচিতির অংশ হিসেবে একসময় যে তিনি আইনশাস্ত্র পড়েছেন, সেটা ভুলে যাননি। গত মে মাসে একদল ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি তাঁদের বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত তো আমি আইনশাস্ত্রে ডিগ্রিধারী।’ সেই বৈঠকে ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, একটি শান্তিচুক্তি হলে পশ্চিমা প্রতিযোগীরা রাশিয়ায় ফিরে আসতে পারে। এর উত্তরে পুতিন আরও বলেন, ‘আপনারা যদি আমাকে চুক্তিপত্রটি দেন, তাহলে আমি উল্টেপাল্টে দেখে বলে দেব কী করতে হবে।’
আমরা সাধারণত স্বৈরাচার মানেই এমন একজনকে ভেবে নিই, যিনি আইনকানুনের তোয়াক্কা করেন না। এটা একদম সত্যি। কিন্তু পুতিনের মতো একজন একনায়কের কাছে আইনের লঙ্ঘনের চেয়ে বরং আইনের দোহাই দেওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সুশৃঙ্খল কাঠামো থেকে নির্দেশ মেনে চলতে চলতে প্রেসিডেন্টের আসন পর্যন্ত পৌঁছেছেন।
আজকের রাশিয়ায় রাজনৈতিক দমন-পীড়নের প্রতিটি নতুন ঢেউয়ের আগে নতুন কোনো আইন পাস হয় অথবা পুরোনো আইনে সংশোধন আনা হয়, যাতে আইন লঙ্ঘন না করেই আরও বেশি মানুষকে ‘আইনের আওতায়’ শাস্তি দেওয়া যায়।
একজন ব্যক্তির ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য আইনি ব্যবস্থাকে সীমাহীনভাবে ব্যবহার করে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘটনাক্রমে একটি উচ্চতর বৈধতার দাবি করে। প্রকৃতপক্ষে পুতিনের সমগ্র রাজনৈতিক জীবনই কেটেছে এমন একটি বৈধতার উৎস খুঁজতে খুঁজতে, যেটা আইনের চেয়েও গভীর। নিজের কর্তৃত্ব প্রমাণের এটা একটা ব্যক্তিগত বাতিক। এটা বিজয়ের বাসনার মতোই একটি ব্যাপার। এটাই ইউক্রেন যুদ্ধে তাকে চালিত করেছে। এ যুদ্ধের লক্ষ্য হলো সামরিক বিজয়ের মাধ্যমে রাশিয়াকে আবার বিশ্বশক্তির অভিজাত ক্লাবে ফেরত নিয়ে যাওয়া। কিন্তু এ প্রত্যাবর্তন পশ্চিমা বিশ্বের স্বীকৃতি ছাড়া অসম্ভব। আর দিন দিন এ ধারণা পরিষ্কার হচ্ছে যে পুতিন সেই স্বীকৃতি হয়তো আর কখনোই পাবেন না।
পুতিনের রাজত্ব শুরুর বছরগুলোতে একটি কৌশল কাজ করেছিল। তিনি পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে সম্মেলনে অংশ নিতেন। দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিলেন। কিন্তু ২০১২ সালে তিনি যখন আবার প্রেসিডেন্ট পদে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন, তখন দেশজুড়ে বড় ধরনের প্রতিবাদ শুরু হয়। তখন থেকেই তিনি বিধ্বংসী পশ্চিমা প্রভাবের বিরুদ্ধে তথাকথিত রুশ ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ রক্ষার লড়াই শুরু করেন।
এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের অর্থ ছিল সরাসরি পশ্চিমের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া, যার পরীক্ষাক্ষেত্র হয়ে ওঠে ইউক্রেন। ক্রিমিয়া দখলকে পুতিন একটি ঐতিহাসিক অবিচারের ‘সংশোধন’ বলে তুলে ধরেছিলেন। এর পরপরই পূর্ব ইউক্রেনে হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রার আগ্রাসন শুরু করেন। এটিকে তিনি চমকপ্রদ বিদ্যুৎ গতির আক্রমণ মনে করেছিলেন। এটা তার পশ্চিমাদের প্রতি বৈরিতাপূর্ণ নীতির চূড়ান্ত রূপ।
পুতিন এখন সেই একই দ্বিধার পড়েছেন। যতটা সম্ভব ভূখণ্ড দখল করে নেওয়া এবং দখল করা অঞ্চলের ওপর বৈধতা প্রতিষ্ঠা—এই দুয়ের মধ্যে কোন পথটি তিনি বেছে নেবেন। স্তালিনও একসময় দ্বিধায় থেকে শেষ পর্যন্ত যে পথ বেছে নিয়েছিলেন, পুতিনও সম্ভবত সেই পথেই হাঁটবেন।এসব প্রচেষ্টা রাশিয়ার ভেতরে পুতিনের সমর্থন জয় করে নেওয়ার জন্য চোখে পড়ার মতো সফল ছিল। তবে একই সঙ্গে এগুলো রাশিয়া ও পশ্চিমের সম্পর্ক ভাঙার নয়; বরং তা নতুনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টাও ছিল। এমনকি ক্রিমিয়া দখল ও পূর্ব ইউক্রেনে সংঘাতের পরও ক্রেমলিন আলোচনার পথ অনুসরণ করে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো মিনস্ক চুক্তি। এর লক্ষ্য ছিল কূটনৈতিক একঘরে অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে প্রধান শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনার টেবিলে নিজের আসন পুনরুদ্ধার করা। সেই প্রচেষ্টাগুলো ব্যর্থ হয় এবং পুতিন আরও ঝুঁকি বাড়ানোর পথ বেছে নেন। এখন ক্রেমলিন কিছু মাত্রায় নমনীয়তা দেখাতে প্রস্তুত।
সব অনমনীয় কথাবার্তার পরও ক্রেমলিন এরই মধ্যে কিছু চরম অবস্থান থেকে সরে এসেছে। মার্চ মাসে পুতিন ইউক্রেনকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে প্রদান কিংবা যেকোনো আলোচনা শুরুর পূর্বশর্ত হিসেবে ইউক্রেনের নির্বাচন দেওয়ার মতো ধারণাগুলো নিয়ে এসেছিলেন। মস্কো এখন আর জোর দিয়ে বলছে না যে ইউক্রেনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা অর্থহীন এবং যেকোনো প্রকৃত চুক্তির আগে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে। রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা নিষিদ্ধকারী আইন বাতিলের জন্য ইউক্রেনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে দাবি তোলা হয়েছিল, সেখান থেকেও রাশিয়া নীরবে সরে এসেছে।
নিশ্চয়ই এ নতুন নমনীয়তারও একটা সীমা আছে। মস্কো এর মূল দাবিগুলো এখনো পরিত্যাগ করেনি। কারণ, গত তিন বছরে রাশিয়া এক যুদ্ধরত দেশে পরিণত হয়েছে। শত্রু হয়ে উঠেছে একপ্রকার পৌরাণিক শয়তান, সেনারা এখন নায়ক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বেশি মানুষ আর কোনো যুদ্ধে নিহত বা আহত হননি। যুদ্ধ-অর্থনীতি সচল হয়ে উঠেছে; ভিন্নমত গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি পুতিন নিজেও এখন প্রায়ই ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ না বলে সরাসরি ‘যুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করছেন। যুদ্ধ যত দীর্ঘ ও বিস্তৃত হয়, এর ফলাফল ততই বিশ্বাসযোগ্য ও জোরালো হতে হয়।
এখানেই আসে দর-কষাকষির বিষয়টি। ক্রেমলিন স্পষ্টতই দর–কষাকষির বিষয়টাকে এমন একটা হিসেবে দেখছে, যেন সেখানে তারা একটি বিজয় দাবি করতে পারে, যেটা তারা যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জন করতে পারেনি। রাশিয়া কেন ইউক্রেনকে এমন সব এলাকা থেকেও সরে যাওয়ার দাবি তুলেছে, যেগুলোর ওপর দেশটির নিয়ন্ত্রণই নেই—এর ব্যাখ্যা এখান থেকে পাওয়া যায়। পুতিনের কাছে বিজয় মানে শুধু ভূখণ্ড দখল নয়। তাঁর কাছে বিজয় মানে, শর্ত চাপিয়ে দেওয়া, নতুন করে সীমান্ত আঁকা এবং সেই নতুন বাস্তবতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়। এভাবেই পুতিন তাঁর কাঙ্ক্ষিত বৈধতা নিশ্চিত করতে পারেন।
পুতিনের এ অবস্থান বুঝতে পারাটা মোটেই কঠিন নয়। এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনে থাকা পুতিনের প্রতি সবচেয়ে সহানুভূতিশীল ব্যক্তিরাও মনে করেন যে পুতিন অনেক বেশি দাবি করছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হতাশা স্পষ্টতই বাড়ছে। শান্তির জন্য তাঁর ৫০ দিনের সময়সীমা এখন কমে এসে ‘১০ বা ১২ দিনে’ দাঁড়িয়েছে, যা তাঁর ধৈর্য ফুরিয়ে আসারই প্রমাণ। অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধক্লান্তির লক্ষণ ও বেদনাদায়ক আপসের বিষয়টি বিবেচনা করা সত্ত্বেও এটা বিশ্বাস করার এমন কোনো কারণ নেই যে মস্কোর চূড়ান্ত শর্ত মেনে নেবে। এমনকি এর কিছু অংশে যদি ওয়াশিংটন সমর্থন দেয়, তারপরও সেটা নয়।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হতাশা স্পষ্টতই বাড়ছে।