মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম আসিয়ানের চেয়ারম্যান হিসেবে ঐতিহাসিক যে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিযেছিলেন, তা খুব দ্রুতই মুখ থুবড়ে পড়ল। তিনি মিয়ানমারের যুদ্ধবিরতি-বিষয়ক একটি চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার কালি শুকানোর আগেই তাকে ভণ্ডুল করে দেওয়া হলো। আবারও সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের তাতমাডো বাহিনী সেই সাগাইং অঞ্চলে নতুন করে বোমা হামলা শুরু করে, যে এলাকা ছিল সাম্প্রতিক ৭.
যেটি মানবিক জানালা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা ছিল তা এখন মিয়ানমারের দীর্ঘ ট্র্যাজেডির আরেকটি অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। এটি লেখা হয়েছে বিশ্বাসঘাতকতার ভাষায়। কিন্তু এই বিশ্বাসঘাতকতা যদিও গভীরভাবে হতাশাজনক, এটি আসিয়ানের ব্যর্থতা নয়; বিশেষ করে আনোয়ারের তো নয়ই। বরং মিয়ানমারের জান্তা ও ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টকে (এনইউজি) যুক্ত করতে তাঁর এই বিরল সাহস ও রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল এখনও পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এর কারণ এই নয়, এটি কয়েক দিনের জন্য হলেও শান্তি এনেছে। বরং এটি তাতমাডোর প্রকৃত একগুঁয়েমিকে উদোম করে দিয়েছে এবং আসিয়ানের কূটনীতিকে নতুন করে স্পষ্টতা ও বৈধতা দিয়েছে।
যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনা আশ্চর্যজনক নয়, বরং এটি একটি সংকেত। এ ক্ষেত্রে সংকেত যতটা স্পষ্ট ততটাই বিপজ্জনক যে, তাতমাডো অঞ্চল, সংহতি ও আস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।
এটি কেবল আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে নয়, বরং নিজস্ব কমান্ড চেইনের মধ্যেও একই ঘটনা দেখা যাচ্ছে। এটি বিশেষ করে সাগাইংয়ের ক্ষেত্রে সত্য, যা দীর্ঘদিন ধরে অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতীকী ও কার্যকরী কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত।
স্থিতাবস্থা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়– যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেওয়া স্পষ্টত তারই প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। সমাধানের চেষ্টা না করে নিরপেক্ষতার মানে হলো কুকর্মে সহযোগিতা করা এবং তা মিয়ানমারের চলমান ভাঙনের সঙ্গে আসিয়ান ও অন্যান্য শক্তির যোগসাজশ বলে বিবেচিত হবে।
উভয় পক্ষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার পর আনোয়ার এখন তার সহযোগী রাষ্ট্রপ্রধানদের এটা বোঝাতে সক্ষম যে, অস্পষ্ট কোনো ঘোষণা দেওয়ার সময় শেষ হয়ে গেছে। জান্তা ও এথনো-ন্যাশনালিস্ট অর্গানাইজেশন (ইএনওএস) উভয়ই যখন তাদের সবচেয়ে দুর্বলতম পর্যায়ে থাকে, তখন পদক্ষেপ অবশ্যই চূড়ান্ত হতে হবে।
এ কারণে আনোয়ারের দ্বৈত-কূটনীতিকে ব্যর্থ বলা যায় না। এটি ছিল একটি কৌশলগত প্রকাশ। জান্তা ও এনইউজি উভয়ের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে আনোয়ার দেখিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ ঐক্য যাচাই-বাছাইয়ের পরও এবং বহিরাগত প্রত্যাশা বেশি থাকলেও আসিয়ান এখনও একসঙ্গে বসতে, যোগাযোগ করতে ও বিষয়গুলো স্পষ্ট করতে আহ্বান জানাতে পারে।
এখন আসিয়ান+জিসিসি+চীন শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার তিনটি ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতা আর কাল্পনিক নয়, এটি চলমান। সমন্বিত হস্তক্ষেপ গৃহীত না হলে আসিয়ান ও জিসিসি বা উপসাগরীয় সহযোগিতা অঞ্চলে সশস্ত্র সংঘাত, মানব পাচার, ডিজিটাল দাসত্ব ও রাষ্ট্রহীনতার বিস্তার লাভ অনিবার্য।
প্রকৃতপক্ষে, মিয়ানমারের বিভক্তির ফলে চীন, থাইল্যান্ড, ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ন্ত্রণহীন অঞ্চলের সৃষ্টি হচ্ছে।
সেগাইং-এ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন আরেকটি প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের চেয়েও বেশি কিছু। এটি ভেঙে পড়ার একটি বিন্দু। আর বিপরীতভাবে এটি আনোয়ার ও আসিয়ানকে তাদের প্রয়োজনীয় শক্তি জোগায়। এই শক্তি তিরস্কার করার জন্য নয়, বরং আঞ্চলিক সংকটের মুহূর্তে নেতৃত্ব ও কৌশল নির্ধারণের জন্য।
ফার কিম বেং: মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক; এশিয়া টাইমস থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
গংগাচড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ, আতঙ্ক কাটেনি এখনও
রংপুরের গংগাচড়ায় ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ঘিরে সহিংসতার শিকার হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। তবে ঘটনার তিন দিন পরেও এলাকায় ফেরেনি অনেক পরিবার। আতঙ্কে এখনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে।
গত ২৭ জুলাই রাতে ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার আগে এলাকায় মাইকিং করে লোকজন জড়ো করা হয়।
পুলিশ, প্রশাসন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, যারা হামলা করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন ‘বহিরাগত’। পাশের নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা থেকে লোকজন এসে হামলা চালিয়ে চলে যায়। হামলার সময় ২২টি ঘরবাড়ি তছনছ ও লুটপাট করা হয়।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এলাকায় অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প বসানো হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে পুলিশ টহল। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঢেউটিন, কাঠ, চাল-ডাল ও শুকনো খাবার বিতরণ করেছে এবং ঘরবাড়ি মেরামতের কাজও শুরু হয়েছে। তবু আতঙ্কিত পরিবারগুলো।
ক্ষতিগ্রস্তদের একজন অশ্বিনী চন্দ্র মোহান্ত বলেন, “সেদিনের ঘটনা ছিল এক ভয়াবহ। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ধর্ম অবমাননাকারী কিশোরকে থানা হেফাজতে দিয়েছি। কিন্তু তারপরও ঘরবাড়ি রক্ষা হয়নি। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি এবং কিছু মুরুব্বি আমাদেরকে অভয় দিয়েছিলেন, কিন্তু রক্ষা হয়নি।”
তিনি আরো বলেন, “আমরা নিজেরাই অভিযুক্ত কিশোরকে থানায় সোপর্দ করেছি। তারপরও মিছিল নিয়ে এসে দুই দফায় আমাদের ২০ থেকে ২৫টি ঘরবাড়ি তছনছ করে দিয়ে লুটপাট করেছে তারা। এদের মধ্যে অধিকাংশ লোকেই অপরিচিত।”
আরেক ভুক্তভোগী দেবেন্দ্র চন্দ্র বর্মন জানান, “প্রথমে অল্পসংখ্যক কম বয়সী কিছু ছেলে আসে। পরে হাজারো লোকজন এসে আমাদের বাড়িঘরে তাণ্ডব চালায়। অনেকেই এখনো আত্মীয়দের বাড়িতে। আমরা চরম আতঙ্কে আছি।”
রবীন্দ্র চন্দ্রের স্ত্রী রুহিলা রানী বলেন, “ছোট ছেলেটা যদি ভুল করে থাকে, আমরা তাকে থানায় দিয়েছি। কিন্তু তারপরও এমন ধ্বংসযজ্ঞ কেন? আমাদের গরু, সোনা-টাকা সব লুটে নিয়েছে। শুধু চাল-ডাল আর টিনে কি জীবন চলে?”
গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রংপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ও সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকুসহ একটি প্রতিনিধি দল। তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণ করেন এবং পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
গংগাচড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আল এমরান বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে কিশোরটিকে গ্রেপ্তার করে থানায় আনা হয় এবং পরে আদালতের মাধ্যমে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তারপরও পুলিশ প্রশাসন সর্বাত্মক নিরাপত্তায় নিয়োজিত।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহামুদ হাসান মৃধা বলেন, “অপরাধীদের ধরতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হচ্ছে সহায়তা। পুলিশ ও সেনাবাহিনী পুরো এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে।”
উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্যমতে, হামলায় ১৫টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাতে ২২টি পরিবার বসবাস করতেন। ঘর মেরামতের পর কিছু পরিবার ফিরলেও অভিযুক্ত কিশোর ও তার চাচার পরিবারের কেউ এখনো ফিরে আসেনি।
ঢাকা/আমিরুল/ইভা