প্রবাসী শ্রমিক: অর্থ বনাম মৃত্যুর হাতছানি
Published: 22nd, April 2025 GMT
সংখ্যা দেখলে মাথা ঘুরে যায়। ২০১৫ থেকে ২০২২– প্রতিবছর সাড়ে ৩ হাজারের বেশি প্রবাসী শ্রমিকের মৃতদেহ দেশে এসেছে। তারা মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত ছিলেন। ২০২৩ ও ’২৪ সালে এ সংখ্যা সাড়ে ৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সত্যিকার অর্থে, গত ১০ বছরে মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যু প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এই সময়ে মোট ৩৮ হাজার প্রবাসী শ্রমিকের মৃতদেহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশে পৌঁছেছে।
সংখ্যা হতবাক করে দেয় যখন তুলনা করি, গত বছর প্রবাসী শ্রমিকদেরই পাঠানো অর্থ থেকে বাংলাদেশ ২৭শ কোটি ডলার আয় করেছে। আমাদের রপ্তানি আয়ের সর্বোচ্চ ৩ হাজার কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির পরই রয়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থপ্রবাহ। রপ্তানি আয়ের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত থেকে গত মাসেই সর্বোচ্চ ৩০০ কোটি টাকা আয় হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে একটি প্রশ্ন ক্রমান্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, ‘বাংলাদেশ কি জীবনের বিনিময়ে অর্থের পেছনে ছুটবে?’
আরও কয়েকটি কথা বলে নেওয়া দরকার। প্রথমত, সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী গত চার দশকে মোট ৫৭ হাজার ২১৬ জন প্রবাসী শ্রমিকের মৃতদেহ দেশে পৌঁছেছে। এর মধ্যে গত এক দশকেই ৩৮ হাজার। এর মানে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এই ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর কারণ কী? নাকি তথ্যের দৃশ্যমানতা বেড়েছে বলে বর্ধিত মৃত্যুর সংখ্যা সম্পর্কে আমরা জানতে পারছি? দ্বিতীয়ত, সংবাদে যে মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখ করা হয়, তা সত্যিকারের সংখ্যার চেয়ে কম। কারণ বহু পরিবারই মৃতদেহ দেশে ফিরিয়ে আনে না; প্রবাসেই সমাধিস্থ করে। যখন একজন প্রবাসী শ্রমিকের মৃতদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়, তখন শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ তা ফিরিয়ে আনা এবং সমাধিস্থ করার জন্য ৩৫ হাজার টাকা দেয়। কথা হচ্ছে, এই অর্থের পরিমাণ কি পর্যাপ্ত? তৃতীয়ত, প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের মৃত্যুর বেশির ভাগই ঘটে মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় দেশগুলোতে। তাহলে কি ওই অঞ্চলের কর্মপরিবেশ এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী? এ বিষয়ে ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপসাগরীয় অঞ্চলের মাত্রাতিরিক্ত গরম ও স্বাস্থ্যগত খুব খারাপ পরিবেশের সঙ্গে এসব মৃত্যুর সম্পর্ক আছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যুর দুটো সামগ্রিক কারণ দর্শানো হয়েছে। এক.
কর্মপরিবেশ-সম্পৃক্ত মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কর্মস্থলে দুর্ঘটনা, কর্মপরিবেশে নিরাপত্তাহীনতা, সড়ক দুর্ঘটনা ইত্যাদি।
নানা রোগের কারণে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের বয়সসীমা ৩৮ থেকে ৪২। এই বয়সসীমার ক্ষেত্রে হৃৎপিণ্ড বিকল বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ কি স্বাভাবিক, নাকি এর জন্য দায়ী বিপজ্জনক কর্মপরিবেশ; মরুভূমির অস্বাভাবিক আবহাওয়া, শ্রমিকের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা ব্যবস্থার অনুপস্থিতি? শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত কুশল ও
তাদের নিরাপত্তার জন্য কর্মস্থলে প্রয়োজনীয় কাঠামো ছিল কি?
শেষ প্রশ্নটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ অনেক সময়েই ঘুম ও বিশ্রাম ছাড়া শ্রমিকদের ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা টানা কাজ করতে হয়। আবাসস্থলে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয়।
প্রশ্ন করা যেতে পারে, উপসাগরীয় অঞ্চলে মৃত্যুর হার বেশি কেন? সে অঞ্চলের অত্যধিক মরুভূমিক উষ্ণতাই হয়তো এর কারণ। যার ফলে শরীরের নানান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শ্বাসকষ্ট, হৃৎপিণ্ড ও বৃক্কের নানান অসুখ এবং মস্তিষ্কের নানান সমস্যা। চাকরি প্রদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অত্যাচারও শ্রমিক মৃত্যুর কারণ কিনা, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
সব বিষয়ই তদন্ত করে দেখা দরকার। শ্রমিক মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণগুলো বিভাজিতভাবে দেখতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, শ্রমিক গ্রহণকারী দেশগুলো এসব সমস্যার প্রতি দায়সারা ব্যবস্থা নেয়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে এসব ব্যাপারে অন্তর্দৃষ্টিমূলক তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা। এমনতর প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য হবে বস্তুনিষ্ঠভাবে শ্রমিক মৃত্যুর কারণ জানা এবং সে ব্যাপারে নানান রকম বিপজ্জনক প্রবণতাকে চিহ্নিত করা। প্রণীত প্রতিবেদনের বিষয়গুলোকে শ্রমিক গ্রহণকারী দেশগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর নজরে আনতে হবে। তাদের সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছুতে হবে কর্মঘণ্টা, নিরাপদ কর্মস্থল, শ্রমিকের নিরাপত্তা এবং তার ওপর সম্ভাব্য নিপীড়নমূলক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও কোনো কোনো বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন তাপমাত্রা উৎসারিত ব্যাধির জন্য দীর্ঘকালীন চিকিৎসা প্রয়োজন; তেমন রোগাক্রান্ত শ্রমিকের চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ। পরিবার থেকে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতাসহ নানা কারণে মানসিক চাপে শ্রমিকদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে। তাই তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে।
প্রবাসী শ্রমিকদের মৃতদেহে কখনও কখনও আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন, সেসব মৃত্যুর পেছনে নিপীড়ন দায়ী কিনা? মোট কথা, প্রবাসে প্রত্যেক শ্রমিকের মৃত্যুর তদন্ত হতে হবে এবং দেখতে হবে তদন্তের ফল শ্রমিক গ্রহণকারী দেশের ভাষ্যের সঙ্গে সামঞ্জ্যপূর্ণ কিনা।
দ্বিপক্ষীয় ভাষ্যের তুলনা খুব জরুরি। কারণ অনেক সময় হৃদযন্ত্রবিষয়ক সব রোগকেই নথিপত্রে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু বলে চিহ্নিত করা হয়।
শ্রমিক গ্রহণকারী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার যখন সমঝোতা করে, তখন সাবধানতা দরকার। নিশ্চিত করতে হবে যে, সেই সব দলিলে প্রবাসী শ্রমিকদের চিকিৎসা, স্বাস্থ্য বীমাসহ সব সহায়তার ব্যবস্থা আছে। অনেক সময় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটি হারিয়ে গেলে তার আত্মীয়স্বজন দিশেহারা হন; মানসিক কষ্টে
থাকেন। অনেক উত্তর না-পাওয়া প্রশ্ন থাকা এসব মানুষের জন্যও আর্থিক এবং মানসিক সহায়তা
থাকা বাঞ্ছনীয়।
মনে রাখা দরকার, প্রবাসী শ্রমিকরা শুধু দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের যন্ত্র নন; তারা মানবসন্তানও বটে। সুতরাং আমরা নিশ্চিতভাবে তাদের অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব, গর্ব অনুভব করব। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে তাদের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও কুশল নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার কোনো সুযোগ নেই; স্বদেশে কিংবা বিদেশে।
ড. সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য
দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ব স থ যগত ব যবস থ পর ব শ র জন য প রব স দরক র তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিতে কর্মীদের জন্য গার্ডিয়ানের ওয়ার্কশপ
নিরবচ্ছিন্ন ডিজিটাল ইন্স্যুরেন্স সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিশ্রুতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সফলভাবে ওয়ার্কশপ আয়োজন করে গার্ডিয়ান লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেড। দিনব্যাপী এ ওয়ার্কশপের মূল লক্ষ্য ছিল গ্রাহকদের আধুনিক ও কার্যকরী ইন্স্যুরেন্স সেবা প্রদানের চাহিদা পূরণে কর্মীদের দক্ষতাকে আরো সমৃদ্ধ করা।
ওয়ার্কশপে উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল উপায়ে ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার নানা কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। যেন প্রতিষ্ঠানটি পরিবর্তনশীল ব্যবসায়িক পরিবেশে গ্রাহকদের ধারাবাহিক এবং উচ্চমানের সেবা প্রদানে সক্ষম হয়। ওয়ার্কশপটি সম্প্রতি কক্সবাজারের ওশান প্যারাডাইজ হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে অনুষ্ঠিত হয়।
গার্ডিয়ানের হিউম্যান রিসোর্সেস অ্যান্ড ট্রেইনিং ডিপার্টমেন্ট এ প্রশিক্ষণ ওয়ার্কশপের আয়োজন করে। এতে অংশ নেন প্রতিষ্ঠানটির ৫৬ জন বিটুবি সেলস টিম সদস্য। প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন প্রখ্যাত কর্পোরেট প্রশিক্ষক আরশাদ হাসান।
তিনি একটি জার্মান বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে গ্লোবাল বিজনেস ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত। মিলার হেইম্যান, ক্রিয়েটিভ সেলিং ও এনএলপি এর মত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেশনসহ তাঁর ২০ বছরেরও বেশিএ খাতে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ ওয়ার্কশপে তিনি খাতসংশ্লিষ্ট তাত্ত্বিক ধারণাগুলোর বাস্তবমুখী প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেন।
ওয়ার্কশপে বিটুবি সেবায় উৎকর্ষ অর্জনে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়; যথা: বিক্রয় দক্ষতা, সমঝোতা (নেগোসিয়েশন) দক্ষতা, সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা, টিম ম্যানেজমেন্ট ও নেতৃত্ব বিকাশ। এ ওয়ার্কশপে ধারণার বাস্তব প্রয়োগের মাধমে অংশগ্রহণকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। গ্রুপ কার্যক্রম, বাস্তব ক্ষেত্রে কেইস স্টাডি ও অন্তর্ভুক্তিমুলক আলোচনার মাধ্যমে প্রশিক্ষণটি অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা নেতৃত্ব, টিমবিল্ডিং ও নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি গ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা অর্জন করেন।
ওয়ার্কশপ আয়োজন নিয়ে গার্ডিয়ানের ইপিএমও’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফসিহউল মোস্তফা বলেন, “পেশাদারিত্বের শীর্ষ পর্যায়ের একজন থেকে এমন গুরুত্বপূর্ণ ক্যারিয়ার স্কিল শেখার সুযোগ আমাদের সবার জন্য একটি অনন্য সুযোগ।”
তিনি আরো বলেন, “এই ওয়ার্কশপ আমাদের ইন্স্যুরেন্স খাতের ডিজিটাল রূপান্তরে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে। দ্রুত পরিবর্তিনশীল এই ডিজিটাল যুগে গ্রাহকদের চাহিদা পূরণে কর্মীদের প্রস্তুত করে তুলতেই এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।”
ওয়ার্কশপে উপস্থিত টিম লিডারেরা টিমের সদস্যদের মধ্যে নতুন ধারণা আয়ত্ত করা ও পরিবর্তনের সাথে দ্রুত মানিয়ে নিয়ে ব্যক্তি ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর আলোকপাত করেন। ওয়ার্কশপ চলাকালে অংশগ্রহণকারীরা বিটুবি কাজের ক্ষেত্রে যে সকল চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, তা নিয়েও আলোচনা করেন। আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা গ্রাহকদের সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করতে তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজের নানা পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ রকিবুল করিম, এফসিএ। আরো উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন বিভাগের প্রধান ও ম্যানেজমেন্ট কমিটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
অনুষ্ঠানের তারা উন্নত ও কার্যকরী সেবা প্রদানে প্রতিষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
উদ্ভাবনী ইন্স্যুরেন্স সমাধান প্রদানে নিবেদিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে গার্ডিয়ান। পাশাপাশি, প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘমেয়াদে সেবার উৎকর্ষ অর্জনে কর্মীদের উন্নয়নে বিনিয়োগ করে যাচ্ছে।-বিজ্ঞপ্তি
ঢাকা/এসবি