সোমবার শ্রম সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদকে প্রধান করে গত নভেম্বরে ১৮ সদস্যের শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। কাজ শুরু করতে নানা কারণে বিলম্বের পর একাধিক দফায় কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। অবশেষে ২১ এপ্রিল কমিশন তাদের কাজটি শেষ করতে পারল।
 
শ্রম জগতের রূপান্তর-রূপরেখা: শ্রমিক অধিকার, সু-সমন্বিত শিল্প সম্পর্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন শীর্ষক প্রতিবেদনে মোটাদাগে ২৫টি সুপারিশ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হলো– শ্রমিক ও তাঁর পরিবারের মর্যাদাকর জীবনযাপন নিশ্চিত করতে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা, বিভিন্ন খাতের শ্রমিকের মজুরি তিন বছর পরপর মূল্যায়ন ও পুনর্নির্ধারণ, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মজুরি না দিলে শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ দান, মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য আপৎকালীন তহবিল, ট্রেড ইউনিয়ন করার শর্ত শিথিল, স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ, নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস এবং স্থায়ী শ্রম কমিশন প্রতিষ্ঠা। মর্যাদাপূর্ণ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে ‘তুই-তুমি’ সম্বোধন চর্চা বন্ধ করতে বলেছে কমিশন, এটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

দেশের শিল্প খাতকে যেসব সমস্যা প্রায়ই অস্থির করে তোলে সেগুরোর অন্যতম হলো ন্যায্য মজুরির অনিশ্চয়তা। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক, সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নিয়োজিত সব শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ ন্যূনতম মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে। উপরন্তু, কোনো খাতের মজুরি কাঠামো নির্ধারণে পরিবারে একক উপার্জনকারী হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে এমন পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে, যাতে শ্রমিক তাঁর পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে পারেন। সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে এটা কার্যকর করা গেলে শ্রম অসন্তোষ বহুলাংশে কমে যাবে। তখন কোনো পক্ষই অপর পক্ষের বিরুদ্ধে অন্তত মজুরি নিয়ে বড় কোনো অভিযোগ করতে পারবে না।

কমিশন ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত যে সুপারিশ করেছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশি-বিদেশি চাপ রয়েছে, তা আমরা জানি। আবার শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রতিনিধি না থাকায় অনেক কারখানায় মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সহসাই টানাপোড়েন তৈরি হয়, যা সুস্থ শিল্প পরিবেশের বিপরীত। বর্তমানে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে কোনো কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা ৩ হাজারের কম হলে ২০ শতাংশের সই লাগে। ৩ হাজারের বেশি হলে ১৫ শতাংশ শ্রমিকের সই লাগে। কমিশন ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে প্রতিষ্ঠানের মোট শ্রমিকের অনুপাতের শর্তের পরিবর্তে ন্যূনতম শ্রমিক সংখ্যা বিবেচনা করার ওপর জোর দিয়েছে। এ জন্য সুপারিশ প্রণয়নে একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন শ্রমিক আন্দোলন মানেই কারখানা ভাঙচুর, সম্পদ ধ্বংস, পরিণামে নিজের রুটি-রুজি নিয়ে শ্রমিকেরই টানাপোড়েনে পড়া। এর সমাধান হিসেবেই ট্রেড ইউনিয়ন প্রথা চালু হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এরপরও ট্রেড ইউনিয়নের নামে মালিকদের জিম্মি করে একপ্রকার অনৈতিক সুবিধা আদায় কিছু শ্রমিক নেতার অভ্যাসে পরিণত হয়। শ্রম সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাব করেছে তা বাস্তবায়ন হলে নিশ্চয় শিল্প খাত সেই অসুস্থ চর্চা থেকে বেরিয়ে আসবে। মোট কথা, সুস্থ ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিক-মালিক উভযেরই স্বার্থ রক্ষা করবে, এককথায় শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখবে।

কমিশন মর্যাদাপূর্ণ শ্রমপরিবেশের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য লিঙ্গ, বর্ণ, জাতিভেদে অবমাননাকর ও অমর্যাদাকর ভাষার ব্যবহার রোধ করার উপায় হিসেবে কর্মপরিবেশে তুই-তুমি সম্বোধন চর্চা বন্ধের যে সুপারিশ করেছে, সেটাও সুস্থ শিল্প  সম্পর্ক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

শ্রম প্রশাসন ব্যবস্থায় জবাবদিহি নিশ্চিত করতে স্থায়ী শ্রম কমিশন গঠনের সুপারিশটিও প্রণিধানযোগ্য। তার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি জাতীয় সামাজিক সংলাপ ফোরাম গঠনের উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছে কমিশন। 

প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ক্ষেত্রে প্রত্যেক শ্রমিককে নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র বা প্রমাণপত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি জাতীয় পেনশন স্কিমের অধীনে শ্রমিকবান্ধব পেনশন স্কিম চালু এবং শিল্পাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় শ্রমিকদের জন্য কার্ডভিত্তিক রেশন দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিটি বিষয়ই সব সেক্টরের শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবি, শ্রম কমিশনও তার স্বীকৃতি দিল।
কমিশনপ্রধান সোমবারই এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সুপারিশকৃত সংস্কারগুলো প্রজ্ঞাপন দিয়ে করতে পারে। তবে সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্যে পৌঁছাতে একটি শ্রম সম্মেলন করার ওপর জোর দেন তিনি। তার এ প্রস্তাব বাস্তবসম্মত বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: মত মত ন য নতম পর ব শ র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

আলী রীয়াজের সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএ পরিচালকের বৈঠক

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সাথে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেক্টোরাল অ্যাসিস্ট্যান্সের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভিত্তিক কর্মসূচির পরিচালক লীনা রিখিলা তামাংয়ের সাথে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সোমবার (২৮ এপ্রিল) রাজধানীর সংসদ ভবনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যালয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএ এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার গ্রেইস প্রিয়েটো উপস্থিত ছিলেন।

কমিশনের পক্ষে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “সংস্কার সংক্রান্ত ৫টি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ সম্পর্কে  রাজনৈতিক দলগুলোর সুনির্দিষ্ট  মতামত জানতে ইতোমধ্যে সুপারিশমালা স্প্রেডশিট আকারে তাদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩৫টি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে আমরা মতামত পেয়েছি এবং তার ভিত্তিতে ২০টি দলের সাথে প্রাথমিকভাবে আলোচনা করেছে কমিশন। আগামী দিনগুলোতেও এ আলোচনা অব্যাহত থাকবে।”

আরো পড়ুন:

জ্বালানি উপদেষ্টার পিএসকে বদ‌লি

পুলিশ সপ্তাহ শুরু মঙ্গলবার, নির্বাচনী নির্দেশনা পাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এমন একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে চায় কমিশন, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পথরেখা তৈরি করবে।”

বৈঠকে ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএর পরিচালক লীনা রিখিলা তামাং কমিশনের কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

ঢাকা/এএএম/এসবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অনির্বাচিত সরকারের করিডোর দেওয়ার এখতিয়ার নেই: বিএনপি
  • অনির্বাচিত সরকারের করিডোর দেওয়ার এখতিয়ার নেই
  • ‘মানবিক করিডর’ প্রতিষ্ঠার আগে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে হবে: চরমোনাই পীর
  • এই প্রথম সকলে মিলে রাষ্ট্র বিনির্মাণের সুযোগ তৈরি হয়েছে: আলী রীয়াজ
  • প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক
  • মানবিক করিডরের সিদ্ধান্ত হলেও শর্ত নিয়ে চলছে আলোচনা
  • ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক
  • প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি পর্যালোচনা
  • প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত
  • আলী রীয়াজের সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএ পরিচালকের বৈঠক